স্মরণ
টিভি নাটকের আব্দুল্লাহ আল মামুন
বাংলাদেশের সংস্কৃতি জগতের যে কজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব আছেন তাঁদের মধ্যে নাট্যজন আব্দুল্লাহ আল মামুন অন্যতম। তিনি একাধারে নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অভিনেতা। বহুমুখী সৃষ্টিকর্মে পারদর্শী মানুষটি সংস্কৃতির সব শাখায় বিচরণ করেছেন বলিষ্ঠভাবে। বাংলাদেশের সব সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে।
আব্দুল্লাহ আল মামুন ১৯৪২ সালে ১৩ জুলাই জামালপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি নাটক রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয়ের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। সাংবাদিক হিসেবে তিনি তাঁর পেশাগত জীবন আরম্ভ করেন। সাংবাদিকতা করতেন ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকায়। এরপর তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান টেলিভিশনে (বর্তমান বাংলাদেশ টেলিভিশন) চাকরিতে যোগ দেন। নতুন কিছু করার আগ্রহ থেকেই তিনি টেলিভিশনে চাকরি নেন। তবে প্রথম দিকে তিনি কাজ আরম্ভ করেন অস্থায়ী হিসেবে। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৬ সালে চাকরিতে স্থায়ী হন এবং সেই সাথে প্রযোজকের দায়িত্ব পান। এরপর ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকতা হিসেবে কাজ করেন। এখানেই তিনি নির্মাণ করেন কালজয়ী এমন কিছু নাটক যা বাংলাদেশের নাটকের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
প্রথম দিকে আব্দুল্লাহ আল মামুন পূর্ব পাকিস্তান টেলিভিশনে রবীন্দ্রনাথের কাহিনী নিয়ে নাটক নির্মাণ করতেন। এ কারণে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে চাপ আসতে থাকে। তৎকালীন কর্তৃপক্ষ আব্দুল্লাহ আল মামুনকে কাজী নজরুল ইসলামের কাহিনী নিয়ে নাটক নির্মাণ করতে চাপ দেন। তবে নজরুলের কাহিনী থেকে নাটক নয়, মামুন নজরুলের গান থেকে নাটক নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। তখনকার সময়ে এ রকম কাজ করা সহজ ছিল না। এক রকম চ্যালেঞ্জ নিয়ে তিনি গান নির্ভর নাটক নির্মাণ করেন। সেটি টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়ার পর ব্যাপক সাড়া পান।
আব্দুল্লাহ আল মামুনকে প্রবাদপ্রতীম খ্যাতি এনে দেয় ‘সংশপ্তক’ ধারাবাহিক নাটকটি। শহীদুল্লাহ কায়সারের কালজয়ী উপন্যাস অবলম্বনে তিনি নাটকটি নির্মাণ করেন। ২৬ পর্বের এই নাটকটি নির্মাণের মাধ্যমে তিনি অপরিমেয় যোগ্যতার প্রমাণ রাখেন। এরপর তিনি একে একে ঘরোয়া, আমি তুমি সে, পাথর সময়, জোয়ার ভাটা, বাবা, শীর্ষবিন্দু, জীবন ছবি, উত্তরাধিকারসহ আরো অনেক নাটক নির্মাণ করেন।
টেলিভিশনে আব্দুল্লাহ আল মামুনের নাটক নির্মাণ সম্পর্কে নাট্য ব্যক্তিত্ব আতাউর রহমান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,’টেলিভিশন প্যানেলে বসে মামুন যখন নির্দেশনা দিত ও অনলাইনে সম্পাদনা করত তা তখন দেখার মতো বিষয় ছিল। আমরা যেন এক তৎপর যোদ্ধা অর্জুনকে দেখতাম। কাজের সময় মামুনের কাছে বিশ্বের সবকিছু সাদা কাগজের পাতার মতো মুছে যেত।’
বাংলাদেশে আজ যেসব ধারাবাহিক নাটক নির্মিত হচ্ছে সেসব নাটকের পথচলা আরম্ভ হয় আব্দুল্লা আল মামুনের হাত ধরেই। আর সে কারণে তাঁকে বাংলাদেশের ধারাবাহিক নাটকের পথিকৃত বলা হয়। তিনি যে ধারা সৃষ্টি করে গেছেন সেই ধারাটাই চলছে এখন পর্যন্ত।
১৯৯১ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে অবসর গ্রহণ করেন আব্দুল্লাহ আল মামুন। এরপর তিনি জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউট, শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি নাট্যচর্চা,মঞ্চ,অভিনয়,চলচ্চিত্র নির্মাণ অব্যাহত রাখেন।
দীর্ঘ রোগ ভোগের পর ২০০৮ সালের ২১ আগস্ট চলে যান না ফেরার দেশে। তাঁর মৃত্যুতে শোকস্তব্দ হয়ে গিয়েছিল পুরো সাংস্কৃতিক অঙ্গন। মাত্র ৬৫ বছর বয়সে নক্ষত্রের হারিয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে পরেনি কেউ। তবে বেঁচে থাকাকালীন আব্দুল্লাহ আল মামুন বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে যে অবদান রেখে গেছেন তাতে তিনি খুব সহজে ম্লান হবেন না। যুগ ধরে থাকবেন তাঁর রেখে যাওয়া সৃষ্টিকর্মের মধ্যে।