রব ফকির : একজন সুরস্রষ্টা
রব ফকির কে? এমন একটি প্রশ্ন মনের ভেতর উঁকি দিতে পারে। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তিনি পরিচিত কেউ নন, আবার খুব অপরিচিত তাও নয়। যাঁরা আধ্যাত্মিক গান সম্পর্কে আগ্রহী, এক-আধটু খবর রাখেন, তাঁদের কাছে রব ফকির পরিচিত নাম। লালন-পরবর্তী সময়ে যাঁরা লালনের ভাবাদর্শে দীক্ষিত হয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছিলেন ‘লালনসংগীত’, তাঁদের মধ্যে রব ফকির অন্যতম। এ প্রজন্মের রব ফকিরকে না চেনারই কথা। কারণ, তিনি কখনো নিজের প্রচার করেননি। থেকেছেন নিভৃতচারী।
ছোটবেলা থেকেই লালনের আখড়ায় যাওয়া-আসা ছিল তাঁর। বাবা সিরাজ জোয়ার্দারের হাত ধরেই লালনের আখড়ায় নিয়মিত যাতায়াত করতেন। সেখানেই তিনি লালনের ভাবাদর্শে প্রভাবিত হন। চর্চা আরম্ভ করেন লালনসংগীত। পরবর্তী সময়ে তিনি লালনসংগীতে এতটা প্রভাবিত হন যে একটি দৈনিক পত্রিকার সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার দেহটাই দোতারা, লালনের গানই আমার ধর্ম।’
রব ফকির দোতারা বাজাতে পারদর্শী ছিলেন। সুর নিয়ে খেলা করতেন প্রতিনিয়ত। তিনি যখন গলায় দোতারা ঝুলিয়ে মঞ্চে উঠতেন, তখন তাঁর দোতারার সুরে মানুষ নিজেকে অন্য জগতে আবিষ্কার করত। দোতারা বাজানোর তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। তখন বেতারে আব্বাসউদ্দীনের গান শুনে দোতারা বাজানোর প্রতি আকৃষ্ট হন। বাজার থেকে কিনে আনেন দোতারা। সেই দোতারায় তোলা সুর তাঁর কাছে ভালো লাগত না। তাই নিজেই তৈরি করেন দোতারা। কাঁঠাল কিংবা নিমগাছের কাঠ এবং ছাগল অথবা গুই সাপের চামড়া আর পিতলের প্লেট দিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি করতেন দোতারা। দোতারার তারগুলো পিতল বা রেশমে পাকানো সুতা দিয়ে তৈরি করতেন। তার পর তিনি দোতারার মাধ্যমে এমন সব সুর সৃষ্টি করেছেন, যা তাঁকে দোতারা জাদুকর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। লালন, রবীন্দ্র, নজরুল—কোনো সংগীতই তাঁর দোতারার সুর থেকে বাদ যায়নি।
রব ফকিরের গুরুর নামও রব ফকির। বয়সে প্রবীণ ছিলেন। তিনি শিষ্য রব ফকিরকে লালনের দেহতত্ত্ব, দর্শনসহ বিভিন্ন বিষয়ে তালিম দেন। খলিসাকুণ্ডিতে তাঁর আখড়ায় চলত তালিম দেওয়ার কাজ। ওস্তাদের কাছ থেকে লালনের যে দর্শন তিনি অন্তরে গেঁথে নিয়েছেন, তা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অন্তরে ধারণ করেছেন। ছড়িয়ে দিয়েছেন লালনের বাণী সর্বত্র।
লালনকে নতুন করে চিনতে শেখানো রব ফকির ছিলেন লালনের মতোই বাউলসাধক। সাদাসিধে এই মানুষটি ভালোবেসেছিলেন দেশের মাটি, মানুষ আর সংস্কৃতিকে। লালনের গান নতুনভাবে উপস্থাপন করে সমাজে ছড়িয়ে দিয়ে এক অহিংস সমাজ গড়তে চেয়েছিলেন।
যে অহিংস সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে রব ফকির লালনের গানকে পৌঁছে দিয়েছেন, তাতে তিনি সফল হয়েছেন কি না জানার আগেই পৃথিবীর মায়াজাল ছিন্ন করে চলে গেলেন।
গাইবেন না আর। বাজাবেন না দোতারার জাদুকরি সুর। স্বল্পভাষী রব ফকির স্বল্প সময়ে চলে যাবেন, এটা হয়তো ঘুণাক্ষরেও কেউ ভাবেনি। ভাববেই বা কেন! বয়স তো বেশি হয়নি। সবে মাত্র ৪৮ বছর। অথচ তাঁর বেঁচে থাকার কথা ছিল আরো অনেকটা বছর। গড় আয়ুর হিসাব তো তাই বলে। তবে এটা ঠিক, মরে যাওয়া মানে চলে যাওয়া নয়। দেহত্যাগ মাত্র। রব ফকিরের রেখে যাওয়া সুর তাঁকে যুগ যুগ ধরে বাঁচিয়ে রাখবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।