টিএসসির ক্যাফেটেরিয়ায় ২০ টাকার খাবারের মান নিয়ে নানা প্রশ্ন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) ক্যাফেটেরিয়া এমন একটি স্থান যেখানে শিক্ষার্থীরা সাশ্রয়ী মূল্যে সকাল, দুপুর ও রাতের খাবার খেতে পারে। মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্যই এই ক্যাফেটেরিয়া। যেখানে ১০ থেকে ২০ টাকার মধ্যেই খাবার খেতে পারেন শিক্ষার্থীরা। তবে বর্তমান বাজার মূল্যের কারণে খাবারের মান ও পরিমাণ নিয়ে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে শিক্ষার্থীদের। তাদের অভিযোগ, এখানে এক কেজি ব্রয়লার মুরগিকে করা হয় ৪৫টি টুকরা। ফলে কারও কারও ভাগ্যে জুটে মাত্র এক টুকরা হাড্ডি। একই সঙ্গে রয়েছে ভাঙ্গা টেবিল-চেয়ারে বসে খাওয়ার অভিযোগও।
টিএসসির প্রতিষ্ঠালগ্নেই এ ক্যাফেটেরিয়াটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন এর প্রথম পরিচালক এ. জেড খান। সে সময় ক্যাফেটেরিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র আনা হয়েছিল সুদূর আমেরিকা থেকে। যদিও এখন সেসবের কিছুই আর ক্যাফেটেরিয়াতে অবশিষ্ট নেই। তারপরও নানা অভিযোগ নিয়ে সগৌরবে টিকে আছে পুরোনো এই ক্যাফটেরিয়াটি। অতীতের মতো বর্তমানে ১০ টাকায় চা, চপ আর সিঙ্গারা পাওয়া অনেকটাই অকল্পনীয় একটি ব্যাপার।
ক্যাফেটেরিয়ার পরিচালক-বাবুর্চিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে চা পাতা, চিনি, লেবু ছাড়াও চায়ের স্বাদ বাড়াতে অনেক কিছু মেশানো হতো। পরবর্তীতে দুধ চায়ের পরিবর্তে চালু হয় লিকার চা। তাতে আদা, দারচিনিসহ অনেক উপাদান থাকত। কিন্তু এখন দ্রব্যমূল্যের কারণে তা আর সম্ভব হয় না।
যখন তাদের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হচ্ছিল তখন ক্যাফেটেরিয়ায় খেতে আসা কয়েকজন শিক্ষার্থী এক টাকার এই চা কে ‘চিনি মেশানো গরম পানি’ বলেও আখ্যায়িত করেন।
২০ টাকায় দুপুর ও রাতের খাবার
ঐতিহ্যবাহী এ ক্যাফেটেরিয়াটিতে ২০ টাকায়ই সেরে নেওয়া যায় দুপুর ও রাতের খাবার। দুপুরের খাবার হিসেবে রোববার পাওয়া যায় ভাত, আলুভর্তা, এক টুকরো মুরগির মাংস আর ডাল। সোমবার ও বুধবার পাওয়া যায় খিচুড়ি-মুরগির মাংস, মঙ্গলবার মুরগির তেহারি আর বৃহস্পতিবার পাওয়া যায় পোলাও-মুরগি। এছাড়া খাবারের সঙ্গে একটি ভুনা ডিম নিতে চাইলে আলাদা গুণতে হয় আরও ১৫ টাকা। দুপুর ১২টা থেকে শুরু হয়ে খাবার শেষ না পর্যন্ত চলতে থাকে দুপুরের খাবার।
দুপুরের খাবারে ভিন্নতা থাকলেও রাতের খাবারে তা নেই। প্রতিদিন রাতে দেওয়া হয় একই রকম খাবার। মুরগি-ভাত আর ডালেই সীমাবদ্ধ রাতের খাবার। সন্ধ্যা ৭টা থেকে খাবার শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকে রাতের খাবার।
তবে এই টিএসসি ক্যাফেটেরিয়াতেই এক সময় দেওয়া হতো গরু ও খাসির মাংস। দামও ছিল নামে মাত্র। ক্যাফেটেরিয়ার পরিচালক জানান, আগে দুপুর ও রাতে গরু ও খাসির মাংস দেওয়া হতো। পৌনে ২ টাকায় গরু ও আড়াই টাকায় খাসির মাংস পাওয়া যেত। কিন্তু এখন মুরগির বাইরে কিছুই রান্না করা হয় না। এ ছাড়াও খাবারের তালিকায় মুরগি রাখার আরেকটি কারণ হলো, সব ধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীরা যাতে বিনা সংকোচে খাবার খেতে পারে।
এদিকে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, টিএসসি ক্যাফেটেরিয়ায় রান্না করা মুরগি খাওয়ার অযোগ্য। মুরগি রান্নায় নামমাত্র মসলা দেওয়া হয়। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বাবুর্চি বলেন, মসলা দেওয়া হয়। তবে আগের থেকে একটু কম দেওয়া হয়। খাবারে কম মসলা দেওয়ার জন্য দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিকেই দায়ী করেন তিনি।
তবে খাবারের দাম নিয়ে শিক্ষার্থীদের কোনো অভিযোগ না থাকলেও খাবারের মান ও পরিমাণ নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী ওয়াসিউল হাবিব জানান, ক্যাফেটেরিয়ায় দুপুরের খাবারের কোনো স্বাদই পাওয়া যায় না। তবুও অন্যান্য জায়গা থেকে কম দামে এখানে খাবার পাওয়া যায় বলেই এখানে খেতে আসা।
সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আহসানুল হক মাহিম জানান, রোববার দেওয়া ভাতের পরিমাণ মোটামুটি ঠিক থাকলেও অন্যান্য দিন যখন পোলাও কিংবা তেহারি দেওয়া হয় এর পরিমাণ খুবই সামান্য। সামান্য ওই খাবারে কারও পক্ষেই দুপুরের আহার সম্পন্ন করা সম্ভব না।
একই বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী তানিশা হক বলেন, ক্যাফেটেরিয়ার এক প্লেট পোলাও ৭-৮ লোকমাও হয় না। আর মুরগির টুকরাগুলো এতো ছোট যে তা প্রথম লোকমাতেই শেষ। মাঝে মাঝে শুধু ছোট একটা হাড্ডিও দেওয়া হয়। আর যে ডালটা দেওয়া হয়, এতে কোনো স্বাদই নেই। ক্যাফেটেরিয়ার খাবারে না পাওয়া যায় কোনো স্বাদ, না খাওয়া যায় পেট ভরে। ক্যাম্পাসে থাকলে কিছু না কিছু খেতে হয়, তাই এখানে খেতে আসা।
টিএসসির সুপারভাইজার হারুন উর রশিদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, মূলত দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণেই সব ধরনের মসলা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে কম মসলার ফলে যে খাবারের স্বাদে খুব বেশি হেরফের হচ্ছে সে কথাও ঠিক নয়। শিক্ষার্থীরা এখানে যে খাবারটি খায়, আমাদের এখানে কাজ করা সকল কর্মচারীরা সেই একই খাবার খায়।
আর পরিমাণ বৃদ্ধির বিষয়টি এই বাজারমূল্যে সম্ভব নয় জানিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি ভর্তুকি দেয় তাহলে এই দামেই পরিমাণ বৃদ্ধি সম্ভব।
আর ভাঙ্গা চেয়ারের বিষয়ে হারুন উর রশিদ বলেন, শিক্ষার্থীরাই অনেক সময় ক্যাফেটেরিয়ার চেয়ার নিয়ে গিয়ে বাইরে বসেন। এভাবেই চেয়ারগুলো নানা সময় তাদের অসাবধানতার কারণে ভেঙ্গে যায়। তবুও ভাঙ্গা চেয়ার পেলে আমরা তা পরিবর্তন করার উদ্যোগ নেই। তবে বাজেট স্বল্পতার কারণে সাথে সাথেই তা পরিবর্তন করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক্যাফেটেরিয়ার গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ ও স্টাফ খরচ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এককভাবে বহন করে। তাই ২০ টাকায় খাদ্য সরবরাহের পরেও সেখান থেকে লাভ করে থাকে ক্যাফেটেরিয়া কর্তৃপক্ষ।
এদিকে, বাজারের দাম হিসেব করে দেখা যায়, ২০০ টাকা কেজি ব্রয়লার মুরগি যদি কেজিতে ৪৫ টুকরা করা হয়, তাহলে প্রতি পিস মুরগির দাম পড়ে ৪ টাকা ৪৪ পয়সা। আর ১৩০ টাকা দামের এক কেজি চিনিগুড়া (পোলাউ) চাল যদি ১২ জনকে খাওয়ানো হয়, তাহলে প্রতি প্লেটের দাম পড়ে ১০ টাকা ৮৩ পয়সা। সব মিলিয়ে মোট খরচ হয় ১৫ টাকা ২৭ পয়সা। সঙ্গে মসলাসহ আনুষাঙ্গিক খরচ আরও তিন টাকা ধরলেও মোট খরচ পড়ে ১৮ টাকা ২৭ পয়সা। সে হিসেবে ২০ টাকার খাবারের প্রতি প্লেটে ১ টাকা ৭৩ পয়সা করে লাভ করে টিএসসি কর্তৃপক্ষ।
খাবারের লাভের টাকা কী করা হয় জানতে চাইলে টিএসসির পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) খোরশেদ আলম এনটিভি অনলাইনকে জানান, এখান থেকে যে লাভ হয় সেটা খুবই সীমিত। লাভের টাকা থেকে টিএসসির বিভিন্ন আসবাবপত্র সংস্কার বা পরিবর্তনের কাজ করা হয়। এছাড়াও লাইট ফ্যান নষ্ট হয়ে গেলে সেটি মেরামতের টাকাও এই লভ্যাংশ থেকেই দিতে হয়।
খাবারের পরিমাণ বাড়ানো হবে কী না, এ বিষয়ে খোরশেদ আলম বলেন, বর্তমানে যে মূল্যে খাবার সরবরাহ করা হয়, সেই টাকায় খাবারের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব নয়। আবার খাবারের মূল্য বৃদ্ধি করে এর পরিমাণ বৃদ্ধির বিষয়টিও আমাদের হাতে নেই। তবে খাদ্য মন্ত্রণালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি আমাদের ভর্তুকি দেয়, তাহলে এই দামেই খাবারের মান ও পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব।
নেই সুপেয় পানির ব্যবস্থা
খাবারের ব্যবস্থা থাকলেও পুরো ক্যাফেটেরিয়ায় নেই একটিও সুপেয় পানির ফিল্টার। তাই বাধ্য হয়ে পিপাসা মেটাতে হাত ধোয়ার বেসিন থেকেই পানি পান করতে হয় শিক্ষার্থীদের। তবে এ পানিকে একদম ফ্রেশ দাবি করে পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, ক্যাফেটেরিয়ার বেসিনে পানি আসে নিজস্ব পাম্পের মাধ্যমে মাটির গভীর থেকে। যার গভীরতা প্রায় ১২০০ ফিট। তাই এই পানি একদম ফ্রেশ। নিজেদের দুর্বলতা ঢাকতে তিনি বলেন, এ পানি পান করতে অনেকের অসুবিধা হওয়ার কথা চিন্তা করেই হাফ লিটারের বোতলজাত পানির ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
তবে কোনো স্পন্সর পেলে অন্তত দুটি সুপেয় পানির ফিল্টার এখানে সংযোজন করা হবে বলেও জানান তিনি।
ভাঙ্গা চেয়ার-টেবিল
ক্যাফেটেরিয়ায় প্রবেশ করেই লক্ষ্য করা যায়, অনেকগুলো চেয়ারই ভাঙ্গা। তবুও চেয়ারের সংকটের কারণে সেই চেয়ারেই বসতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। অনেকগুলো খাবারের টেবিলও দেখা যায় ভাঙ্গা অবস্থায়। সেগুলোতেই খাবার খাচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
ভাঙ্গা চেয়ার পরিবর্তনে অপারগতা জানিয়ে খোরশেদ আলম বাজেটের সীমাবদ্ধতাকে দায়ী করে বলেন, ভাঙ্গা চেয়ারগুলো ধীরে ধীরে পরিবর্তন করা হচ্ছে। তবে সব ভাঙ্গা চেয়ার একসাথে পরিবর্তনের বাজেট আমাদের নেই।