একযুগ পরও অচেনা আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর
বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। ১৯৫২সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৭১’র এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, সবখানেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে রয়েছে অসংখ্য ঐতিহাসিক স্থাপনা। যার কোনোটি সবার কাছে পরিচিত, আবার এমনও অনেক স্থাপনা আছে যা তেমন পরিচিত নয়। তেমনই একটি স্থাপনা ভাষা শহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালা। উদ্বোধনের ১২ বছর পার হলেও অনেকটা অপরিচিতই রয়ে গেছে জাদুঘরটি।
কে ছিলেন আবুল বরকত?
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন, আবুল বরকত ছিলেন অন্যতম। তাঁর ডাক নাম আবাই। ১৯২৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুরের বাবলা গ্রামে জন্ম বরকতের। ১৯৪৫ সালে তালিবপুর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪৭ সালে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন তিনি। ভারত বিভাগের পর ১৯৪৮ সালে তার পরিবার ঢাকায় চলে আসে। ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে চতুর্থ হয়ে স্নাতক সম্পন্ন করে এবং একই বিভাগে স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন।
বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) সামনে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে বিক্ষোভ মিছিল করে ছাত্র-জনতা। পুলিশ মিছিলে গুলি চালালে হোস্টেলের ১২ নম্বর শেডের বারান্দায় গুলিবিদ্ধ হন আবুল বরকত। তাঁকে ঢামেক হাসপাতালে জরুরি বিভাগে ভর্তি করালে রাত আটটার দিকে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ২১ ফেব্রুয়ারি রাতেই আবুল বরকতের আত্মীয়-স্বজনের উপস্থিতিতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয় তাঁকে। এ ভাষা শহীদের মা হাসিনা বেগমই ১৯৬৩ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন।
আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘরের প্রতিষ্ঠা
জাদুঘরটির পরিচালক অধ্যাপক আবু মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এলে সব ভাষা শহীদদের স্মরণে তাঁদের নামে নিজ নিজ এলাকায় স্মৃতি জাদুঘর করার নির্দেশ দেয়। এরই প্রেক্ষিতে ময়মনসিংহে শহিদ জব্বারের নামে ও নোয়াখালীতে শহিদ সালামের নামে করা হয় স্মৃতি জাদুঘর। কিন্তু আবুল বরকতের বাড়ি ছিল ভারতের মুর্শিদাবাদে। কিন্তু সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে একটি স্থান চায় সরকার। পরবর্তীতে ২০১২ সালের ২৫ মার্চ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ভেতরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আবুল বরকতের নামে এই স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালার উদ্বোধন করেন ভাষাসৈনিক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি হাবিবুর রহমান। ২০০৮ সালের ৩ অক্টোবর এ জাদুঘরের নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ২০০৯ সালের ১৬ জুন।
অবস্থান
আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর পলাশীর মোড়ে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে অবস্থিত। হলের পেছনের গেট দিয়ে ঢুকে হাতের বাম দিকে তাকালেই দেখা যাবে পোড়ামাটি রঙের দৃষ্টিনন্দন দোতলা এক ভবন, যার গায়ে বড় করে লেখা ‘ভাষাশহীদ আবুল বরকত স্মৃতি জাদুঘর ও সংগ্রহশালা’।
ছুটির দিনগুলোতে বন্ধ থাকলেও রোববার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টার পর্যন্ত খোলা থাকে এ জাদুঘর। এ সময় দর্শনার্থীরা জাদুঘরটি ঘরে দেখতে পারবেন। তবে দুপুর ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত নামাজ ও খাবারের বিরতিতে বন্ধ থাকে জাদুঘরটি।
কী আছে এই জাদুঘরে
জাদুঘরটির নিচতলায় রয়েছে আবুল বরকতের ছোটবেলার খেলনা, শিক্ষাগত যোগ্যতার বিভিন্ন সনদপত্রের অনুলিপি, বাবাকে লেখা চিঠি, পরিবারের সসদস্যদের ছবি,ব্যবহৃত তিনটি কাপ এবং পিরিচ, ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত বিভিন্ন পেপার কাটিং, ভাষা শহীদদের ছবিসহ নানা ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন। এছাড়াও এখানে রয়েছে ক্যানভাসে আঁকা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে ছাত্রদের মিছিলসহ বিভিন্ন আলোকচিত্র। আবুল বরকত ছাড়াও ভাষা শহীদ রফিকের ম্যাট্রিকুলেশন সার্টিফিকেট, শহীদ শফিউর রহমানের রক্তমাখা শার্ট ও কোর্টের ছবিসহ নানা ঐতিহাসিক জিনিস রয়েছে এখানে।
২০০০ সালে ভাষা শহীদ আবুল বরকত পেয়েছিলেন একুশে পদক (মরণোত্তর), সেটির রেপ্লিকাও সংরক্ষিত রয়েছে এখানে। রয়েছে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিবর্ষণের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের কপিও।
অধ্যাপক আবু মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, তিনি নিজে আবুল বরকতের জন্মভূমি মুর্শিদাবাদের বাবলা গ্রামে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনদিন থেকে সাক্ষাৎ করেন বরকতের পরিবারের লোকজনের সঙ্গে। বরকতের চাচাতো ভাই মানিক মিয়ার বরাত দিয়ে তিনি জানান, শহীদ হওয়ার দুিএক বছর আগে শেষবারের মতো নিজ গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন আবাই ওরফে আবুল বরকত। সেখান থেকে ফিরে এসে ‘বরকতের সন্ধ্যানে’ নামে একটি প্রতিবেদনও লিখেছিলেন অধ্যাপক দেলোয়ার। তিনি সেখান থেকে সংগ্রহ করেন আবুল বরকতের প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল, তার নিজের বাড়ির ছবিসহ তাঁর বেশকিছু স্মৃতি চিহ্ন।
ভাষা আন্দোলনের সবচেয়ে সমৃদ্ধ লাইব্রেরি:
এই সংগ্রহশালাটির দ্বিতীয় তলায় রয়েছে একটি লাইব্রেরি। লাইব্রেরিটিতে ভাষা আন্দোলন নিয়ে সাড়ে চারশো ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত প্রায় চার শতাধিকসহ মোট আট শতাধিক বই সংগৃহীত আছে বলে জানান জাদুঘরটির পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু মো. দেলোয়ার হোসেন। তিনি জানান, ভাষা আন্দোলনের ওপর যত বই বের হয়েছে তার একটা গ্রন্থবিবরণী বের করা হবে এখান থেকে। যা থেকে ধারণা পাওয়া যাবে, ভাষা আন্দোলন নিয়ে এখন পর্যন্ত মোট কী পরিমাণ বই বের হয়েছে।
প্রতিষ্ঠার ১২ বছর পার হলেও পরিচিতি পায়নি জাদুঘরটি
জাদুঘরে ঢুকতে প্রয়োজন হয়না কোনো টিকিটের। ঢোকার সময় নিজের পরিচয় খাতায় রেজিস্ট্রার করে যে কেউ পরিদর্শন করতে পারে জাদুঘরটি। তবুও উদ্বোধনের একযুগ পার হলেও অনেকটা অপরিচিতই রয়ে গেছে জাদুঘরটি। আসে না তেমন দর্শনার্থীও৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর কাছে জাদুঘরটির সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে বেশিরভাগই বলেছেন জাদুঘরটি তাদের কাছে অচেনা। এর অবস্থান সম্পর্কেও কোনো ধারণা নেই তাদের।
এ বিষয়ে জাদুঘরটির পরিচালক বলেন, নানা কারণেই সংগ্রহের একটা ঘাটতি রয়েছে এখানে। আমাদের এখানে ১০ মিনিট ঘুরলেই মোটামোটি সবকিছু পরিদর্শন করা শেষ হয়ে যায়। তাই যারা একবার ঘুরে গেছেন তারা আর পরবর্তীতে আসতে চান না। এছাড়াও ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান লাভের অনীহাকেও এর আরেকটি কারণ হিসেবে দায়ী করেন তিনি।
অপরিকল্পিত স্থাপনা
জাদুঘরটির অবস্থানের দিকে তাকালে দেখা যায়, এর দক্ষিণে পলাশীর রাস্তা আর উত্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফদের বাসস্থান। তাই এর স্থান বৃদ্ধি তেমনভাবে আর সম্ভব নয়। জাদুঘরের পরিচালক বলেন, তখন যারা এটি নির্মাণ করেছিল তারা তেমন কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই এটি করেছিলেন। যার কারণে অনেক জায়গার অপচয় হয়েছে। এটি এমনভাবে করা হয়েছে যে, চাইলে কোনোদিকেই আর জাদুঘর বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়।
নেই প্রয়োজনীয় জনবল
তিনজন গার্ড ও একজন অফিস সহকারীসহ মোট চারজন দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে জাদুঘরটি। দুই বছর আগে জাদুঘরের গাইড (প্রদর্শক) মারা গেলেও এই পদে এখনও নতুন কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এসব বিষয়ে পরিচালক বলেন, গাইড মারা যাওয়ার পর আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আবেদন করেছি। এছাড়াও তিনজন গার্ড দিয়ে পরিচলনা করাও কঠিন। তারা তিনজন নিয়মিত ৩ ঘন্টা করে ডিউটি করে। কেউ ছুটিতে গেলে তখন শিডিউল মেইনটেইন করা কঠিন হয়ে যায়। এ বিষয়ে একাধিকবার আবেদন করেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো সাড়া পাননি বলেও জানান তিনি। এছাড়াও জাদুঘরটিতে নেই কোনো পরিচ্ছন্নতাকর্মীও।
এদিকে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিনা বেতনে এই জাদুঘরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু মো. দেলোয়ার হোসেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের গভর্নিং বডির সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন অধ্যাপক দেলোয়ার। সেই সুবাদে ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকে বিনা বেতনে আবুল বরকত জাদুঘরে কাজ করছেন বলে জানান তিনি। এছাড়াও বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের সঙ্গেও বিনা বেতনে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। তিনি ছাড়া জাদুঘরে কর্মরত বাকী চারজনের বেতন-ভাতা প্রদান করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
জাদুঘর নিয়ে পরবর্তী পরিকল্পনা
জাদুঘরটি নিয়ে পরবর্তী পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে পরিচালক অধ্যাপক দেলোয়ার জানান, বরকতের ঢাকা এবং মুর্শিদাবাদ পর্ব নিয়ে আলাদা একটা কর্ণার চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। বাবাকে লেখা বরকতের লেখা চিঠিগুলো রেলিংয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে। যাতে করে দর্শণার্থীদের পড়তে সুবিধা হয়। এছাড়াও স্পন্সর পেলে ডিজিটাল স্ক্রিন যুক্ত করার পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি।