আ বিউটিফুল মাইন্ড
সুন্দর মন, সুন্দর হৃদয়
১৯৪৭ সাল। আমেরিকার নিউজার্সির প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে এক শীতের সকাল। নিজের জিনিসপত্র নিয়ে হাজির হলো এক ছাত্র। গণিতে সম্মানজনক এক বৃত্তি পেয়ে প্রিন্সটনে পড়ার সুযোগ পেয়েছে সে। সব সময় আনমনে নিজের মতো কী যেন বকেই চলছে সে। মাথা ঝাকিয়ে, মুখ বিড়বিড় করে আঙুলে কী যেন গুনছেন অভিনেতা রাসেল ক্রো। তিনি অভিনয় করছেন বিখ্যাত গনিতবিদ জন ন্যাশের ভূমিকায়। ছবি আ বিউটিফুল মাইন্ড।
শনিবার সড়ক দুর্ঘটনায় ন্যাশ এবং তাঁর স্ত্রী অ্যালিসিয়ার মৃত্যুর পর টুইটারে রাসেল ক্রো লিখেছেন, ‘শুনে পাথর হয়ে গেলাম। আমার সহানুভূতি থাকবে ন্যাশ এবং অ্যালিসিয়ার পরিবারের প্রতি। সুন্দর এক জুটি। সুন্দর মন, সুন্দর হৃদয়।’
ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ২০০১ সালে। ১৩৫ মিনিটের ছবিটি বক্স অফিসে যেমন রাজত্ব করেছে তেমনি ২০০২ সালে অস্কারে জিতে নিয়েছিল সেরা ছবি, সেরা পরিচালকসহ চারটি পুরস্কার। মনোনয়ন পেয়েছিল আরো চারটি শাখায়। জন ন্যাশের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতা হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন রাসেল ক্রো। পাঁচ কোটি ৮০ লাখ ডলারে নির্মিত ছবিটি আয় করেছিল ৩১ কোটি ৩৫ লাখ ডলার।
জন ন্যাশ বরাবরই অন্যমনষ্ক এক ছাত্র। কিন্তু তাকে নিয়ে প্রিন্সটনের বাকি ছাত্রদের আগ্রহের কমতি নেই। কারণ সবাই ন্যাশের খুব প্রশংসা শুনেছে। ক্লাসে অমনোযোগী, অনুপস্থিত ছাত্র ন্যাশ। সবাই পাবলিকেশনের জন্য আইডিয়া জমা দিলেও ন্যাশ কিছুই দেননি। সময় শেষ হয়ে আসছে। ন্যাশ ভেবেই চলছেন। নিজের মতো করে নতুন সূত্র দিতে চান ন্যাশ। কারো সাথে কথা না বললেও নিজের রুমমেট চার্লস হারম্যানের সাথে অনেক কথা বলেন ন্যাশ। ঝগড়া করেন, সূত্র নিয়ে আলাপ করেন। ন্যাশ কথা বলতে না চাইলেও হারম্যান যেচে এসে ন্যাশকে জ্বালাতন করেন।
ইউনিভার্সিটিতে বন্ধুদের আড্ডায় মেয়ে পটাতে গিয়ে পেলেন গেম থিউরি। পুরনো এই থিউরিকে চ্যালেঞ্জ করলেন তিনি। ভাঙলেন, গড়লেন নিজের মতো নতুন করে।
অ্যাডাম স্মিথ গেম থিউরিতে বলেছিলেন প্রতিটা মানুষই নিজের জন্য। কিন্তু ন্যাশ বললেন, সবাই নিজের জন্য প্রতিযোগিতায় না নেমে যদি একজন আরেকজনকে সুযোগ করে দেয় তাহলে প্রাপ্তির সম্ভাবনা অনেক বেশি। এটার ওপর ভিত্তি করেই গভর্নিং ডায়নামিক্সের নতুন এক সূত্র আবিষ্কার করলেন ন্যাশ। সেটা ছাপা হলো জার্নালে। এর সূত্র ধরেই ন্যাশ চলে এলেন আলোচনায়। পড়ানোর সুযোগ পেলেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি)।
এমআইটিতে ক্লাস নেওয়ার সময় অ্যালিসিয়া লার্দে নামের এক ছাত্রীর প্রেমে পড়েন ন্যাশ। অ্যালিসিয়াকেই বিয়ে করেন তিনি।
এরই ফাঁকে সোভিয়েতদের টেলিকমিউনিকেশনের কোড ভাঙার কাজ পান ন্যাশ। পেন্টাগনে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। সে সময় পার্চার নামের এক সেনা অফিসারের সাথে পরিচয় হয় তাঁর। কিন্তু ন্যাশ বুঝতে পারেন বড় ধরনের বিপদের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছেন তিনি। পার্চারের সাথে গাড়িতে যাওয়ার সময় সোভিয়েত গোয়েন্দারা গুলি ছোড়ে তাঁদের দিকে।
এর পরই মৃত্যুভয় গ্রাস করে ন্যাশকে। সব সময়ই মনে হয় কেউ তাঁর পিছু নিয়েছে। সোভিয়েতরা তাঁকে বাঁচতে দেবে না। প্রথমে বুঝতে না পারলেও, অ্যালিসিয়া একসময় টের পান অস্বাভাবিক আচরণ করছেন ন্যাশ। তাঁকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার বলেন, প্যারানয়েড স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় ভুগছেন ন্যাশ। হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ন্যাশকে, শুরু হয় চিকিৎসা। স্কিৎজোফ্রেনিয়ার সাথে শুরু হয় ন্যাশের যুদ্ধ। নিজের মনের ভেতরে তৈরি চরিত্রগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন তিনি। ডাক্তারের দেওয়া উচ্চমাত্রার ওষুধ নেওয়া থেকে বিরত থাকেন তিনি এবং আবার বন্দি হয়ে পড়েন নিজের কল্পনার তৈরি চরিত্রগুলো কাছে। রুমমেট হারম্যান, হারম্যানের ভাতিজি মার্সি এবং সেনা অফিসার পার্চার সবাই আসলে কল্পনায় তৈরি চরিত্র।
ন্যাশ এ থেকে মুক্তি চান, ফিরে যেতে চান নিজের স্বাভাবিক জীবনে, গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চান তিনি। ন্যাশের পাশে থাকেন স্ত্রী অ্যালিসিয়া। বন্ধু মার্টিন হ্যানসনের সহযোগিতায় প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির গণিত বিভাগে পড়ানোর এবং গবেষণার সুযোগ পেয়ে যান ন্যাশ। আবারও ফিরে আসেন জীবনের কাছে। ১৯৯৪ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন জন ন্যাশ।
ছবি শেষ হয়ে গেলেও বাস্তব জীবনে কখনো ন্যাশের পাশ থেকে সরে যাননি অ্যালিসিয়া। এমনকি মৃত্যুতেও দুজন দুজনের সঙ্গী হলেন।