ডেঙ্গু আতঙ্কে সারা দেশ, নিরব ঢাবি প্রশাসন
দিন গড়ালেই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা। শিশুরাও বাদ যাচ্ছে না। হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ডগুলোতে যেন পা ফেলার জায়গা নেই। প্রায় দিনই পাওয়া যাচ্ছে মৃত্যুর খবর। মানুষের মধ্যে তাই ছড়িয়ে পড়ছে আতঙ্ক। মশার আবাসস্থল ধ্বংসের জন্য বারবার দেওয়া হচ্ছে তাগিদ। রাজধানী ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশা নিধনের সঙ্গে সঙ্গে বের হচ্ছে ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়ে। এমন পরিস্থিতিতে ক্যাম্পাস নিয়ে যেন মাথা ব্যথা নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) প্রশাসনের। মশার আবাসস্থলে ধ্বংসে নেই তেমন কোনো উদ্যোগ। ভয়ে দিন পার করছেন শিক্ষার্থীরা। এরইমধ্যে ঢাবির মেডিকেল সেন্টারে তিনজন শিক্ষার্থী ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি আছেন। আর ঈদুল আজহার পর বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থেকে প্রতিদিনই বিপুল শিক্ষার্থী জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, 'ক্যাম্পাসে ময়লা-আবর্জনা নেই।’ তিনি জানান, সারা দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেছে। এজন্য সব দপ্তর ও হলগুলোতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নির্দেশনা সম্বলিত বার্তা বা চিঠি দেওয়া হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে ময়লা-আবর্জনার স্তুপ জমে আছে। বিশেষ করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় পাঠাগারের ঠিক দক্ষিণ-পূর্ব পাশে, কলা ভবনের পূর্ব পাশে অর্থাৎ প্রক্টর অফিসের পেছনে এবং সূর্যসেন হল ক্যাফেটেরিয়ার পাশে অবস্থিত শিক্ষক কোয়ার্টারের সামনে (রাস্তার পশ্চিম পাশে) আবর্জনা ও আগাছায় ভরপুর। এ ছাড়া হাকিম ও মল চত্বরসহ ক্যাম্পাসের বেশ কয়েকটি জায়গায় একটু বৃষ্টি হলেই দীর্ঘ সময় ধরে পানি জমে থাকে, হয়ে যায় স্যাঁতসেঁতে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের পুকুর, প্রশাসনিক ভবন ও সূর্যসেন হলের মাঝের রাস্তার দুপাশ এবং সমাজবিজ্ঞান চত্বরের ফুয়ারা যেন মশা উৎপাদনের আদর্শ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এর বাইরে বঙ্গবন্ধু হল, জসিমউদদীন হল, ফজলুল হক মুসলিম হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, এ এফ রহমান হল এবং মুহসীন হলের আঙ্গিনাসহ ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায়ই আগাছা জন্মেছে। সেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করতে বা এসব স্থানে নিয়মিত মশানাশক ব্যবহার করতে দেখা যায় না।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ছাত্রী নুসরাত তাবাসসুম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অবহেলা সবসময় শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাণঘাতী বিপদের কারণ হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় অপরিকল্পিত বিল্ডিং ও বিভিন্ন প্রজেক্ট ক্যাম্পাসের স্বাস্থ্যমান ক্ষুণ্ণ করেছে। ডেঙ্গুর মতো ভয়াবহ রোগে শিক্ষার্থীরা প্রায় প্রতি বছরই আক্রান্ত হচ্ছেন এবং এর প্রতিরোধে তেমন কোনো পদক্ষেপ আমরা কখনোই দেখতে পাইনি। শিক্ষার্থীদের স্বার্থে বলতে চাই, অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা সরিয়ে ক্যাম্পাসের পরিবেশ সুস্থ করা দরকার। মশক নিধন কর্মসূচি গ্রহণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের সংস্করণ আশু প্রয়োজন।’
লোক প্রশাসন বিভাগের সা’দ জিয়া বলেন, ‘ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এখন অনেক মানুষই মারা যাচ্ছে। কিন্তু, এই পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ঢাবি প্রশাসনের দৃশ্যমান পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না, যা খুবই হতাশাজনক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায় শেওলা এবং ময়লার স্তুপ দেখা যায়। এসব থেকে ডেঙ্গু ছড়াতে পারে এবং এর কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কেউই আক্রান্ত হতে পারে৷ যদি কেউ আক্রান্ত হয়ে মারা যায়, এটার দায়ভার কে নেবে? তাই এই পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জরুরী পদক্ষেপ নিয়ে ডেঙ্গু দমনে যা যা কারণীয় তা বাস্তবায়ন করা উচিত। যার মধ্যে কোথাও ময়লা জমা না রাখা অন্যতম। জনসচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য সকল হলে প্রশিক্ষণ ও মিডিয়া বিজ্ঞাপন ইত্যাদি ব্যবহার করা হতে পারে।’
বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু পরিস্থিতির তথ্য জানিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা মেডিকেল সেন্টারের রাজু নামে এক কর্মচারী বলেন, ‘এখানে আসা মোট রোগীর আনুমানিক ৩০ শতাংশই জ্বরে আক্রান্ত। যার অধিকাংশই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত।’
সিনিয়র মেডিকেল অফিসার ডা. হাফেজা জামান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হওয়ার পর থেকে আমাদের মেডিকেলে অনেক জ্বরের রোগী আসছে। এর মধ্যকার বেশিরভাগই ডেঙ্গু আক্রান্ত। আজ পর্যন্ত আমরা এখানে তিনজন ভর্তি করেছি। আর সাধারণ ডেঙ্গুর চিকিৎসাটা আমরা এখানে দেই, আশঙ্কাজনক থাকলে রোগীকে অন্য হাসপাতালে রেফার করে দেই।’
সহকারী মেডিকেল অফিসার ডা. অভিজিৎ রায় বলেন, ‘মেডিকেলে আসা ১০ জন জ্বরের রোগীর মধ্যকার সাত থেকে আটজনেরই ডেঙ্গু পজিটিভ ধরা পড়ছে। এর পরিমাণটা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্যাম্পাসে থাকা ময়লা-আবর্জনা থেকে ও বিভিন্ন ধরনের পাত্র বা কাপে একটু পানি জমলেই মশা সেখানে ডিম পাড়ে। সেখান থেকে জন্ম নেওয়া মশা ডেঙ্গু রোগীকে কামড়িয়ে সুস্থ কাউকে কামড় দিলেই মূলত রোগটা তারও হয়ে যায়, এভাবেই মূলত রোগটা ছড়ায়। আর যেখানে অপরিষ্কার থাকে বা পানি জমে থাকে, সেই এরিয়াতেই মশা বাস করে এবং মানুষের শরীরে বসে। কারণ, এরা বেশি দূর মাইগ্রেট করতে পারে না। এক্ষেত্রে, ক্যাম্পাস পরিষ্কার রাখা ও নিয়মিত মশক নিধন অন্যতম সমাধান হতে পারে।’
ডেঙ্গু প্রতিরোধে এবং ক্যাম্পাস পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে কোন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে কি না, এ বিষয়ে জানতে এস্টেট ম্যানেজার (ভারপ্রাপ্ত) ফাতেমা বিনতে মুস্তাফার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ততার কথা জানান। বলেন, পরে কথা বলবেন।
সিনিয়র সিকিউরিটি অফিসার মো. আক্কাস আলী বলেন, ‘আমি এখন এদিকটা দেখি না, এস্টেট ম্যানেজার বলতে পারবেন।’
এস্টেট অফিসের আরও কয়েকজন সহকারী ম্যানেজারের সঙ্গে একাধিকবার চেষ্টার পরও যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মো. মাকসুদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস তো প্রতিদিনই পরিষ্কার করা হয়। ক্যাম্পাস পরিষ্কার রাখতে সবসময় আমাদের কার্যক্রম অব্যাহত আছে। তবে মাইক্রো ড্রেনেজ সিস্টেমে কিছু সমস্যা থাকতে পারে। আর হলগুলোতেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জরুরি নির্দেশনা দেওয়া আছে। আর যদি কেউ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে থাকে, তাহলে অন্য কোন এলাকা থেকে আক্রান্ত হয়ে আসতে পারে তারা।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, 'ক্যাম্পাসে ময়লা-আবর্জনা নেই। তবে নির্মাণ কাজের জন্য কিছুটা সমস্যা হয়েছে। ক্যাম্পাস এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি নিট অ্যান্ড ক্লিন। আর বর্তমানে সারা দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেছে। এজন্য আমরা সকল দপ্তর এবং হলগুলোতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নির্দেশনা সম্বলিত বার্তা বা চিঠি দিয়েছি। আমাদের সকলেরই সচেতন থাকতে হবে।'