বন্যায় রোগবালাই ও স্বাস্থ্যবিধি
বন্যার সময় পানিতে ডুবে ও সাপের কামড়ে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যায়। বিশুদ্ধ পানির অভাব, মলমূত্র ও রাসায়নিকের কারণে কলেরা, ডায়রিয়া ইত্যাদি রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। অনেক মানুষ একসঙ্গে থাকার কারণে শ্বাসনালির প্রদাহ, ফ্লু, হাঁপানি, স্ক্যাবিস, ফুসকুড়ি ও ফোড়া ইত্যাদি দেখা দেয়। মশাবাহিত রোগ যেমন ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া বেশি হয়।
তবে বন্যা-পরবর্তী সময়েও নানা সংক্রামক ও অসংক্রামক ব্যাধির শিকার হয় মানুষ। বন্যার্ত মানুষকে মানবিক সাহায্য দেওয়ার সময় এদিকেও নজর দেওয়া জরুরি। বন্যাকবলিত এলাকার ৪০ শতাংশ মৃত্যুর কারণ বন্যা-পরবর্তী ডায়রিয়াজনিত রোগ। তাই বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা সবচেয়ে জরুরি বিষয়। বন্যাকবলিত এলাকায় পানি বিশুদ্ধকরণ বড়ি, স্যালাইন লাগবে প্রচুর। এ ছাড়া জন্ডিস, টাইফয়েড-জাতীয় পানিবাহিত রোগের কথাও মাথায় রাখতে হবে। চাই যথেষ্ট অ্যান্টিবায়োটিকের সরবরাহ। শিশুরা নিউমোনিয়া, শ্বাসনালির প্রদাহ, কনজাংটিভাইটিস, মেনিনজাইটিস, ত্বকে ছত্রাক সংক্রমণে বেশি ভুগতে পারে। প্রাক্-দুর্যোগ ভ্যাকসিন প্রদান, সঠিক সময়ে অ্যান্টিবায়োটিক, পরিচ্ছন্নতা বোধ, সঠিক পুষ্টি, নিরাপদ খাবার এই রোগগুলোকে প্রতিহত করতে পারে। ত্রাণ হিসেবে শুকনো, টিনজাত বা প্যাকেটজাত খাবার ভালো, কিন্তু যথেষ্ট পুষ্টিমান বা ক্যালরির বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় শিশুরা দ্রুত অপুষ্টি, আমিষের অভাবে আক্রান্ত হবে, রোগবালাই বাড়বে।
বন্যার পানি ওঠার পর এবং পানি নেমে যাওয়ার পর পানিবাহিত বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়। বিশেষ করে বিশুদ্ধ পানির অভাবে পানিবাহিত রোগ যেমন- ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, টাইফয়েড, পেটের পীড়া, কৃমির সংক্রমণ, চর্মরোগ রোগ এবং চোখের রোগ বৃদ্ধি পায়। এজন্য মানুষের স্বাস্থ্য সচেতন থাকা খুবই প্রয়োজন। বন্যা পরবর্তী পানিবাহিত যেসব রোগ হতে পারে এবং এসব রোগের সতর্কতায় কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, তা সংক্ষিপ্তভাবে নিচে আলোচনা করা হলো।
বন্যা এবং বন্যা পরবর্তী সময়ের রোগের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহতা দেখা দেয় ডায়ারিয়া নিয়ে। ছোট-বড় সবার ডায়ারিয়া হতে পারে। ছোট্ট শিশুরা ডায়ারিয়ায় বেশি ভোগে। এটি মূলত পানিবাহিত রোগ। খাবারের মাধ্যমে এ জীবাণু শরীরে প্রবেশ করে। বন্যার সময় দূষিত পানি পান করা হয় বলে ডায়রিয়া বেশি হয়।
ডায়রিয়া প্রতিরোধে সচেতন হতে বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। পানির কারণেই ডায়রিয়া রোগ হয়। তাই বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করতে হবে। দুর্যোগের সময় বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করা না গেলে বিশুদ্ধ করার উপকরণ ব্যবহার করতে হবে।
এ ছাড়া সাবান, পরিষ্কার পানির পাত্র সংগ্রহে রাখতে হবে। টিউবওয়েলের পানি পাওয়া না গেলে বিভিন্ন জলাশয়ের পানি ফুটিয়ে পান করা যাবে। পানি ফুটিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দিলে জীবাণু মরে যায়। এরপর উপরের পানি তুলে পান করা যাবে।
পানি ফুটানো ছাড়াও ফিটকিরি অথবা ব্লিচিং পাউডার মিশিয়ে বিশুদ্ধ করে নেওয়া যেতে পারে। ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে শরীর থেকে লবণ ও পানি বের হয়ে যায়। তখনই মৃত্যুর শঙ্কা বাড়ে। তাই ডায়ারিয়া হলে স্যালাইন, ভাতের মাড় খাওয়া যেতে পারে।
তাছাড়া চিড়ার পানি, ডাবের পানি, গুড়ের শরবত দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়াও রোগীকে খাবারের আগে ও পরে এবং টয়লেট থেকে ফেরার পর সাবান বা ছাই দিয়ে দুই হাত ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। শিশুরা বন্যা পরবর্তী সময়ে পুষ্টিহীনতায় ভোগে। তাদের শরীরে ভিটামিনের অভাব দেখা দেয়।
পর্যাপ্ত খাবার না পেয়ে তারা দুর্বল হয়ে যেতে পারে। ফলে নানা রোগে শিশুরা আক্রান্ত হয়। তাই শিশুদের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে। বিভিন্ন ত্রাণ সামগ্রী শিশুদের খাবার আলাদা করে রাখতে হবে। শিশুরা দুর্বল অনুভব করলে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
বন্যার পানিতে অনেক দূষিত উপাদান থাকে। তাই এই সময় চর্মরোগও প্রকোপ আকার ধারণ করে। পানিবাহিত চর্মরোগগুলোর যথাযথ চিকিৎসা নিতে হবে। যতটা সম্ভব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে। বন্যা পরবর্তী সময়ে শিশুদের নিউমোনিয়া হতে পারে। এটি ফুসফুসের প্রদাহজনিত একটি রোগ। এছাড়াও ঠান্ডাজনিত বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়।
দীর্ঘায়িত বৃষ্টিপাত এবং বন্যার পানিতে মশার উপদ্রব বেড়ে যায়। তাই এসব অঞ্চলে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগেরও শঙ্কা বাড়ে। তাছাড়া বন্যপ্রাণী, ইঁদুর ইত্যাদির জন্য লেপটোপিরোসিস ও অন্যান্য রোগের সংক্রমণের ঝুঁকিও বাড়ে।
বানভাসি মানুষের মধ্যে ফাংগাস এবং অন্যান্য জীবাণুগুলোর অত্যাধিক সংমিশ্রণ হতে পারে। যার ফলে অ্যালার্জি এবং হাঁপানিতে আক্রান্ত রোগীরা বিপাকে পড়ে। শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ বেড়ে যায়। তাই এই সময় শিশু, প্রবীণ এবং গর্ভবতী নারীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে।
এ ছাড়াও বন্যার পানিতে সাপের উপদ্রবও বেড়ে যায়। সাপ শুকনো জায়গার সন্ধান করে এবং বাড়ির ভেতরে ঢুকে যায়। তাই এই সময় সাপের কামড়ের ভয়ও থাকে। বন্যার সময়কালীন যত মৃত্যু হয় তার মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে আছে সাপেকাটা।
বন্যার সময় সাপ তাদের আবাস হারিয়ে শুকনো স্থানে মানুষের সঙ্গে অবস্থান নেয়। এজন্য সাপে কাটার পরিমাণ বেড়ে যায়। বিষহীন সাপে কাটলে ভয়ের কিছু নেই তবে বিষধর সাপে কাটলে রোগীকে বাড়িতে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে হাসপাতালে নিতে হবে।
যদি সাপে কাটা স্থানে দুটি বা একটি চিহ্ন দেখা যায় সেই সঙ্গে সাপে কাটা স্থানে তীব্র ব্যথা বা জ্বালা করা, স্থানটি ফুলে লাল হওয়া, ঘুম ঘুম ভাব, মাথাব্যথা ও মাথা ঝিম ঝিম করা, বমি বমি ভাব ও বমি হওয়া, রক্ত বমি, দুর্বলতা, একটি জিনিস দুটি দেখা, শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে বুঝতে হবে বিষধর সাপে কেটেছে।
কিন্তু যদি ছোট ছোট অস্পষ্টভাবে অনেকগুলো দাঁতের চিহ্ন দেখা যায় তাহলে বুঝতে হবে সাপটি বিষহীন। প্রথমে সাপে কাটা রোগীকে বোঝাতে হবে ভয়ের কিছু নেই। সেই সঙ্গে সাহস জোগাতে হবে। রোগীকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য ব্যবস্থা করার সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দিতে হবে।
রোগীকে শুইয়ে দিয়ে যে অঙ্গে সাপ দংশন করেছে সে অঙ্গটি নড়াচড়া সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিতে হবে। হাড় ভেঙে গেলে যেভাবে বাঁশের কঞ্চি বা সোজা লাঠি দিয়ে ব্যান্ডেজ করা হয় সেভাবে বাঁধুন। হাত-পায়ে দংশনের স্থানে একটি মোটা কাপড় বা গামছা দিয়ে পুরো হাত-পা পেঁচিয়ে দিন বা দংশিত স্থানের ওপরে খুব শক্ত না হয় এমন করে গিট দিন।
অসংখ্য শক্ত গিট দেবেন না। এতে করে দংশিত অঙ্গে পচন ধরতে পারে। দংশিত স্থান ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে পরিষ্কার ব্যান্ডেজ বা কাপড় দিয়ে আবৃত করে রাখুন। দংশিত স্থানের আশপাশে কাটাকাটি করবেন না, সুই ফোটাবেন না, রক্ত চুষে বের করবেন না, বিভিন্ন গাছ লতাপাতার রস, গোবর লাগাবেন না।
যদি কথা বলতে বা গিলতে সমস্যা দেখা দেয় তবে কোনো কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করবেন না। ওঁঝা-বৈদ্যের কাছে সময় নষ্ট না করে রোগীকে হাসপাতালে দ্রুত স্থানান্তর করুন। হাসপাতালে রোগীকে অ্যান্টিভেনাম, টিটেনাস প্রতিষেধক দিতে হবে।
বন্যার সুদূরপ্রসারী কিছু প্রভাব আছে। ডায়াবেটিস ও রক্তচাপের রোগীর শর্করা ও রক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। সাধারণ দৈনন্দিন ওষুধ ও মেডিকেল সার্ভিসের ব্যাঘাত ঘটার কারণে হয় এটা। নানা ধরনের মানসিক সমস্যা, যেমন দুঃস্বপ্ন, নিদ্রাহীনতা, ক্ষুধামান্দ্য বেড়ে যায়।
লেখক : ডা. মো. কামরুজ্জামান, কামরুল সহযোগী অধ্যাপক পালমোনোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইন্সটিটিউট।