চলচ্চিত্র সমালোচনা
রুস্তমে কেমন করলেন অক্ষয়?
সত্য ঘটনা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হলে সেটা নিয়ে আগ্রহটা বেশি থাকে। আর সেটা যদি হয় কোনো চাঞ্চল্যকর সত্য, তাহলে তো কোনো কথাই নেই। ‘রুস্তম’ ঠিক তেমন একটা চলচ্চিত্র। যে কারণে সবার আগ্রহ এখন ‘রুস্তম’কে ঘিরে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে এই আগ্রহটা বলিউডের অন্য তারকাদের মাঝেও দেখা গেছে। কী এমন আছে ছবিটিতে? এমন প্রশ্নের উত্তর জানতেই দেখে ফেললাম ‘রুস্তম’। কী দেখলাম সেটা বলার আগে ছবির কাহিনীর দিকে একবার চোখ বুলাই।
একজন সৎ, দেশপ্রেমিক এবং অকুতোভয় নৌবাহিনীর কমান্ডার রুস্তম পাভরি। দেশের জন্য প্রয়োজনে জীবন দিতেও প্রস্তুত তিনি। তাই নৌবাহিনীতে তাঁর সুনাম রয়েছে। স্ত্রী সিন্থিয়াকে নিয়ে সুখের সংসার বলা চলে। স্ত্রীকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন রুস্তম। ছুটিতে বাড়ি ফেরার পথে ফুল নিয়ে স্ত্রীকে চমকে দিতে চাইলেও ফিরে দেখেন স্ত্রী নেই। পরিচিত কয়েক জায়গায় ফোন করে জানতে পারেন সেখানেও যাননি স্ত্রী সিন্থিয়া। হঠাৎ রুস্তম আলমারি খুলে গিফট বক্স, কিছু চিঠি দেখতে পান। সেগুলো ভালোভাবে দেখে তিনি নিশ্চিত হন যে তাঁর বন্ধু বিক্রম মাখিজার সঙ্গে সিন্থিয়ার বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক চলছে।
এমন ঘটনা জানার পর রুস্তম সিদ্ধান্ত নেন বন্ধু বিক্রমকে হত্যা করবেন। সেই ভাবনা থেকেই তিনি বিক্রমের বাড়িতে গিয়ে গুলি করে হত্যা করেন। তবে হত্যা করার পর তিনি পালিয়ে যাননি। আত্মসমর্পণ করেছেন। আত্মসমর্পণ করার পরও রুস্তম নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। শুধু তাই নয়, বিক্রম মাখিজাকে খুন করার পরও দেশবাসী রুস্তমের পক্ষে ছিল। যার প্রমাণ দেখা যায় চলচ্চিত্রের শেষে যখন রুস্তমকে খালাস দেওয়া হলো তখন অনেক মানুষ কোর্টের বাইরে প্লাকার্ড হাতে স্লোগান দেয়।
ওপরে শুরুতে সত্য ঘটনা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা বলেছিলাম। ১৯৫৯ সালের নানাবতী মামলার ওপর পুরো ছবিটি চিত্রায়ণ করা হয়েছে। নানাবতী ছিলেন নৌ কমান্ডার। বাস্তবে যিনি নানাবতী, চলচ্চিত্রে তিনি রুস্তম। তখন এই ঘটনাটি নিয়ে সমগ্র ভারতে তোলপাড় শুরু হয়েছিল। সাধারণ জনগণ থেকে আরম্ভ করে মিডিয়া সবকিছু নানাবতীর পক্ষে ছিল। নানাবতী মুক্তি পাওয়ার পর স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যান। যদিও চলচ্চিত্রে রুস্তমের মুক্তি পাওয়া পর্যন্ত দেখানো হয়েছে।
এখন কথা হলো পরিচালক সত্য ঘটনার আলোকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গিয়ে শেষের দিকে হঠাৎ করে কাহিনীর গলা চেপে ধরলেন কেন? স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসার যে নিদর্শন দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, সেটা আরেকটু বাড়িয়ে দিলে হয়তো খুব একটা ক্ষতি হতো না। সত্য ঘটনায় আমরা জানতে পারি নানাবতী শেষে তিন বছর জেল খেটে স্ত্রী এবং সন্তানকে নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যান। তিনি যখন দেশ ছাড়েন তখন অনেকের মনে প্রশ্ন ছিল, দেশবাসীর সমর্থন থাকার পরও তিনি কেন দেশ ছেড়ে চলে গেলেন? আজও অজানা প্রশ্নের উত্তরটি পরিচালক চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দিতে পারলে ভালো হতো, তাহলে আলাদা একটি মাত্রা যোগ হতো।
এবার ছবির সামগ্রিক দিক সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। প্রথমে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য নিয়ে কিছু বলি। একটি ছবির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো চিত্রনাট্য। ভালো চিত্রনাট্য দর্শককে পর্দামগ্ন করে রাখতে যথেষ্ট। এ ক্ষেত্রে রুস্তমের চিত্রনাট্য বেশ ভালো বলতে হবে। এ জন্য চিত্রনাট্যকার বিপুল কে রাওয়াল বাহবা পেতেই পারেন। তবে তিনি সত্য কিছু বিষয় বাদ রেখেছেন। হয়তো সমালোচনা এড়াতে এমনটি করেছেন। বিষয়টি ইতিবাচক।
অভিনেতা হিসেবে অক্ষয় কুমার সম্পর্কে খুব বেশি কিছু বলার নেই। তিনি বরাবরই ভালো অভিনেতা হিসেবে বলিউডে প্রশংসিত। নৌ কমান্ডারের চরিত্রে তিনি দারুণভাবে মানিয়ে গিয়েছেন। কমান্ডারের চরিত্রে যে রকম ম্যানারিজম থাকা প্রয়োজন, তার পুরোটাই অক্ষয় কুমারের ভেতর ছিল। মাঝে একটি পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে অক্ষয় কুমার বলেছিলেন, এই ছবিটির জন্য তিনি নিজেকে বিশেষভাবে তৈরি করেছেন। অক্ষয়ের চরিত্রে প্রথমে জন আব্রাহামকে ভাবা হয়েছিল। পরে অক্ষয়ের ওপর ভরসা করা হয়। ভালো অভিনয়ের মাধ্যমে অক্ষয় বুঝিয়ে দিলেন ভরসা করাটা বিফলে যায়নি। পুরো চলচ্চিত্রে অক্ষয়কে একজন স্বামী ও অফিসার হিসেবে দেখা গেলেও খুব একটা রোমান্টিক দৃশ্য ছিল না। যতটুকু ছিল তাতে প্রয়োজনমতোই নিজের সেরাটা দিয়েছেন তিনি।
স্ত্রী সিন্থিয়ার চরিত্রে অভিনয় করা ইলিয়ানা ডি ক্রুজকে চলচ্চিত্রজুড়ে নিষ্প্রাণ মনে হয়েছে। গোপন প্রেমের রোমান্টিক দৃশ্য কিংবা কান্নার দৃশ্য খুব একটা নজর কাড়তে পারেননি। নায়কপ্রধান চলচ্চিত্রে নায়িকাদের অভিনয় করার তেমন সুযোগ থাকে না। তবে যতটুকু সুযোগ পাওয়া যায়, ততটুকু কাজে লাগাতে হয়। ইলিয়ানা ডি ক্রুজ যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছিলেন নিজেকে প্রমাণ করার। আবার তিনি যে খুব খারাপ করেছেন তাও নয়। কোর্টে দাঁড়িয়ে অক্ষয়ের কাছে ঘটনার বর্ণনা দেওয়া এবং তারপর অক্ষয়ের হাত ধরে চেয়ারে বসার দৃশ্য ভালোবাসার নিদর্শন হয়ে থাকবে।
পার্শ্বচরিত্রে এশা গুপ্তার কথা আলাদা করে বলতে হবে। তিনি এখানে অ্যান্টি হিরোইনের চরিত্রে অভিনয় করেছন। তাঁর এক্সপ্রেশন, সংলাপ বলার ধরন সবকিছু চলচ্চিত্র-উপযোগী। তাঁর ধূমপান করার দৃশ্যটি দর্শক মনে রাখবে অনেকদিন।
এ ছাড়া বাকি চরিত্রগুলো যার যার মতো করে ভালো করেছেন। দৃশ্য অনুযায়ী চরিত্রের এন্ট্রি ঠিকমতোই হয়েছে। সংগীত নিয়ে বলতে গেলে আহামরি কিছু ছিল না। আবহ সংগীতের বিষয়টাও সাধারণের কাতারে ফেলতে চাই।
সবশেষে বলব, ১৯৫৯ সালের যে কাহিনীকে পরিচালক টিনু সুরেশ দেশাই পর্দায় তুলে ধরতে চেয়েছেন, তাতে পুরোপুরি সফল হয়েছেন সেটা বলা যাবে না। নির্মাণে কিছুটা নড়বড়ে ভাব ছিল। যাঁরা নানাবতীর কাহিনী সম্পর্কে জানেন, তাঁরা হয়তো পার্থক্যটা ধরতে পারবেন। আবার এটাও ঠিক, পুরাতন কাহিনীর কোনো ছবি এখন নির্মাণ করতে গেলে কিছুটা পরিবর্তন হবেই। কস্টিউম, সেট ডিজাইনসহ আরো নানা সমস্যা থেকেই যায়। তবু একটি সত্য ঘটনাকে যেভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে তাতে পরিচালককে প্রশংসা না করলে অন্যায় হয়ে যাবে।
চলচ্চিত্রের নাম : রুস্তম
পরিচালক : টিনু সুরেশ দেশাই
অভিনয় : অক্ষয় কুমার, ইলিয়ানা ডি ক্রুজ, এশা গুপ্তা প্রমুখ
সময় : দুই ঘণ্টা ২৭ মিনিট ৪১ সেকেন্ড
রেটিং : ৩.৫/৫