সালমান-ক্যাটরিনার ‘টাইগার থ্রি’ নিয়ে কেন এত বিতর্ক
সালমান খান ও ক্যাটরিনা কাইফের জুটি মানেই ছবি সুপার হিট হওয়ার শতভাগ সম্ভাবনা। এরসঙ্গে আবার যখন যুক্ত হলো শাহরুখ খান, হৃত্বিক রোশন ও ইমরান হাশমির মতো তারকা; তখন প্রত্যাশা দ্বিগুণ হওয়ার কথা বলাই বাহুল্য। সিনেমাপ্রেমীরা ঠিক এই সহজাত অভিজ্ঞতারই সম্মুখীন হলেন ১২ নভেম্বর ‘টাইগার থ্রি’ মুক্তির মাধ্যমে। এক থা টাইগার' (২০১২), টাইগার জিন্দা হ্যায়(২০১৭), ওয়ার(২০১৯) ও পাঠান (২০২৩) নিয়ে যশ রাজ ফিল্মসের সৃষ্টি করা স্পাই ইউনিভার্সের পঞ্চম সিনেমা এটি।
মনীশ শর্মা পরিচালিত ভারতের সর্বাধিক প্রত্যাশিত চলচ্চিত্রটির এই মুক্তিলগ্নে সিনেমাটিকে ঘিরে জন্ম নিয়েছে কিছু বিতর্ক। কী সেই বিতর্ক! আর তা কতটুকুই বা প্রভাব ফেলছে ফিল্মের জনপ্রিয়তায়, চলুন- জেনে নেওয়া যাক।
৩০০ কোটি রুপি বা প্রায় ৩৯৭ কোটি বাংলাদেশি টাকার (১ ভারতীয় রুপি = ১.৩২ বাংলাদেশি টাকা) সমান বাজেটে তৈরি করা সিনেমাটি কয়েকটি দেশে নিষিদ্ধ হওয়ার শোরগোল উঠেছে। দেশগুলো হলো: ওমান, কুয়েত ও কাতার।
চলচ্চিত্রের খলনায়ক ইমরান হাশমি একটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। এই সংগঠনগুলো সরাসরি মুসলিম ধর্ম-প্রধান দেশগুলোকে প্রতিনিধিত্ব করায়, একটি নেতিবাচক পটভূমির ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। ফলশ্রুতিতে, চিত্রায়নটির মাধ্যমে দেশগুলোর ধর্মীয় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে।
তবে চূড়ান্তভাবে নিষিদ্ধকরণের বিষয়টি এখনও রটনার মাঝেই সীমাবদ্ধ।
অপরপক্ষে, দেশগুলোতে এখনও চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে ছবির কাহিনি নিয়ে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে শিগগিরই মুক্তি দেওয়া হবে দেশগুলোর প্রেক্ষাগৃহে। তবে বিনা কর্তনে ভারতে মুক্তির ছাড়পত্র পাওয়া সিনেমাটির মধ্যপ্রাচ্যে নিষিদ্ধ হওয়ার পেছনে আরেকটি স্পর্শকাতর বিষয়কে দায়ী করা হচ্ছে। আর সেটি হচ্ছে, জোয়া চরিত্রে অভিনীত ক্যাটরিনা কাইফের তোয়ালে পরিহিত একটি অ্যাকশন সিকুয়েন্স। তোয়ালে পরিহিত অবস্থায় ক্যাটরিনা কাইফের অ্যাকশন দৃশ্য যশ রাজ ফিল্মসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এই প্রকল্পের সিংহভাগই খরচ হয়েছে অ্যাকশন দৃশ্যের জন্য। ধুন্ধুমার দৃশ্যগুলোর একটি ছিল ক্যাটরিনা ও জনপ্রিয় হলিউড মুভি ব্ল্যাক উইডো বা বুলেট ট্রেনখ্যাত মিশেল লি’র তোয়ালে পরা অবস্থায় মার্শাল আর্ট।
চলচ্চিত্রের অ্যাকশনকে আলাদাভাবে প্রতিনিধিত্ব করা সিকুয়েন্সটি স্থান পেয়েছিল মুভির ট্রেইলারেও। তারপর থেকেই দুই নারীর এমন মুষ্ঠিযুদ্ধ নিয়ে শুরু হয়ে যায় হৈচৈ।
ভারতীয় চলচ্চিত্রে এরকম অ্যাকশন দৃশ্য এই প্রথম এবং ক্যাটরিনাই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী হিসেবে এই দুঃসাহস দেখালেন। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তুরস্কে শ্যুট করা হয়েছিল দৃশ্যটি। এজন্য দু’জনকেই বহুদিন ধরে প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে বিখ্যাত দক্ষিণ কোরিয়ান অ্যাকশন ডিরেক্টর সি ইয়ংয়ের কাছে।
কিন্তু এই দুঃসাহসকে ঘিরেই বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন বলিউড হিরোইন। ইন্টারনেট নির্ভর সফ্টওয়্যার ডিপফেক-এর মাধ্যমে দৃশ্যটিকে বিকৃত করে শেয়ার করা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। স্বভাবতই ভিডিওটি ভাইরাল হতে খুব বেশি সময় নেয়নি।
ডিপফেক প্রযুক্তির ব্যবহার এই প্রথম নয়। আগেও এর সাহায্যে ছবি বা ভিডিও এডিট করে ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে। বর্তমানে এরসঙ্গে জুড়ে গেছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাও। কিছুদিন আগেই এরকম বিড়ম্বনার শিকার হয়েছিলেন দক্ষিণ ভারতীয় অভিনেত্রী রশ্মিকা মন্দানা।
এমন পরিস্থিতিতে ইলেকট্রনিক্স ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য জারি করা হয়েছে কঠোর নির্দেশিকা। তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০০০-এর ৬৬ডি ধারা মতে, যেকোনো ধরনের কম্পিউটার নির্ভর উৎসকে কাজে লাগিয়ে কেউ যদি যোগাযোগের মাধ্যমকে ভুল ভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করে, কিংবা কোনো ব্যক্তির সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করে, তাহলে তার তিন বছর পর্যন্ত জেল ও জরিমানা হতে পারে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত।
হিন্দির পাশাপাশি তেলেগু ও তামিল ভাষায় মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটি দেখানোর ব্যাপারে হল মালিকদের শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে যে, অন্তত তিন সপ্তাহ অন্য কোনো চলচ্চিত্র চালানো যাবে না। সময় এতটা দীর্ঘ না থাকলেও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান যশ রাজ ফিল্মসের এমন শর্ত ছিল ‘পাঠান’ মুক্তির সময়েও।
এমন বড় বাজেটের মুভির কাছে অন্যান্য আঞ্চলিক সিনেমাগুলো এমনিতেই কোণঠাসা হয়ে থাকে। এরসঙ্গে এমন শর্ত থাকলে ব্যবসা করাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে তুলনামুলক ছোট স্টুডিওগুলোর জন্য।
শুধু নির্দিষ্ট কোনো হল নয়, দেশের প্রতিটি রাজ্যেই হল মালিকদের এমন শর্ত দিয়েছে যশ রাজ। গোটা ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসের কোনো হিন্দি ছবির জন্য এতটা সময় ধরে হল ছেড়ে দেওয়ার নজির এই প্রথম।
বলিউডের অন্যতম প্রভাবশালী ও সফল প্রযোজনা সংস্থার এমন অযৌক্তিক নির্দেশিকা ঘিরেই ক্ষুব্ধতা বাড়ছে অন্যান্য প্রযোজক-পরিচালকদের মধ্যে।‘টাইগার থ্রি’ নিয়ে এত বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও এতটুকু ঘাটতি পড়েনি সিনেমাটির প্রত্যাশা ও জনপ্রিয়তায়। মুক্তির আগেই অগ্রিম টিকিট বাবদ এর আয় হয়েছে ১৩ কোটি রুপি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৭ দশমিক দুই কোটি টাকা।
এ ছাড়া মুম্বাই ওয়ার্ল্ড স্ক্রিনিং থেকে সিনেমার সালমান আর শাহরুখের অংশের মোবাইল ফোন রেকর্ড সামাজিক মাধ্যমে ফাঁস হয়ে যায়। এমনকি পরবর্তীতে হৃত্বিকের দৃশ্য ধারণ করেও আরেকটি স্পয়লার ছড়ানো হয় অনলাইন জুড়ে। এতে প্রচারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার চেয়ে দর্শকদের আগ্রহ উল্টো আরও বেড়ে গেছে দ্বিগুণ পরিমাণে।