আমি প্রতি মুহূর্তে সংগ্রাম করি : প্রসেনজিৎ
দুই বাংলার জনপ্রিয় অভিনেতা প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়। অভিনয় করেছেন দুই বাংলার চলচ্চিত্রে। মাঝেমধ্যে তাঁকে দেখা গেছে বলিউডের চলচ্চিত্রেও। তবে বিশেষ করে টালিগঞ্জ চলচ্চিত্রের অভিনেতা হিসেবে তিনি অধিক পরিচিত। পয়লা বৈশাখে মুক্তি পেয়েছে তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্র ‘ওয়ান’। এতে তিনি অভিনয় করেছেন নেতিবাচক চরিত্রে। সম্প্রতি ছবিটির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রসেনজিৎ কথা বলেছেন ভারতীয় চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা ফিল্মফেয়ারের সঙ্গে। এনটিভি অনলাইন পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।
‘ওয়ান’ ছবিতে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আদিত্য সেন চরিত্রে অভিনয় করে কতটা উত্তেজিত?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় : আমি এর আগে সৃজিত মুখার্জির ‘বাইশে শ্রাবণ’ চলচ্চিত্রে নেতিবাচক চরিত্রে অভিনয় করেছি। আমি সাধারণত যা করি তার থেকে ব্যতিক্রম কিছু খুঁজছিলাম। মানুষ প্রসেজিতের ব্যতিক্রম কিছু প্রত্যাশা করে। অবশ্যই ব্যতিক্রম কিছু। ‘ওয়ান’ একদম ঠিক ছিল এবং আমি দীর্ঘদিন তথাকথিত বাণিজ্যিক ছবিতে অভিনয় করিনি। কলকাতার মানুষের পরিষ্কার ধারণা আছে কোনটা বাণিজ্যিক ছবি, আর কোনটা আর্ট ফিল্ম! কিন্তু আমি অনুভব করি এটি একটি বাণিজ্যিক ছবি। এটি একটি বুদ্ধিদীপ্ত ছবি। এটি সাধারণ ঢিশুম ঢিশুম ছবি না। আমি চিত্রনাট্য পছন্দ করেছি। ছবির অ্যাকশান দৃশ্যগুলো ছিল এক ধরনের মানস্তাত্বিক খেলা। আমি একজন প্রতিভাবান স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীর চরিত্রে অভিনয় করেছি। তবে সে তার মনকে মন্দ দিকে ধাবিত করে।
‘ওয়ান’-এর গল্পে বিশেষত্ব কী ছিল?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় : এটি একটি বুদ্ধিদীপ্ত চলচ্চিত্র। যা হিন্দি ছবির মতো মসৃণ। বাঙালি তার মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে ভালোবাসে। যে কারণে কল্পিত গোয়েন্দা ছবি ফেলুদা, ব্যোমকেশ বক্সী কলকাতায় প্রচুর জনপ্রিয়। বাংলা সাহিত্য অনেটকাজুড়ে গোয়েন্দা চরিত্র। আমার মনে হয় দর্শক যখন ‘ওয়ান’ দেখবে তখন রহস্য খুঁজে পাবে এবং বিড়াল-ইঁদুরের মতো চরিত্রের সঙ্গে বুদ্ধির খেলা খেলতে চাইবে।
কিন্তু ‘ওয়ান’ তো জনপ্রিয় তামিল ছবি ‘থানি অরুভান’ ছবির রিমেক। রিমেক ছবিতে অভিনয় করার ক্ষেত্রে কতটুকু সন্দেহপ্রবণ ছিলেন?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় : আমি এর আগে অনেক রিমেক ছবিতে অভিনয় করেছি। ‘রাওডি রাথোড়’-এর রিমেক ছিল আমার ‘বিক্রম সিংহ’ । রিমেক খারাপ কিছু নয়। একটি কেবল অভিযোজন মাত্র। আপনি যখন ভালো ছবি দেখবেন যেমন- গাজনী। এটিও রিমেক ছবি। ‘থানি অরুভান’ ইরানি ছবি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতীয় আদলে নির্মাণ করা। এখন আমরা স্বত্ব কিনে পরিবর্তন করে বাঙালি দর্শকদের মনের মতো করছি। আমি মনে করি ‘বাইশে শ্রাবণে’র পর তরুণরা এই ছবিটি পছন্দ করবে।
চরিত্রের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে তামিল ছবিটি দেখেছেন?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় : আমি একবার দেখেছি। ছবির প্রযোজক-পরিচালক বলেছেন আমি ছাড়া এই ছবিটি হবে না। তাঁরা এমন একজনকে চেয়েছিলেন যে বড় তারকা। অরবিন্দ স্বামী ‘থানী অরুভান’ ছবিতে আমার চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
আপনি অতিরিক্ত ওজন কমিয়েছেন আদিত্য সেন চরিত্রের জন্য এবং সেই সঙ্গে আপনাকে তরুণ দেখাচ্ছে।
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় : আমাকে চরিত্রের জন্য ৩৫ বছর দেখানো হয়েছে। ইয়াশের থেকে সামান্য বড়। কিন্তু বাস্তবে সে আমার বয়সের অর্ধেক। যেমনটি আমির খান ‘দঙ্গল’ ছবিতে করেছিল। দুঃখের বিষয় হলো সে যেভাবে প্রস্তুতি নেয়, সেরকম প্রস্তুতি নেওয়ার মতো সময় আমাদের নেই। ব্যক্তি জীবনে আমি সুশৃঙ্খল। আমি আমার নিজস্ব খাদ্য এবং পরামর্শকের মাধ্যমে ১৫ দিনে পরিবর্তন করেছি। আমি প্রতিদিন এক ঘণ্টা ২০ মিনিট ইয়োগা এবং সর্বনিম্ন দুই ঘণ্টা জিম করেছি। আমি এই আকৃতির শরীর চেয়েছিলাম।
আপনি ইয়াশ দাসগুপ্ত ও নুসরাত জাহানের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। এই নতুন অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করতে কেমন লেগেছে?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় : মজার ছিল। ইয়াশ অভিনয় করেছে রনজয় বোস নামের আইপিএস অফিসারের চরিত্রে। আমি এর আগে নুসরাতের সঙ্গে সৃজিতের ‘জুলফিকার’ ছবিতে অভিনয় করেছি। তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করা মজার ব্যাপার। কারণ তারা দারুণ কাজ করেছে। তারা আমাকে প্রচুর চ্যালেঞ্জ দিয়েছে। এখন দেখার বিষয় পর্দায় কাকে বেশী উদ্যোমী দেখায়।
তারা কি কোনোভাবে ভীত ছিল?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় : তারা আমাকে অনেক সম্মান দেখিয়েছে। কিন্তু আমি যখন সেটে ছিলাম তখন তাদের বলেছি আমরা সবাই সমান। দিনশেষে চলচ্চিত্রের কাজ করতে হবে। পর্দায় আদিত্য সেন ও রনজয় বোসকে বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়া প্রয়োজন। যখন আমি শট দিতাম তখন তাদের বলতাম কোন শটটি ভালো! এই শিল্প আমাকে প্রচুর সম্মান দিয়েছে। তবে আমি তাদের কাছে শুধু তারকা নই। তারচেয়ে বেশি আমি তাদের বড় ভাই।
বিরশা দাশগুপ্তর পরিচালনা কেমন ছিল?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় : বিরশা একজন তরুণ উদ্যোমী পরিচালক। আমি এর আগে তাঁর পরিচালনায় ‘মহানায়ক’ টেলিভিশন ধারাবাহিক করেছি। চলচ্চিত্রে এটি তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম কাজ। সে নিজস্ব জায়গা তৈরি করে নিয়েছে। সে চলচ্চিত্র পরিবার থেকে এসেছে। তার ভাই রিভু দাশগুপ্ত বলিউডে অমিতাভ বচ্চনকে নিয়ে ‘তিন’ নামে একটি ছবি নির্মাণ করেছে।
শুটিংয়ে কোনো মজার ঘটনার কথা বলুন।
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় : শুটের জন্য ইয়াশ পুলিশের পোশাক পরেছিল। কিন্তু এতে সে অস্বস্তিবোধ করছিল। সে বলছিল ড্রেসম্যানকে সাহায্য করার জন্য। আগে আমি এই পোশাক পরেছি তাই তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে যাই। আমি তাকে ইউনিফর্মের বেল্ট পরা দেখিয়ে দিয়েছি। আমি এটি খুব আকস্মিকভাবে করেছি কিন্তু সে মনে করেছিল আমি তার ড্রেসম্যান। সবাই এটি দেখে হাসতে আরম্ভ করল।
চলচ্চিত্রে ৩৩ বছর পার করলেন। এই তিন দশক ধরে এক নম্বর অবস্থানের চাপ কীভাবে সামলেছেন?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় : অবশ্যই প্রতি মুহূর্তে নিজের অবস্থান ধরে রাখা প্রচুর চাপের । যখন নতুনরা এই শিল্পে এলো আমি তাদের সুযোগ দিয়েছি। নতুন প্রজন্ম এসে প্রচুর ভালো কাজ করছে। কিন্তু আমি আমার অবস্থান সম্পর্কে সচেতন। আমি অমিতাভ বচ্চন ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে দেখেছি। তাঁরা সব ছবি স্বাচ্ছন্দ্যে বহন করেছেন। আমি তাঁদের কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করছি। ৮-১০ বছর ধরে ‘অটোগ্রাফ’ অথবা ‘জাতিস্বর’-এর মতো কিছু ব্যতিক্রমী ছবি করার চেষ্টা করছি।
নতুন প্রজন্মের ভেতর কে আপনার জায়গায় যেতে পারবে বলে মনে করেন?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় : সবার সুযোগ রয়েছে। জিৎ এবং দেব এরই মধ্যে অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। আবির চমৎকার কাজ করছে। যীশু দারুণ অভিনেতা এবং সে যেকোনো কিছু পারে। আমরা এমন একটি জায়গায় পৌঁছেছি যেখানে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী একক নায়ক হতে পারে। ৩০ বছর আগে এটি কল্পনা করা যেত না। সময় ও চিন্তা বদলাচ্ছে। আমাদের এটির সঙ্গে এগিয়ে চলা উচিত।
আপনি ‘শঙ্খচিল’ ছবিতে অভিনয় করার জন্য সেরা অভিনেতা হিসেবে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন।
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় : অ্যাওয়ার্ড যেকোনো অভিনেতার জন্য আশীর্বাদ। মাঝে মাঝে আমি ব্যবসার জন্য ছবি করি কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের ধরন একই হয় না। এ ক্ষেত্রে ‘মনের মানুষ’ অথবা ‘শঙ্খচিল’-এর কথা বলা যায়। এগুলো সমান্তরাল ছবি। সে কারণে সমালোচকদের প্রশংসা প্রয়োজন। এটি আমার এক ধরনের পারিশ্রমিক। তা ছাড়া এটি আমাকে অনেকটা আনন্দ দেয়।
কিন্তু সমালোচকদের প্রশংসা এবং ব্যবসায়িক সাফল্য। এই দুটির ভেতর কোনটি নির্বাচন করবেন?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় : দুটোই আমার কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি ভালো ছবি নির্মাণ করেন তাহলে বক্স অফিসে ব্যবসা করবে। গৌতম ঘোষের ‘মনের মানুষ’ সুপারহিট ছবি। মানুষ এখনো ছবিটি নিয়ে আলোচনা করে। ‘শঙ্খচিল’ ভালো ব্যবসা করেছে এবং সেরা বাংলা চলচ্চিত্রের পুরস্কার পেয়েছে। আমি নিজের সন্তুষ্টির জন্য এসব ছবি করি। ‘অটোগ্রাফ’, ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর পর ভালো ছবি ব্যবসা করতে আরম্ভ করল। ‘প্রাক্তন’ গত বছর সেরা ব্যবসা সফল ছিল। সামনে সৃজিতের ‘কাকাবাবু’ করছি।
এই ৩৩ বছরে মাইলফলক কী?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় : ‘অমর সঙ্গী’ (১৯৮৭) আমাকে প্রসেনজিৎ বানিয়েছে। ২০০০ সালে ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’ বাংলা ছবির অর্থনৈতিক হিসাব বদলে দিল। ‘অটোগ্রাফ’ ও ‘বাইশে শ্রাবণ’ বাংলা ছবির যাত্রা পরিবর্তন করে দিল। এই শিল্পের সব মাইলফলকে আমার নাম জড়িত। এটি আমার মা এবং দর্শকদের আশীর্বাদ। একজন পঞ্চাশোর্ধ ভদ্রমহিলা আমার ভক্ত এবং তার নাতির বয়স সম্ভবত ১৪, সেও আমার ভক্ত। এই শিল্পে আর কী চাই বলুন?
নিজেকে কিভাবে বর্ণনা করবেন?
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় : আমি আমার কাজের প্রতি খেয়ালী, স্বার্থপর ও সৎ। আমি এখনো নিজেকে সংগ্রামী হিসেবে বিবেচনা করি। আমি প্রতি মুহূর্তে সংগ্রাম করি।