ফিল্ম রিভিউ
তিনকালের সংগ্রাম নিয়ে ‘ভুবন মাঝি’
‘ভুবন মাঝি’ ছবির কাহিনী সহজ ও সরল। এতে একজন সহজ সরল মানুষের সংগ্রামী হয়ে ওঠার গল্প দেখানো হয়েছে। গল্প শুরু হয়েছে ১৯৭০ সালের প্রেক্ষাপটে এবং শেষ হয়েছে ২০১৩ সালে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর গ্রামের যুবক নহির কুষ্টিয়া শহরে ডিগ্রি পড়তে আসে। দেশজুড়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের উত্তাল পরিবেশ ও স্বাধীনতা আন্দোলনে যখন সবার উত্তেজনার পারদ চরমে, তখন নহির ছিল নির্বিকার। সে সময় কাটাচ্ছিল বই, থিয়েটার, আর চাচাতো বোনের বান্ধবী ফরিদা বেগমের সঙ্গে। স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত ফরিদা তাকে যুদ্ধে যেতে বলে। নহির জানায় তার মরতে বড় ভয় লাগে। তবুও ফরিদার অনুপ্রেরণায় সে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেয়।
নহির স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বাংলাদেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক মুহূর্ত (৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ইপিআর বিদ্রোহ, মেহেরপুরের মুজিবনগর সরকার) চিঠি লিখে জানায় ফরিদাকে। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের বিভিন্ন ভয়াবহতা তাকে বিচলিত করে। সে ভয় পেতে থাকে। কিন্তু ভীতু, সহজ, সরল এ মানুষটিও একসময় রুখে দাঁড়ায়, যখন সে জানতে পারে তার প্রিয় ফরিদা ধর্ষিত হয়েছে আসলাম রাজাকারের দ্বারা। যুদ্ধের পর ফরিদা আর কুষ্টিয়ায় ফিরে আসেনি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে নহির তখন ব্যতিক্রমী বাউল নহির শাহতে পরিণত হয়। ২০০৪ কুষ্টিয়ার আলমডাঙ্গায় বাউলদের চুল কেটে দেওয়া হয়। সেখানে ছিলেন বাউল নহির শাহ। তাকে নিয়েই তথ্যচিত্র নির্মাণ করতেই কুষ্টিয়া যান সোহেল ও এলি। সেখান থেকে ছবির কাহিনী চলে যায় ২০১৩ সালে যেখানে দেখানো হয় বাউল নহির শাহ মারা গেছেন। ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি ও ব্লগার হত্যার উত্তাল পরিবেশে সোহেল ও এলির বিভিন্ন প্রতিবাদমূলক কাজও দেখানো হয়। বিভিন্ন প্রতিবাদের কারণে বিচার হয় অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া আসলাম রাজাকারের। ২০০৪ সালে কুষ্টিয়ায় বাউলদের চুল দাড়ি কেটে দেওয়ার জন্য তাকেই দায়ী করা হয়। ছবিটি শেষ হয় বাউল নহির শাহের শেষ চিঠি দিয়ে যা জমা ছিল বীরাঙ্গনা ফরিদার কাছে।
বাংলাদেশে মুক্তি পাওয়া এটি পরমব্রতের প্রথম ছবি। দুর্দান্ত অভিনয়ে ছবিটিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন পরমব্রত। কলকাতার ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয়ে তুলে এনেছেন তিনি। তাই হয়তো পরমব্রতকে পর্দায় দেখে একে কলকাতার কোনো ছবি ভেবে ভুল হতে পারে দর্শকদের। অভিনয়ের মধ্যে অতিরঞ্জিত কোনোকিছু পাওয়া যায়নি। অপর্ণা ঘোষের অভিনয় ছিল সাবলীল। অভিনয় ও অভিব্যক্তি দুটির মাধ্যমেই তিনি ১৯৭১ সালের পটভূমিতে মানিয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়া যথেষ্ঠ মানানসই ছিল মাজনুন মিজানের অভিনয়। সহচরিত্রে পরমব্রতকে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছে মাজনুন মিজানের অভিনয়।
ছবিটির মূল চমক এর এডিটিং বা সম্পাদনায়। প্যারালাল এডিটিং বা সমান্তরাল সম্পাদনার মাধ্যমে ১৯৭১, ২০০৪, ২০১৩ সালের অবস্থা একই সঙ্গে দেখানো হয়েছে। ১৯৭১ সালের অবস্থার সঙ্গে ২০১৩ সালের অস্থিতিশীল দেশের পরিস্থিতির একটি সমন্বয় করার চেষ্টা করা হয়েছে। চমৎকার সম্পাদনায় দুই সময়ের সংগ্রামের গল্প ফুটে উঠেছে। প্রথমটি স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম আর দ্বিতীয়টি মৌলবাদীদের হাত থেকে স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম।
ছবিটির আলোকসজ্জা ছিল পরিমিত। অত্যাধিক আলোর ব্যবহার করা হয়নি। এ ছাড়া রাতের বিভিন্ন দৃশ্য চিত্রায়নে ছবিতে যথেষ্ঠ আলো ব্যবহার করা হয়েছে।
বাংলাদেশের ছবিতে যে জিনিসটিকে সবচেয়ে অবহেলা করা হয় তা অডিও। তবে এই ছবিতে অডিওর ব্যবহার ভালোভাবে করা হয়েছে। গান নয়, শুধু আবহসঙ্গীত দিয়ে যে দর্শককে সুরের সঙ্গে সঙ্গে গাইতে বাধ্য করা যায় তা বেশ ভালোভাবেই করতে পেরেছেন সদ্য প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী কালিকাপ্রসাদ। এ ছাড়া ছবিটিতে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন গেরিলা সংগ্রামের দৃশ্যে গুলি বা গ্রেনেডের প্রকৃত আওয়াজের ব্যবহার করা হয়েছে।
অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র থেকে ভুবন মাঝিতে সংলাপের ভিন্নতা রয়েছে। ছবির বেশকিছু সংলাপ দাগ কেটে গেছে দর্শকদের মনে, ‘দেশের এমন মুহূর্তে বীরেরা রেললাইনের ওপর বসে থাকলে চলবে?’ বা ‘এখনো পাকিস্তান চাস?’ এ ছাড়া একটি সংলাপ দিয়ে ১৯৭১ এবং ২০১৩ কে এক করা হয়েছে, যেমন দুটি ভিন্ন সময়ে নহির ও সোহেল বলে ওঠে, ‘আমার যে মরতে বড় ভয় লাগে।’ যেখানে ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ২০১৩ সালে ব্লগারদের হত্যার হুমকির সঙ্গে সংযোগ করা হয়েছে।
চলচ্চিত্রটি নিপুণ হাতে নির্মাণ করেছেন পরিচালক ফাখরুল আরেফিন খান। শুধু একটি দেয়াল এবং দুটি চরিত্রকে ফ্রেমবন্দি করে একটি ক্যালেন্ডারের মাধ্যমে যে মুক্তিযুদ্ধের সময়কে প্রকাশ করা যায় তা দেখিয়েছেন তিনি। ছবিটিতে ১৯৭১ সালকে আরো ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলতে সে সময়কার বিভিন্ন জিনিসপত্রের ব্যবহার দেখা গেছে, এতে ছবিটি আরো বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে। এ ছাড়া চলচ্চিত্রের বিভিন্ন লোকেশন নির্বাচনের ক্ষেত্রে যথেষ্ঠ নৈপুণ্য দেখিয়েছেন পরিচালক।
ক্যামেরার কাজে যথেষ্ঠ দক্ষতার ছাপ ছিল। গোটা ছবিতে লং শটের ব্যবহার বেশি দেখা গেছে। এ ছাড়া গেরিলা যুদ্ধের বিভিন্ন দৃশ্য চিত্রায়নে ছবিটিতে চমৎকারভাবে ক্যামেরার ব্যবহার দেখা গেছে।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে সরকারি অনুদান পাওয়া ছবি ভুবন মাঝি। ছবিটির নির্মাণশৈলী, লোকেশন, অডিও সব কিছুতেই পরিচালক উৎরে গেছেন। তবে পরিচালককে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায় ছবিটির রূপসজ্জার জন্য। ছবিটিতে মামুনুর রশিদ ও অন্যরা যে আলগা দাড়ি লাগিয়েছিলেন তা সহজেই বোঝা গেছে। এ ছাড়া ছবিতে জাতীয় সঙ্গীতের সুর ব্যবহার কতটা যৌক্তিক সে প্রশ্ন থেকেই যায়। তবে পরিশেষে বলা যায় ছবিটিতে মুক্তিযুদ্ধ, বাউল বা সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, ব্লগার হত্যার হুমকি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে সমান্তরালে যেভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তাতে এই ছবি এক ভিন্ন মাত্রার সংযোজন করেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্রে।
ভুবন মাঝি (২০১৭)
চরিত্রায়নে
পরমব্রত চ্যাটার্জি (নহির), অপর্ণা ঘোষ (ফরিদা), শুভাশীষ ভৌমিক (আসলাম রাজাকার) কাজী নওশাবা আহমেদ (এলি), মামুনুর রশিদ (বড় হুজুর), ওয়াকিল আহাদ (সোহেল) মাজনুন মিজান (মিজান) সুষমা সরকার (নার্স), লালিম হক (বাউল নহির সাঁই)
পরিচালক
ফাখরুল আরেফিন খান।