মোশাররফ, আরফান, হাসানের আড্ডা
শুটিং করতে না এসে একা বেড়াতে এলে অনেক ভালো হতো। হাতে একটা বই থাকবে। একটা শীতল পাটি থাকবে। সেখানে শুয়ে শুয়ে শুধু বই পড়া। ধুর কিসের শুটিং! একদিন সত্যি সত্যি এ রকম করব। কথাগুলো আরফান আহমেদকে ফিসফিস করে বলছিলেন মোশাররফ করিম।
মোশাররফ করিম চুপিচুপি কথা বললেও আরফান সেটা করেননি। উচ্চস্বরে তিনি বললেন, ‘আরে আপনি এই কথা তো কম করে হলেও এক হাজার সেটে গিয়ে বলেছেন।’
সত্যিই কি মোশাররফ করিম প্রতিটি সেটে গিয়ে একই কথা বলেন? এমন প্রশ্ন শুনে আরফান আহমেদ বললেন, ‘আরে না। আমি যতগুলো নাটকের সেটে মোশাররফ ভাইয়ের সঙ্গে ছিলাম, সেখানেই তিনি এমন কথা বলেছেন।’
পুবাইলের শান্ত এক পল্লীতে আড্ডা জমে উঠেছে। আসলে আড্ডা দিতে নয়, তাঁরা সেখানে গেছেন সালাউদ্দিন লাভলুর ‘দি ভিলেজ ইঞ্জিনিয়ার’ ধারাবাহিক নাটকের শুটিং করতে। মোশাররফ করিম আর আরফান আহমেদের গল্প চুপচাপ বসে শুনছিলেন আ খ ম হাসান। তিনিও শুটিং করতেই এসেছেন এই সবুজে ঘেরা গ্রামটিতে।
শুটিং আপাতত বন্ধ তাই চলছে আড্ডাবাজি। আরফান আহমেদ বললেন, “মোশাররফ ভাই সব সময় ‘আইন’ নিজের হাতে তুলে নেন। মোশাররফ ভাই একজন হেল্পফুল কো-আর্টিস্ট। আমরা যত বাজে কাজই করি না কেন মোশাররফ ভাই সেটা নিজের হাতে তুলে নেন। একাই উনি ভালো করে পুরো অভিনয়টাকে মজবুত করেন। এ জন্যই বলছি নিজের হাতে ‘আইন’ তুলে নেওয়ার বিষয়টা মোশাররফ ভাইয়ের মধ্যে আছে। আমি সব সময় ওনার কাছে লাভ খুঁজি। আমি জানি উনি পাশে থাকলেই আমার অভিনয় অনেক ভালো হবে। আমি ফেল করব না। ১০০-তে ১০০ না পেলেও ৩৩ পাব।”
মোশাররফ করিমের এত প্রশংসা করছেন। এবার তাঁর খারাপ গুণ কী কী আছে সেগুলো শুনতে চাই। এমন প্রশ্ন শুনে একটু নড়েচড়ে বসলেন আরফান আহমেদ, বললেন, ‘তাঁর কোনো বদগুণ নাই। সে মদ খায় না, ভাত খায়।’
মোশাররফ করিমের কোনো দোষের কথা না বললেও আ খ ম হাসান সম্পর্কে একটু অভিযোগের স্বরে আরফান আহমেদ বললেন, ‘ওই যে উনি হাসান সাহেব আপনার পাশে বসে আছেন তিনি এখন মাছচাষি।’
মানে কি? সত্যি নাকি?
আরফান বলে চললেন, ‘আলবৎ সত্যি। সে কয়েকটা পুকুরে মাছ ছেড়েছে। সেগুলো নাকি বড় হবে। দেশ ও জাতির সেবা করবে। আমি বুঝি না মাছ বড় করে কী হবে? আমার কথা বিশ্বাস না করলে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন।’
আ খ ম হাসানের কাছে জানতে চাইলাম, ঘটনা কি সত্যি? মাথা ঝাঁকিয়ে তিনি সম্মতি জানালেন।
আ খ ম হাসান শুরু থেকেই মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। কিছুতেই তিনি মুখ খুলছেন না। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি আজ কোনো সাক্ষাৎকার দেব না। কারণ একটু আগে ঘুম থেকে উঠেছি। সবার কথা শুনতেই ভালো লাগছে।’ হাসানের সরল স্বীকারোক্তি।
আ খ ম হাসান যেহেতু কথাই বলবেন না, তাই আলাপ শুরু করলাম আড্ডার মধ্যমণি মোশাররফ করিমের সঙ্গে। মোশাররফ ভাই, আপনার ডাক নাম কী?
মোশাররফ করিম বললেন, ‘বাসার সবাই আমাকে শামীম বলে ডাকে।’
আপনার তো অনেক প্রশংসা শুনলাম, জনপ্রিয়তা তো আকাশচুম্বী। বিনয় করে মোশাররফ করিম বললেন, ‘আরে ও কিছু না। সবই ওপরওয়ালার ইচ্ছা। আমিও অভিনেতা। হাসান ও আরফানও অভিনেতা। আমাদের দেশে এখনো যে ভালো অভিনেতা আছে এটা কেউ জানে না, যারা অভিনয় করছে তারাও জানে না। এর কারণ কী জিজ্ঞাসা করলে আমি বলব অভিনেতারা চ্যালেঞ্জ নিয়ে কত ভালো অভিনয় যে করতে পারে, তাদের সেই অভিনয় তুলে ধরার অবকাঠামোই এখানে নেই। ধরেন হাসান, তিনি অনেক ভালো অভিনয় করেন। একটা দৃশ্য শেষ করে তিনি আরেকটা দৃশ্যে কী অভিনয় করবেন সেটার জন্য যে ভাবনা দরকার সেটা তিনি করতে পারেন না। কারণ সময় কম। বাংলাদেশে ভালো পরিচালক ও ক্যামেরাম্যানও আছে। আমরা সব সময় ভালো লাইটের কথা বলি। বাংলাদেশের একজন ক্যামেরাম্যানের ভালো লাইট কী, সেটাই তো তার জানার সময় নেই। পরিচালক ভালো লোকেশনে শট নেবে। কিন্তু পারছে না। কেন? কারণ একটাই-পয়সা নেই। আমি জানি না এই কথাগুলো বলা ঠিক কি না।’
মোশাররফ করিম একটু থেমে বলতে লাগলেন, ‘ভারত থেকে অনেক পরিচালক বাংলাদেশে শুটিং করতে আসেন। তাঁদের আমি অনেক শ্রদ্ধা করি। তাঁদের কয়েকজনের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তারা এমনও বলেছেন সারা দিনে তাঁরা আড়াইটা দৃশ্য করেছেন। আমি তাদের জ্ঞিজ্ঞাসা করেছি, আচ্ছা একদিনে মাত্র আড়াইটা দৃশ্য করলেন? এত টাকা কে দিচ্ছে? তাঁরা উত্তরে বলেছিলেন, চ্যানেল এবং প্রযোজকরা দিচ্ছে। আমাদের দেশের পরিচালকদের তা দেওয়া হয় না। কারো সাহসই নেই এত টাকা দেওয়ার। কীভাবে তাহলে ভালো জিনিস তৈরি হবে? এই দেশে অনেক গুণী অভিনেতা ছিলেন, যাঁরা মারা গেছেন। তাঁদের নাম অনেকেই উচ্চারণ করেন না, যারা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেতে পারতেন হয়তো। আমাদের ভয়ানক পরশ্রীকাতরতা আছে। পরশ্রীকাতরতা করে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়া যায় কিন্তু জাতির কোনো উপকার হয় না।’
মোশাররফ করিম একটু থামলে তাঁকে প্রশ্ন করি, আপনাদের অভিনয়গুলো কিছুটা একই ধরনের বলে শোনা যায়। কথাটা কি আপনারা মানেন? মোশাররফ করিম বললেন, ‘আপনি দেখেন লেখকদের লেখাতেও কিন্তু আলাদা স্টাইল আছে। বইয়ের ওপরে নাম না দেখেই শুধু শেষের পৃষ্ঠা পড়লেও আপনি বুঝতে পারবেন এটা সুনীলের লেখা, এটা হুমায়ূন আহমেদের লেখা। আমি ব্যক্তিগতভাবে বলি, হাসান ও আরফানের অভিনয়ের আলাদা একটি ম্যাজিক রয়েছে। আমারও আছে। একটা কথা বলি, আমরা অভিনেতা কিন্তু আমরা সেই অর্থে অভিনয় করতে পারছি না। এটা সত্যি।’
অভিনয় করতে না পারার কারণ জানতে চাইলে মোশাররফ বললেন, ‘আমাদের সবার মাথা ছাদে গিয়ে ঠেকেছে। ছাদ ফুটো করা হোক। তাহলে আরো অভিনয় বেরিয়ে আসবে।’
আলাপ ধীরে ধীরে একটু ভারী হতে শুরু হলো। পরিবেশ হালকা করতে মোশাররফ করিমকে প্রশ্ন করলাম, দি ভিলেজ ইঞ্জিনিয়ার’ নাটকে ইঞ্জিনিয়ারটা কে? তিনি জানালেন, ‘আমিই ইঞ্জিনিয়ার। এখন সেই ইঞ্জিনিয়ারের পোশাকই পরে আছি। মাসুম রেজার গল্প বরাবরই অসাধারণ। তাঁর গল্পে দর্শন থাকে। এই নাটকটিতেও পাওয়া যাবে। আর লাভলু ভাই তো অসম্ভব গুণী নির্মাতা। এই কথা আমি তাঁকেও বলি। তিনি নিজে অভিনয় করেছেন, সম্পাদনা করেছেন, ক্যামেরার কাজ করেছেন, ভালো মানের নাটকও নির্মাণ করে যাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে কাজ করার আলাদা মজা আছে।’
সূর্যের আলো ক্রমশ কমতে শুরু করেছে। শেষ বিকেলের আলোতে শুটিং স্পটটি দেখতে অনেকটা ডিমের কুসুমের মতই লাগছিল। ড্রাইভার সাগর ভাই হঠাৎ স্পটে এসে হাজির। বুঝতে আর বাকি রইল না যে আমাদের ফিরতে হবে।
ফেরার সময় দেখি পরিচালক সালাউদ্দিন লাভলু বরই খাচ্ছেন। আমাদেরও খেতে দিলেন। বরই খেতে খেতে তিনি বললেন, ‘এই নাটকটি অনেক ভালো হবে। মোশাররফ, আরফান, হাসান একদম ফাটিয়ে দিচ্ছে।’