ফিল্ম রিভিউ
জালালের ডিসটোপিয়ান অলাতচক্র
ছবির নাম নিয়ে একটু থতমত খেয়েছেন অনেকে। পূর্বতন সময়ে প্রস্তাবিত ‘জালালের পিতাগণ’ থেকে অনেকটা সাদামাট ধাঁচে ‘জালালের গল্প’ হয়ে যাওয়া, কারণটা কি? আমরা কি জালালকে চিনি? নাকি পরিচালক জালালকে চেনাতে চান বিশেষ কোনো পাঁয়তারায়? এসব উদ্দেশ্য কিংবা সম্ভাব্যতা-যাচাইকরণ পাশে রেখে যারা শুধু টিকেট কেটে সিনেমা হলে ছবি দেখার উদ্দেশ্যে গেছেন, তাঁদেরও নিজেদের প্রতারিত মনে করবার কিছু নেই! প্রশংসা তো রয়েছেই, যিনিই ছবিটা দেখেছেন, অন্তত এটুকু বলেছেন, ‘হুম, ভালোই ছবিটা। গান-টান কিছু নাই, তাও ভালোই।’
জালালকে দেখতে গিয়ে দর্শক এক বৃত্তাকার পথের এক কোণা থেকে অসচেতন মানসে যাত্রা শুরু করে। নদীর পানিতে বিশাল, লম্বা-চওড়া স্পেস নিয়ে বাঁধানো ক্যামেরা ফ্রেমে এক ডেকচিতে ভেসে আসা জালালের আবির্ভাব আন্দাজ করা যায়। শিশুর কান্নার ননডাইজেটিক সাউন্ড সেটা পাকাপাকি করে। বাস্তব হয়েও ঠিক যেন বাস্তব না আকাশে উড়ে যাওয়া কিছু পাখির কারণে। জাদুবাস্তব কি? নির্মাতা কি লাতিন আমেরিকার চলচ্চিত্রে প্রভাবিত। আমরা সে আলাপে পরে আসি। তবে প্রাথমিকভাবে বোঝা যায় যে জালালের পরিচয় ঠিকঠাক পাওয়ার কোনো উপায় নেই, কারণ তার আসলে কোনো পরিচয়ই নেই। সমাজ, বা তার সাময়িক পালকের তরফ থেকেই তার নাম ঠিক হয় জালাল। ‘আগে পিছে কিছু নাই’? এমন প্রশ্নে পরে নামের আগে ‘মোহাম্মদ’ যুক্ত হয়। প্রাথমিকভাবে কে জালালকে নেবে এ নিয়ে ঠেলাঠেলি শুরু হলেও জালালের আবির্ভাবে নদীতে মাছের জোয়ার আসে যেন! ধর্ম এবং কুসংস্কারের অন্ধবিশ্বাসে জর্জরিত সমাজ নাদান জালালকে ‘পাতি মহাপুরুষ’ বানিয়ে দেয়। এখান থেকেই জালালের কথা শুরু। আমরা প্রোটাগনিস্টের পরিচয়ের সুবিধার্থে বলতে পারি, জালাল একজন জন্মপরিচয়হীন মানুষ, যার জীবনের শুরু হয়েছে একজন অ্যাকসিডেন্টাল মহাপুরুষ হিসেবে। আর পরে গল্প গড়িয়েছে আরো বাড়তি দুই ধাপে। এই দুই ধাপে বালক জালাল এবং তরুণ জালালের জীবন এবং জীবনের গতিপথ দেখানো হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন কাহিনীতে-যদিও কাহিনীগুলো একই, অবিকল। পটভূমি, চরিত্রের নামধাম আর সময়ের কিছু রকমফের থাকলেও ভিত্তিমূলে কোনো ফারাক নেই। জালালের গল্প তাই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আসলে একই গল্প, যে গল্পটা তিনবার বলা হয়েছে।
জালালের পরিচয়ের সাথে সাথেই আমরা জালালের পারিপার্শ্বিক সমাজের পরিচয় পাই। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল, একটু শহুরে গ্রাম এবং রুক্ষ শহর। এই তিনটি স্থানে জালাল চরিত্রের বিকাশ ঘটেছে ছবির ন্যারেটিভের সাথে সাথে। প্রেক্ষাপট, অবকাঠামোগত বা ঘটনার সাপেক্ষে এই তিনের মধ্যে বৈশিষ্ট্যগতভাবে পার্থক্য থাকলেও প্রকৃতপক্ষে আসলে এগুলোর মধ্যে কোনো পার্থক্য অবিদ্যমান। জালালকে মাঝখানে রাখলে তার দুইপাশে সমাজের যত অনাচার-নিপীড়ন-অজ্ঞতা, আরেকপাশে প্রতিবাদী আর নির্যাতিতের ব্যর্থ আক্ষেপ। এমন সমাজে জালালের কোনো অতীত নেই, গ্রহণযোগ্য কোনো বর্তমান নেই, এমনকি ভরসা করার মতো কোনো ভবিষ্যৎও নেই। জালালকে ঘিরে থাকা সমাজের চক্রাবর্তকে রূপকভাবে যদি একক ধরা হয়, তবে সেখানে সৌন্দর্যের কোনো অস্তিত্ব নেই। সেখানে কোনোকিছুই সঠিক বিন্যাস, নিয়ম, স্বাভাবিকত্ব দিয়ে চলে না- বরং তার উল্টোভাবেই বজায় থাকে গতিশীলতা। সে হিসেবে জালালের পারিপার্শ্বিক সমাজ আবির্ভূত হয়েছে ডিসটোপিয়ান কাঠামোয়। টেরি গিলিয়ামের ‘ব্রাজিল’ ছবিতে আমরা ডিসটোপিয়ান সমাজের একটি চমৎকার নিদর্শন দেখতে পাই যেখানে সবকিছুই বিশৃঙ্খলভাবে চলে, সমস্ত স্বপ্নের যেখানে অপমৃত্যু হয় এবং দুঃস্বপ্নই যেখানে সহজাত বাস্তব। একই রকম দেখা যায় জালালের সমাজে, এখানে সন্তানপ্রাপ্তির বিষয়টি কোনো অবস্থাতেই সহজাতভাবে কাম্য নয়- তা সে সন্তানকে ভাগ্যক্রমে পাওয়া হোক, না পাওয়ার হোক কিংবা স্বাভাবিকভাবে পাওয়া হোক, যেভাবেই হোক না কেন। জালাল চরিত্রটির ক্রমবিকাশ এবং আপাত পরিসমাপ্তি এই অবকাঠামো ব্যবস্থাকে জারি রাখে স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
জালাল প্রতিবারই, জন্মের শুরু থেকেই বেঁচে থাকার চেষ্টায় নিরন্তর সংগ্রাম করেছে। ডেগচির মধ্যে ভেসে থেকেও প্রাণ যায়নি তার, বস্তায় পুরে দেওয়া হলেও সেবারেও মরেনি, শেষটায় কি মরল? সেটা প্রশ্নের মতো থেকে যায়, তবে পুনরায় ডেগচিতে ভেসে যাওয়া শিশুর মাঝ দিয়ে জালালের পুনরাবির্ভাব ঘটে। সার্কেল এন্ডিংয়ের ফরম্যাটে এই গল্প বুনে যাওয়ায় দক্ষতা দেখিয়েছেন পরিচালক। টানা, ঝরঝরে ভঙ্গিতে গল্পটা টেনে যাওয়ার জন্যও প্রশংসা পাবেন তিনি।
ছবির কলাকুশলীদের নিয়ে বাড়তি কিছু বলার নেই। সব শিল্পী কখনোই সমান হবেন না, কাজেই পারফরম্যান্সে ভালোমন্দ থাকবেই। নির্দিষ্ট করে কারো অভিনয় ভালো বা কারোটা মন্দ হয়েছে, সেগুলোর প্রাসঙ্গিকতা মোটামুটি নেই। তবে সাফল্য–ব্যর্থতার দায়ভার অবশ্যই পরিচালকের ওপরই বর্তায়। নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে হয়তো তিনি চাইলেই আরো ভালো অভিনয়টা বের করে আনতে পারতেন কিছু শিল্পীর কাছ থেকে। একই কথা বলা চলে ছবির দৃশ্যকল্প কিংবা শট নিয়েও। চমকপ্রদ কিছু শট ছাড়া বাকিটুকু মোটামুটি সাদামাটা, তাতে বৈচিত্র্যের অভাব রয়েছে স্পষ্টভাবেই। ভণ্ড ওঝার ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আচম্বিতেই দর্শককে সচেতন করে দেওয়া কুকুরের চিৎকারের মতো চমক হাতেগোনাই থেকেছে। কিংবা বলা যায় সবশেষ গল্পে শিলার পেটে কান পেতে অনাগত শিশুর অস্তিত্ব টের পাওয়ার জন্য জালালের প্রয়াস-এমন চমৎকার ভিজ্যুয়ালও খুব বেশি পাওয়া যায়নি। টানটান ন্যারেটিভের মতো দৃশ্যায়নে ততটা সাফল্য দেখাতে পারেননি পরিচালক, তবে উতরে যেতে পেরেছেন সহজেই-এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
‘জালালের গল্প’র সবচেয়ে বড় বিষয়, জালালের পরিচয় খুঁজে বের করা। জালালকে চিনে ওঠা। আপাতদৃষ্টিতে, পুরোটা সময়ে ঘটনার সাইডলাইনে বসবাস করা জালালই কেন এই ছবির নাম ভূমিকায়, তার ব্যাখ্যা মেলে জালালের পর্যবেক্ষণ পরিক্রমায়। জালাল একটি অক্ষমতার নাম, একইসাথে জালাল সমাজকাঠামোর একটি বিশাল অংশের প্রতিনিধিত্বকারী। এই অংশের বাসিন্দারা সবসময়ই সমাজের চলমান পরিক্রমায় অক্ষম দর্শকের ভূমিকা পালন করে। লক্ষ করলে দেখা যায়, দ্বিতীয় গল্পে বাবার সাথে মা কিংবা ওঝার সাথে মায়ের শারীরিক সম্পর্ক জালাল দেখে ফেলে লুকিয়ে। এই ভয়্যারিস্টিক টেন্ডেন্সি থেকে জালাল কখনোই বেরিয়ে আসতে পারেনি। তার এই স্কোপোফিলিক প্লেজার নেওয়ার বিষয়টি পরে পূর্ণাঙ্গ হয়- এর ভয়াবহ বিকাশ দেখা যায় গল্পের শেষ অংকে। এ সময়ে চোখের সামনে তারই প্রেমিকার (?) ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলে অক্ষম আক্রোশে জালাল ফুঁসলেও জানালার আড়াল থেকে দেখতে চায় ভেতরে কী হচ্ছে। এটি কি শুধুই জালালের বৈশিষ্ট্য, নাকি জালাল যে সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী তাদেরও? এ প্রশ্ন থেকে যায়, যার উত্তর একেকজনের কাছে একেক। আমাদের সমাজে জালালরা সরাসরি নিপীড়িত হয় না, নিপীড়ন করার ক্ষমতাও এদের নেই, এদের অবস্থান মধ্যবর্তী পর্যায়ে। তবে, এই মধ্যবর্তী পর্যায় থেকে সরে আসতে চাইলেই তারা কোপের মুখে পড়ে। জালালের জীবনের তিন পর্যায়েই এই বিষয়টি পরিলক্ষিত। এই ডিসটোপিয়ান অলাতচক্রে আটকেপড়া জালালের সহসাই মুক্তি পাওয়ার সুযোগ নেই। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিট্যুড’ তথা ‘নিঃসঙ্গতার ১০০ বছর’ উপন্যাসের জাদুবাস্তবতায় আমরা দেখি, সময়ের পর সময় পেরোলেও প্রাচীন অভিশাপ থেকে মুক্তি মেলে না কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার পরিবারের। তেমনি, তিনস্তরের সময়, প্রেক্ষাপট এবং পরিস্থিতি ছাপিয়েও ডেগচিতে ভেসে যাওয়া ভাগ্য বা দূর্ভাগ্য; কিংবা এক আজন্মের অভিশাপ থেকে মুক্তি মেলে না জালালের। সামঞ্জস্যর সাপেক্ষে একে ম্যাজিক রিয়্যালিজম বলা যায়, নাকি বাংলাদেশি রিয়্যালিজম বলা শ্রেয়তর? সে বিতর্ক ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাকুক। আপাতত আমাদের সুযোগ আছে একটি সৃজনশীল, বুদ্ধিদীপ্ত এবং সিনেম্যাটিক এলিমেন্ট-কলাকৌশলে ভর করে বানানো একটি খাঁটি বাংলাদেশি ছবিকে সাধুবাদ জানানোর। সেটা ‘জালালের গল্প’ যারা এত দূর টেনে নিয়েছেন, তাঁদের সবারই প্রাপ্য।