ফিল্ম রিভিউ
মহুয়া সুন্দরী, কামের দেবী হয়েই রইলে
রাজশাহীর উপহার সিনেমা হল। সিনেমা শুরু হওয়ার ১০ মিনিট আগে ঢুকলাম। দেখি, হাতে গোনা কয়েকটা দর্শক। এমন সময় এক নারী তাঁর দুই সন্তানকে নিয়ে ঢুকলেন। পরে দেখি আরো কয়েকজন নারী সিনেমা দেখতে এসেছেন। সিনেমা হলে নারীদের এই উপস্থিতি দেখে বেশ ভালো লাগছিল। মনে হচ্ছিল, পরিবার নিয়ে হলে গিয়ে সিনেমা দেখা যায় না-এই অভিযোগ যারা করে তাদের মুখ বুঝি বন্ধ হতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে কিছু দর্শক হয়ে গেছে।
ছবির শুরুর আগে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা পতপত উড়তে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম। যখন বসি দেখি, আমার সঙ্গে আর মাত্র একজন বসছে। হলজুড়ে আমরা দুজন বাদে আর কেউ দাঁড়াল না। এতে বেশ হতাশই হলাম।
এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে রওশন আরা নীপা পরিচালিত মহুয়া সুন্দরী। চলচ্চিত্রটির কাহিনী একটি যাত্রাদলকে ঘিরে। এই যাত্রাদলের প্রধান আকর্ষণ দলের সেরা অভিনেত্রী ছবি (পরী মণি)। মহুয়া সুন্দরী যাত্রাপালায় মহুয়া চরিত্রে ছবির অভিনয় দেখে মুগ্ধ হন মিয়ার বেটার বিদেশ ফেরত ছেলে (সুমিত)। পরে টাকার লোভে ছবি মিয়ার বেটার ছেলেকে সঙ্গ দিতে যায়। একপর্যায়ে তারা একে অপরকে ভালোবেসে ফেলে। কিন্তু যাত্রাপালার সামান্য অভিনেত্রীর সঙ্গে তো বিত্তশালী মিয়ার বেটার ছেলের মিলন হতে পারে না। তাই নানা ঘটনার চড়াই-উৎরাইয়ের পর ছবিকে চিরদিনের জন্য ফ্রেমে বাঁধা ছবি হয়ে যেতে হয়।
সিনেমার শুরুতেই দেখা যায়, যাত্রাদলের সবাই নৌকা থেকে নামছে। সবার শেষে নামে পরী। নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যায়। ধরে তারই এক দেহের খদ্দের। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই পরীর বুক-পিঠ-নাভি প্রদর্শন করে একটি গান দেখা যায়। শুরুতেই পরীর এ রকম কামুক উপস্থাপন দেখে বেশ থতমত খেয়ে যাই। ভাবতে থাকি, যে মা তার সন্তানদের নিয়ে সিনেমা দেখতে এসেছেন তিনি কীভাবে বসে আছেন?
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নারী চলচ্চিত্রনির্মাতা রওশন আরা নীপার আগমন দেখে বেশ আশান্বিত হয়েছিলাম। অন্তত আর যাই হোক, তিনি তো নারীদের সম্মানটুকু দিতে পারবেন। কিন্তু না নির্মাতা নীপা সেই আশার পাতে বালি ঢেলে দিলেন। অন্য আট-দশটা নির্মাতার মতো তিনিও নারীকে ভোগ্য পণ্য হিসেবেই চলচ্চিত্রে উপস্থাপন করলেন। তাই যে পরিবার, নারী দর্শকগুলো এই নির্মাতার ওপর ভরসা করে হলে ফিরে ছিলেন, সেই ভরসার জায়গাটুকু হয়তো আর থাকল না।
মহুয়া সুন্দরীতে নির্মাতা রওশন আরা নীপার পশ্চিমাপ্রীতি দেখে বেশ অবাকই হতে হলো। চলচ্চিত্রে নায়ককে এ রকম বুলি বারবার আওড়াতে দেখা যায় যে, ‘দেশের বাইরে পড়াশোনা করে শিখেছি, মানুষের কোনো জাতপাত হয় না/ ছবিকেই বিয়ে করব, বিয়ে করে দেশের বাইরে নিয়ে যাবো।’ এ রকম আরো অনেক কথাই নায়কের মুখ দিয়ে বলিয়ে নেন নির্মাতা নীপা। তাই নির্মাতার জ্ঞাতার্থে বলতে হয়, মানুষের কোনো জাতপাত হয় না, একথা শত বছর আগেই বলে গেছেন লালন সাঁই। শুধু লালন নয়, এমন আরো অনেককেই পাওয়া যাবে যারা এ কথা বলেছেন ও এখনো বলছেন। এর জন্য পশ্চিমে যেতে হয় না।
আর পরীকে বিয়ে করে নায়ক সুমিত ফ্রান্সে নিয়ে যেতে চান। সেখানে নাকি যাত্রাশিল্পীর বেশ কদর। নির্মাতাকে তাই বলতেই হয়, তিনি কয়জনকে বিদেশে নিয়ে যাবেন? পরীর মতো এ দেশে শত শত যাত্রাশিল্পী আছে। যাদের সব সময়ই মানবেতর জীবনযাপন করতে হয়। অথচ এ দেশেই একসময় যাত্রাশিল্পীদের গৌরব ছিল, সম্মান ছিল। এদিকে পাশ্চাত্য-শেতাঙ্গ শাসকরা ‘সভ্য’ জাতি হিসেবে শত বছর ‘অসভ্য’ ভারতবাসীদের শাসন-শোষণ করেছে। এখনো করে যাচ্ছে, তবে একটু ভিন্ন রূপে। সেই যে পশ্চিমারা সভ্য-অসভ্যের কাঠামো তৈরি করেছিল তার মধ্যেই পড়ে রইলেন নির্মাতা। তাই তো এসব কিছু ভুলে গিয়ে তিনি পশ্চিমাদের প্রেমে বুদ হয়ে রইলেন!
চলচ্চিত্র একটি শিল্পমাধ্যম। অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের মতো এরও একটা নিজস্ব ভাষা আছে। আর সেই ভাষাকে পূর্ণতা দিতে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে লাইটিং। অথচ নির্মাতা রওশন আরা নীপার এই লাইটিংয়ের ব্যাপারটা যেনো খেয়ালই করেননি! উদাহরণ হিসেবে বলা যায় নায়ক-নায়িকার চুমুর দৃশ্যে সূর্যকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, মারামারির দৃশ্যে- কখনো রাত, কখনো দিন। আবার যাত্রাদলের নৌকা দিয়ে চলে যাওয়ার সময় ভোরের আলোর কমাবাড়া বিরক্তি তৈরি করে। এ রকম অনেক জায়গাতেই আলোর অসঙ্গতি মহুয়া সুন্দরীকে ম্লান করে দেয়।
চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে আরেকটি ব্যাপার গুরুত্বপূর্ণ হলো লোকেশন বা স্থান। মহুয়া সুন্দরী একটি গ্রাম-বাংলার সিনেমা। এই গ্রাম-বাংলার দৃশ্যায়ন করতে গিয়ে তিনি নায়কদের এমন এক বাড়ি দেখালেন, বাংলাদেশের সবগুলো গ্রাম ঘুরলে কোথাও বাড়ি চোখে পড়ার কথা নয়। ফলে চলচ্চিত্র যে ঘোর তৈরি করে, এ রকম স্থান নির্বাচনে মহুয়া সুন্দরী তা করতে ব্যর্থ হয়।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চলচ্চিত্র থেকে ভারতবর্ষের চলচ্চিত্রের আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য আছে। সেটা হলো গান, যা অন্যান্য দেশের চলচ্চিত্রে খুব একটা দেখা যায় না। তবে চলচ্চিত্রে গানগুলোও আসে একটু বিশেষ পরিস্থিতিতে, যা ওই পরিস্থিতির প্রতিনিধিত্ব করে। একই সঙ্গে গানেরও বিশেষত্ব থাকে। কিন্তু মহুয়া সুন্দরীর নির্মাতা অনেক সময় সেই পরিস্থিতি ও গানের মর্ম না বুঝে হঠাৎ করেই জুড়ে দেন, ‘আমারে কী রাখবেন গুরু চরণও দাসী।’ লালন সাঁইয়ের এই গানটিকে যেন নির্মাতা একটি ব্র্যান্ড হিসেবেই ব্যবহার করেন।
নির্মাতা রওশন আরা নীপা বাংলাদেশের যাত্রাদলের যে সংকট, বিলুপ্তির কারণ তা হয়তো অনেকটাই ধরতে পেরেছেন মহুয়া সুন্দরীতে। কিন্তু বাংলার গ্রাম-বাংলায় যে যাত্রাপালা দেখানো হয়, তা তিনি বর্তমান চলচ্চিত্রের সুপার হিট অভিনেতাদের দিয়ে ধরতে পারেননি। বরং মহুয়া সুন্দরী যাত্রাপালার দৃশ্যায়ন যে ডকুমেন্টেশন করে রাখল তা গ্রাম-বাংলার যাত্রাপালার জন্য ক্ষতিকরই বটে।
গত ৫০ বছরে বাংলা চলচ্চিত্রের যে কাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে, তার বাইরেও যেতে পারেনি মহুয়া সুন্দরী। অর্থাৎ এই চলচ্চিত্রেও দেখা যায়, বড়লোক আর গরিবের দ্বন্দ্ব। তবে নির্মাতা শেষ দৃশ্যে এসে একটু দর্শকদের ভিন্নতার স্বাদ দিতে পেরেছেন। তা হলো, বাংলা চলচ্চিত্রের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বাস্তবতার বাইরে গিয়ে সুখের মিলন। এ ক্ষেত্রে তিনি নায়িকার মৃত্যু দেখিয়ে একটু বাস্তবতার কাছাকাছি যেতে পেরেছেন বা ভিন্নতা আনতে পেরেছেন।
মূলধারার নির্মাতাদের মধ্যে একটা ধারণা প্রায় বদ্ধমূল হয়ে আছে যে, চলচ্চিত্রের সহিংসতা-যৌনতাই বোধহয় দর্শকদের হলে টানতে পারে। তাই তাঁরা প্রায় বেশির ভাগ চলচ্চিত্রেই সহিংসতা-যৌনতাকে জোর করে টেনে আনেন। মহুয়া সুন্দরীতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে দেখা যায়। যেখানে কারণে-অকারণে নায়িকার বুক-পিঠ-নাভি দেখানো হয়। তাই বলতে হয়, সুন্দর সিনেমা যদি বানানো যায়, তাহলে যে মা তাঁর সন্তানদের নিয়ে সিনেমা দেখতে এসেছেন তাঁরা আবারও আসবেন।