কফি টাইমের আড্ডায়
মিরপুরের কফি টাইম রেস্তোরাঁর সামনে যখন পৌঁছালাম, তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। রেস্তোরাঁর ওপরে সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা ‘কফি টাইম’। লেখার ভেতরে চারপাশ ঘিরে আলো জ্বলছে। নিচে দাঁড়িয়ে আছেন তরুণ নাট্য নির্মাতা মিজানুর রহমান আরিয়ান। আমাকে স্বাগত জানাতেই তাঁর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা। দেখা হওয়া মাত্র মুখে প্রাণবন্ত হাসি রেখে হাত বাড়িয়ে দিলেন করমর্দন করার জন্য। প্রাথমিক আলাপ শেষে নিয়ে গেলেন রেস্তোরাঁর ভেতরে। রেস্তোরাঁতে ঢুকতেই কানে ভেসে এলো তাহসানের গাওয়া নাটকের একটি গান। নাটকটির পরিচালক মিজানুর রহমান আরিয়ান নিজেই। রেস্তোরাঁর দেয়ালে সারি সারি কাঠের গুঁড়ি আর বাঁশ দিয়ে সাজানো, যা রেস্তোরাঁকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা।
রেস্তোরাঁর এক কোণে বসতেই খাবার অর্ডার করলেন আরিয়ান। আড্ডা হবে খাওয়ার পরে। তবে আড্ডার বিষয় আরিয়ান নির্মিত কোনো নাটক নয়। তাঁর রেস্তোরাঁ ব্যবসার আদ্যোপান্ত জানাই ছিল আড্ডার প্রধান উদ্দেশ্য। খাওয়ার পর্ব শেষ করে শুরু হলো আড্ডা। তবে আড্ডা শুরুর আগে নির্মাতা মিজানুর রহমান আরিয়ান সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন।
মিজানুর রহমান আরিয়ান বর্তমান সময়ে জনপ্রিয় একজন নাট্য নির্মাতা। ভালোবাসার নাটক নির্মাণে সুনাম রয়েছে তাঁর। এ পর্যন্ত তাঁর বেশকিছু নাটক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে।
যা হোক, এবার কফি টাইমের আড্ডায় আসি। নামে কফি টাইম হলেও এখানে আধুনিক মানসম্পন্ন খাবার পাওয়া যায়। রেস্তোরাঁটি আরিয়ানের একার নয়। কয়েকজন বন্ধু মিলে ছোট পরিসরে রেস্তোরাঁর ব্যবসা শুরু করেছিলেন প্রায় বছর দুই আগে। পরে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পরিসর বাড়ানো হয় রেস্তোরাঁর।
নির্মাণের পাশাপাশি রেস্তোরাঁ ব্যবসায় আসার কারণ সম্পর্কে মিজানুর রহমান আরিয়ানের কাছে জানতে চাইলে বলেন, ‘যখন রেস্তোরাঁর ব্যবসা শুরু করি তখন আমি নাটক নির্মাণে খুব একটা ব্যস্ত ছিলাম না। প্রথমে আমরা এটি ব্যবসা হিসেবে দেখিনি। আমরা বন্ধুরা আড্ডা দেওয়ার জন্য একটি ছোট জায়গায় কফি শপ দেই। নিজেদের জন্য বলতে পারেন। তারপর একসময় মনে হলো এটা বড় করা সম্ভব। সেই ভাবনা থেকে এই ব্যবসায় আসা।’
রেস্তোরাঁ শুরু করার প্রথম দিকের কথা জানতে চাইলে এর অন্যতম অংশীদার আরিয়ানের বন্ধু মাহতাব ইসলাম বলেন, ‘তখন আমরা পড়াশোনা শেষ করেছি। বন্ধুরা সবাই চাকরি খুঁজছে। যার কারণে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ কমে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে যখন দেখা হতো বন্ধুদের সঙ্গে, তখন বিভিন্ন জায়গায় খেতে যেতাম। আমরা খুব ভোজনরসিক। বাইরে যখন আমরা খেতাম তখন সেখানকার খাবারের মান খুব একটা ভালো লাগত না। একসময় মনে হলো আমরা কম মূল্যে ভালো খাবার সার্ভ করব। আমরা নিজেরাও ভালো খাবার খাব। অন্যদেরও খাওয়াব। এরপর রেস্তোরাঁ দেওয়ার চিন্তা করলাম।’
খাবার প্রস্তুতে কফি টাইম উন্নত মান এবং পরিচ্ছন্নতার দিকে বিশেষ নজর দিয়ে থাকে। খাবারে কীভাবে নতুনত্ব আনা যায় সে বিষয়ে প্রতিনিয়ত চলে গবেষণা। গবেষণার প্রধান দায়িত্ব পালন করেন তানভীর আহমেদ রবি। যদিও তিনি এটা মানতে নারাজ। তাঁর মতে, রেস্তোরাঁর সঙ্গে জড়িত সবাই খাবারে নতুনত্ব আনার জন্য নিরলস কাজ করছেন।
কফি টাইম রেস্তোরাঁর কোনো রকম প্রচার করা হয় না। এ বিষয়ে রেস্তোরাঁটির আরেক অংশীদার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি আমাদের রেস্তোরাঁর খাবার ভালো হলে এক কাস্টমার অন্য কাস্টমারকে বলবে। এটাই আমাদের প্রচারণা। এই নীতিতেই এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।’
সাইফুল ইসলামের কথার সঙ্গে আরিয়ান যোগ করে বলেন, ‘আমরা যেমন ভালো খাবার সার্ভ করতে আত্মপ্রত্যয়ী, তেমনি এখানে যাঁরা খেতে আসেন, তাঁদের সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর।’
পেশায় আলোকচিত্রী সাজ্জাদ হোসেন খান সজীব প্রায় নিয়মিত কফি টাইম রেস্তোরাঁয় খেতে আসেন। রেস্তোরাঁর খাবারের মান ও নিরাপত্তাব্যবস্থা কেমন? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘খুব ভালো মানের খাবার এখানে পরিবেশন করা হয়। ভালো খাবারের কারণে মূলত এখানে আসি। সেই সঙ্গে নিরাপত্তাব্যবস্থাও চমৎকার।’
সন্ধ্যার অবসর সময় কাটাতে রেস্তোরাঁয় খেতে আসা তিন বান্ধবীর কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল খাবারের দাম সম্পর্কে। দাম সহনীয় পর্যায়ে আছে এমনটি জানান তাঁরা।
এবার কফি টাইম রেস্তোরাঁয় ঠিক কী ধরনের খাবার পাওয়া যায় সে বিষয়ে আলোকপাত করা যাক। চিকেন তন্দুরি, চিকেন রেশমি কাবাব, চিকেন টিক্কা, চিকেন চিলি কাবাব, চিকেন আফগানি, বিফ বঁটি, বিফ শিক, প্লেইন নান, বাটার নানসহ আরো বেশকিছু আইটেমের খাবার পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে বিভিন্ন পদের কফি তো রয়েছেই। তবে এখানকার তন্দুর রুটি খুব জনপ্রিয়। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এখানে তন্দুর রুটির স্বাদ নিতে আসেন।
ঢাকা শহরে মোট তিনটি শাখা রয়েছে কফি টাইম রেস্তোরাঁর। ভোজনরসিক পাঠকদের স্বার্থে শাখা তিনটির ঠিকানা দিয়ে দেওয়া হলো। সময়-সুযোগমতো পরিবার কিংবা প্রিয়জনদের নিয়ে একবার স্বাদ পরখ করে আসতে পারেন।
প্রধান শাখা : বাড়ি-এইচ ১/২, ব্লক-এ, এভিনিউ-৫, সেকশন-৬, মিরপুর, ঢাকা।
দ্বিতীয় শাখা : হাউস-২, রোড-২০, সেক্টর ১১, উত্তরা, ঢাকা।
তৃতীয় শাখা : প্লট-এ, রোড-২, ব্লক-এফ, সেকশন-২, মিরপুর, ঢাকা।
আড্ডা প্রায় শেষের দিকে। এমন সময় মিজানুর রহমান আরিয়ানকে প্রশ্ন করা হলো, পরিচালনা ছেড়ে দিলে পুরোপুরি রেস্তোরাঁ ব্যবসায় থিতু হবেন কি না? তিনি উত্তরে বলেন, ‘পরিচালনা ছাড়ার ইচ্ছা নেই কখনো। যদি ছেড়ে দিতে হয়, তাহলে রেস্তোরাঁ ব্যবসা নিয়ে থাকব। তবে গার্মেন্টস ব্যবসা করার ইচ্ছা আছে। দেখা যাক কী হয়! সময় সবকিছু বলে দেবে।’
রাত বাড়তে লাগল। কফি টাইম ততক্ষণে জমে উঠেছে। আড্ডা শেষে বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। মৃদু শীতল হাওয়ায় সোডিয়াম আলোর শহরে হাঁটতে হাঁটতে মান্না দের সেই কালজয়ী গানের লাইনগুলো মনের কোণে ভিড় জমাতে আরম্ভ করলো- কফি হাউসের আড্ডাটা আজ আর নেই, আজ আর নেই।