ফিল্ম রিভিউ
কিছুটা হলেও আশা জাগিয়েছে ‘গ্যাংস্টার রিটার্নস’
‘আমরা বর্তমান সময়কে মাথায় রেখে ছবি নির্মাণ করছি।’ কথাটি বলেছেন ‘গ্যাংস্টার রিটার্নস’ সিনেমার পরিচালক আশিকুর রহমান। “অবশেষে মুক্তি পাচ্ছে ‘গ্যাংস্টার রিটার্নস’” শিরোনামে এনটিভি অনলাইনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আশিকুর রহমান ঠিক কী কারণে এ কথা বলেছিলেন, তা জানি না। তবে এ কথা সত্য, চলচ্চিত্র একটা সময়কে রিপ্রেজেন্ট করে। ‘গ্যাংস্টার রিটার্নস’ নামই সেই সময়কে ধরার ক্ষেত্রে অনেকটাই সফল। কারণ দেশের বর্তমান যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থাৎ একের পর এক ব্লগার-লেখক-প্রকাশক, বিদেশি, ধর্মীয় উপাসনালয়ে হত্যা করে চলে যাচ্ছে, কেউ তাদের চিহ্নিত পর্যন্ত করতে পারছে না, সেই বিচারে ‘গ্যাংস্টার রিটার্নস’ নামটি বর্তমান সময়ের সঙ্গে যায়। শুধু চলচ্চিত্রের নাম নয়, সমাজে এমন অনেক কিছুই থাকে যা কোনো না কোনোভাবে সময়কে ধরে রাখে। তাই বলা যায়, কেউ যদি আজ থেকে ৫০ বছর পর বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বুঝতে চায় সে ক্ষেত্রে ‘গ্যাংস্টার রিটার্নস’ নামটি সহায়ক হতে পারে।
‘গ্যাংস্টার রিটার্নস’ মধ্যবিত্ত পরিবারের এক বেকার যুবকের কাহিনী। ওই যুবক শাওন (অপূর্ব) চাকরির সন্ধান না পেয়ে একপর্যায়ে সন্ত্রাসী চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। কিন্তু সন্ত্রাসের ওই দুর্বিষহ জীবন তার ভালো লাগে না। তাই সে সন্ত্রাস ছেড়ে দিতে চাইলে হারাতে হয় মা-বোন-প্রেমিকাকে। স্বজন হারানোর প্রতিশোধ নিতে আবার সে ফিরে আসে সন্ত্রাসের জগতে। প্রতিশোধ নিতে গিয়ে আবার তার প্রেম হয়। প্রতিশোধ শেষে সুস্থ জীবনে ফিরে আসে শাওন।
বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে ‘গ্যাংস্টার রিটার্নস’ নিয়ে কিছুটা হলেও আশার জায়গা আছে। কারণ গতানুগতিক হলেও নির্মাতা আশিকুর রহমান একটা গল্প বেশ ভালোভাবেই তুলে আনতে পেরেছেন চলচ্চিত্রটিতে। কথাটি এ কারণে বলা, বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের অনেক সিনেমাতেই পরিচ্ছন্ন একটা গল্পই খুঁজে পাওয়া যায় না। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সিনেমা থেকে কাট-পেস্ট করে এমন এক অবস্থার তৈরি করে, শেষ পর্যন্ত গিয়ে অনেক সময় কিছুই দাঁড়ায় না। যা বর্তমান সময়ে দর্শকদের সিনেমা হল বিমুখ হওয়ার একটা কারণও বটে।
রঙের নিজস্ব একটা ভাষা আছে। সে তার ভাষায় কথা বলতে জানে। তাই চলচ্চিত্রে রঙের যদি সুষ্ঠু ব্যবহার করা সম্ভব হয় তাহলে তা আলাদা একটা ব্যঞ্জনা দিতে পারে। যে ব্যঞ্জনা অন্য কোনো কিছুর কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব নয়। নাম থেকেই বোঝা যায়, ‘গ্যাংস্টার রিটার্নস’ একটি অ্যাকশনধর্মী সিনেমা। এই সিনেমাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য পুরো সময় রঙের যে ব্যবহার বা আবহ তৈরি করেছেন নির্মাতা, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। কারণ এতে দৃশ্যের সঙ্গে রঙের এমন এক সম্মিলন ঘটেছে, যা সিনেমাটিকে আলাদা একটা ব্যঞ্জনা দেয়। একই সঙ্গে লোকেশন বা স্থান নির্বাচনের ক্ষেত্রেও নির্মাতা মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। যা দৃশ্যগুলোর সঙ্গে অনেকটাই প্রাসঙ্গিক।
চিত্রনায়ক মান্নার মৃত্যুর পর বাংলা চলচ্চিত্রে শাকিব খান ছাড়া আর কেউ ওই ভাবে অ্যাকশনধর্মী সিনেমায় দাঁড়াতে পারেননি। তাই জায়গাটা এখনো অনেকটাই ফাঁকা পড়ে আছে। এই ফাঁকা জায়গা পূরণে ‘গ্যাংস্টার রিটার্নস’ একটু হলেও আশা জাগাতে পেরেছে। কারণ টিভি নাটকের জনপ্রিয় অভিনেতা অপূর্ব এই সিনেমাতে তাঁর অ্যাকশন লুক ফুটিয়ে তুলতে অনেকটাই সফল। তাই অপূর্বকে নিয়ে এই ফাঁকা জায়গা পূরণের স্বপ্ন দেখার অবকাশটা থেকেই যায়।
নির্মাতা আশিকুর রহমান আবহ সঙ্গীতের ব্যবহার মন্দ করেননি। কিন্তু তিনি মাঝেমধ্যে গিয়ে গুলিয়ে ফেলেছেন। তাই তো দেখা যায়, শেষে মারামারির দৃশ্যে শাওনকে মারার সময় খলনায়ক আসলাম ভাইয়ের (টাইগার রবি) হুংকারের শব্দ বারবার ভেসে আসে। কিন্তু শাওন যে মার খাচ্ছে সেটারও যে এক ধরনের আওয়াজ বা ধ্বনি আছে, সেদিকে যেন নির্মাতার কোনো খেয়ালই ছিল না।
আশিকুর রহমান আরেকটা জায়গায় আশা জাগিয়েছিলেন। সেটা হলো, নায়িকা হলেই যে তাঁকে স্লিম হতে হবে, অর্থাৎ শরীরের মাপটা ৩৬-২৪-৩৬ হতে হবে। স্লিম বা শরীরের মাপ ঠিক না থাকলে যেন নায়িকা হওয়া যায় না। অর্থাৎ ভালো অভিনয়ের চেয়ে যেখানে শরীরের মাপটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ, এই যে একটা ধারণা দাঁড়িয়ে গেছে ওই জায়গাতে। ‘গ্যাংস্টার রিটার্নস’-এর প্রথম অংশে অপূর্বর প্রেমিকা হিসেবে অভিনয় করেন শম্পা। সিনেমাতে শম্পাকে দেখতে বেশ মোটা-সোটাই মনে হলো। অর্থাৎ ৩৬-২৪-৩৬ নয় আর কি। তাই শম্পাকে অপূর্বর বিপরীতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখে মনে হলো, আশিকুর রহমান যেন সেই ধারণার বাইরে বেরিয়ে এসেছেন।
কিন্তু এই ধারণা ভাঙতে সময় নেয়নি। শম্পা মারা গেলে অপূর্বর প্রেম হয় পিয়ার সঙ্গে। যেখানে পিয়ার স্লিম শরীর বা শরীরের মাপ একদম পারফেক্ট। তাই বলতে হয়, নির্মাতা আশিকুর রহমান পিয়ার মতো স্লিম শরীর এনে এটাই প্রমাণ করেন, নায়িকা হতে হলে স্লিম শরীরটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ মোটা শরীর নিয়ে প্রধান নারী চরিত্র বা নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করা যায় না।
নির্মাতা আশিকুর রহমানের নারী নিয়ে আরেকটি দিকের অবতারণা করা প্রয়োজন বোধ করছি। সেটা হলো, তিনিও নারীকে পণ্য বানিয়ে বিক্রি করার সুযোগটা হাতছাড়া করলেন না। তাই একটা আইটেম গানে নায়িকাকে ভিজিয়ে খুব ভালোভাবেই তার বুক-পিঠ-ঊরু দেখালেন। সিনেমায় শম্পার উপস্থাপন বেশ শালীন হলে পিয়ার উপস্থাপন একটু দৃষ্টিকটুই বটে।
সিনেমায় নায়কের মা ও এক মাস্তানকে পুড়িয়ে মারার দৃশ্য একদম প্রাণবন্ত হয়নি। স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছিল, তারা আগুনে পুড়ছে না, এগুলো গ্রাফিক্সের কাজ। আর যে কয়েকটি দৃশ্যে রক্ত দেখানো হয় এক-দুটি বাদে সেগুলোও প্রত্যাশার জায়গা ধরে রাখতে পারেনি। কারণ ওগুলো যে রক্ত না রং, তা স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়। এই বিষয়গুলো চলচ্চিত্রকে বাস্তবতার কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারে না।
কিছু ত্রুটি-বিচ্চুতি বাদ দিলে নবীন নির্মাতা আশিকুর রহমান ‘গ্যাংস্টার রিটার্নস’-এ মন্দ করেননি। কারণ সিনেমা হলে গিয়ে পুরো সিনেমা দেখতে দর্শকের বিরক্তি লাগবে না বলেই আশা করা যায়। যা বর্তমান সময়ের অনেক সিনেমাই এটুকু করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এটুকু পারলেও হয়তো এ দেশের চলচ্চিত্রশিল্পের এতটা দূরবস্থা হতো না। তাই হয়তো আশিকুর রহমানের কাছে প্রত্যাশার অনেক কিছুই থেকে যায়।