সংকট-অব্যবস্থাপনায় ঢাবির কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, সমাধানের আশ্বাস
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে এক সুদীর্ঘ, সুবিশাল আর গৌরবময় ইতিহাস। আর সেই ইতিহাসের এক বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সবার অমলিন স্মৃতিবিজড়িত স্থান এটি। এখন যা নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বলে দাবি বর্তমান শিক্ষার্থীদের। তাদের দাবি—বহিরাগতদের প্রবেশ বৃদ্ধিতে আসন সংকট হচ্ছে প্রকট, নেই পর্যাপ্ত আলো। শেলফ থেকে নিজে বই নেওয়ার অনুমতি না থাকায় থাকতে হয়ে দীর্ঘ অপেক্ষায়, উচ্চ শব্দে কথা-আড্ডা চললেও নিরসনে নেওয়া হচ্ছে না ব্যবস্থা। আছে শৌচাগার সংকটও। যদিও বেশ কিছু বিষয়ে সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন লাইব্রেরিয়ান মো. এম নাসিরউদ্দিন মুন্সী। আর কিছু বিষয় নির্ধারিত হওয়ায় তাতে তার কোনো করণীয় নেই বলেও দিয়েছেন জানিয়ে।
জানা গেছে, গ্রন্থাগারটি ১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা কলেজ ও ল’কলেজ থেকে প্রাপ্ত প্রায় ১৮ হাজার বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে যাত্রা শুরু করে গ্রন্থাগারটি। বর্তমানে এখানে প্রায় ছয় লাখ ৮০ হাজারের মতো বই এবং জার্নালের সংগ্রহ রয়েছে এখানে। এছাড়া আছে প্রায় ৩০ হাজারের মতো বিরল পাণ্ডুলিপি। সপ্তাহের রোববার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা আর শুক্রবার বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা ও শনিবার সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে গ্রন্থাগারটি। এর আছে গ্রন্থাগারের প্রশাসনিক ভবন, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ভবন এবং বিজ্ঞান গ্রন্থাগার ভবন। এই তিন শাখা থেকে পরিচালিত হয় সব কার্যক্রম।
আসন সংকট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩টি অনুষদ, ৮৩টি বিভাগ, ১৩টি ইনস্টিটিউট, ২০টি হল, তিনটি হোস্টেল মিলিয়ে মোট ৩৭ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী অধ্যায়ন করছে। এর বাইরেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পরও অনেকে আসেন লাইব্রেরিতে। এত পাঠকের জন্য লাইব্রেরিতে আসন মাত্র এক হাজার ৪০০টির মতো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী শিক্ষার্থী বলেন, এমনিতেই আমাদের লাইব্রেরিতে আসন সংখ্যা খুবই সীমিত। তার ওপর আবার সিটগুলো দখলের দৌরাত্ম্য। ফাঁকা সিট দখল করে হরদম চলে আড্ডাও। নারী শিক্ষার্থীদের আলাদা পাঠকক্ষকে অনেকে বানিয়ে ফেলেছেন বিশ্রামকক্ষ। টেবিলের ওপর মাথা রেখেই ঘুমিয়ে থাকতে দেখা যায় অনেককে। ফলে অনেক সময় রুমে ঢুকেও ফিরে যেতে হয়।
যদিও এখনই এই পরিসরে আসন বৃদ্ধির কোনো সুযোগ নেই বলে জানান লাইব্রেরিয়ান মো. এম নাসিরউদ্দিন মুন্সী। তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, বর্তমান লাইব্রেরিতে সিট সংখ্যা বৃদ্ধির কোনো সুযোগ নেই। তবে, ১২তলা বিশিষ্ট সেন্ট্রাল লাইব্রেরি ও ১০তলা বিশিষ্ট সায়েন্স লাইব্রেরি করার পরিকল্পনা আছে। সেখানে প্রতিটি ফ্লোর হবে ৪৫ হাজার স্কয়ার ফুটের। তখন আর জায়গার সমস্যাটা থাকবে।
লাইব্রেরিয়ান আরও বলেন, নতুন উপাচার্য আসার পর এ নিয়ে মিটিং হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর একনেক থেকে অনুমতি আসলে হয়তো এ বছরই একটা অগ্রগতি আমরা শুনতে পাব। গ্লোবাল ইকোনোমিক ক্রাইসিসের মধ্য দিয়েও এ কাজগুলোকে গুরুত্ব দেওয়ার চিন্তা আমাদের আছে।
নেই শিক্ষার্থী শনাক্তের ব্যবস্থা, বাড়ছে বহিরাগত প্রবেশ
লাইব্রেরিতে প্রবেশে ঢাবি শিক্ষার্থীর শনাক্তের ব্যবস্থা নেই। ফলে সেখানে বহিরাগতদের উপস্থিতি সব সময়ের। ইদানিং তা বেড়েছে বলে দাবি ঢাবি শিক্ষার্থীর। তাদের অভিযোগ, বহিরাগতরা প্রতিনিয়ত লাইব্রেরিতে এসে সিট দখল করে রাখেন। ফলে ঢাবির প্রকৃত শিক্ষার্থীরা অধ্যায়নের সুযোগ পাচ্ছেন না। এই দখল অবশ্য বহিরাগতরাই শুধু না, ঢাবির অনেকেও করে থাকেন। এ বিষয়ে একাধিকবার অভিযোগেও কোনো লাভ হয়নি বলে দাবি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকের।
বিষয়টি তুলে ধরে গ্রন্থাগারিকের কাছে জানতে চাইলে তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, বহিরাগত যারা আসেন, তাদের বেশিরভাগই ঢাবিরই কোনো না কোনো শিক্ষার্থীর সঙ্গে আসেন। এ ছাড়া ঢাবির সাবেক শিক্ষার্থীরাও আসেন, যাদের কাছে পুরনো কার্ড আছে। তাই বহিরাগতদের প্রবেশ বন্ধ করতে বেতার কম্পাঙ্ক চিহ্নিতকরণ (আরএফআইডি) গেটের কাজ চলছে। সেইসঙ্গে আরও দুটি গেট তৈরির অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে। গেট সংস্কারের কাজ হয়ে গেলে কার্ড প্রেস করে ঢুকতে হবে। তখন বহিরাগতসহ মেয়াদোত্তীর্ণ কার্ডধারীরাও আর ঢুকতে পারবেন না।
শেলফ থেকে নিজে বই নেওয়ার অনুমতি নেই
শিক্ষার্থীরা জানান, শিক্ষক বলে দিয়েছেন বা পাঠ্যক্রমে আছে বলেই আমরা বই পড়ি, তা কিন্তু নয়। অনেক সময় আমরা বইয়ের নাম, প্রচ্ছদ, লেখকের নাম কিংবা বিভিন্ন কারণে বই বেছে নিই। কোনো পরিকল্পনা না থাকলেও একটি বই চোখে পরলে মনে হতেই পারে যে এটা পড়া দরকার, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের বর্তমান পদ্ধতিতে সম্ভব না।
ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী আবু বকর সিদ্দিকীও জানান, বই যে কক্ষে আছে সেই কক্ষের প্রবেশ পথ টেবিল দিয়ে আটকানো। সেই টেবিলে বসে থাকেন একজন। কোনো বইয়ের প্রয়োজন হলে একটি কাগজে বইয়ের নাম ও লেখকের নাম লিখে তার কাছে দিতে হয়। এরপর তিনি ভেতর থেকে সেই বই খুঁজে নিয়ে আসেন।
উচ্চ শব্দে পড়াশোনায় ব্যাঘাত
লাইব্রেরিতে উচ্চ আওয়াজ প্রবেশের অভিযোগ জানান অনেক শিক্ষার্থী। এ ছাড়া লাইব্রেরিতে বসে উচ্চস্বরে কথা বলা, ফোনালাপ, চেয়ার টানাটানি নিষিদ্ধ থাকলেও নেই তার কার্যকারিতা। অনেকে বাবার প্রাইভেট টিউশনের কাজটিও সেরে ফেলেন এখানেই। ‘ডেটিং স্পট’ করে রেখেছেন অনেকে বলে রয়েছে অভিযোগ।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, কর্তৃপক্ষ বরাবরই এসব ব্যাপারে উদাসীন। ইসলামিক স্টাডিজের শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান বলেন, যেকোনো ধরনের মানববন্ধন, মিছিল-মিটিংয়ের আয়োজন করা হয় রাজু ভাস্কর্যে অথবা টিএসসিতে। এসব অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত মাইকের আওয়াজ সরাসরি লাইব্রেরিতে আসে। ফলে পড়ায় বিঘ্ন ঘটে এবং মনোযোগ নষ্ট হয়।
এ বিষয়ে লাইব্রেরিয়ান বলেন, আমাদের রুমগুলো এসি করা। আমাদের শিক্ষার্থীরা যদি থাইগ্লাসগুলো লাগিয়ে রাখেন, তাহলে আর বাইরের শব্দ ভিতরে প্রবেশ করবে না। সাউন্ড প্রুফ রুম তৈরির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, শিক্ষার্থীরা যদি তাকে এ বিষয়ে লিখিতভাবে জানায়, তাহলে তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে তা জানাবেন।
নেই পর্যাপ্ত আলো
দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী খাদিজা শরীফ জানান, লাইব্রেরিতে যে লাইটগুলো দেওয়া আছে সেগুলো অনেক পুরনো। এগুলোতে আলোও তেমন নেই। একটা অন্ধকার ভাব হয়ে থাকে। তাই অনেকক্ষণ এই লাইটের নিচে পড়লে ঘুম পায় অথবা মাথা ব্যাথা শুরু হয়।
লাইব্রেরিয়ান বলেন, শিক্ষার্থীরা এ ব্যাপারে তাকে আগে কখনও জানায়নি। যেহেতু এনটিভি অনলাইনের মাধ্যমে তিনি এ ব্যাপারে জানতে পেরেছেন, তাই দ্রুতই লাইট পরিবর্তনের বিষয়টি তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে জানাবেন বলে আশ্বস্ত করেন।
শৌচাগার সংকট
গ্রন্থাগারে ঢুকতেই প্রথম তলার শৌচাগারের অবস্থা স্যাঁতস্যাঁতে। দুর্গন্ধ। চারদিকে ছড়িয়ে আছে ব্যবহৃত টিস্যু। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার টয়লেটগুলোর অবস্থাও একই। কোনো কোনোটার অবস্থা আরও খারাপ। আবার তিন তলায় নেই মেয়েদের জন্য টয়লেট। শিক্ষার্থীদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত আসন-সংকট সমাধানসহ পর্যাপ্ত শৌচাগার বৃদ্ধি করা এবং এর সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে কার্যকর পদক্ষেপগ্রহণ করা।
সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী ফাহিম জানান, লাইব্রেরির মতো শৌচাগারে ঢুকতেও দিতে হয় লম্বা লাইন।
ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী বিথী রায় বলেন, ছেলেদের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার টয়লেট থেকে সবসময়ই দুর্গন্ধ আসে। আর লাইব্রেরির তিন তলায় মেয়েদের কোনো শৌচাগার নেই। তাই মেয়েদের ওয়াশরুমে সব সময় লাইন লেগেই থাকে। জরুরি প্রয়োজনে বাধ্য হয়েই কলাভবন বা ডাকসুর টয়লেট ব্যবহার করতে হয়।
শৌচাগার বৃদ্ধির বিষয়ে গ্রন্থাগারিক বলেন, কিছুদিন আগেই মেয়েদের জন্য দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় একটি করে ওয়াশরুম নতুন করে করা হয়েছে। কাজেই, তৃতীয় তলায় মেয়েদের ওয়াশরুম নেই এমন তথ্য ভুল। ওয়াশরুমের ক্রাইসিসটা বর্তমানে আর নেই। এ ছাড়া শৌচাগারকে আরও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য তিনি কর্মচারীদের নির্দেশনা দেবেন বলেও আশ্বস্ত করেন।
সময় বৃদ্ধির দাবি
সপ্তাহের রোববার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা আর শুক্রবার বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা ও শনিবার সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে গ্রন্থাগারটি। সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সস্টিটিউটের শিক্ষার্থী ফাহিম বলেন, কর্মচারি বৃদ্ধির মাধ্যমে সপ্তাহের প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা যদি লাইব্রেরি খোলা রাখা যায়, তাহলে আর লাইন ধরে শিক্ষার্থীদের দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। লাইব্রেরির ওপর শিক্ষার্থীদের চাপও অনেকটা কমে আসবে। কারণ তখন কেউ দিনে, কেউ রাতে এসে পড়তে পারবে।
ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক শিক্ষার্থী নাবিল হাসান জানান, আমরা যারা চাকরি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তাদের মধ্যে অনেকেই আছি যারা সারা রাত পড়াশোনা করি। আমি নিজেও। রাতের বেলা যদি লাইব্রেরি খোলা রাখা সম্ভব নাও হয়, তবুও যেন অন্তত একটা ফ্লোর খোলার পদক্ষেপ নেয় কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে লাইব্রেরিয়ান নাসিরউদ্দিন বলেন, উন্নত দেশগুলোতে যেমন ২৪ ঘন্টাই লাইব্রেরি খোলা থাকে। আমাদের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতেও এমন ব্যবস্থা করার একটা পরিকল্পনা আছে। খুব শিগগির এটি নিয়ে মিটিং হবে।
জানা গেছে, ১৯২১ সালে কলা, বিজ্ঞান ও আইন অনুষদের ১২টি বিভাগের অধীনে ৬০ জন শিক্ষক ও ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী ও প্রায় ১৮ হাজার বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে শুরু করে গ্রন্থাগারটি। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের প্রশাসনিক শাখায় (বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মূল ভবন) স্থানান্তর করা হয়। এরপর কার্জন হল প্রাঙ্গণের পুকুরের উত্তর পাশে অবস্থিত একটি ভবনের নিচতলায় স্থানান্তরিত হয় গ্রন্থাগারটি। সবশেষ বর্তমান কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ভবনে স্থানান্তরিত হয় এটি।