ইতিহাস-ঐতিহ্য
টিএসসিতে গ্রিকদের শেষ স্মৃতিচিহ্ন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) সন্ধান মেলে গ্রিকদের রেখে যাওয়া সর্বশেষ স্মৃতিচিহ্নের; যা টিএসসির ভিতরে সবুজ মাঠের দক্ষিণ কোণায় অবস্থিত। হলুদ রঙের এই সমাধি সৌধটি দেখতে চতুষ্কোণ আকৃতির কুটিরের মতো, চারদিকে লোহার গ্রিল দিয়ে আটকানো এটি।
ইতিহাস
আনুমানিক ১৮০০-১৮৪০ সালের মধ্যে এটি তৈরি করা হয়েছিল। বর্গাকার এবং সমতল ছাদ-যুক্ত এ স্থাপনায় প্রাচীন গ্রিসের ডরিক রীতি অনুসরণ করা হয়েছিল। এ সমাধির চার কোণের দেয়াল কিছুটা প্রক্ষিপ্ত এবং পূর্ব দিকে এর একমাত্র প্রবেশদ্বারটি অবস্থিত। ভবনটির প্রবেশদ্বারের ওপরে রয়েছে একটি মার্বেল ফলক, যেখানে গ্রিক ভাষায় লেখা: ‘যাদের তুমি (ঈশ্বর) বেছে নিয়েছ এবং সঙ্গে নিয়েছ, তারা ভাগ্যবান’। সেইন্ট টমাস গির্জার যাজক জে এম ম্যাকডোনাল্ডের উদ্যোগে নির্মিত হয়েছিল টিএসসি চত্ত্বরে অবস্থিত গ্রিক এই স্মৃতি সৌধটি।
যে উদ্দেশ্যে এসেছিলেন গ্রিকরা
উর্বর জমি হওয়ার কারণে ব্যবসার উদ্দেশ্যে বিদেশিদের প্রথম পছন্দ ছিল এই বাংলা। তাই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীরা এদেশে এসে বসবাস করতেন। ঢাকায় ইউরোপীয়দের আগমন ঘটে সতেরো শতকের প্রথমভাগে। ব্যবসার উদ্দেশ্যে পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি ও ইংরেজদের সঙ্গে গ্রিকরাও ঢাকায় আসেন। মূলত ব্যবসার উদ্দেশ্যই এদেশে তাদের আগমন ঘটতো। বিদেশীদের মধ্যে সর্ব প্রথম আগমন ঘটে পর্তুগিজদের। ভারতে গ্রিকদের আগমন ঘটে ষোড়শ শতকের শুরুর দিকে। উপমহাদেশে যেসব গ্রিক এসেছিলেন তাদের বেশির ভাগই ছিলেন ব্যবসায়ী।
ইতিহাসবিদদের মতে, গ্রিকরা ঢাকায় এসেছিল ইউরোপিয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে পরে। ১৭৭০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে ঢাকায় দুই শতাধিক গ্রিক বসবাস করতেন। তারা বিশেষত কাপড়, পাট, লবণ ও চুনের ব্যবসা করতেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি তারা এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। অধিকাংশ গ্রিকের ঠাঁই হয়েছিল ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে। কিন্তু এখানকার আবহাওয়ায় গ্রিকরা বেশিদিন বাঁচত না। বহু সময় ধরে গ্রিকরা এখানে বসবাস করলেও বর্তমানে দেশে তাদের কোনো স্থাপত্য নেই বললেই চলে।
গ্রিকদের সর্বশেষ সমাধি সৌধ
ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে গ্রিক কবরস্থানসহ বিভিন্ন জায়গায় যেসব গ্রিক স্মৃতিচিহ্ন ছিল, তা সব বিলীন হয়ে গেছে। তবে ঢাবির ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসিতে) রয়েছে এদেশের গ্রিকদের সর্বশেষ সমাধি সৌধটি। তবে, সমাধিসৌধের সামনে কোনো লিখিত বিবরণী না থাকায় এটির ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা নেই তেমন কারোরই। কারো মতে, এটি গ্রিকদের তৈরি মন্দির, কারো মতে এটি কারো কবর আবার কেউবা মনে করেন, এটি কোনো পুরাতন উপাসনালয়।
গ্রিকদের মৃত্যুর স্মৃতিচিহ্ন
টিএসসিতে অবস্থিত হলুদ রঙের চার দেয়ালের ঘরটি আসলে একটি গ্রিক পরিবারের ৯ সদস্যের মৃত্যু স্মৃতিকে ধরে রাখতেই নির্মিত একটি সমাধিসৌধ। ভিতরের দেওয়ালে রয়েছে কালো রঙের ৯টি পাথর বা শিলালিপি। এর পাঁচটি গ্রিক এবং চারটিতে ইংরেজি ভাষায় লেখা। সবচেয়ে পুরনো পাথরটি সুলতানা আলেকজান্ডারের, যিনি ১৮০০ সালে মারা গিয়েছিলেন। ঘড়ির কাটার দিক দিয়ে প্রথম এপিটাফ টি সুলতানা আলেকজান্ডারের, দ্বিতীয়টি থিয়োডোসিয়ার, তৃতীয়টি মাদালিয়েন এবং সোহিয়া জর্দানের এবং চতুর্থ এপিটাফটি নিকোলাস ডিমেট্রাস এলিসের স্মরণে লেখা।
অযত্ন- অবহেলায় বিবর্ণ সৌধটি
অযত্ন-অবহেলায় অনেকটা বিবর্ণ আকার ধারণ করেছে এ সৌধটি। দেওয়ালের কোথাও কোথাও প্লাস্টার খসে পড়েছে। গ্রিক হাইকমিশনের অর্থায়নে ১৯৯৭ সামে সংস্কার করা হয়েছিল এটি। এরপর গত দুই বছর আগে ঢাবি কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে এটি সর্বশেষ সংস্কার করা হয়। সরেজমিনে এর বর্তমান অবস্থা দেখতে গেলে এর উপর নানা লেখাসহ অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় পাওয়া যায় গ্রিক এই স্তম্ভটিকে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে টিএসসির উপ-পরিচালক নজীর আহমদ সিমাব এনটিভি অনলাইনকে জানান, শিক্ষার্থীরাই মূলত বিভিন্ন সময় স্তম্ভের উপর এসব লেখা-লেখি করেছে, তবে এটিকে পুনরায় সংস্কারের জন্য পুরাকৃতি অধিদপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।
‘কান্তজীর মন্দিরের একটি টিম এসে এর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে গেছে। সভায় বিল পাস হলেই এটি পুনরায় সংস্কার করা হবে’ বলে আশ্বস্ত করেন তিনি।
স্মৃতিস্তম্ভ সম্পর্কে ঢাবি শিক্ষার্থীদের মতামত
শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলতে চাইলে অনেকেই জানায় টিএসসিতে অবস্থিত এই স্মৃতিস্তম্ভের ব্যপারে কিছুই জানেন না তারা। বেশিরভাগ সময়ই অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে স্মৃতিস্তম্ভটি। এ ছাড়াও স্তম্ভের আশে-পাশে কোনো ফলক না থাকা এবং স্তম্ভের গায়ে নানা লেখালেখি থাকার কারণেই ঐতিহাসিকভাবে এর গুরুত্ব সম্পর্কে আন্দাজ করতে পারেন না অনেকে।
ঢাবির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মাহিম জানায়, ‘যেহেতু গ্রিকদের রেখে যাওয়া দেশের সর্বশেষ স্মৃতিস্তম্ভ এটি। তাই এ স্মৃতিস্তম্ভের বাইরে একটি ফলক যুক্ত করা উচিত, যাতে এ স্তম্ভ সম্পর্কে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিস্তারিত জানতে পারে। এ ছাড়াও স্তম্ভটি নিয়মিত পরিচ্ছন্ন করতে কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন এ শিক্ষার্থী।