জন্মদিন
বলিউডের কাজলকন্যা
স্কুলে পড়াশোনা করা অবস্থায় এক ছোট্ট মেয়ে যদি সিনেমায় কাজ শুরু করে দেয়, তাও আবার নায়িকার চরিত্রে, একেবারে নাচ-গানওয়ালা কমার্শিয়াল সিনেমায়- তাহলে কি তার বাবা-মা থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশী আর আত্মীয়স্বজন একটু হলেও ভ্রূ কুঁচকাবেন না? ১৯৭৪ সালের আজকের দিনে জন্ম নেওয়া কাজল মুখার্জি, মানে কাজল এসবে কিন্তু মোটেও পরোয়া করেননি।
তবে সবাই হয়তো এত মাথা ঘামাননি। মা তনুজা তো বিখ্যাত অভিনেত্রী এককথায় বলতে গেলে। বিনোদনজগতের বাসিন্দা হয়েও খুব একটা লাভ হলো না, মেয়ের প্রথম সিনেমা ‘বেখুদি’ বক্স অফিসে ফ্লপ হিসেবে নাম লেখাল। মেয়ের জীবন শুরু হলো ফ্লপ দিয়ে।
আব্বাস মাস্তান নামের দুই ভাই সিনেমা বানাবেন, এমন কিছু তাঁরা দেখাতে চাচ্ছিলেন যেটা বলিউড এর আগে দেখেনি, যেখানে নায়কই খলনায়ক। নায়িকা চরিত্রে প্রথমে শ্রীদেবীকে নেওয়ার কথা ভাবছিলেন- কিন্তু স্ক্রিপ্টে শ্রীদেবীকে মেরে ফেলার কথা ছিল। তখনকার এই জনপ্রিয় নায়িকাকে স্ক্রিনে মেরে ফেলার এত বড় ঝুঁকি এই দুই ভাই নিয়ে চাচ্ছিলেন না। নতুন একজন নায়িকা নিলেন শিল্পা শেঠি নামের, শিল্পার বোনের চরিত্রে নিলেন সেই ফ্লপ দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করা মেয়েকে।
সমস্যা শেষ হয়নি তখনো, এই ধরনের অ্যান্টিহিরো রোলে কেউই কাজ করতে চাচ্ছিলেন না, এই রোল একে একে ফিরিয়ে দিলেন সালমান খান, তাঁর ভাই আরবাজ খান, অক্ষয় কুমার, অনিল কাপুরের মতো স্টাররা। সিনেমা না করার আরেকটা কারণ ছিল, একদম নতুন নায়িকা, যে আবার ক্যারিয়ার শুরু করেছে ফ্লপ দিয়ে, তার ওপর চেহারায় তেমন ‘জৌলুস’ নেই। নতুন নায়িকার বিপরীতে অবশেষে এলো আরেক নতুন ছেলে, যাকে দেখে সেই মেয়ের প্রথম রিঅ্যাকশন ছিল- ‘এই ছেলে নায়ক?! এই শ্যামলা চিকন ছেলেটা? ওহ গড!’ কে জানত এই শ্যামলা চিকন শাহরুখ নামের ছেলেটার সঙ্গে তার জুটিকে ভারতীয় ছবির কাল্ট ক্লাসিক জুটিতে পরিণত হবে?
‘বাজিগর’ নামের সেই সিনেমা সুপারহিট, তার সঙ্গে হিট এই দুজন নতুন ছেলেমেয়ে, রাতারাতি সুপারস্টার। রাতারাতি সুপারস্টার হওয়া মেয়েটা আবার রাতারাতি ব্যর্থতার স্বাদ পেল পরের দুটি সিনেমা দিয়ে, এরপরে সাফল্য আসল আবার সেই ‘শ্যামলা আর চিকন’ ছেলেটার সঙ্গে কাজ করে, এবার অবশ্য সঙ্গে সালমান খানও ছিল- সিনেমার নাম ‘করন অর্জুন’। বছরের অন্যতম সেরা হিট ছিল সেই সিনেমা।
ততদিনে এই দুজনের জুটি সেই রকম হিট। ১৯৯৫ সালের ২০ অক্টোবর এমন এক সিনেমা করলেন এই দুজন, যে সিনেমা কোটি মানুষকে ভালোবাসতে শেখাল এবং মুক্তির পর থেকে এখনো একটি সিনেমা হলে তিন বেলা চলছে। সিনেমার নাম দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে- যেটাকে ফ্যানরা সংক্ষেপে বলেন DDLJ.
১৯৯৫ কাজলের জন্য আরেকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ বছর, এই বছর তিনি আরেক ‘শ্যামলা’ ছেলের প্রেমে পড়েন, সিনেমাতে নয়- বাস্তবে। ছেলের নাম অজয় দেবগন। মজার ব্যাপার হলো, ছেলেকে প্রেমের প্রোপোজ তিনি নিজেই করেন!
বিয়েটা তখনো হয়নি, তার আগে নিজেকে আরেকটু প্রমাণ করা বাকি ছিল তাঁর। এতদিন যেখানে সবাই বলত- শাহরুখের জন্যই তুমি হিট, সেই কথার ঝাঁজটা একটু কমানোর জন্য এমন দুটো পারফর্মেন্স করলেন- যেটা দেখে সবাই বলতে বাধ্য হলো যে তিনি আসলেই কতটা অসাধারণ অভিনেত্রী। ‘গুপ্ত’ সিনেমায় নেগেটিভ রোল আর ‘দুশমন’-এ নিজের ডবল রোল-এর আগে নারীকেন্দ্রিক ডবল রোল খুব কম হয়েছিল আর তার মতো এ রকম দুর্দান্ত পারফর্মেন্স তো অবশ্যই কম হয়েছিল! ‘গুপ্ত’ সিনেমায় করা নিজের পারফর্মেন্সকে নিজের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জিং রোল বলেন তিনি এবং তিনিই প্রথম অভিনেত্রী ছিলেন যিনি নেগেটিভ রোলে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পান।
পারফর্মেন্স এরপর আরো ভালো ছিল, দিন দিন সাফল্যের গ্রাফটা তরতর করে উপরে উঠছিল। সালমানের সঙ্গে ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা ক্যেয়া’ সিনেমার একটা দৃশ্যে সালমানের মা সেজে অভিনয় করা থেকে শুরু করে ‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়’। একই সঙ্গে এক টমবয় আর চিরাচরিত ভারতীয় নারীর রোল প্লে- দর্শকের ভোলা অসম্ভব।
অতঃপর ১৯৯৯ সালে ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে বিয়ের মালাবদল, টানা দুই মাস ধরে হানিমুন উদযাপন! এরপর দুজনের একসঙ্গে সিনেমা- একসঙ্গে সাফল্য আর ব্যর্থতাকে সামাল দেওয়া- ২০০১ এ আবার শাহরুখের সঙ্গে সিনেমা, ডিরেক্টরের আসনে পুরোনো বন্ধু করন জোহর। সঙ্গে অমিতাভ, জয়া আর ঋত্বিক-কারিনা। জীবনের ক্ষণিক আনন্দ আর ক্ষণিক বেদনার সঙ্গে নাম মিল রেখেই যেন সিনেমার নাম ‘কাভি খুশি কাভি গম’।
২০০১ সালে ঘোষণা দিলেন, সিনেমা থেকে সাময়িক বিরতি নেবেন, কারণ একটাই-পরিবারকে সময় দেওয়া। তবে একদম বিরতি নেননি, ভালো স্ক্রিপ্ট পেলেই কাজ করেছেন। প্রমাণ ২০০৬ সালে আমির খানের বিপরীতে ‘ফানা’।
পরিচালক কুনাল কোহলি যখন এই সিনেমার স্ক্রিপ্ট আমির খানকে শুনাচ্ছিলেন, তখন আমিরকে তিনি বললেন, এই সিনেমায় আপনি যাকে বলবেন আমরা তাঁকেই নায়িকা হিসেবে নেব, তিনটা চয়েস বলেন আপনার পছন্দমতো। মিঃ পারফেকশনিস্ট বললেন, ‘আমার তিনটা চয়েস হলো কাজল, কাজল এবং কাজল। এই স্ক্রিপ্টে তার চেয়ে পারফেক্ট কেউ নেই!’
কাজলকে নিয়ে যতই বলা হোক, শেষ করা কঠিন। বাণিজ্যিক ছবিতে মেধার সঙ্গে পারফরমেন্স অনেক লম্বা সময় ধরে তাঁর মতো কজন বলিউডি নায়িকাই দেখিয়েছেন! স্ক্রিপ্ট পছন্দ না হলে তিনি কাজ করেন না। সিনেমায় নায়ক যেই হোক, শাহরুখ বা আমির- সেখানে কাজলের ক্যারেক্টারের আলাদা একটা গভীরতা এবং প্রাধান্য থাকবেই।
নিজের অভিনয় নিয়ে বলেছেন, ‘আমি শুধু ক্যারেক্টারের ইমোশনকে নিজের ভেতরে অনুভবের চেষ্টা করি। মাই নেম ইজ খানে আমার একটা দৃশ্য আছে, আমার ছেলে মারা গেছে আর আমি তার লাশ জড়িয়ে ধরে ‘কাম ব্যাক’ বলে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে কান্না করছি। করন আমাকে বলেছিল তুমি নিজের মতো করে করো। বিয়ের পর আমি যখন প্রথম মা হই, আমার সেই সন্তানটা বাঁচেনি- সন্তান হারানোর কষ্টটা তাই আমার জানা। সেই কষ্টটা মনে করার চেষ্টা করলাম, দেখলাম কিছুতেই চোখের পানি আটকাতে পারছি না, এমনকি করন নিজেও কেঁদে ফেলেছিল! করন আমার অনেক ভালো একটা বন্ধু, ও কাজের কথা বললে আমি না করতে পারি না। এমনকি ওর যে ছবিতে আমি নেই, সেখানেও আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমি থাকি, যেমন কাল হো না হো বা কাভি আলবিদা না কেহনা।’
প্রথম সন্তানকে হারালেও এখন তিনি দুই সন্তানের গর্বিত মা। যত ব্যস্তই থাকুন না কেন- সন্তানের যত্নের দিকে তাঁর নজর থাকে সর্বক্ষণ। যদিও মা হিসেবে নিজের কিছু দুর্বলতা তিনি অকপটে প্রকাশ করেন, ‘আমি রান্না করতে পারি না, একেবারেই না, এমনকি এক কাপ চাও না। আমার সন্তানরা বড় হয়ে কখনো কাউকে বলতে পারবে না- আহ! আমার মায়ের হাতের রান্না যা ছিল না!’ শুধু নিজের সন্তানদের জন্য না, পথের শিশুদের জন্যও তাঁর খেয়াল কম নেই। অনেক সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত তিনি, যার মাঝে আছে বেশ কিছু শিশু সংগঠনের সাহায্য করা।
অনেকের সঙ্গে অভিনয় করলেও শাহরুখের সঙ্গে তিনি যখন ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান, তখন যেন দুনিয়ার সব কিছু থেমে যায়। এই দুজন যখনই একসঙ্গে পর্দায় এসেছেন, তখনই বক্স অফিসে অঢেল পয়সা এনেছেন আর সাধারণ মানুষের অঢেল ভালোবাসা নিয়ে গেছেন। বলিউডের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জুটিও বলা যায় তাঁদের নির্দ্বিধায়। এখন পর্যন্ত এই দুজনের কোনো সিনেমা ব্যর্থ হয়নি- ব্যবসা আর মানের দিক থেকে। চারবার ফিল্মফেয়ারে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার, বিপরীতে শাহরুখ। দুজন এখনো ছয় মাস পরপর মারাঠা মন্দিরে গিয়ে দর্শকের সঙ্গে DDLJ দেখেন। ‘শাহরুখের সঙ্গে আপনার যে কেমিস্ট্রি, এই জেনারেশনে সে রকম আর কাকে দেখেন?’ এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই রণবীর আর দীপিকা। ওদের দুজনের মাঝে সেই রকম একটা ব্যাপার আছে বটে!’
মাই নেম ইজ খানের পাঁচ বছর পর তিনি আবার কামব্যাক করছেন, সেই শাহরুখের সঙ্গে। সিনেমার নাম দিলওয়ালে, রিলিজ ডেট ১৮ ডিসেম্বর। দেখা যাক, প্রত্যাবর্তন কেমন হয়! তবে কাজল-শাহরুখ জুটি কখনোই দর্শক বা বক্স অফিসকে হতাশ করবে না, বাজি ধরতে পারেন নিশ্চিন্তে।
সঙ্গে তাঁকে আজকে জন্মদিনের শুভেচ্ছাও জানিয়ে দিন।