ফিল্ম রিভিউ
‘অন্তর জ্বালা’য় ঘাটতি রয়েই গেছে
অপারেশন থিয়েটার। অস্ত্রের আঘাতে জীবন-মৃত্যুর সন্নিকটে নায়কের ছোট ভাই। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা, এই বুঝি প্রাণ যায় যায়। অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অপেক্ষা করছে যুবকের বড় ভাই (নায়ক)। এমন পরিস্থিতিতে কী করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না সে। সব দুশ্চিন্তা একযোগে জড়ো হয়েছে তাঁর মাথায়। এমন সময় মুখের মাস্ক খুলতে খুলতে অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এলেন ডাক্তার। বড় ভাই ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘রোগীর কী অবস্থা’? ডাক্তার স্বাভাবিকসুলভ উত্তর দিলেন— ‘এখনো সংকট কাটেনি রোগীর’। চলচ্চিত্রের পর্দায় এ ধরনের ঘটনা দেখেনি, এমন মানুষ পাওয়া দুঃসাধ্য। এ রকম চিরাচরিত কাহিনী ও দৃশ্য দেখতে হয়েছে, চলচ্চিত্র নির্মাতা মালেক আফসারীর সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘অন্তর জ্বালা’য়। তিনি বেশ কিছু ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।
মালেক আফসারীর চলচ্চিত্রে এরকম গৎবাঁধা দৃশ্য দেখব! এমন আশা নিয়ে সিনেমা হলে যাইনি। দুই বছর বিরতি নিয়ে স্বনামধন্য চলচ্চিত্র নির্মাতা মালেক আফসারী ‘অন্তর জ্বালা’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন। মুক্তি পাওয়ার আগেই চলচ্চিত্রের ট্রেইলার, গান নিয়ে চলচ্চিত্রপাড়া ও চলচ্চিত্রপ্রেমী দর্শকদের আকৃষ্ট করেছিল ‘অন্তর জ্বালা’। খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে নতুন চলচ্চিত্র মুক্তি দিয়েছেন মালেক আফসারী। উদ্বোধনী দিনেই প্রায় ১৫৭টি হলে ‘অন্তর জ্বালা’ মুক্তি পেয়েছে। অনেক বন্ধ হলও চালু হয় এই চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর মাধ্যমে। এখন কথা হলো— দেশের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের ভালো চলচ্চিত্র দেখার সাধ পূর্ণ করতে পেরেছে কি ‘অন্তর জ্বালা’!
মাংস বিক্রেতা (কসাই) বাবার দুই ছেলে আলাল ও দুলাল। আলাল বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক মান্নার অন্ধভক্ত। মান্না অভিনীত কোনো চলচ্চিত্র মুক্তি পেলেই দেখে ফেলেন আলাল। চলচ্চিত্র দেখার অপরাধে রাগী কসাই বাবা একদিন আলালকে খুব পেটান। আলাল রাগে-অভিমানে রাতে মায়ের গহনা চুরি করে ছোটবেলায় বাড়ি থেকে পালান। শহরে গিয়ে সিনেমা হলে চাকরি নেন। সিনেমা হলের পাশের এক হিন্দু মেয়ের সঙ্গে আলাল প্রেমে পড়েন। শেষ পর্যন্ত আলাল তাঁর ভালোবাসার পরিণতি দেখতে পান না। নিজের চোখের সামনে নিজ গলায় বঁটি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন আলালের ভালোবাসার মানুষটি। আলাল গ্রামে ফিরে আসেন, বাবা আলালকে মেনে নিতে চান না। ছোট ভাই দুলাল ডিশ লাইনের ব্যবসা করেন। ব্যবসা সূত্রে ছোট ভাইয়ের শত্রুদের সঙ্গে আলালও সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এভাবে মালেক আফসারীর ‘অন্তর জ্বালা’ চলচ্চিত্রটির কাহিনী আগাতে থাকে। চলচ্চিত্রের শেষ পরিণতি বললাম না এই জন্য যে, দর্শকরা হলে গিয়েই দেখুক শেষটুকু। চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য করেছেন পরিচালক নিজেই।
দীর্ঘ সময় বিরতির পর পরিচালক একটি ভালো চলচ্চিত্র দর্শকদের উপহার দেবেন, এই মর্মেই হয়তো তিনি চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছেন। তবে চিত্রনাট্য তৈরির ক্ষেত্রে আরেকটু যত্নবান হতে পারতেন তিনি। চলচ্চিত্রের কাহিনীতে দেশের মহানায়ক মান্নার উপস্থিতি আছে চোখে পড়ার মতো। পরিচালক চলচ্চিত্রের গল্পটি খুব সরলভাবে উপস্থাপন না করে ভিন্নতার আশ্রয় নিতে পারতেন। চলচ্চিত্রটি দেখেও তাই মনে হয়েছে।
‘অন্তর জ্বালা’ চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করেছেন নায়ক জায়েদ খান নিজেই। নায়কের নিজস্ব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জেড কে মুভিজ ‘অন্তর জ্বালা’র স্বত্বাধিকারী। এই প্রতিষ্ঠানের এটাই প্রথম প্রযোজিত কোনো চলচ্চিত্র। প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণে খরচ করতে কমতি করেননি চিত্রনায়ক জায়েদ খান। ‘অন্তর জ্বালা’ চলচ্চিত্রটির শুটিং হয়েছে পিরোজপুর শহর ও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে। ১২০ দিন ধরে চলেছে চলচ্চিত্রের শুটিং। এই চলচ্চিত্রে প্রি-প্রোডাকশন, প্রোডাকশন ও পোস্ট-প্রোডাকশন মিলে ব্যয় হয় দুই কোটি টাকার বেশি। চলচ্চিত্রটি নির্মাণে খরচ করতে বিন্দুমাত্র কৃপণতা করেননি পরিচালক ও প্রযোজক। এ জন্য তাঁরা খুব আশাবাদীও ছিলেন এর ব্যবসা সফলতা নিয়ে।
দর্শক ছবি দেখেই বুঝবেন ছবিতে কোথায় যেন কিছু একটা ঘাটতি রয়েই গেছে! ‘অন্তর জ্বালা’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন জায়েদ খান, পরী মণি, বড়দা মিঠু, চিকন আলী, অমিত হাসান প্রমুখ। অভিনেতা-অভিনেত্রী হিসেবে সবার চেষ্টা ছিল প্রাণবন্ত অভিনয় করার। করেছেনও তাঁরা। তবে, পাত্রপাত্রীদের কোথাও কোথাও অভিনয়ের কমতি রয়েছেই, ‘অন্তর জ্বালা’র প্রধান নায়ক জায়েদ খান ভালো অভিনয় করার পথে উঠেছেন, আবার পিছলে পড়ে গেছেন বলে মনে হয়েছে। তাঁর কান্নাকাটির দৃশ্যগুলোর অভিনয় অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে দর্শকের কাছে। আর বাংলা চলচ্চিত্রের চিরাচরিত আঞ্চলিক সংলাপ ‘তোরে আমি দেইখ্যা লমু’ এ ধরনের সংলাপ ভালো দর্শকের কাছে বরাবরই অপ্রিয়। এ ধরনের সংলাপ ছিল ‘অন্তর জ্বালা’য়। সংলাপের ক্ষেত্রে এ ধরনের ভাষা ব্যবহার না করলেও পারতেন পরিচালক মালেক আফসারী। এর আগে এ ধরনের সংলাপ বাংলা চলচ্চিত্রে ব্যবহার যখন ব্যবহার শুরু হয়েছে, তখন থেকে রুচিশীল দর্শকরা হল ছাড়তে শুরু করেছে। এখনো হলগুলো দর্শকখরায় রয়েছে। নায়িকা পরী মণি তাঁর স্বাভাবিক অভিনয়টা করার চেষ্টা করেছেন। তবে অমিত হাসান, বড়দা মিঠু দ্বারা পরিচালক আরেকটু প্রাণবন্ত অভিনয় বের করতে পারতেন। আর নায়ক জায়েদ খানের কাছে দর্শকের প্রত্যাশা আরো ছিল বটেই।
চলচ্চিত্রের শুরুটা দর্শকদের যেভাবে আকৃষ্ট করতে পেরেছে, পরে এর ধারাবাহিকতা কিছু মন্থর ছিল। এখানেই ছন্দ-পতন ‘অন্তর জ্বালা’র। এই ঘাটতি কিছুটা কাটিয়ে উঠেছে এর গান ও আবহ সংগীতের প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে। সংগীতশিল্পী এস আই টুটুলের আবহ সংগীতের ভোকাল ও চলচ্চিত্র শুরুর শৈশবের গান দর্শকরা খুব উপভোগ করেছে। দৃশ্যধারণ, পোশাক পরিকল্পনা, মেকআপ ব্যবহারে পরিচালক দিয়েছেন নান্দনিকতার পরিচয়, সম্পাদনাতেও এ ধরনের চেষ্টা ছিল। ‘অন্তর জ্বালা’ চলচ্চিত্রটির নির্মাণের ক্ষেত্রে সিনেমেটিক যাত্রা লক্ষণীয়। এ জন্য পরিচালকের প্রাণপণ চেষ্টাও ছিল। তবে অভিনয়, চিত্রনাট্য, সংলাপ, নির্মাণ-ভাবনা ক্ষেত্রে আর একটু পরিপক্বতা পরিচালকের কাছে আশা করলে দর্শক হয়তো ভুল করবে না। কারণ প্রায় দুই বছর বিরতি দিয়ে মালেক আফসারী ‘অন্তর জ্বালা’ নির্মাণ করেছেন। ভালো করার চেষ্টা ছিল মালেক আফসারীর। তারপরও কোথায় যেন একটু কমতি রয়েই গেছে পুরো ছবিতে। তাঁর কাছে দর্শকের প্রত্যাশা আরো বেশি ছিল।
লেখক : সাংবাদিক ও নাট্যকর্মী