ফিল্ম রিভিউ
‘জিরো ডিগ্রী’র পারদ উঠল কি?
এক্সপেক্ট, আনএক্সপেক্টেড। বাংলা থ্রিলার ছবি। সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার। এ রকম আরো অনেক ট্যাগলাইন। চমকে যাওয়ার মতো, সাথে আশা করার মতো। আমরা আশাবাদী ছিলাম দারুণ রকম। বদলে যাবে বাংলা ছবির খোলনলচে। সেই আশার প্রদীপে ছাই চাপা পড়ে এমন করুণ-দশা হবে; সেটা আসলেই আম বা বোদ্ধা দর্শক-কেউই বুঝি বিশেষ আশা করেনি। আমরা কি এহেন ‘অপ্রত্যাশিত’ কিছু ‘প্রত্যাশা’ করেছিলাম?
মুক্তির পর পরই কোনো ছবির আপাদমস্তক ময়নাতদন্ত করে বিশ্লেষণ ছাপিয়ে দেওয়া আমার কাছে একটু অমানবিক। এমনিতেই আমাদের দেশের সিনেমার অবস্থা বিশেষ সুবিধের নয়, তার উপরে নেতিবাচক রিভিউয়ের জন্য ছবিটার যদি ব্যবসা মার খেয়ে যায়, কিংবা কাহিনী পড়ে অনেকে আর হল পর্যন্ত না এগোন! ইন্টারনেট বা ফেসবুকের এই যুগে লোকে এখন পারলে এক বোতল মিনারেল ওয়াটার কিনে খাবার আগেও খানাপিনা সংক্রান্ত কোনো গ্রুপে রিভিউ-রেটিং পড়ে তারপর চিন্তা করে কোন পানির বোতলটা কেনা ঠিক হবে। সেখানে সিনেমার ক্ষেত্রে যাচাইয়ের মাপকাঠি আরো ব্যাপক। সে জন্যই ৬ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পাওয়ার পর একটু সময় নেওয়া। কিংবা বলা যেতে পারে ছবিটাকে একটু সময় দেওয়া। এত আর টরেন্ট ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করা ফ্রি ছবি না যে পছন্দ হলো না আর চট করে হার্ডড্রাইভ থেকে শিফট-ডিলিট চেপে হাপিশ করে দেওয়া যায়! মুক্তির পর এখন প্রায় সপ্তাহ তিনেক সময় পেরিয়েছে, এখন তাই দুটো ভালো-মন্দ বলা নিষ্ঠুর আচরণে গণ্য হবে না বোধ করি!
মুক্তির পরপর ‘জিরো ডিগ্রী’ নিয়ে বহুবিধ আলোচনা হয়েছে। প্রথাবিরোধী নতুন ঘরানার ছবি থেকে সমাজের কোনো একটি অংশকে নষ্ট করে ফেলার মতো বিশাল ক্ষমতাধর (!) ছবি হিসেবে আখ্যা, সবই জুটেছে এই ছবির কপালে। দূর্ভাগ্যজনকভাবে, এই বিশ্লেষণাদিকে এক পাশে রেখে দিয়ে শুধু ছবিটিকে নিয়ে যদি আলাপ হয়- তাহলে বলতে হবে ছবিটির কপাল বড়ই মন্দ। বেচারা ছবিটাকে না ন্যূনতম যত্ন বা ধারাবাহিকতা রেখে বানিয়েছেন নির্মাতা-কারিগররা, না সংলাপ আর চিত্রনাট্যটি সামান্যতম বিশ্বাসযোগ্য বা কাজ চালাবার মতো গুরুত্ব দিয়ে হয়েছে লেখা, না মোটা দাগে শিল্পীরা এক চিলতে গুরুত্ব দিয়ে চরিত্রটার মধ্যে থেকে বা বিষয়টা সম্বন্ধে এতটুকু জেনে অভিনয় করেছেন। এর ফলাফল আর কিছু নয়, থ্রিলার ছবি দেখতে গিয়ে হলভর্তি দর্শকের অনেকেই পেট চেপে হাসতে হাসতে বেরিয়েছেন। থ্রিলার ছবি, সাহসী ছবি দেখতে গিয়ে এমন হাসির উপকরণ গিলতে হবে; তা হয়তো অনেকেই বিশেষ প্রত্যাশা করেননি।
সে যাক, মন্দ কথা না বলে বরং ছবিটার ভালো বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা ভালো এবং নিরাপদ। কারণ সেটা দ্রুত লিখে শেষ করা যাবে! ছবির পুরো কাহিনী যে ছকের ওপর তৈরি হয়েছিল সেটি খুবই ভালো। একটি ননলিনিয়ার স্টোরিটেলিংয়ের প্রচেষ্টায় প্রোটাগনিস্ট অমিত (মাহফুজ) এবং সোনিয়ার (জয়া আহসান) নিজ নিজ জীবনে প্রতারিত হওয়া এবং সেখান থেকে ঘুরে তাদের শোধ নেওয়ার প্রয়াস। রিভেঞ্জ থ্রিলারের আঙ্গিকে চিন্তা করলে, জমজমাট প্লট। সাথে ছবিটি আসলে কোথা থেকে শুরু হয়েছে বা ছবির বর্তমান ও অতীত ঠিক সরল রেখায় আছে কি নেই তাও বোঝা যায় না চট করে। যেমন গদার বলে দিয়েছেন যে সিনেমার শুরু এবং শেষ থাকা জরুরি তবে সেটা একটা গৎবাঁধা পদ্ধতিতেই হবে তেমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সে পারিপ্রেক্ষিত থেকে বাংলা ছবির চিরাচরিত লিনিয়ার স্টোরিটেলিংয়ের ধারা থেকে বের হওয়ার জন্য ‘জিরো ডিগ্রী’র প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাতে হয়।
ছবিতে সংক্ষিপ্ত কিন্তু চমৎকার উপস্থিতি ছিল টেলি সামাদের। ওই অল্প সময়ের মধ্যেই অসামান্য অভিনয় দিয়ে তিনি চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে কোন রেড ওয়াইনটি বনেদি আর কোনটি সস্তা! নাচের শিক্ষকের ভূমিকায় তার সহজাত শারীরিক ভঙ্গিমা কিংবা লোলুপ পুরুষের ক্রুর দৃষ্টি- সবটাই একদম কড়া! সারাজীবন কমিক রোলে অভিনয় করলেও খলচরিত্রে ভয়ংকর হয়ে ওঠার কায়দাটা তিনি ভালোই দেখিয়েছেন। তাঁর এই সামান্য ক্ষণের উপস্থিতিকে মানের বিচারে তুলনা করা যায় ডেভিড ফিঞ্চারের সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ছবি ‘সেভেন-এর শেষমুহূর্তে কেভিন স্পেসির আবির্ভাবের সাথে। ‘জিরো ডিগ্রী’র প্লটের সাথে যথাযথ সুবিচার নিঃসন্দেহে টেলি সামাদই ঠিকঠাক করেছেন বা করতে পেরেছেন।
প্রশংসা পাওয়ার মতো অভিনয় করেছেন রুহি। পারিবারিকভাবে বিবাহিত একটি উচ্ছল যৌবনের পূজারি এবং গ্ল্যামারাস মেয়ে কিভাবে সন্তান কিংবা সংসারী ঘরানার কোনো টিপিক্যাল পুরুষের সঙ্গতে বিরক্ত হয়ে ওঠে- তার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ রুহির চরিত্র আর অভিনয়ের সাথে সাথে টের পাওয়া গেছে। তার আচরণ এবং চরিত্রে অনবরত উত্থান-পতন ঘটে ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত; যা একেবারেই বাস্তব সম্মতভাবে দেখানো হয়েছে- বা রুহি দেখাতেও পেরেছেন।
একইভাবে, সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ট্যাগলাইনের প্রতি সামান্য সুবিচার করতে সক্ষম হয়েছে ছবির যবনিকা পতনের সময়টি। অমিত, নীরা আর সোনিয়ার একত্রিত হওয়ার অসামান্য (!) পদ্ধতিটুকু বাদ দেই বরং। তিন খুনির এক হয়ে টেবিলে বসে পোলাও খাওয়া (একে দ্য লাস্ট সাপারের একটি ডার্ক রিপ্রেজেন্টেশনও বলতে পারেন!), ছবিতে জয়া ও মাহফুজের প্রথম এবং শেষবারের মতো তাক লাগানো অভিনয় এবং প্রত্যেকের উন্মাদের মতো হাসি এবং এখানে নতুন কায়দায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের সংযোজন- পিওর সাইকোলজিক্যাল থ্রিলারের স্বাদ দিতে সক্ষম হয়। দুর্ভাগ্যবশত একেবারে শেষমুহূর্তে এবং ওই একটিবারের জন্যই! কেন্দ্রীয় চরিত্র কিংবা চরিত্রদের প্রত্যেকের অভিনবভাবে মৃত্যুর বিষয়টিও ছিল বেশ অভিনব- বিশেষ করে বাংলা ছবির প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে বলা যায় যে, ভায়োলেন্সের এমন চমৎকার দৃশ্যায়ন এ দেশের খুব কম ছবিতেই হয়েছে।
এ ছবির গানগুলো যে পরিমাণে যত্ন, পরিশ্রম, নতুনত্ব নিয়ে বানানো হয়েছে; তার ছিঁটেফোঁটাও যদি ছবির মূল অংশে জুটত; তাহলে ‘জিরো ডিগ্রী’র গল্পটা অন্যরকম হতে পারত। গানগুলোর নির্মাণ, কথা, সুর- সবই এক কথায় চমৎকার। জেমসের গাওয়া ‘আলোটাই দেখেছ দেখোনি অন্ধকার’ গানটি শুনে আর দেখে সবচেয়ে বেশি হয়েছে এ আফসোস। আহা, মূল ছবিটা যদি একটু ‘এ রকম’ যত্ন নিয়ে বানাত!
‘জিরো ডিগ্রী’ নিয়ে গুনে গুনে প্রশংসা করলে এটুকুই। বাকি পুরোটাই ফলাফলে ‘জিরো’। ছবির বাকি সব সংলাপ, চরিত্র, ঘটনা, ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ফলাফল, ক্লাইম্যাক্স, অ্যাকশন- সব কিছুর চিত্রায়ন এবং তার মাঝে সংযোগ এতটা দুর্বল ও অপেশাদারীভাবে করা যে- তার বর্ণনা দিয়ে শেষ করা অসম্ভব। চলচ্চিত্রের পরিভাষায় কিছু শব্দ আর টার্ম ব্যবহার করা হয় (মিজ অঁ সেন, ডাইজেটিক সাউন্ড, টেম্পোরাল ডিজলোকেশন, মন্তাজ, সেলফ রিফ্লেক্সিভ ইত্যাদি ইত্যাদি হাবিজাবি) এবং ইচ্ছাকৃতভাবেই সেগুলোর সাপেক্ষে এই ছবির কোনো বিচার বিশ্লেষণ করব না। কারণ এই শব্দ বা টার্মগুলো বোদ্ধাদের অধিকারেই কেবল; আমাদের মতো সাধারণ দর্শকদের কাছে এর সবই আসলে দুর্বোধ্য। যার জন্য সোজাসাপ্টা ব্যাখ্যাই নিরাপদ বরং।
কিছু কিছু সিকোয়েন্স বা ক্লাইম্যাক্স জমে উঠতে নিয়েও দিনশেষে মুখ থুবড়ে পড়েছে। উদাহরণ দিয়ে বলতে গেলে, নার্সিং হোমের প্রথম আভাস যখন দর্শক পান সেটা জমে উঠতে পারত; কিন্তু সমীকরণে মিল বজায় রাখতে গিয়ে গল্পে অমিত এবং সোনিয়া দুজনকেই দিব্যি সেখান থেকে ছেড়ে দেওয়া হলো, তাও একই সময়ে। সেখান থেকে বের হতে না হতেই তারা একদম ফ্রেশ চেহারা আর গেটআপের মাহফুজ আহমেদ এবং জয়া আহসান! ঠিক যেমনভাবে আত্মহত্যা করতে গিয়ে সোনিয়ার ‘অতন্দ্রিলা’ খ্যাত কবি ওয়াহেদের সাথে গিয়ে সাক্ষাৎ, প্রেম এবং সামগ্রিক ফলাফলের মাঝে আসলে যোগসাজশ মেলা ভার; ততটাই উদ্ভট এবং গাঁজাখুরিভাবে অমিত ও সোনিয়ার প্রতিশোধের গল্প শুরু; সেই নার্সিং হোম বা পাগলা গারদ থেকে ছাড় পাওয়া থেকে। কিভাবে তারা একই নার্সিং হোমে এল, নাকি সেটা পাগলা গারদই ছিল, অথবা তাদের কে সেখানে নিয়ে এসেছিল- ছাড়ালোই বা কে; এসব প্রশ্নের কথা নাই বা তোলা হোক। হয় তো বাঙালির যতসব সন্দেহবাতিক মন!
কিন্তু একটা প্রশ্ন না রেখে তো পারা যায় না। ‘জিরো ডিগ্রী’ একটি বাণিজ্যিক ছবি এবং নির্মাতাদের বক্তব্য অনুসারে এটি কেবল থ্রিলারই নয়- সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ছবি। সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার ছবিতে প্রোটাগনিস্ট যদি এই ফেসবুকের দিনদুনিয়ায় বউ ফেসবুকে কার সঙ্গে কী করছে তার বিন্দুটি টের না পায়, গোয়েন্দা পুলিশ কালো মোটরসাইকেল ট্র্যাক করে ফেলে (এখানে অবশ্য ভিন্ন কাহিনী!) কিন্তু একটা চালু মোবাইল নাম্বারকে ট্র্যাক করার পরিশ্রমও করে না, রুহি পালিয়ে চলে যাওয়ার ঠিক মাঝপথে ফুটপাথ থেকে নেমে কিভাবে যেন ট্যাক্সি আটকে ফেলে তার প্রেমিক/স্বামী, তাকে হত্যা করে রুহি দেশে ফিরলে সে কথা ইন্টারপোল বাঙালি পুলিশকে জানিয়ে দেয় কিন্তু পুলিশ তাকে ধরতেই পারে না (!), ফেসবুকে স্ত্রীর নামের সঙ্গে মিল আছে এমন আরেকজনকে মেসেজ পাঠাতেই মানে মানে কাজ হয়ে যায় একজন উঠতি প্যারানয়েড ব্যক্তি অমিতের কিংবা ‘অতন্দ্রিলা’ কবি ওয়াহেদ ঠিক সোনিয়ার রুমমেটের সঙ্গেই প্রেম করে কবিতা শুনিয়ে ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি! এই নগণ্য দর্শকের মতো অনেকেই তখন আর না পেরে বলে ওঠেন- ভাই থামেন! গাঁজাখুরিরও তো একটা সীমা আছে, নাকি!
একইসাথে ‘বাণিজ্যিক ছবি বনাম এলিট মহলের ছবি’- সংক্রান্ত একটি অতিচর্বিত তর্ক এখানে আসতে পারে। এটা বাণিজ্যিক ছবি তাই এখানে অনেক কিছু ঐসব ‘আর্ট’ ফিল্মের মতো হবে না, এখানে অনেক কিছুই একটু ‘অন্যরকম’ হবে ইত্যাদি ইত্যাদি! এটা নিয়ে একটাই কথা বলার আছে- গোঁজামিল, জোড়াতালি এবং অপেশাদারী নির্মাণশৈলী মানেই বাণিজ্যিক ছবির নামান্তর- এ কথা কোন কেতাবে লেখা আছে? সিনেমা কোনো ছেলেখেলা নয়, যথেষ্টই সিরিয়াস- হোক না তা বাণিজ্যিক ছবি, অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের ছবি, থ্রিলার ছবি, কমেডি ছবি কি বায়োগ্রাফি।
প্রোডাক্ট প্লেসমেন্ট, ইন ব্র্যান্ডিং, ক্যারেক্টার ব্র্যান্ডিং- এই ধরনের কিছু টার্ম বোধ করি এখন অনেকের কাছেই অজানা নয়। সবদেশের ছবিতেই এটা ঘটে আজকাল, নেহাত ওজনে আর প্রয়োগে কমবেশি ফারাক থাকে। ‘জিরো ডিগ্রী’র এ বিষয়টিকেও আসলে প্রশংসার তালিকায় সংযোজিত করব কী না বুঝতে পারছিলাম না। নীরার বিমানবন্দর যাওয়ার সময়টিতে আসলে ঠিক বুঝলাম না, আসলে নীরার বিদায় দেখানো গুরুত্বপূর্ণ নাকি নির্দিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানের সিল মারা লাগেজ ক্যারিয়ার দেখানো গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো গুরুত্বপূর্ণ দুটোই, তবে লাগেজ ক্যারিয়ারের লম্বা শটে বোঝা গেছে- পয়সা যেদিকে গড়ায়, শিল্পও সেদিকে তাকিয়ে বাহবা দেয় বটে! যার কারণে চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্সে যে সোলেমানি তরবারির ম্যাজিক তরিকায় অমিত (মাহফুজ আহমেদ) ও সোনিয়ার (জয়া আহসান) ‘দেখা’ হলো (মনে পড়ছে এই দুর্দান্ত ক্লাইম্যাক্সে হলভর্তি দর্শকে গলা ফাটিয়ে হাসির আওয়াজ); তখনো চালক দেখবে না ‘বাহন’ দেখবে তার হদিশ পাননি দর্শক। বাইক ধাওয়া করার ‘দুর্দান্ত’ সিকোয়েন্সটি তো রীতিমতো চলচ্চিত্র গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত! সবশেষে অমিত সোনিয়াকে উদ্ধার করার জন্য একটি মোটরসাইকেলের গুরুত্ব, একজন মোটরবাইক চালকের আত্মকাহিনীসহ বাইক চালানোর পদ্ধতি- বিষয়াশয়ের বিশেষ বিবরণ দেন- তাতে ইন-ব্র্যান্ডিংয়ের চাহিদায় মুখিয়ে থাকা প্রতিষ্ঠান বেজায় খুশি হতেই পারেন! ছবির দ্বিতীয়ার্ধ থেকে অনেকটা সময় পর্যন্ত অমিতকে প্রতিশোধ স্পৃহায় ক্ষিপ্ত কোনো পুরুষ নয়; বরং একটি যানবাহন-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মাঝারি গোছের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরই মনে হয়েছে বেশি! সবশেষে মনে হয়েছে, অমিত ও সোনিয়ার সাক্ষাতের পেছনে মুখ্য কারণ আসলে সিনেমার নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের মোটরবাইকের আত্মকাহিনী বর্ণনা করা।
এমন সম্ভাবনাময় একটি ছবির দশা কেন এতটা করুণ হলো, তা নিয়ে আসলে সঠিকটা নির্মাতারাই ভালো বলতে পারবেন। বাইরের দেশে একটা ছবির চরিত্রের জন্য নিজেদের আগাগোড়া বদলে ফেলেন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। বসবাস করেন ছবিটির সাথে। মার্লোন ব্র্যান্ডো গডফাদার ছবির জন্য নিজের দুটো দাঁত উপড়ে ফেলেছিলেন। এটা অনেক বড় উদাহরণ। ক্রিশ্চিয়ান বেল, হিথ লেজার, ব্র্যাড পিটদের মতো অজস্র হলিউডি তারকা দেখিয়েছন চরিত্রের জন্য নিজেকে বদলে ফেলার ফর্মুলা। যাহোক; অত দূরের কথা বাদ দিয়ে পাশের দেশ ভারতের দিকে দেখলেও হয়। এখানকার অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও কিন্তু নিজেদের কম বদলে ফেলেন না। সেটা কেবল ছবির প্রতি তাদের ডেডিকেশন নির্দেশ করে না, সাথে ছবির প্রতি তাদের সম্মান আর সিরিয়াসনেসটাও বুঝিয়ে দেয়। একইসঙ্গে সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার আর বারো জাতের তের প্রোজেক্টে একসাথে কাজ করলে ফলাফল আর কিছু না- একটি অপার সম্ভাবনাময় ‘জিরো ডিগ্রী’র কপালে দিনশেষে জিরোই জোটে! ‘জিরো ডিগ্রী’র এই ডেডিকেশন আর সম্মানটুকু এর কুশীলব কিংবা নির্মাতার কাছ থেকে প্রাপ্য ছিল। দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ছবিটি যখন রিভেঞ্জ থ্রিলারে মোড় নিতে ধরে, তখন কিন্তু মাহফুজ বা জয়া- কাউকেই মনে হয়নি তারা এই চরিত্রের জন্য মোটামুটি কিছুটা সময় নিয়েও একাগ্রভাবে বসবাস করেছেন। তাঁদের দেখে না মনে হয়েছে তারা আসলে এই চরিত্রের উপযোগী আর না ঠিক থেকেছে ছবির সামান্যতম ধারাবাহিকতা। বাংলা ছবির চিরাচরিত দর্শন আর কাঠামো আগাগোড়া বদলে দেওয়ার সক্ষমতা ‘জিরো ডিগ্রী’র যতটা ছিল, এতটা সম্ভাবনা নিয়ে আরেকটি ছবি কবে আসতে পারবে তা বলা ভার! ক্ষোভ আর হতাশাটা সেখানেই বড্ড বেশি বাজে।
দিনশেষে একটা কথা বলা দরকার। থ্রিলার ছবির কাহিনী বলতে পয়সা লাগে না, ভালো একটা কাহিনী লাগে। থ্রিলার ছবিতে ঘটনাগুলোর মধ্যে সম্পর্ক আর যোগবিয়োগের হিসাবটুকু ঠিক রাখা খুবই খুবই খুবই দরকার- নতুবা তা থ্রিলার থেকে একটা দুর্বল মানের কমেডি ছবিতে পরিণত হয়। ‘জিরো ডিগ্রী’র পরিণতি মেনে নেওয়াটা খুব কষ্টকর, কারণ ‘মহান’ হয়ে ওঠার সাধ্য ছিল ছবিটির-কেবল অযত্ন আর অবহেলার কারণে যা দিনশেষে ‘জিরো’তেই পরিণত হয়েছে। অনিমেষ আইচ ছোটপর্দায় বহুদিন ভালো কাজ করেছেন, বিশেষ কিছু জটিলতায় আটকে গেছে তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবিটি (না–মানুষ)। সুতরাং তিনি আসলে ফিল্ম ডিরেক্টর হিসেবে ভালোভাবে কাজ করেননি নাকি এটুকুই তার সাধ্য- সেটা প্রশ্ন হিসেবেই থাকুক। চিত্রনির্মাতা হিসেবে তিনি অতীতে যেহেতু পরীক্ষিত ছিলেন না, সুতরাং তাকে আর যাই হোক অবহেলার দায় দেওয়া যায় না। তিনি যে পদ্ধতিতে বা ভঙ্গিমায় ছবিটি নির্মাণ করেছেন, তাকে একটা শব্দ দিয়েই যথাযথ বিচার করা যায়- গোঁজামিল। কেন হবে এটা? তিনি জটিল কোনো কাজ করতে গিয়ে হিসেব মেলাতে পারেন না, এ কথা তো বলার কোনো সুযোগই নেই! আমি বিশ্বাস করতে চাই যে চিত্রনাট্যের বিষয়টিই এখানে মুখ্য, যার দুর্বলতা পরিচালক অনেক চেষ্টা করেও ঢাকতে পারেননি। শহিদুল জহিরের ‘কাঁটা’র মতো প্রচণ্ড রকমের জটিল এক গল্পকে অনিমেষ যেভাবে পর্দায় ফোটাতে পেরেছিলেন (এখানে বড় পর্দা না ছোট পর্দা, তা প্রশ্ন হিসেবে বিবেচ্য নয়), সেটা দেখলে তার ক্ষমতার প্রতি সন্দেহ থাকে না, কেবল ভক্তি আসে। সেই ভক্তি থেকেই বলা- থ্রিলার ছবিতে আর যাই হোক, গোঁজামিলের তো কোনো ধরনের ঠাঁই নাই। সুতরাং ভবিষ্যতে যদি তিনি আরো ছবি বানানোর কাজ করতে চান, বিশেষ করে থ্রিলার ছবি তিনি যদি আবারও নির্মাণ করেন- তাহলে অবশ্যই এই সমীকরণে সমতাকরণ বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে তাঁর, বোঝাপড়া করে নিতে হবে চিত্রনাট্যের সাথে। নতুবা শূন্যমানের নির্মাণকাহিনী চওড়াই হবে কেবল, বাড়বে কিছু আনএক্সপেক্টেড বিরক্তি!