‘সুইটহার্ট’-এর রেশ যেন থেকেই যায়
ভালোবাসা দিবসকে সামনে রেখে ১২ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে মুক্তি পেয়েছে চলচ্চিত্র ‘সুইটহার্ট’। ছবিটির ভালো-মন্দ বিচারের আগে সিনেমাটির কাহিনী জেনে নেওয়া যাক। শিক্ষিত মুসলিম পরিবারের ছেলে জিসান। তিনি ভালোবাসেন খ্রিস্টান পরিবারের প্রিলিনাকে। তাঁদের দুজনের ভালোবাসার মধ্যে ধর্ম নয়, বাদ সাধে স্বার্থান্বেষী প্রিলিনার বড় ভাই জর্জ। জর্জ বিদেশ যাওয়ার লোভে চক্রান্ত করে বোনকে বিয়ে দেন লন্ডনপ্রবাসী রিচার্ডের সঙ্গে।
এদিকে বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে জিসান দেশে এসে জানতে পারেন, তাঁর ভালোবাসার মানুষটি এখন অন্যের ঘরনী। এ কথা শোনার পর জিসান প্রথমে ভেঙে পড়লেও একপর্যায়ে নিজেকে সামলে নেন। বাবার পরিত্যক্ত মিল-ফ্যাক্টরি পুনরায় চালু করে নিজে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। অন্যদিকে প্রিলিনা স্বামী হিসেবে রিচার্ডকে মেনে নিতে না পারায় তাঁদের ডিভোর্স হয়ে যায়। কিন্তু প্রিলিনা যখন ফিরে আসেন, তখন তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে জীবনের শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে। তারপরও প্রিলিনার সান্ত্বনা হয়তো এই যে, জীবন সায়াহ্নের শেষনিশ্বাসটা ভালোবাসার মানুষের বুকে নিতে পেরেছেন।
নির্মাতা ওয়াজেদ আলী এমন একটা সময় খ্রিস্টান-মুসলমানের প্রেমের সম্পর্ক দেখালেন, যখন পুরো বিশ্ব এই ধর্মের নামে বিভক্ত। নির্মাতা ছবিতে দেখিয়ে দিলেন, খ্রিস্টান-মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ কোনো সমস্যা নয়, সমস্যাটা কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের। যারা নিজেদের স্বার্থের প্রয়োজনে ধর্ম, জাতপাতকে ব্যবহার করেন।
সিনেমায় এই স্বার্থান্বেষী মানুষের ভূমিকায় দেখা যায় প্রিলিনার ভাই জর্জকে। জর্জ বিদেশ যাওয়ার জন্য বোন প্রিলিনাকে বিয়ে দিতে চান রিচার্ডের সঙ্গে। কিন্তু প্রিলিনা ভালোবাসেন মুসলিম জিসানকে। জিসানের সঙ্গে প্রিলিনার বিয়ে হলে জর্জের বিদেশ যাওয়া হবে না। তাই তাঁকে বারবার বলতে শোনা যায় জিসান মুসলিম, তাই তাদের মিলন হতে পারে না। কিন্তু প্রিলিনা ও জিসানের মা উভয়েই তাঁদের সম্পর্ক মেনে নেন। কারণ তাঁরা হয়তো বিশ্বাস করেন, মানুষের জন্য ধর্ম, ধর্মের জন্য মানুষ নয়।
রিচার্ড বিয়ে করে প্রিলিনাকে লন্ডন নিয়ে গেছেন- এ সংবাদ শোনার পর জিসান ভেঙে পড়েন। কিন্তু পরের ফ্লাইটেই প্রিলিনার খোঁজে লন্ডন চলে যাননি। একপর্যায়ে নিজেকে সামলেও নেন। এই অংশটুকু দর্শকদের চলচ্চিত্রের সঙ্গে একাত্ম হতে বাধ্য করে। পুরো চলচ্চিত্রে অতিনাটকীয়তার ছাপ অল্প-বিস্তর থাকলেও এ অংশে তা না দেখিয়ে নির্মাতা আলাদা একটা স্বাদ দর্শকদের দিতে পেরেছেন।
প্রিলিনা দেশে ফিরে এলে বিপদের দিনে পাশে দাঁড়াতে প্রিলিনার মা জিসানকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে যান। ওই সময় প্রিলিনা যখন তাঁর অপরাধ স্বীকার করে জিসানের কাছে ক্ষমা চান, তখন করুণ সুরের রাগ বেজে ওঠে। যা দর্শকদের প্রিলিনার দুঃখে দুঃখিত করে। এ ছাড়া চলচ্চিত্রে সংগীতের ব্যবহার মন্দ ছিল না।
চরিত্র নির্বাচন, বাড়ির ডেকোরেশনের মধ্য দিয়ে নির্মাতা মুসলিম আর খ্রিস্টান পরিবারকে বেশ ভালোভাবেই ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। চলচ্চিত্রের লোকেশন নির্বাচনও ছিল বেশ প্রাসঙ্গিক। দিতি, রিয়াজ, মিমসহ অন্য কলাকুশলীদের অভিনয় মোটামুটি ভালোই করেছেন। বাপ্পিও হয়তো ভালোই করেছেন, তবে সেটা তাঁর জায়গা থেকে।
এবারে আসি নির্মাতাদের একটা ‘কমন রোগ’ বিষয়ে। আর সেটা হলো যৌনতা, যা বাংলা চলচ্চিত্রশিল্প ধ্বংসের অন্যতম প্রধান কারণও বটে। কিন্তু তারপরও কেন যেন নির্মাতাদের মাথায় এটা ঢোকে না যে, চলচ্চিত্রে কারণে-অকারণে শরীরের রগরগে উপস্থাপনের কারণে ইচ্ছে সত্ত্বেও পরিবার নিয়ে দর্শকরা সিনেমাহলে আসতে পারেন না। তাহলে কাদের নির্মাতারা তাঁদের উদ্দিষ্ট দর্শক হিসেবে বিবেচনা করেন? তরুণদের? যদি তাই হবে, তরুণরা তো ঘরে বসেই মোবাইল, কম্পিউটারে পর্নোগ্রাফি দেখে নিতে পারেন। তাহলে সিনেমা হলে কেন?
এই সাধারণ হিসাবটা ওয়াজেদ আলী সুমনের মাথায়ও ঢুকল না। তাই তো তিনি প্রিলিনা চরিত্রে অভিনয় করা মিমকে গোসলের পর দীর্ঘ সময় ধরে চুলের পানি মুছতে দেখান। এমনকি দৃশ্যকে স্লো করে দেন! যাতে মীমের শরীর দেখে দর্শকের যেন কামতৃষ্ণা মেটে!
এ ছাড়া চলচ্চিত্রে প্রিলিনার অনুরোধে জিসানকে বলতে শোনা যায়, তিনি স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়তে যাবেন তবে এ ক্ষেত্রে প্রিলিনাকে বাংলার মেয়েদের মতো শাড়ি পরতে হবে। কিছুক্ষণ পর বুঝতে কষ্ট হলো না কেন এই শাড়ি পরার শর্ত জুড়ে দেন জিসান। শাড়ি পরতে দেরি হচ্ছে দেখে জিসান হুট করে প্রিলিনার ঘরে ঢুকে যান। পরে জিসানই শাড়ি পরিয়ে দিতে শুরু করেন। সে সময় প্রিলিনা বা মীমের নাভি ও তার নিচের অংশ, বুক-পিঠকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যা দর্শকের কামের জোগান দেয়। কৌশলে এভাবে যৌনতা ঢুকিয়ে চলচ্চিত্রশিল্পকে ধ্বংস করার দায় তাই ওয়াজেদ আলী সুমনকেও নিতে হবে।
চলচ্চিত্রের শুরুতে দেখা যায়, জিসানের জন্য তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব মেয়ে পাগল। অনেকের পছন্দের মানুষ একজন হতেই পারে। তাই বলে তা প্রকাশের তো একটা মাত্রা থাকে। জিসানের ওপর এ রকম অতিরিক্ত বিশেষত্ব আরোপের ফলে চলচ্চিত্র তার স্বাভাবিকত্ব হারায়। এ ছাড়া বাংলা চলচ্চিত্রের কিছু সাধারণ কথোপকথন আছে, চিন্তা আছে। যা অধিকাংশ চলচ্চিত্রেই পাওয়া যায়। ‘সুইটহার্ট’-এও তা দেখা যায়। এসব এড়ানো গেলে হয়তো সিনেমা আরো প্রাণবন্ত হতো।
এখন কিছু কথা দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই। পর্দায় প্রথম যখন প্রিলিনা বা মীমকে দেখা গেল তখন দর্শক বেশ স্বাভাবিক অবস্থাতে ছিলেন। যখনই নায়িকার শরীরের একটু ভাঁজ দেখা যায়, তখনই দেখি দর্শকদের ইঙ্গিতপূর্ণ চিৎকার ও আচরণ। এই ধরনের মানসিকতার পরিবর্তন না হলে সিনেমা হলের পরিবেশ যেমন ভালো হবে না, সামাজিক অবস্থারও তেমনি কোনো পরিবর্তন হবে না। দিন শেষে ভালো-মন্দ সবাই ভালো থাকতে চায়। তাই এই মানসিকতার পরিবর্তন খুব জরুরি। এগুলো আইন দিয়ে, নিয়ম করে হয় না।
কিছু ভুল-ত্রুটি সত্ত্বেও ‘সুইটহার্ট’-এর সার্থকতা হয়তো এখানেই যে, চলচ্চিত্রটির মধ্য দিয়ে পরিচ্ছন্ন একটা কাহিনী বলতে পেরেছেন। যে কাহিনী দর্শকদের মনোযোগ ধরে রাখতে পেরেছে। প্রিলিনার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যা সার্থকতা পায়। ফলে সিনেমা দেখার পর দর্শকের মনে এর একটা রেশও থেকে যায়। যা দর্শকদের হল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরও কিছু সময় ধরে সিনেমাটি নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।