হাইভোল্টেজ প্রার্থী ডা. এনামুর রহমান কেন হারলেন ?
‘আসলে ভালা মাইনষের লাইগা রাজনীতি না। ভদ্দরলোক পাইয়া প্রতিমন্ত্রী ডা. এনাম সাবরে এমনভাবে নাকানি-চুবানি খাওয়াইব- হেইডা মনে হয় সে নিজেও কল্পনা করে নাই’- সাভারে ভোটের ফলাফলে জয়-পরাজয় নিয়ে এমন আলোচনা এখন তুঙ্গে। আজ সোমবার (৮ জানুয়ারি) বাজার বাসস্ট্যান্ডে চায়ের দোকানে এমনটাই বলছিলেন ষাটোর্ধ্ব জুলমত আলী।
জুলমত আলীর কথায় উপস্থিত অনেকেই সায় দিলেন। কেউ কেউ আক্ষেপ করে বললেন, “ডাক্তার মানুষ, উনার আসলে পচাগলা রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়াটাই ঠিক হয়নি। হলেও ১০ বছরে তিনি গতানুগতিক ধারার ‘রাজনীতিবিদ’ হতে পারেননি। বরং সবকিছু জেনে-বুঝেই তাঁর হাতে নৌকা তুলে দিয়ে দিনশেষে বেচারা এনামকে এক অর্থে কোরবানি দেওয়া হয়েছে।’
যার ফলাফল ঢাকা-১৯ আসনে হাইভোল্টেজ প্রার্থী হিসেবে নিজ দলের দুই স্বতন্ত্রপ্রার্থীর কাছে শোচনীয় পরাজয়ের গ্লানি বয়ে বেড়াতে হচ্ছে দুইবারের সংসদ সদস্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমানকে।
সব মিলিয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি হিসেবে তাঁর রাজনীতির ক্যারিয়ার এখন খাদের কিনারায়।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে প্রার্থী ছিলেন ১০ জন। তিনজন বাদে অন্য সবাই ছিলেন আলোচনার আড়ালে।
ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায় ডা. এনাম হয়েছেন তৃতীয়। প্রাপ্ত ফল অনুযায়ী ৮৪ হাজার ৪১২ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছে আশুলিয়া থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্বনির্ভর ধামশোনা ইউনিয়ন পরিষদের পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম। ঈগল প্রতীকে তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় কপাল পোড়া সাবেক সংসদ সদস্য তালুকদার মো. তৌহিদ জং মুরাদ। তাঁর প্রাপ্ত ভোট৭৬ হাজার ২০২। আর আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. এনামুর রহমান পেয়েছেন ৫৬ হাজার ৩৬১ ভোট।
একজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছে সজ্জন হিসেবে পরিচিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের শোচনীয় পরাজয় নিয়েই চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে নির্বাচনি এলাকা ছাপিয়ে সারা দেশে।
নৌকার শিবিরের একাধিক সূত্র বলেছে, ‘ডা. এনাম নির্বাচনে কঠোর পরিশ্রমের পাশাপাশি অর্থ খরচে কোনো কার্পণ্য করেননি। কাড়ি কাড়ি টাকা ঢেলেছেন ঠিকই, তবে সেটা ছিল অপাত্রে ঢালার মতোই, উলুবনে মুক্তা ছাড়ানো।
পড়তে পারেননি নেতাকর্মীদের চোখের ভাষা। বুঝতে পারেননি মনের ভাষা। প্রকৃত নির্বাচনের খেলাটা কেমন হয় সেটাও ঠাওর করতে পারেননি কখনই। স্থানীয় পর্যবেক্ষকরা বলছেন, নৌকার মনোনয়নপত্র হাতে পাওয়ার পরের চিত্রটাও ডা. এনামের জন্য মোটেও সুখকর ছিল না। প্রতিটি দিন ছিল বিভীষিকাময়।
অধিক ভোটারনির্ভর এলাকার চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচনি বৈতরণী পার হতে তিনি যার ওপর অতিমাত্রায় নির্ভর করেছিলেন সেই ধামশোনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম রাতারাতি পদত্যাগ করে নৌকার মনোনয়ন চেয়েও না পেয়ে নিজেকে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেওয়ায় বড় ঝাঁকুনি খান তিনি।
সেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার আগেই জাতীয় স্মৃতিসৌধকে ধারণ করা পাথালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পারভেজ দেওয়ান এবং ইয়ারপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সুমন ভূঁইয়া ট্রাক মার্কার প্রার্থী সাইফুল ইসলামকে সমর্থন দেওয়ায় বেকায়দায় পড়েন ডা. এনাম।
বিপর্যয়ের শেষ এখানেই নয়। ১০ বছরের ব্যবধানে হঠাৎ করেই স্বতন্ত্রপ্রার্থী হওয়ার সুযোগে এক দশক পর সাভারে ফেরেন সাবেক সংসদ সদস্য তালুকদার মো. তৌহিদ জং মুরাদ। শামীম ওসমানের ‘খেলা হবের’ মতোই ‘আইয়ো আইয়ো’ ‘আমার জন্য মায়া লাগে না’ আবেগী এমন সংলাপ আওড়িয়ে রাতারাতি তার পক্ষে সাভার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী হায়দার, সাভার সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোহেল রানা, আশুলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহাবুদ্দিন, পৌরসভার দুটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলরসহ বেশ কিছু নেতাকর্মী মুরাদ জংয়ের পক্ষে নেমে গেলে ডা. এনামের শিবির আরও দুর্বল হয়ে পড়ে।
এই দুর্বলতা কাটাতে ডা. এনামকে নির্ভর করতে হয় ‘বাঘের বেশে’ আসা কিছু বেড়ালের ওপর। এর বাইরে পদধারী বেশ কিছু নেতা এবং জনপ্রতিনিধিকে ডা. এনামের সঙ্গে দেখা গেলেও প্রকৃতপক্ষে তাদের আন্তরিকতা এবং সততা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে খোদ দলের মধ্যেই।
এখন ফলাফল বিপর্যয়ের পর যত দোষ নন্দ ঘোষের মতোই সব দায় চাপানো হচ্ছে একান্তই ডা. এনামের ওপর। নিরুপায় ডা. এনামও তা মেনে নিয়েছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, খোদ দলের নেতাকর্মীরা টাকা নিয়েছেন তাঁর, কাজ করেছেন পছন্দের অন্য প্রার্থীর পক্ষে।
যারা ডিগবাজি দিয়ে ডা. এনামকে ছেড়ে মুরাদ জংকে সংসদ সদস্য বানিয়ে নিজেদের আরও আখের গোছানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন তারাও হতাশ। ফলাফল ঘোষণার আগে বিজয় নিয়ে সরব হলেও এখন চুপসে গেছে। দিনশেষে এনামের কাছে, নৌকার বিপক্ষে ‘গাদ্দার’ বলেই পরিচিতি পেয়েছেন খোলসের আড়ালে থাকা নেতারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একজন সিনিয়র নেতা বলেন, ডা. এনামের বড় ব্যর্থতা তিনি ১০ বছরে নিজের ১০ জন কর্মী তৈরি করতে পারেননি। চিনতে পারেননি আপন পর। নেতাদের বড় শক্তি তাদের কর্মী। তার কর্মী নেই তার শক্তি সামর্থ্য নিয়ে কথা বলার কি-ই বা থাকে। এখানে ডা. এনাম একা হারেননি, হেরেছে আওয়ামী লীগও। তার মতো সজ্জন, ত্যাগী একজন মানুষকে নেত্রী চিনলেও চিনতে পারেনি সাধারণ নেতাকর্মীরা।