ফিল্ম রিভিউ
দেবী : মনস্তাত্ত্বিক নয়, ভৌতিক
বাংলাদেশের প্রথম সফল ভৌতিক বা অতিপ্রাকৃত চলচ্চিত্র ‘দেবী’। এর আগের ভৌতিক চলচ্চিত্রের নিদর্শন হিসেবে ‘ডাইনী বুড়ি’র (২০০৮) খোঁজ পাওয়া যায়। হলিউডে ভৌতিক বা অতিপ্রাকৃত একটি শক্ত ও অত্যন্ত জনপ্রিয় জঁরা। আগের ‘এক্সরসিস্ট’ (১৯৭৩), মাঝের ‘স্লিপি হলো’ (১৯৯৯) বা ‘ব্লেয়ার উইচ প্রজেক্ট’ (১৯৯৯) বা হালের ‘দ্য কনজুরিং’ (২০১৩)—হরর ছবির সংখ্যা গুনে শেষ করা যাবে না। দর্শকরা জড়োসড়ো হয়ে সেসব দেখেনও। এমনকি আমেরিকার সবচেয়ে শিল্পসম্মত পরিচালকরাও ভৌতিক বা অতিপ্রাকৃত বিষয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। যেমন স্ট্যানলি কুব্রিকের ‘দ্য শাইনিং’ (১৯৮০) কিংবা ডেভিড লিঞ্চের ‘ব্লু ভেলভেট’ (১৯৮৬)। ভারতেও মাঝেমধ্যে ভৌতিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এই তো সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে হিন্দি চলচ্চিত্র ‘পরী’ (২০১৮), তাও আবার বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। কিন্তু বাংলাদেশে ভৌতিক বা অতিপ্রাকৃত চলচ্চিত্র নির্মিত হয় না বললেই চলে। সেটা ভালো ব্যাপার না মন্দ, সেই বিচারে যাওয়ার দরকার নেই, কেবল একটি পর্যবেক্ষণ হিসেবে বলা হলো। ‘ডাইনী বুড়ি’ অত্যন্ত নিম্নমানের চলচ্চিত্র, যতটা না কাহিনীর জন্য, তার চাইতে নির্মিতির জন্য। তাই অতিপ্রাকৃত বিষয়ের সুনির্মিত চলচ্চিত্র ‘দেবী’ নিয়ে আলোচনায় আমি আগ্রহী হয়েছি।
‘দেবী’কে প্রথম সফল ভৌতিক/অতিপ্রাকৃত চলচ্চিত্র বলা যাচ্ছে, কারণ চলচ্চিত্রটিতে যত্নের ছাপ রয়েছে। আবার হুমায়ূন আহমেদের মিসির আলীর চরিত্রনির্ভর কাহিনী এখানে রয়েছে। দেশের সেরা দুই অভিনেতা-অভিনেত্রী চঞ্চল চৌধুরী আর জয়া আহসান এখানে অভিনয় করেছেন। কিন্তু পরিচালক অনম বিশ্বাসের প্রথম চলচ্চিত্র এটি। হুমায়ূনের কাহিনীনির্ভর সব চলচ্চিত্রই তো আর ভালো চলচ্চিত্রের আখ্যা পায়নি। ফলে এটিও ব্যর্থ চলচ্চিত্র হতে পারত। অনম বিশ্বাসের পূর্বের যে চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্টতার হদিস পাওয়া যায়, সেটিও অবশ্য সাফল্যের স্মারকই বহন করছে। ‘আয়নাবাজি’ (২০১৬) চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার ছিলেন তিনি। ‘দেবী’রও চিত্রনাট্যকার তিনি। চিত্রনাট্যকার হিসেবে তিনি ‘দেবী’কে যুগোপযোগী করেছেন, ২০১৮ সালের প্রেক্ষাপটে গল্পকে সাজানো হয়েছে। অন্যতম চরিত্র নীলু (শবনম ফারিয়া) ফেসবুক সূত্রেই মন্দ লোক সাবেতের (ইরেশ যাকের) পাল্লায় পড়ে, চরিত্রগুলো দেদার স্মার্টফোন ব্যবহার করে। কিছু ক্ষেত্রে কাহিনীতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। সেটা এমন দোষের কিছু নয়, সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গেলে কিছু পরিবর্তন হবেই। কারণ দুটো দুই মাধ্যম, প্রকাশের ভাষাও ভিন্ন। প্রথম পরিচালনায় এসে, তাও আবার অপ্রচলিত একটা জঁরায় কাজ করেছেন, প্রথম উদ্যোগে অনম বিশ্বাস উতরে যেতে পেরেছেন। মিসির আলী নিয়ে এর আগে টেলিভিশনে নাটক হয়েছে, কিন্তু চলচ্চিত্রে এই প্রথম উদ্ভাসিত হলেন মিসির আলী।
আনিসের (অনিমেষ আইচ) স্ত্রী রানু (জয়া আহসান) প্রায়ই রাতে নানান ধরনের শব্দ শুনতে পায়, কারা যেন তাকে ডাকে, তাদের গন্ধ টের পায়। এসব শব্দ রানুকে ভীত করে তোলে, ঘুমের মধ্যে সে হাসে বা কাঁদে। অন্যদিকে রানুর রয়েছে এক বিশেষ ক্ষমতা, সে অনেক ক্ষেত্রে কী ঘটবে আগে থেকে টের পায়, অন্য মানুষের অনেক কিছু বলে দিতে পারে। তার ভাষায়, স্বপ্নের মতো করে অনেক কিছু সে দেখতে পায়, এবং সেগুলো সত্যিও হয়। আনিস ও রানু যে বাড়িতে ভাড়া থাকে, সেই বাড়িওয়ালার মেয়ে নীলুকে সে একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গাড়িতে করে যেতে নিষেধ করে। নীলু রিকশা করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়, এবং সত্যি সত্যি সেদিন গাড়িটা ছিনতাই হয় এবং ড্রাইভার সব খুইয়ে অন্তর্বাসমাত্র পরে বাড়ি ফেরে। একদিকে ভূতগ্রস্ততা, অন্যদিকে অস্বাভাবিক ক্ষমতার অধিকারী হওয়া, রানুকে নিয়ে চিন্তিত আনিস যায় মিসির আলীর কাছে। মিসির আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের খণ্ডকালীন অধ্যাপক, তিনি মনস্তাত্ত্বিক অস্বাভাবিকতাকে যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করেন। সব রহস্যজনক ব্যাপারকে যুক্তির ডালপালায় সমাধান করেন তিনি। তার রহস্য উদঘাটনের এই প্রক্রিয়ায় তার সাথি হওয়া সব সময়ই আনন্দদায়ক এক অভিজ্ঞতা উপন্যাসের পাঠকের জন্য। মানুষের মনস্তত্ত্বের নানান গলি-উপগলি-বাঁক বেয়ে মিসির আলী আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসেন চেনা জগতে, আমাদের আশ্বস্ত করেন, আমাদের নিশ্চিন্ত করেন। নয়তো মানুষের আচরণগত অস্বাভাবিকতা, রহস্যময়তা, বীভৎসতার ব্যাখ্যা আমরা সাধারণত পাই না, আমরা বিভ্রমের মধ্যে কুহকের মধ্যে হারিয়ে গিয়ে অসহায় বোধ করি। দেবী চলচ্চিত্রে মিসির আলী অবশ্য মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পাশাপাশি নিজেই অনুসন্ধানে নেমেছেন, গোয়েন্দাগিরিও করেছেন।
তবে ‘দেবী’ চলচ্চিত্রে আমরা মিসির আলীকে খুব সফল হতে দেখি না। অনেক কিছু তিনি নিজে অনুসন্ধান করে বের করেন, ব্যাখ্যা দাঁড় করান, কিন্তু তিনি নিজেও স্বীকার করেন মানুষের ব্রেইনের অদ্ভুত কিছু ক্ষমতার কথা, জগতের অদ্ভুত কিছু ঘটনার কথা, যা ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। বলা যায়, অন্য উপন্যাসে মিসির আলীর তুলনায় ‘দেবী’র মিসির আলীর সফলতার মাত্রা কমই। বরং অতিপ্রাকৃত ঘটনাই জয়যুক্ত হয়, রানুর মনোবৈকল্য চরমে ওঠে, সে তার ভেতরে সেই অতিপ্রাকৃত শক্তি বা দেবীকে অধিষ্ঠান হতে দেয়। তার দেহ থেকে দেবী তার ক্ষমতা দিয়ে বিপদগ্রস্ত নীলুর দেহে সঞ্চারিত হন, দেবীগ্রস্ত নীলু সাবেতকে হত্যা করে ও নিজেকে রক্ষা করে। এভাবে পুরোনো মন্দিরের দেবী রানুকে কিশোরীবেলায় জালাল নামের ধর্ষকের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন। তখন থেকেই রানু দেবী-আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে মাঝেমধ্যে। এমনকি দেবীর মনোতুষ্টির জন্য ক্ষয়িষ্ণু জমিদারদের বলি দেওয়া দুই কন্যাশিশু ভূত আকারে রানুর আশপাশে ঘোরাঘুরি করে।
চলচ্চিত্রের একেবারে শুরুতে ১৭৫৭ সালের এক দৃশ্য দেখানো হয়, যেখানে এক নারীকে বলি দেওয়া হবে, কিন্তু বলি দেওয়ার মুহূর্তে মাথা কাটা পড়ে খোদ জল্লাদের। সেই নারী এরপর দেবীর মূর্তির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। এরপর ২০১৮ সালের কাহিনী শুরু হয়। অর্থাৎ ১৭৫৭ সালে যেই দেবী এক নারীকে রক্ষা করেছিল, সেই একই দেবী এই কাহিনীতে হাজির থাকবেন। বলা যায়, এ এমন এক দেবী যিনি বিপদগ্রস্ত নারীকে রক্ষা করেন। কিন্তু যেই নারীর শরীরে বা মনে তিনি অধিষ্ঠান নেন, সেই নারী আচরণে হয়ে পড়ে অস্বাভাবিক, অন্য সব নারী থেকে সে হয়ে পড়ে আলাদা। এই পুরো ব্যাপারটা কাহিনীতে পাঠক-দর্শকের জন্য ধারণা দেওয়া হলেও, মিসির আলী সবটা বুঝতে ব্যর্থ হন। তার যৌক্তিক বিশ্লেষণ পদ্ধতি হাল ছেড়ে দেয়, কিন্তু দর্শকরা আধিভৌতিক বাস্তবতাকেই কাহিনীর বাস্তবতা হিসেবে ধরে নিতে বাধ্য হন। ‘দেবী’ তাই মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলার চলচ্চিত্র না হয়ে পরিণত হয়েছে পুরোপুরি এক ভৌতিক চলচ্চিত্রে।
অন্য সব চলচ্চিত্রের তুলনায় ভৌতিক চলচ্চিত্রে শব্দের ব্যবহার বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রানুর কিছু দেখার চাইতে কিছু শোনার বিষয়টিই কাহিনীতে বারবার এসেছে। আবার ভয়ের আবহ তৈরিতে আবহ শব্দ বা ইফেক্ট সাউন্ডের ব্যবহার খুবই জরুরি। শব্দের ব্যবহার এই চলচ্চিত্রে মনোযোগ পেয়েছে। চিত্রগতভাবেও ভৌতিক পরিবেশ তৈরি করতে কন্যাশিশুদ্বয়ের অশরীরী উপস্থিতি চলচ্চিত্রে ভয়ের মাত্রা যোগ করতে অনেক কাজে দিয়েছে। এই দুই ভূত দেখে ‘দি শাইনিং’-এর দুই কন্যাশিশুর ভূতের কথা মনে পড়ে যায়। অস্বাভাবিক ক্ষমতার অধিকারী, কৈশোরের দুর্ঘটনা থেকে পলাতক-ভীত রানুর চরিত্রে গুণী জয়া আহসানের অভিনয় সুনাম রক্ষা করেছেন। এর আগে মিসির আলী চরিত্রে টেলিভিশনে আবুল হায়াত, শতাব্দী ওয়াদুদ, আশীষ খন্দকার প্রমুখকে দেখা গেছে। গুণী অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীও নিজেকে ভেঙে মিসির আলীর উপযোগী করে তুলেছেন, তা যদি হুমায়ূন-বর্ণিত মিসির আলীর সঙ্গে নাও মেলে, তবু অসুবিধা নেই। সংকোচপ্রিয় সাধারণ মেয়ে নীলুর চরিত্রে শবনম ফারিয়াও চমৎকার অভিনয় করেছেন। তুলনায় স্বামী আনিস চরিত্রে অনিমেষ আইচ কিংবা সাইকোপ্যাথ সাবেত চরিত্রে ইরেশ যাকেরের আরেকটু ভালো করার সুযোগ ছিল।
নীলুকে একবার মিসির আলীর ক্লাসে ছাত্রী হিসেবে দেখা গেছে। নীলু আর মিসির আলীর শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্ককে কাহিনীতে কোনো কাজে লাগানো হয়নি। দুই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের একটি সম্পর্কের কোনো ব্যবহারই দেখা গেল না চিত্রনাট্যে। এটি চিত্রনাট্যেও এক দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত হবে। অন্যথা তাদের সম্পর্কিত না দেখালেও কাহিনীতে কিছু যেত-আসত না। আরেকটি বিষয়, দেবীর যদি মূর্তি থেকে নারীর দেহে লীন হওয়ার ঘটনাই ঘটে (যেমন রানুর ক্ষেত্রে ঘটেছে), তাহলে প্রথমে যে ১৭৫৭ সালের বলিদানের ঘটনায় দেবীর ভূমিকা দেখা গেল, তাতে তো তাকে প্রস্তররূপেই থেকে যেতে দেখা গেল। এই গরমিলের রহস্য ভেদ হয়নি কাহিনীতে। নাকি ১৭৫৭ সাল থেকে বা বহু শতাব্দী ধরে বিভিন্ন দেবী এ রকম নারীদের রক্ষা করে আসছেন? দেবী চলচ্চিত্রটি অতিপ্রাকৃত কাহিনীর হলেও ভৌতিক চলচ্চিত্রের সাধারণ প্রবণতা অনুযায়ী বনে-জঙ্গলে কাহিনী গড়ায়নি, পুরোনো মন্দিরের একটি প্রেক্ষাপট রয়েছে মাত্র; বরং রানুর বাড়ি, মিসির আলীর ডেরা, রানুর কৈশোরকালের মধুপুর—সবই বাস্তবানুগভাবে তৈরি করা হয়েছে। সাইকোপ্যাথ সাবেতের চরিত্রটি অবিকশিত থেকে গেছে, প্রেমিক থেকে হন্তারকে হঠাৎ রূপান্তরের কোনো ব্যাখ্যা হাজির করা হয়নি, রানুর চরিত্রটির বর্তমান পরিণতির জন্য যেমন বিস্তৃত কার্যকারণ হাজির করা হয়েছে। সাবেত চরিত্রটি বেশ টিপিক্যাল, অনুমানযোগ্যও। এ রকম সাইকোপ্যাথ চরিত্র আমরা বহুবার বহু চলচ্চিত্রে দেখেছি। শেষে বলা যায়, ভৌতিক-অতিপ্রাকৃত চলচ্চিত্রের বৈশ্বিক যে দীর্ঘ ঐতিহ্য, তার সঙ্গে তুলনা করলে হয়তো ‘দেবী’কে একটু ম্রিয়মাণই লাগবে; কিন্তু বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গড় মানের বিচারে এটি ‘ভালো’ তকমাই পাবে। অপ্রচলিত জঁরার চলচ্চিত্র হিসেবেও এটি বিশেষ মনোযোগের দাবিদার।
আমার রেটিং ৬.৫।