হিট অ্যালার্টের মধ্যে স্কুল খোলা কতটা যৌক্তিক?
দেশে তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে। চলতি মাসে ২৩ দিন তাপপ্রবাহ অব্যাহত ছিল। ১৯৪৮ সালের পর ৭৬ বছরের মধ্যে এক বছরে তাপপ্রবাহের দিনের রেকর্ড ভেঙেছে গত শুক্রবার। এমন পরিস্থিতিতে খুব দ্রুত বৃষ্টির কোনো আশ্বাস দিতে পারেনি আবহাওয়া অধিদপ্তর। এই অবস্থা চলতে পারে আরও অন্তত এক সপ্তাহ। দেশে চতুর্থ দফায় হিট অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। এর মধ্যে আজ রোববার (২৮ এপ্রিল) থেকে খোলা হচ্ছে দেশের সব স্কুল-কলেজসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরেকটু অপেক্ষা করা উচিত ছিল। এখনই এই সিদ্ধান্তে আসা ঠিক হয়নি।
শিশু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. সফি আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “এই তাপমাত্রার মধ্যে শিশুদের কোনভাবেই ঘর থেকে বের হওয়া উচিত না। তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে শিশুরা বাইরে গেলে নানা ধরনের রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে। ফলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত স্কুল বন্ধ রাখাই ভালো। বৃষ্টি হওয়ার পর তাপমাত্রা কিছুটা কমতে পারে। তখন স্কুল খুললে ভাল হতো। এখন যেহেতু স্কুল খোলা হচ্ছে, তাই বাচ্চাদের পোশাক, স্কুলের পরিবেশসহ আনুষঙ্গিক সব বিষয়ে খোঁজ রাখতে হবে।”
শনিবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, চলমান দাবদাহের কারণে কোমলমতি শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শিশুকল্যাণ ট্রাস্ট পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর লার্নিং সেন্টারগুলোর শ্রেণি কার্যক্রম চালুর বিষয়ে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আগামী শনিবার থেকে ক্লাস হবে। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর বিষয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। অর্থাৎ শনিবার আগের মতোই সাপ্তাহিক ছুটি থাকছে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়েছে, ২৮ এপ্রিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণি কার্যক্রম চলমান থাকবে। এক পালায় (শিফটে) পরিচালিত বিদ্যালয়গুলো প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত চলবে। আর দুই পালায় বিদ্যালয়গুলোয় প্রথম পালা সকাল ৮টা থেকে সকাল সাড়ে ৯টা এবং দ্বিতীয় পালা সকাল পৌনে ১০টা থেকে থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত চলমান থাকবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা সিটি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক বেদার উদ্দিন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, “শিক্ষা কারিকুলামে তো অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে। বিশেষ করে করোনার পর যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, সেটা এখনও আমরা পুষিয়ে উঠতে পারিনি। এভাবে যদি দিনের পর দিন স্কুল বন্ধ থাকে তাহলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেক বড় শিখন ঘাটতি তৈরি হবে। তবে এই তাপপ্রবাহের মধ্যে প্রাইমারি স্কুল বন্ধ রেখে হাইস্কুল ও কলেজ খোলা হলে ভালো হতো। অন্তত আর একটা সপ্তাহ প্রাইমারি স্কুল বন্ধ রাখা উচিত ছিল। কিন্তু সমস্যা হল, সামনে যে গরম কমবে তারও তো কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।”
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জিয়াউল কবির দুলু ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমরা সরকারের কাছে দাবি করেছিলাম আর অন্তত একটা সপ্তাহ স্কুলগুলো যেন বন্ধ রাখা হয়। এই পরিস্থিতিতে বাচ্চারা বাইরে বের হলে কোন সংকটের দায় কে নেবে? তারপরও সরকার যেহেতু স্কুল খুলতে চায়, আমরা অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার কথা বলেছিলাম। এখন তো সরকার আমাদের সেই অনুরোধও রাখল না। ফলে এখন সরকার যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে আমাদের ইচ্ছা না থাকলেও সবাইকে সেটা মেনে নিতে হবে।”
এর আগে গত বৃহস্পতিবার এক আদেশে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত শনিবারও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার নির্দেশনা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, তাপপ্রবাহ এবং অন্যান্য কারণে শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ থাকার ফলে যে শিখন ঘাটতি তৈরি হয়েছে, তা পূরণ এবং নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী শিখন ফল অর্জনের জন্য পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহের শনিবারও শ্রেণি কার্যক্রম চলবে। আগামী ২৮ এপ্রিল রোববার থেকে যথারীতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে এবং শ্রেণি কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। নির্দেশনায় আরও বলা হয়, তাপপ্রবাহ সহনীয় পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত অ্যাসেম্বলি বন্ধ থাকবে। শ্রেণি কার্যক্রমের যে অংশটুকু শ্রেণিকক্ষের বাইরে পরিচালিত হয়ে থাকে এবং শিক্ষার্থীদের সূর্যের সংস্পর্শে আসতে হয়, সেসব কার্যক্রম সীমিত থাকবে।
অনেক অভিভাবক বলছেন, অধিকাংশ স্কুলে এয়ার কন্ডিশনার নেই। পাশাপাশি বাচ্চাদের স্কুলে আনা নেওয়া করতে রিকশা-সিএনজিসহ নানা ধরনের যানবাহন ব্যবহার করতে হয়। এতে দীর্ঘ সময় রোদের মধ্যে রাস্তায় থাকতে হয় শিশুদের। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই ধরনের সিদ্ধান্তে অনেক বাচ্চা রাস্তায় অসুস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেক অভিভাবক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। তারা বলছেন, আর এক সপ্তাহ স্কুল বন্ধ রাখলে কি ক্ষতি হবে? কিন্তু এই তাপমাত্রার মধ্যে বাচ্চারা স্কুলে গেলে বরং ক্ষতি বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, “স্কুল খোলা বা বন্ধ রাখার ব্যাপারে বোর্ডের সঙ্গে মন্ত্রণালয় আলোচনা করে না। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করে মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে। ফলে তারা নিশ্চয় খোলার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিয়েছে বলেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বোর্ডের কোনো ভূমিকা নেই।”
তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, “কথায় কথায় স্কুল বন্ধ রাখার পক্ষে আমি না। আমার বক্তব্য হল, তাপপ্রবাহের কারণে সবকিছু চলতে পারলে, স্কুল চলবে না কেন? হ্যাঁ, স্কুল খোলা রাখতে হলে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সেটা নিতে হবে। এখন দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন দুপুর বেলা রাস্তায় পানি ছিটাচ্ছে। এটা তো কিছু হলো না। সূর্য ওঠার আগে বা সূর্য ডোবার পরে পানি দিতে হবে। সেটাও রাস্তায় না, মাটিতে বা গাছে। এভাবে অপরিকল্পিতভাবে কাজ করলে তো সংকট বাড়বে। স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং অভিভাবকেরা সবাই মিলে যদি ইতিবাচকভাবে বিষয়টি দেখে তাহলে তো সমস্যা হওয়ার কথা না।”