ডুব : পরিচিত গল্প, নিজস্ব ঢঙে
ডুব। অভিযোগ ও আপত্তির মুখে এখনো দেশে মুক্তি পায়নি মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত এই ছবি। তবে বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে ‘ডুব’ প্রদর্শিত হচ্ছে, অংশ নিচ্ছে প্রতিযোগিতায়। সম্প্রতি সাংহাই চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয় ছবিটি। আর সেখান থেকেই ছবিটির সমালোচনা প্রকাশ করে দ্য হলিউড রিপোর্টার। এখানে সমালোচনার পুরোটাই অনুবাদ করে দেওয়া হলো।
ভারত-বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায়, মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর পরিচালনায় ‘ডুব : নো বেড অব রোজেজ’ চলচ্চিত্রে ইরফান খান ফুটিয়ে তুলেছেন একটি পরিবার ভাঙার গল্প।
আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও খ্যাতির শীর্ষে থাকা ইরফান খানের অভিনয় ‘ডুব’ চলচ্চিত্রটিকে একটি সাধারণ বিচ্ছেদের ঘনিষ্ঠ গল্প থেকে বিশেষ কিছুতে পরিণত করেছে।
প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে স্বকীয় চিন্তাধারার বাংলাদেশি অতর পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সূক্ষ্ম বিষয়গুলোকে খুঁটিয়ে দেখা এবং নির্লিপ্তভাবে বাস্তবধর্মী গল্প বলার ক্ষমতা ছবিটিকে নিয়ে গেছে অন্য উচ্চতায়। মেলোড্রামা হিসেবে ছবিটিতে যা পুরোটা জুড়েই বজায় ছিল।
‘ডুব : নো বেড অব রোজেজ’ চলচ্চিত্রের গল্প শুরু হয় একটি বিয়ের দৃশ্যের মাধ্যমে। যেখানে একজন খ্যাতিমান নির্মাতা তাঁর সম্ভ্রান্ত স্ত্রীর সঙ্গে বহু বছরের সংসার ভেঙে দিয়ে বিয়ে করেন কৈশোরে পা দেওয়া মেয়ের সহপাঠীকে। না, ছবিতে কোনো হত্যার রহস্য বিশদভাবে উন্মোচন করা হয়নি; বরং একজন নির্মাতার অহংকার ও অভিমানের গল্প ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে, ঢাকার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে তৈরি হয় পারিবারিক বিশৃঙ্খলার গল্প। বলা হয়েছে, কষ্ট ও দুঃখে নিমজ্জিত হওয়া পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের কথা।
‘টেলিভিশন’ ও ‘পিঁপড়াবিদ্যা’র মতো জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাণের কারণেই ফারুকীর নাম সংযুক্ত হয় এবারের সাংহাই চলচ্চিত্র উৎসবে। ‘ডুব’ চলচ্চিত্রটি হয়তো পরিচিত কোনো গল্প বলছে, কিন্তু ছবিটিতে সেই পরিচিত গল্পই বলা হয়েছে নিজস্ব ভঙ্গিতে। ছবিটির চিত্রায়ণের ধরন ও গতি আপনার কপালে চিন্তার ভাঁজ তৈরি করবে। সাংহাই চলচ্চিত্র উৎসব প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত হওয়া স্বাধীনচেতা ছবিগুলোর মধ্যে একমাত্র ‘ডুব’ চলচ্চিত্রই দিতে পেরেছে বিনোদনের ছোঁয়া। ছবিটির জন্য দর্শকের সংখ্যাও ছিল চোখে পড়ার মতো। এ জন্য ইরফান খানের বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ভক্তরা একটা ধন্যবাদ পেতেই পারেন।
এবারের সাংহাই ফিল্ম ফেস্টিভালে সেরা ছবির পুরস্কার জিতেছে ফিলিপাইনের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘পেডিকেভ’। আর সেরা অ্যানিমেশন চলচ্চিত্রের পুরস্কার জিতেছে ‘লাভিং ভিনসেন্ট’।
ভারতের ভিন্নধারার চলচ্চিত্র ‘লাঞ্চবক্স’ বা হলিউডের ‘লাইফ অব পাই’, ‘জুরাসিক পার্ক’ ও ‘ইনফার্নো’তে অভিনয় করা ইরফান খান দুর্দান্ত অভিনয়ের ধারা বজায় রেখেছেন ‘ডুব’ চলচ্চিত্রেও।
কলকাতা চলচ্চিত্র শিল্পের জায়ান্ট এস কে মুভিজের সঙ্গে বাংলাদেশের জাজ মাল্টিমিডিয়ার যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হয়েছে ছবিটি। তবে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে চলচ্চিত্রটিকে অননুমোদিত বায়োপিক আখ্যা দিয়ে এর ছাড়পত্র আটকে দেওয়া হয়। বায়োপিকের অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি পেলেও ছবিটির মুক্তি আটকে যায় আবারও। কারণ ছবিটির বিষয়বস্তু। বাংলাদেশে একজন পুরুষের তালাক দিয়ে তরুণী কাউকে বিয়ে করা সামাজিক রীতিনীতি-বহির্ভূত। যতই বিতর্ক থাকুক, ছবিতে কোনো লাম্পট্য প্রকাশ পায়নি; বরং এটি একটি ভালো মানের চলচ্চিত্র হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে।
গল্পের শুরুতে অহংকারী, হতাশাগ্রস্ত, জটিলতায় পরিপূর্ণ জাভেদ হাসানের (ইরফান খান) মনে সুপ্ত একটি বাসনা থাকে। গল্পের নায়িকা নীতুর (ভারতীয় অভিনেত্রী পার্নো মিত্র) সঙ্গে জাভেদকে সময় কাটাতে দেখা যায়। তবে এ সম্পর্ক নিয়ে জাভেদ তার স্কুলশিক্ষিকা স্ত্রী মায়ার (রোকেয়া প্রাচী) মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছিল। বাইরে ঘুরতে যাওয়ার অজুহাতে গাড়ি নিয়ে বের হয় জাভেদ ও মায়া। কথার মারপ্যাঁচে সে তার সুপ্ত বাসনার কথা জানায় মায়াকে। নীতুর সম্পর্কে জাভেদ বলে ওঠে, ‘আমরা যতটা দূরে সরেছি, ততটাই কাছে এসেছি।’ কথাটি শুনে মায়া জাভেদের দিকে এমনভাবে তাকায় যেন জাভেদ একজন উন্মাদ। জাভেদ মায়াকে আরো জানায়, তাদের মধ্যকার সম্পর্কে একঘেয়েমি চলে এসেছে। যখন জাভেদের এই গোপন ইচ্ছার কথা তার সন্তানরা জানতে পারে, তখন তারা জাভেদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়।
সুন্দরী নীতুকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে জাভেদ পরিবার থেকে আলাদা হয়ে নিজের ফিল্ম স্টুডিওতে একা থাকতে শুরু করে। জাভেদের মেয়ে সাবেরী (নুসরাত ইমরোজ তিশা) ও নীতু দুজনেই একই স্কুলে ও একই শ্রেণিতে পড়াশোনা করত। স্কুলজীবনের বহু প্রতিযোগিতায় তারা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বীও ছিল। সাবেরীর চোখে জাভেদের সঙ্গে নীতুর সম্পর্ক একটা প্রতিযোগিতা হিসেবে প্রতীয়মান হয়, যেখানে নীতু তাকে হারিয়ে জিতে গেছে। নীতুকে নিয়ে যৌন আবেদনও ঘোরাফেরা করত জাভেদের মাথায়। কিন্তু ফারুকীর চিত্রনাট্য সে পথে হাঁটেনি। ক্যামেরার সুনিপুণ কারুকার্যে যৌন আবেদনকে সরিয়ে আবেগের দিকে বেশি ইঙ্গিত দিয়েছেন ফারুকী।
খ্যাতিমান পরিচালক হওয়ার কারণে জাভেদের সঙ্গে নীতুর সম্পর্কের ঘটনা গণমাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায়। ফলে জাভেদের চলচ্চিত্রে কাজ করা ছেড়ে দেয় নীতু। এরপর একদিন জাভেদের বাসায় আসে নীতু এবং সেখানেই রাত্রিযাপন করে। জাভেদের জন্য নীতুর সঙ্গে রাত্রিযাপন মোটেও কঠিন ছিল না। কিন্তু জাভেদের পরিবারের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে জাভেদের প্রতি সর্বোচ্চ সহমর্মিতা দেখিয়ে বিষয়টি মেনে নেওয়া এবং পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া। যেখানে জাভেদ বাবা হিসেবে সফল এবং জীবিত, সেখানে এমন ঘটনা পরিবার ঠিক মেনে নিতে পারেনি। স্পর্শকাতর জাভেদের সামনে দুটি পথ খোলা থাকে—এক. তার পরিবার, দুই. একটি কিশোরী মেয়ে। নিজের সঙ্গে নিজেই দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে জাভেদ।
ছবিটির অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সাবেরির চরিত্রটি। সাবেরি চরিত্রটির আবেগকে তিশা অনেকটাই বাস্তবসম্মতভাবে তুলে আনতে পেরেছেন। রাগান্বিত, লজ্জিত, প্রতিহিংসাপরায়ণ একটি মেয়ে তার বাবার প্রতি ভালোবাসার দুয়ার চিরতরে বন্ধ করে দেয় শুধু তার মায়ের জন্য। অন্যদিকে, মায়া চরিত্রে অভিনয় করা রোকেয়া প্রাচীকে উপস্থাপন করা হয়েছে অতিমানবীয় মানসিক উচ্চতাসম্পন্ন একজন নারী হিসেবে। ছবিটির শেষ দৃশ্যকে নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যেখানে মা ও মেয়ের মনে থাকা কষ্টকে দূর করতে তারা একটি ঘাসভর্তি খোলা মাঠে যায়। সেখানে কল্পিত মুঠোফোন যোগাযোগ হয় মা ও মেয়ের মধ্যে। যেখানে মা তার বাবার প্রতি অব্যক্ত ভালোবাসার কথা জানায় মেয়েকে।
সমসাময়িক ও ধ্রুপদি মিশ্রিত পাভেল আরিনের সংগীত পরিচালনা ছবির সঙ্গে প্রত্যাশা অনুযায়ী মিলে গেছে।
প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান : আই কে কোম্পানির সহযোগিতায় জাজ মাল্টিমিডিয়া ও এস কে মুভিজ।
চরিত্রায়নে : ইরফান খান, নুসরাত ইমরোজ তিশা, পার্নো মিত্র, রোকেয়া প্রাচী, রাহাদ হোসেন।
চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় : মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
আলোকচিত্র পরিচালনায় : শেখ রাজিবুল ইসলাম।
প্রযোজক : আবদুল আজিজ, অশোক ধানুকা, হিমাংশু ধানুকা।
সংগীত : পাভেল আরিন।
সম্পাদনা : মোমেন বিশ্বাস।
প্রতিযোগিতার স্থান : সাংহাই চলচ্চিত্র উৎসব।