নির্বাচনের পর আ.লীগ-বিএনপি সংলাপের আহ্বান আইসিজির
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আর দুদিন। এই নির্বাচনে রাজনৈতিক সংকট নিয়ে ভাবছেন অনেকে। যদিও ব্রাসেলসভিত্তিক পর্যবেক্ষক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) মনে করে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপ হলে সংকট সমাধানের সম্ভাবনা বাড়বে৷
আজ বৃহস্পতিবার (৩ জানুয়ারি) এক প্রতিবেদনে আইসিজি বলেছে, বিরোধীদল বিএনপিকে বাইরে রেখে যে নির্বাচন হতে চলেছে, তাতে গ্রহণযোগ্যতার অভাব আছে। ফলে এটি শুধু বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভাজনই বাড়াতে যাচ্ছে না, এর সঙ্গে আছে সহিংসতার ঝুঁকিও।
আইসিজির প্রতিবেদন অনুযায়ী, নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার মতো সময় যেহেতু এখন আর নেই, তাই স্বল্পমেয়াদে অস্থিতিশীলতা এড়াতে এবং একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নিয়ে কাজ করতে সংস্থাটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে নির্বাচনের পর সংলাপের তাগিদ দিয়েছে তারা৷ আইসিজি মনে করে, এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ভোটাররা প্রকৃত অর্থে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পাবে। বাংলাদেশের বিদেশি উন্নয়ন অংশীদার, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের প্রতি দুটি দলকে সংলাপে উৎসাহিত করার আহ্বানও জানিয়েছে সংস্থাটি।
জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার ঠিক আগমুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ রকম একটা উদ্যোগ নেওয়া হলেও সেটা হালে পানি পায়নি বলে দাবি করেছে আইসিজি। তারা প্রতিবেদনে বলেছে, সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে খুব একটা উৎসাহ দেখানো হয়নি৷
ক্রাইসিস গ্রুপ মনে করছে, নির্বাচনের পর সরকারের সংলাপে রাজি হওয়ার বেশ কিছু যৌক্তিক কারণ রয়েছে। সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জকেই তারা উপস্থাপন করেছে।
বাংলাদেশের বর্তমান সময়টাকে একটা ‘সন্ধিক্ষণ’ আখ্যা দিয়ে ক্রাইসিস গ্রুপ বলেছে, ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিকূল পরিস্থিতির পাশাপাশি ক্রমাগত অভ্যন্তরীণ বিরোধিতা সরকারের ওপর চাপ বাড়িয়ে দেবে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে বিবাদমান দুই পক্ষকে সংলাপে বসতে হবে বলে মনে করে সংস্থাটি।
‘নির্বাচন ছাপিয়ে : বাংলাদেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসন’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে আইসিজি বলেছে, ‘প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে সম্পর্ক পুনর্গঠন এবং বাংলাদেশকে গণতন্ত্র, শান্তি ও স্থিতিশীলতার পথে ফিরিয়ে আনতে আলোচনার জন্য উভয় পক্ষ থেকে ছাড় প্রয়োজন৷ দেশটির বিদেশি অংশীদার, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের উচিত, তাদের সেই দিকে সক্রিয়ভাবে উৎসাহিত করা৷’
নির্বাচন পরবর্তী সংলাপের বিষয়ে আইসিজির আহ্বান সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাসিম বলেন, পাঁচ বছর পর যে নির্বাচনটা হবে সেখানে তারা (বিএনপি) অংশগ্রহণ করবে কি করবে না, তা নিয়েই এখন কেবল আলোচনা হতে পারে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘যারা নির্বাচনে আসে না, নির্বাচনে বিশ্বাস করে না, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, তাদের সঙ্গে সংলাপ করে কী-ই বা হবে? যারা এ সব কথা বলছে, তারা ওদের আনার চেষ্টা করেছে, তারা চেয়েছিল সত্যিকার অর্থেই আসুক, সবাইকে নিয়ে ইলেকশনটা হোক, তারা পারেনি। তারপরও তারা বিএনপির ওপর এই বিশ্বাস রাখে কীভাবে? এখন যেটা হবে, পাঁচ বছর পর যে নির্বাচনটা হবে, সেখানে তারা অংশগ্রহণ করবে কি করবে না, তা নিয়ে আলোচনা চালু হতে পারে। এটা ভেবেই হয়তো এখন এটা বলা হচ্ছে।’
বিএনপিও যে এক্ষেত্রে তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে সেরকম ইঙ্গিত এখনও দৃশ্যমান নয়। ক্রাইসিস গ্রুপের প্রস্তাব সম্পর্কে মন্তব্য জানতে চাইলে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘আমরা ২০১১ সাল থেকেই দাবি করে আসছি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা। এটা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তারা পদত্যাগ করে এটা পুনঃপ্রবর্তন করলেই সংকটের সমাধান হবে। নির্বাচনের পরে সংলাপ সম্ভব কি না, এটা আমাদের দলের নীতিনির্ধারকেরা অবশ্যই ভেবে দেখবেন। কিন্তু, এটা কীভাবে সম্ভব হবে, যখন আমাদের চেয়ারম্যান বাইরে, মহাসচিব কারাগারে?’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার মনে করেন, শর্তহীন যেকোনো আলোচনা সবার জন্যই মঙ্গলজনক হবে। তিনি বলেন, ‘আমি প্রথমে বলব, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছে বা যে আহ্বান জানিয়েছে, সেটাকে আমি স্বাগতম জানাই। স্বাগতম জানাই এ কারণে, নির্বাচন হচ্ছে, নির্বাচনে বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা অংশগ্রহণ করছে, এটা সত্য এবং একইসঙ্গে এটাও সত্য, বড় একটি দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। কে ঠিক, কে বেঠিক—এই তর্ক চলতে থাকতে পারে, তথাপি বাস্তবতা এই, যেকোনো কারণেই হোক একটা পক্ষ অনুপস্থিত থাকার কারণে নির্বাচনটা সর্বাংশে সুন্দর হচ্ছে না। এজন্য আমি মনে করি, নির্বাচনের পরে দেশের স্বার্থে বিবাদমান দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হতে পারে।’
এ ধরনের সংলাপ আদৌ কোনো ফলাফল বয়ে আনবে কি-না সে সম্পর্কে এখনই কোনো উপসংহারে পৌঁছাতে রাজি নন অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, ‘আলোচনা থেকে প্রথমবার, দ্বিতীয়বার লাভ না আসুক, কিংবা এমনকি লাভের আশা না করেও আলোচনা হতে পারে। কারণ, আমরা সব সময় মনে রাখব, সংলাপের অনুপস্থিতি সংঘাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। সেটা আমরা কেউ চাই না। এখন কেউ যদি বলে, তাদের সঙ্গে কিসের সংলাপ, কেউ যদি বলে যে, আমাদের এই দুটা শর্ত আছে, পাঁচটা শর্ত আছে, এগুলো পূরণ করলে আমরা সংলাপে বসব—তাহলে অবশ্য সংলাপের প্রশ্নটা নিরর্থক হয়ে যায়।’
পরিস্থিতির যাতে অবনতি না ঘটে, দেশের স্থিতিশীলতা এবং দেশের গণতন্ত্রের জন্য যা যা দরকার, সেগুলো সবারই করতে হবে বলেও মনে করেন এই অধ্যাপক।
শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘এক্ষেত্রে কারও অহম কিংবা কারো হুঙ্কার কোনোটারই কোনো সুযোগ নেই। হোক আলোচনা। শুনুক না সবাই, উনারা কে কী বলছেন, সে জন্য আমি মনে করি, শর্তহীন যেকোনো আলোচানাই স্বাগতম।’