হলের পর ১৭ বছরে এসে কেন্দ্রীয় মাঠও হারাতে বসেছে জবি
নানা সংকট, সম্ভাবনায় ১৭ বছরে পা রাখলো দেশের ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি)। প্রায় তিন দশক ধরে প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ১১টি হল। বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চেষ্টা চালালেও হলগুলো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এদিকে এবার ধুপখোলার কেন্দ্রীয় মাঠটিও হারাতে বসেছে বিশ্ববিদ্যালয়।
জবির একমাত্র খেলার মাঠে মার্কেট নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। গত ২৬ অক্টোবর গভীর রাতে সিটি করপোরশনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে খননের কাজ শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, সিটি করপোরেশনের মেয়র আশ্বাস দিলেও তাদের না জানিয়েই মাঠে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করা হয়েছে। এদিকে কাজ থামাতে আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়ার কথা বলেছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ১৯৮৪ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার জন্য নিজস্ব কোনো মাঠ না থাকায় ধূপখোলা খেলার মাঠটি তিন ভাগ করে। এক ভাগ তৎকালীন সরকারি জগন্নাথ কলেজকে ব্যবহার করার জন্য মৌখিকভাবে অনুমতি দেন। তখন থেকেই প্রতিষ্ঠানটি খেলার মাঠ হিসেবে ধূপখোলা মাঠটিকে ব্যবহার করছে। এই মাঠেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ২০ অক্টোবরকে ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। তবে সরকারি ছুটি থাকায় আগামীকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে ক্যাম্পাসে বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের উদ্বোধন করবেন উপাচার্য অধ্যাপক মো. ইমদাদুল হক।
এদিন প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দুপুর ১২টার দিকে ভার্চুয়াল আলোচনার আয়োজন করা হয়েছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বনাম জগন্নাথ কলেজ। এ নামেই বিংশ শতাব্দীর অধিকাংশ সময় জুড়ে পরিচিত ছিল। ১৮৫৮ সালে ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল নামে এর প্রতিষ্ঠা হয়। ১৮৭২ সালে এর নাম বদলে জগন্নাথ স্কুল করা হয়। বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরী তার বাবার নামে জগন্নাথ স্কুল নামকরণ করেন।
১৮৮৪ সালে এটি একটি দ্বিতীয় শ্রেণির কলেজে ও ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণীর কলেজে পরিণত হয়। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা শুরু হলে জগন্নাথ কলেজের স্নাতক কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির শিক্ষার্থী, শিক্ষক, গ্রন্থাগারের বই পুস্তক, জার্নাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। পুরানো ঢাকার নারী শিক্ষায় বাধা দূর করতে ১৯৪২ সালে সহশিক্ষা চালু করা হয়। ১৯৪৮ সালে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে ১৯৪৯ সালে আবার এ কলেজে স্নাতক পাঠ্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৩ সালে অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান পুনরায় কো-এডুকেশন চালু করেন। ১৯৬৮ সালে এটিকে সরকারিকরণ করা হয়, কিন্তু পরের বছরেই আবার এটি বেসরকারি মর্যাদা লাভ করে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ জগন্নাথ কলেজে পাকিস্তানি হানাদাররা হামলা চালায়। ছাত্ররা অনেকে পালিয়ে প্রাণরক্ষা করেন। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে জবি ক্যাম্পাসে গণহত্যা চালানো হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জগন্নাথের কয়েক হাজার শিক্ষক, শিক্ষার্থী শহীদ হন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে এবং মুক্তির সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। জগন্নাথ কলেজে হানাদারদের ক্যাম্প করা হয়। যুদ্ধ শেষে এখানে গণকবরের সন্ধান মেলে উদ্ধার করা হয় কয়েক ট্রাকভর্তি মানুষের কঙ্কাল। ১৯৮২ সাল থেকে শুরু হয় এলাকার প্রভাবশালীদের জগন্নাথ কলেজের হল দখলের পাঁয়তারা। ছাত্রদের সঙ্গে এলাকাবাসীর সংঘর্ষ বাধে বারবার। প্রথমে বেদখল হয়ে যায় কুমারটুলি ছাত্রাবাস। এরপর একের পর এক বেদখল হয় ৮৪ জিএল পার্থ লেন, কুমারটুলিতে (ওয়াইজঘাট স্টার সিনেমা হলের পেছনে) অবস্থিত হলগুলো। ১৯৯২ সালে ১৪টি হলের মাত্র তিনটি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে থাকে। বাকিগুলো পুলিশ ও এলাকাবাসীরা দখল করে নেয়। তিনটি হলের দুটি (মাহমুদা স্মৃতি ভবন ও এরশাদ হল) বর্তমানে ভেঙে মসজিদ ও কলা অনুষদ করা হয়েছে।
২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫ পাশের মাধ্যমে এটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে মোট ছয়টি অনুষদের অধীনে ৩৬টি বিভাগের ও দুটি ইনস্টিউটের মাধ্যমে এখানে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে।
বাংলাদেশের একমাত্র অনাবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। তবে অনাবাসিক তকমা ঘুচিয়ে ক্যাম্পাসের বিপরীত পাশে বাংলা বাজার সংলগ্ন ছাত্রীদের জন্য ‘বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল’ নামে ১৬ তলাবিশিষ্ট এক হাজার আসনের একটি হলের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। ছাত্রী উঠানোর প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে।
১৬ বছরের পথচলায় বিশ্ববিদ্যালয়টির ঝুলিতে অনেক প্রাপ্তি আছে। বিসিএস, সরকারি ও কর্পোরেট চাকরি, ব্যাংক জবসহ বিভিন্ন চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অসামান্য অবদান রাখছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি, ইন্টারনেট সুবিধা এবং গবেষণাগারেও নজর বাড়ানো হয়েছে। সমগ্র ক্যাম্পাসও ইন্টারনেটের আওতায় আনা হয়েছে। ই-বুক সিস্টেম চালু করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীকে এডুকেশন মেইলের আওতায় আনা হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা গুগল মেইলের অনেক সুবিধা ভোগ করছে।
এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য নবনিযুক্ত উপাচার্য একটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কমিটিও করে দিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. ইমদাদুল হক এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়য় ১৬ পেরিয়ে ১৭ বছরে পা রেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয় এখন যুবক। উন্নয়নের শুরু হবে এখন। আগে তো এটি কলেজ ছিল, বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজের মধ্যে তো অনেক পার্থক্য। কলেজে শুধু পড়াশুনা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা গবেষণাও করে। আমাদের লক্ষ্য শিক্ষা ও গবেষণার মান বাড়ানো। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে নজর দিতে হবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা যাতে গবেষণা করতে পারে, পাশাপাশি পড়াশুনার জন্য বিদেশেও যেতে পারে।’
খেলার মাঠের বিষয়ে ইমদাদুল হক বলেন, ‘মাঠের বিষয়ে মেয়রকে আবারও চিঠি দিয়েছি, পাশাপাশি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়েও চিঠি দিয়েছি। আর কোনো আইনি পদ্ধতিতে যাওয়া যায় কিনা সে বিষয়টি দেখছি। তবে নতুন ক্যাম্পাস হয়ে গেলে মাঠ এখানে ক্যাম্পাস আরেক জায়গায়। তাই কেরানীগঞ্জে আমাদের নিজস্ব জায়গায় দ্রুত খেলার মাঠ তৈরির চিন্তাভাবনা করছি। আবার সেখানে কর্মচারীদের জন্যও আবাসিক ব্যবস্থার চিন্তাভাবনা আছে।’