শঙ্খচিল
গৌতম ঘোষের ‘মেরা জওয়ান মহান হে’
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ভারতীয় সীমান্তরক্ষা বাহিনী তথা বিএসএফের জওয়ান অমিয় ঘোষের বন্দুকের গুলিতে মৃত্যু হয় ফেলানী খাতুনের। ভারতের আসামে ক্ষুদ্র ব্যবসা করতেন ফেলানী খাতুনের বাবা নুরুল ইসলাম। ভারতীয় দালালের সহায়তায় অনন্তপুর সীমান্তের ৯৪৭ নম্বর মূল পিলারের কাছে ৩ ও ৪ এস পিলারের মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে তাঁরা দেশে ফিরছিলেন। দালালরা মই দিয়ে ভোরে তাদের দেশে ফিরতে সহায়তা করছিল। নূরুল ইসলাম মই বেয়ে পেরিয়ে যেতে পারলেও ফেলানী খাতুন আটকে পড়ে কাঁটাতারের ফাঁদে। সে ফাঁদ থেকে উদ্ধার পেতে চিৎকার করে উঠে ফেলানী। আর ফেলানীর চিৎকার চিরতরে স্তব্ধ করে দেয় অমিয় ঘোষের বন্দুক।
ওপরের বর্ণনাটুকু এ জন্য যে শঙ্খচিলের শুরুর দৃশ্যটা তেমনই। এ রকম কাঁটাতার পেরুতে যাওয়া এক যুবকের বুকে গুলি চালায় বিএসএফ। পরের দৃশ্য প্রতিবাদী সাংবাদিকদের বিনা বিচারে গুলি চালানোবিষয়ক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বিএসএফ-প্রধান জানান, নিশ্চয় দোষীদের বিচার হবে। আর যারা গুলি চালিয়েছে তাদের মধ্যেও মানবিকতা রয়েছে। এরপরেই তিনি হঠাৎ নস্টালজিক হয়ে বলেন, সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় মূলত এসব মানুষের ওপর গুলি চালানো হয়েছে। যেন দেশভাগের কারণে একদল হতাশ জওয়ান ২০১৬ সালে এসে নির্বিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা করছে। কিন্তু আফসোস এও যে তাদের গুলিতে কেবল বাংলাদেশের একদল সাব-অলটার্ন মানুষ ছাড়া আর কেউ মারা যায় না। যে বিচারের কথা বিএসএফ-প্রধান বলেছেন বাস্তবের মতো সিনেমাতেও তার দৃশ্যায়ন ছিল যথারীতি অনুপস্থিত।
এ তো ছিল ছবির শুরু মাত্র। ছবির তখনো অনেক বাকি। মূলত এরপর পুরো সিনেমায় যা দেখানো হবে, তাকেই কেবল জায়েজ করে নিতে অপ্রাসঙ্গিকভাবে এই দৃশ্যটুকু জুড়ে দেওয়া, যা পরিচালক গৌতম ঘোষের ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। কিন্তু এটুকুতেই হয়তো স্বস্তি পাচ্ছিলেন না গৌতম। তাই আরেকটি দৃশ্যে এক বিজিবি কর্মকর্তা সাংবাদিকের কাছে কিছু কিছু এলাকায় ভারত-বাংলাদেশ যে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে তা দেখিয়ে বেড়াচ্ছেন। দুই আলাদা আলাদা দেশের অস্তিত্ব অস্বীকার করার মধ্যে কোনো সার্থকতা নেই। আলাদা হয়েও সদিচ্ছা থাকলে পাশাপাশি দুটি দেশ ভালোভাবে থাকতে পারে। বাস্তবিক অর্থে সেটি কেবল ইউটোপীয়ই নয়, অযৌক্তিকও। দেশভাগের যন্ত্রণা যেমন সত্য। তেমন দুটি দেশ যে এখন সম্পূর্ণ আলাদা সেটিও সত্য।
এরপর পুরো সিনেমায় বিএসএফের জওয়ানদের মহান, পরোপকারী এবং মানবিক প্রমাণ করতেই যেন গৌতম ঘোষ তাঁর সামর্থ্যের সবটুকু ঢেলে দিয়েছেন। সীমান্তবর্তী এক স্কুল মাস্টারের (প্রসেনজিৎ) ছোট্ট মেয়ে রূপসাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে সিনেমার পরবর্তী কাহিনী। শুরু থেকে দেখা যায় বেশ চটপটে ও দুরন্ত এবং কৌতূহলী মেয়ে রূপসা। সব কিছুকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে চায় সে। বাবা বাদল মাস্টার গ্রামের স্কুলশিক্ষক। ক্লাসিকাল রবীন্দ্রপ্রেমী বাঙালিরা যেমন হয় তেমনই সে। তাঁর স্ত্রী লায়লাও (কুসুম শিকদার) অনেকটা তেমনই। বাবা-মা দ্বারা প্রভাবিত মেয়েটাও তাই। যেমন বাবার কিনে আনা জিয়ল মাছ পুকুরে ছেড়ে দেওয়া। আতশ কাচ দিয়ে সব খুঁটিয়ে দেখা এবং মেলায় ঘুরতে গিয়ে ভারতীয় এক জওয়ানের সঙ্গে দোস্তি তৈরি করা। সবকিছুতেই বেশ সাবলীল সে। সিনেমার টুইস্ট মূলত এখানেই।
আমরা জানতে পারি সেই জওয়ানের রূপসার বয়সী একটা মেয়ে আছে। রূপসাকে সে মিট্টি (মিষ্টি) বলে ডাকে। তাদের মধ্যে এ বন্ধুত্ব যে কতটা সুদূরপ্রসারী তা আমরা খানিক পরেই জানতে পারব। যখন জানতে পারব রূপসার হৃৎপিণ্ডের একটি বাল্ব নষ্ট। রূপসার দ্রুত ভালো চিকিৎসার জন্য বড় হাসপাতালে নেওয়ার দরকার হয়। দুয়ে দুয়ে পাঁচ মেলাতে গিয়ে আমরা দেখব, খুলনা বা ঢাকার চেয়ে ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার টাকী শহর অনেক কাছে।
কিন্তু এভাবে অন্য দেশে যাওয়া সে যতই জরুরি হোক, তা তো রীতিমতো বেআইনি। মেয়ের কারণে ক্লাসিকাল নীতিনৈতিকতা থেকে বেরিয়ে বাদল মাস্টার শেষপর্যন্ত টাকী হাসপাতালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার এই উৎকৃষ্ট সময়ে যেখানে বাদল মাস্টারের বাসায় কম্পিউটার পৌঁছে গেছে। সেখান থেকে কেন একটি অসুস্থ মেয়েকে চিকিৎসার জন্য জরুরি অবস্থায় ঢাকা কিংবা খুলনা নেওয়া যাবে না সে প্রশ্ন থেকেই যায়। এটা কি বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্দশার কারণে নাকি অন্য কিছু? সেই সঙ্গে একজন সুশিক্ষিত এবং মধ্যবিত্ত রুচিবান মানুষ কি বুঝতে পারেননি পরবর্তী আসন্ন সমস্যার কথা। জ্ঞানীদের জন্য ভাবনার বিষয় হতে পারে।
কিন্তু সিনেমা এখানেই শেষ নয়। চিকিৎসার জন্য ঢাকা কিংবা খুলনা যাওয়া যত কঠিন, টাকীতে যাওয়া আরো বেশি বিপদসংকুল হয়ে ওঠে। বিনা পাসপোর্ট আর ভিসায় আরেকটা দেশে ত সহজ বিষয় না। ওই সময় দৃশ্যপটে আবারও সেই ভারতীয় জওয়ান। প্রথমে অপারগতা জানালেও পরে রূপসার কথা শুনে মৌন সম্মতি জানায়। ঠিক এই জায়গায় এসে আমাদের বলিউডে বজরঙ্গি ভাইজানের কথা মনে পড়ে। সেখানেও বজরঙ্গির পাকিস্তান প্রবেশে ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হয় বিএসএফ। এখানেও তার চরিত্র ভিন্ন কিছু নয়। কিন্তু জটিলতার এখানেই শেষ নয়। টাকী যাওয়ার পর তাদের জানানো হয় চিকিৎসার জন্য যতদিন থাকতে হবে নাম এবং ধর্ম বদলে থাকতে হবে। এখানেই জেগে ওঠে ক্লাসিকাল বাঙালির আত্মপরিচয়ের সংকট। এমনিতেই মেয়ের অসুস্থতা তাদের ধার্মিক করে তুলেছে, তার মধ্যে হঠাৎ এমন আবদার অস্বস্তি আরো বাড়িয়ে দেয়।
তবুও মেয়ের কারণে এখানেও আপস করে নেন বাদল আর লায়লা। ব্যাপারটা বাদলের জন্য যতটা সহজ ছিল, লায়লার জন্য তেমন না। লায়লাকে বাধ্য হয়ে শাখা-সিঁদুর পরতে হয়। যে কারণে সে মেয়ের সামনেও যেতে পারে না। একপর্যায়ে মেয়েকে কলকাতা নিতে হয়। সেখানেও পরিচয় গোপন রাখতে হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেয়েকে বাঁচাতে না পারলে ফেটে যায় বাদলের জ্বালামুখ। আত্মপরিচয়ের সংকট যেন আর বাঁধ মানে না। তিনি চিৎকার করে জানিয়ে দেন তাঁর নাম মুনতাসীর মামুন চৌধুরী বাদল, তাঁর বউয়ের নাম লায়লা। এখানে লায়লার ধর্মীয় পরিচয়ও তীব্রতর হয়ে ওঠে।
সে মিথ্যা বলে অন্য ধর্মের বেশ নেওয়াকে মেয়ের মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে। এরপর বাদলের অনুরোধে ‘দায়লু’ ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মেয়ের লাশ দেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এখানেও আবার শেষবারের মতো দৃশ্যপটে সেই মহৎপ্রাণ জওয়ানের আবির্ভাব।
সুসজ্জিত রূপসার কফিন বিএসএসের কাছে হস্তান্তর করে সে নিজের হৃদয়বান উপস্থিতিকে আরো খানিকটা বিস্তৃত করে তোলে। অন্যদিকে আইন ভঙ্গ করে বেআইনিভাবে অন্য দেশে যাওয়ার অপরাধে বাদল আর লায়লার ঠাঁই হয় ভারতের কারাগারে। সিনেমা কিন্তু এখানেই শেষ। কাহিনীকে অনেক বেশি জোরালো করতে গিয়ে গৌতম ঘোষ অতিনাটকীয়তা এবং অপ্রয়োজনীয় দৃশ্য সিনেমায় ঢুকিয়েছেন।
কখনো কখনো মনে হচ্ছিল সিনেমার আড়ালে দীর্ঘ টেলিফিল্ম চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। লায়লা চরিত্রে কুসুম শিকদার প্রমিত বাংলায় কথা বলবেন নাকি আঞ্চলিক ভাষায়, সিনেমাজুড়ে সে দ্বন্দ্ব দূর করতে পারেননি। শঙ্খচিলের আকর্ষণ বলতে রূপসা চরিত্রটি। এই চরিত্রে সাঁঝবাতির দারুণ অভিনয়ের কথা বলতেই হয়। যেটুকু হয়ে ওঠেনি, তার জন্য তার চেয়ে পরিচালকের দায় বেশি। শুধুমাত্র বিএসএফকে মহান বানানোর দায়িত্ব না নিলে গৌতম ঘোষ হয়তো ভালো সিনেমা বানাতে পারতেন।
দুই দেশের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হোক, এটাই সমস্ত স্বাভাবিক জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের কামনা। পাশাপাশি দুটি ক্রমবর্ধমান রেষারেষি নিয়ে এগুতে পারে না। তবে শুধুমাত্র ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী মহৎ এই এজেন্ডা দিয়ে ছবি বানিয়ে ফেলাটা ফেলানীর রক্তের সঙ্গে এক প্রকার প্রতারণা। আমি বলছি না মহৎপ্রাণ জওয়ান নেই। কিন্তু বিপরীত চিত্রটা উঠে আসা সমানে জরুরি। সেটাকে এড়িয়ে যাওয়াটা দর্শকের সঙ্গে তো বটেই, নিজের সঙ্গেও প্রতারণা। সেই সঙ্গে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু বাস্তবিক পদক্ষেপ নেওয়া।
দিনশেষে শঙ্খচিল উড়ুক তার যেখানে খুশি। কেবল শিকারির বন্দুকের গুলিতে তাকে যেন কাঁটাতারে ঝুলে মরতে না হয়-এটাই প্রার্থনা।