মার্গারিটা উইথ আ স্ট্র
বিষাদের পাঁচালি
সোনালি বোসের পরিচালনায় ‘মার্গারিটা উইথ আ স্ট্র’ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার আগেই সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছে দেদার। বলিউডের মহাতারকা অমিতাভ বচ্চন প্রশংসা করেছেন ছবিটির, কাল্কি কোচলিনের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে কেঁদেই ফেলেছিলেন সুপারস্টার আমির খান। গত শুক্রবার মুক্তি পাওয়া এই ছবি নিয়ে মুম্বাই মিররে রিভিউ লিখেছেন রাহুল দেশাই, এটি শেয়ারও করেছেন কাল্কির সাবেক স্বামী অনুরাগ কশ্যপ। আলোচিত এই ছবির বিশেষ রিভিউটি ভাষান্তর করা হলো।
ভারতীয় চলচ্চিত্রকাররা শারীরিক/মানসিক অক্ষমতা কিংবা হতাশা নিয়ে ছবি বানানোর পথ তেমন একটা মাড়ান না। সঞ্জয় লীলা বনসালির সব ছবির দিকে নজর বুলিয়ে দেখুন, এমন সামাজিক অবস্থা নিয়ে পরিচালকদের তিনি ছবি বানাতে উদ্বুদ্ধ করেন, যা সমস্যা এড়িয়ে পকেট ভারী করার দিকেই বেশি মনোযোগী। এই বিষয়টার মুখোমুখি হতে হবে সরাসরি, নাটুকেপনার মাধ্যমে নয়। সে কারণেই ‘মার্গারিটা উইথ আ স্ট্র’ সরাসরি দেখিয়েছে শারীরিক সমস্যাগ্রস্ত এক নারীর (কাল্কি কোচলিন) জীবনের চ্যালেঞ্জিং এবং জটিল পর্যায়সমূহ, হৃদয় নিংড়ানো এক শুভ্র চিত্রায়ন।
অক্ষমতাকে সহজাতভাবে দেখার এবং বোঝার সুযোগ করে দিয়েছে এই ছবি। প্রোটাগনিস্টের (কেন্দ্রীয় চরিত্র) সবচেয়ে একঘেয়ে আর ব্যক্তিগত মুহূর্তগুলোকে স্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে এই ছবিতে। এটা বোঝা খুব দুষ্কর- সিনেমার চরিত্র, এমনকি সুপারহিরোরাও কীভাবে জীবনের সহজাত চাহিদা বা বোধগুলোর মুখোমুখি হয়? আমরা কি কখনো সুপারহিরোদের খেতে, কাঁদতে, ভাবতে কিংবা স্বমেহনে উদ্যত হতে দেখেছি? পরিচালক সোনালি বোস একটানা আর নিখুঁত চিত্রায়নে এই প্রতিনিয়ত আর নিশ্চুপ রুটিনটি দেখিয়েছেন একের পর এক দৃশ্যে, গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী এক গল্প। লায়লার অ্যাডভেঞ্চার চিত্রায়িত হয়েছে তীব্র ঘনিষ্ঠতায়, এক ১.৮৫:১-এর চিরাচরিত অ্যাসপেক্ট রেশিওর থেকেও খানিকটা বেশি। এক উদ্ভট পরিবারের আখ্যান এভাবেই দেখানো হয়েছে, এ জন্যই নয় যে তাদের গঠনটা ভিন্ন-এ কারণেই যে তাদের সামনে অন্য কোনো পথ খোলা নেই। চারপাশেই ছাড় দেওয়ার মনোভাব, তবে সেখানে শুধু বিষণ্ণতা নেই, আছে ছোট্ট- রোদ্রোজ্জ্বল-নিজস্ব ঢঙের এক পরিবার, লায়লার হুইলচেয়ার রহস্য, তার সুতীব্র লেখনী, আছে ভ্রম বা মোহ। তাদের মাতৃতান্ত্রিক পরিবার, হতে পারে পরিবারটি পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভাগা পরিবারগুলোর একটি, তারপরও ‘জীবন থেমে থাকে না’ এই সূত্র তাদের জানা, আর এই সূত্র ধরা দেয় শিখ বাবার (কুলজিৎ সিং) সৌম্য মুখাবয়বে।
তবে নির্মাতারা যে জায়গাটা খুঁড়েছেন গভীর থেকে আরো গভীরে, সে জায়গাটা ভিন্ন। তীব্র, স্পষ্ট আর কড়াভাবে দেখিয়েছেন যৌন-মনস্তত্ত্বের উত্থান বা বিকাশ, যা এখনো যেকোনো ভারতীয় মায়ের জন্য ভয়াবহ দুঃস্বপ্নই বলা যায়। লায়লার পর্নোগ্রাফি-মোহ, যৌনানুভূতির তৃপ্তি বুঝে ওঠার সংগ্রাম, এক অন্ধ পাকিস্তানি অ্যাক্টিভিস্টের সাথে ‘প্রথম’ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং এই সম্পর্কের কারণে লায়লার জীবনের ‘পরীক্ষামূলক’ পর্যায়ে এক হঠাৎ ছেদ। প্রেমের সম্পর্কে দারুণ রসায়ন ফুটিয়ে তুলেছেন এই দুই অভিনয়শিল্পী, যেখানে তাঁরা দেখিয়েছেন-তারা একে অন্যের জন্য বা এককভাবে অক্ষম নন, বরং তারা স্বাভাবিক দুনিয়ার এক প্রেমিকযুগল মাত্র। যুক্তরাষ্ট্রকেই কেন সব সময় যৌন-বিপ্লবের ভূমি হিসেবে দেখাতে হবে তা আমার বুঝের বাইরে, তবে উদার ম্যানহাটনের এই প্রেক্ষাপট সবাইকেই সঠিক পথটি বেছে নেওয়ার উপায় দেখিয়ে দিয়েছে ঠিকই।
অবশ্য ছবিটিকে চরিত্রনির্ভর মনে হয়নি, বরং অনেক বেশি সাংঘর্ষিক পরিস্থিতিকে ভিত্তি করেই ছবির কাহিনী গড়ে উঠেছে বলে মনে হয়েছে। নীল চোখের ব্রিটিশ ছাত্রটির সাথে লায়লার যোগাযোগটা মনে হয়েছে বাড়াবাড়ি রকমের পূর্বনির্ধারিত। মা চরিত্রে রেবতি ছিলেন অসামান্য, কিন্তু লায়লার উভয়কামী চরিত্র উদঘাটনে তাঁর প্রতিক্রিয়া অনেকটা অতিরঞ্জিত ঠেকেছে। তবে বলতেই হয়, মূল ভূমিকায় কোচলিনের অসামান্য চিত্রায়ন এই ছবিটিকে সচরাচর একটি ‘ফিল্ম-স্কুল ক্লিশে’ ছবির বদলে একটি হৃদয় ছুয়ে দেওয়া ছবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। তাঁর ছোট ছোট অনুভূতি, তাঁর প্রকাশ, চিন্তাভাবনা, বিজয়, প্রত্যাখ্যান, কষ্টসাধ্য পদক্ষেপ আর অবশ্যই, তার বুদ্ধিদীপ্ত আকর্ষণীয় চোখের দৃষ্টি; কিছুই তো ভোলা যাবে না! কেবল তাঁর জন্য হলেও, ‘মার্গারিটা উইথ আ স্ট্র’ এক অসামান্য অভিজ্ঞতা নিয়ে দেখার মতো ছবি বটে!