হঠাৎ কিডনি বিকলের চিকিৎসা কী?
একিউট রেনাল ইনজুরি বা হঠাৎ কিডনি বিকল বিভিন্ন কারণে হয়। তবে সঠিক সময় চিকিৎসা নিলে এ রোগ নিরাময় করা সম্ভব। আজ ২৪ আগস্ট এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৩০তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের কিডনি রোগ বিভাগের চিফ কনসালটেন্ট অধ্যাপক ডা. এম এ সামাদ।
প্রশ্ন : কিডনি বিকল হয়ে যাওয়াকে আপনারা দুই ভাগে ভাগ করে থাকেন। একিউট এবং ক্রনিক। একিউট রেনাল ফেইলিউর আগে বলা হতো, এখন একে বলা হয় একিউট ইনজুরি। আসলে এই একিউট এবং ক্রনিক বিষয়টি কী?urgentPhoto
উত্তর : কিডনির যে কার্যকারিতা আছে সেটা হঠাৎ করেই যদি লোপ পায় অথবা কমে যায় এবং সেটা ঘণ্টা থেকে শুরু করে কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহের মধ্যে হয়, একে একিউট কিডনি ইনজুরি বলে। আগে বলা হতো কিডনি বিকল বা কিডনি ফেইলিউর। কিন্তু ফেইলউর শুনলেই তো মনে একটা ভীতির সঞ্চার হয়। সে জন্য এখন একে বলা হয় একিউট কিডনি ইনজুরি। আর ক্রনিক যেটা সেটা হলো, এমন কতগুলো কারণ আছে যে কারণে কিডনির কার্যকারিতা ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে। এটি লোপ পেতে পেতে কখনো কখনো মাসের পর মাস বা যুগ লেগে যায়। প্রক্রিয়াটি দীর্ঘমেয়াদি সে জন্য এটা ক্রনিক। তবে একটা পার্থক্য আছে-একটা স্বল্প সময়ে হয়, আরেকটি দীর্ঘ সময়ে হয়। এটা যদি হঠাৎ করে হয়, তবে যদি সঠিক চিকিৎসা দেওয়া হয় তখন দেখা যায় প্রায় ৮০ থেকে ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে কারণ ভেদে সম্পূর্ণ নিরাময় হয়ে যেতে পারে। তবে যদি কোনো কারণে চিকিৎসা করার পরও রোগ দেখা যায়, তিন মাসের মধ্যে এটা ভালো হলো না, তখন সেটা আবার ক্রনিকে চলে যায়। একিউট কিডনি ফেলিউর দীর্ঘমেয়াদি কিডনি বিকলের দিকে যেতে পারে। তবে সেটা খুব অল্প পরিমাণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যদি সঠিকভাবে চিকিৎসা করা যায়, তবে আকস্মিক কিডনি বিকল সম্পূর্ণ নিরাময় হয়ে যেতে পারে। আর ক্রনিক কিডনি বিকল যদি একবার হয়ে যায়, সেটা নিরাময় হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে যেহেতু এটা ধীরে ধীরে খারাপের দিকে যায়, তাহলে যে গতিতে কিডনি খারাপ হচ্ছে সেটা কমানো সম্ভব। অনেক সময় চার নম্বর ধাপ থেকে তিন অথবা দুই নম্বর ধাপে ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। কিন্তু পুরোপুরি ভালো করা যায় না।
প্রশ্ন : হঠাৎ একজন মানুষের কিডনি বিকল হওয়ার ঘটনা ঘটে কেন?
উত্তর : কিডনিতে প্রতিনিয়ত রক্ত পরিবাহিত হচ্ছে। এর জন্য একটা রক্তচাপের প্রয়োজন পড়ে। কোনো কারণে যদি দেখা যায় এই রক্তচাপ কমে গেল, এই সমস্যা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শরীরে যদি পানিশূন্যতা হয় বা কমে যায়, তখন এই সমস্যা হয়। আমাদের দেশের প্রচলিত কারণ ডায়রিয়া, বমি। এরপরেই যেটা আসে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় যে রক্তক্ষরণ হয় অথবা প্রসবের সময় মায়েদের যে রক্তক্ষরণ হয়, সেগুলোর কারণে এই সমস্যা হতে পারে। এ ছাড়া আরো কারণ আছে। যেমন, প্যানক্রিয়াটাইটিস অর্থাৎ পেটের যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আছে সেগুলোতে কোনো সমস্যা হলে এমন হতে পারে। আবার দেখা যায়, অনেক সময় ডেঙ্গু হচ্ছে বা মারাত্মক যদি কোনো জ্বর হয়। এই জ্বরের সময় যদি দেখা গেল তার যতটুকু পানি খাওয়া উচিত, ততটুকু খেতে পারছে না। পাশাপাশি বমি হচ্ছে। তাহলে তার পানিশূন্যতা দেখা দেয়। সেই কারণেও তার একিউট কিডনি ইনজুরি হতে পারে। তা ছাড়া যেকোনো মারাত্মক সংক্রমণ যদি শরীরে হয় যেটিকে সেপটিসিমিয়া বলে, এ রকম হলে এই অবস্থায় হঠাৎ করে রক্তচাপ কমে যায়, তখন এই সমস্যা হতে পারে। আবার কারো হার্ট অ্যাটাক হয়ে রক্তচাপ কমে যায়, কারো লিভারের রোগ হয়ে রক্তচাপ কমে যায়- এসব কারণেও এই সমস্যা হতে পারে। আরো কিছু কারণ রয়েছে। যেগুলো কিডনির নিজস্ব রোগ, যেমন, যখন মুখ ফুলে যায়, প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায় সে কারণে হতে পারে। অনেক সময় ব্যথার ওষুধ বা অ্যান্টিবায়োটিকের কারণেও অনেক ক্ষেত্রে আকস্মিক কিডনি বিকল হতে পারে। আবার প্রস্রাবের নালিতে বা কিডনির ভেতর যে নালি আসছে সেখানে যদি পাথর হয় বা টিউমার হলে তাহলেও আকস্মিক কিডনি বিকল হতে পারে। আবার ভেজাল খাবারের জন্য অনেক ক্ষেত্রে হঠাৎ কিডনি বিকল হতে পারে।
প্রশ্ন : কী ধরনের ভেজাল খাবারে আকস্মিক কিডনি বিকল হতে পারে?
উত্তর : যেমন বিভিন্ন সবজি, মাছে ফরমালিন দেওয়া হচ্ছে। এই ফরমালিনের কারণে এমন হতে পারে। কার্বাইট দিয়ে ফল পাকানো হয়, এতে আকস্মিক কিডনি বিকল হতে পারে। আর দীর্ঘদিন এটা ব্যবহার করতে থাকলে আকস্মিক থেকে ক্রনিকে চলে যেতে পারে।
প্রশ্ন : কী ধরনের সমস্যা দেখলে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। আমি যে কারণগুলো বললাম সেগুলো চোখে পড়ার মতো। যদি দেখা যায় এ রকম কারণগুলো আছে তার সঙ্গে প্রস্রাবের পরিমাণটা কমে যাচ্ছে এবং সারা দিনে যেখানে তার এক থেকে দেড় লিটার প্রস্রাব হওয়ার কথা, যে প্রস্রাবের রং পানির মতো হওয়ার কথা সেগুলো না হয়ে তার পরিমাণ একদমই কমে গেল অথবা শিশুদের ডায়রিয়া হওয়ার পর দেখা গেল ছয় ঘণ্টার মধ্যেও প্রস্রাব হচ্ছে না, হলেও অন্য দিনের তুলনায় খুবই সামান্য তখনই ধারণা করতে হবে সে আকস্মিক কিডনি বিকলের দিকে চলে যাচ্ছে। তখনো অন্য কোনো উপসর্গ তখন দেখা দেয় না। কিন্তু যখন এই প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়, দেখা যায় যে একদিন-দুদিন চলে গেছে তখন প্রস্রাবের মাধ্যমে যে বিষাক্ত পদার্থগুলো বেরিয়ে যায়, তখন রক্তের মধ্যে ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন, পটাশিয়াম, এসিড এগুলো জমতে থাকে। তখন তার খাওয়ার রুচি কমে যায়, বমি বমি ভাব হয়। অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। প্রচুর পানি পিপাসা পেতে পারে। আবার দেখা যায়, প্রস্রাব হচ্ছেই না। তখন মনে করছে বেশি করে পানি খাই, স্যালাইন দিই- এই বেশি করে পানি পানের জন্য শরীরে তখন পানি জমে যেতে পারে। তখন হাত-মুখ-শরীর ফুলে যেতে পারে এবং শ্বাসকষ্ট শুরু হতে পারে। সাধারণত এ ধরনের লক্ষণ নিয়েই রোগী আমাদের কাছে আসে।
প্রশ্ন : হঠাৎ কিডনি বিকলের বেলায় চিকিৎসা কী?
উত্তর : যখন বলা হয় কিডনি বিকল হয়েছে, তখন আতঙ্ক কাজ করে। কিন্তু হঠাৎ কিডনি বিকল হওয়ার বেলায় যদি সময়মতো চিকিৎসা নেওয়া যায়, তাহলে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় হয়ে যেতে পারে। কাজেই চিকিৎসা মানে ডায়ালাইসিস নয়। প্রথমে যে কারণে সমস্যাটি হয়েছে, তার চিকিৎসা করতে হবে। কারণগুলোর চিকিৎসা করার পর সাহায্যকারী চিকিৎসা দিতে হবে। নেফ্রোলোজিস্টের কাছে গিয়ে পানির ঘাটতি হলে সেটা পূরণ করতে হবে, রক্তচাপ কমে গেলে বাড়ানোর ওষুধ দিতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটা ভালো হয়ে যায়।