অ্যাজমা বা হাঁপানির কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধের উপায়
বৃষ্টির মৌসুমে বাতাসে আর্দ্রতা বাড়ায় মোল্ডসহ বিভিন্ন ধরনের ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়া জাতীয় অণুজীবের বংশবিস্তার ঘটে। ফলে স্যাঁতসেঁতে দূষিত বাতাস শ্বাসকষ্টজনিত স্বাস্থ্য জটিলতাগুলোকে আরও গুরুতর করে তোলে। এরমধ্যে যেকোনো বয়সের মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে রোগটি দেখা যায় সেটি হচ্ছে অ্যাজমা। মূলত এই রোগের কোনো প্রতিকার নেই, তবে এর লক্ষণগুলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। চলুন, অ্যাজমা রোগের কারণ, লক্ষণ, ও প্রতিরোধের উপায়গুলো সম্বন্ধে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
অ্যাজমা কি
ফুসফুসে বাতাস চলাচলের জন্য নির্ধারিত শ্বাসনালীগুলোতে দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহজনিত রোগ অ্যাজমা বা হাঁপানি। এটি কোনো সংক্রামক ব্যাধি নয়, তবে হৃদরোগ বা ক্যান্সারের মতো বিশ্বের মারাত্মক ব্যাধিগুলোর একটি।
শ্বাসযন্ত্রের নিম্নদেশের শ্বাসনালীগুলো ব্রঙ্কি নামে পরিচিত। এগুলোর ছোট ছোট শাখাগুলোকে বলা হয় ব্রঙ্কিওল্স। হাঁপানির সময় বিশেষত এই ব্রঙ্কি এবং ব্রঙ্কিওল্সে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ ঘটে, যার ফলে পার্শ্ববর্তী মসৃণ পেশীগুলো সংকুচিত হতে থাকে। এভাবে সংকোচনের পুনরাবৃত্তির ফলে নালীগুলো ফুসফুসে বাতাস পরিবহনের অযোগ্য হয়ে পড়ে। এরই চূড়ান্ত পরিণতি হচ্ছে অ্যাজমা।
অ্যাজমা বা হাঁপানির কারণ
মূলত পরিবেশ, বংশগতি ও নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন তীব্রতার অ্যাজমা সৃষ্টি হয়ে থাকে। এই তীব্রতা রোগের উপসর্গ ও চিকিৎসা উভয়কেই প্রভাবিত করে। জিনগত প্রভাবের কারণে ১২ বছর বয়সের আগে হাঁপানি শুরু হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অপরদিকে, ১২ বছর বয়সের পরে এই ব্যাধি হওয়ার পেছনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দায়ী থাকে পরিবেশগত প্রভাব।
পরিবেশগত কারণ
এখানে মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করে অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী পদার্থ বা অ্যালার্জেন এবং বায়ু দূষণসহ অন্যান্য পরিবেশগত রাসায়নিক উপাদান। অ্যাজ্মাজেন নামে পরিচিত পদার্থগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যামোনিয়া, ল্যাটেক্স, ফর্মাল্ডিহাইড, গ্লুটারাল্ডিহাইড ও অ্যানহাইড্রাইড্স। এছাড়াও রয়েছে কীটনাশক, ঝালাই ও ঢালাই থেকে উৎপন্ন ধোঁয়া, ধাতু বা কাঠের ধূলিকণা, যানবাহন মেরামতে ব্যবহৃত আইসোসায়ানেট স্প্রে, আঠা, রঞ্জক, ধাতব কাজ করা তরল, তেল, ও ছাঁচ।
কোনো ধূমপায়ীর ধোঁয়া তার আশেপাশে থাকা গর্ভবতী নারীর হাঁপানির কারণ হতে পারে। ট্র্যাফিক দূষণ বা উচ্চ ওজোন স্তর নিম্নমানের বাতাসের জন্য দায়ী। এমন পরিবেশে তীব্র অ্যাজমার ঝুঁকির মধ্যে থাকে এখানে বসবাসরত শিশুরা।
গৃহস্থালি বিভিন্ন উদ্বায়ী জৈব যৌগের সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে ঘরের শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্ক উভয়েরই অ্যাজমা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ফর্মাল্ডিহাইড, প্লাস্টিকের সিন্থেটিক পলিমার হিসেবে প্রস্তুতকৃত পলিভিনাইল ক্লোরাইড বা পিভিসি।
সাধারণ গৃহস্থালি অ্যালার্জেনগুলো হলো ধুলিকণা, তেলাপোকা, পশুর পশম বা পাখির পালকের অংশ ও ছাঁচ। এছাড়া রেসপিরেটরি সিন্সিশিয়াল ভাইরাস এবং রাইনোভাইরাসের মতো শ্বাসযন্ত্রের কিছু সাধারণ ভাইরাল সংক্রমণ রয়েছে। এগুলো ছোট বাচ্চাদের অ্যাজমা হওয়ার ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
বংশগতি-সংক্রান্ত কারণ
জিনগত বৈশিষ্ট্য জীবদ্দশায় যে কোনো সময় অ্যাজমার দিকে পরিচালিত করতে পারে। যমজ সন্তানদের একজনের এই রোগ হলে, অপরজনেরও এতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ২৫ শতাংশ।
কিছু জিনগত বৈচিত্র্য শুধুমাত্র তখনই হাঁপানির কারণ হতে পারে, যখন সেগুলো নির্দিষ্ট পরিবেশগত অ্যালার্জেনের সান্নিধ্যে আসে। এর সবচেয়ে উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হলো এন্ডোটক্সিন ব্যাকটেরিয়া। এর সম্ভাব্য উৎস হলো তামাকের ধোঁয়া, কুকুর-বিড়াল, এবং গৃহপালিত পশুপাখির খামারসহ।
স্বাস্থ্যগত অবস্থা
অ্যাটোপিক এক্সিমা, অ্যালার্জিক রাইনাইটিস এবং অ্যাজমা- এই তিনের সমন্বিত ব্যাধিকে বলা হয় অ্যাটোপি। হাঁপানি হওয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী ঝুঁকির কারণ হলো অ্যাটোপিক রোগের ইতিহাস। যাদের এক্সিমা বা হে ফিভার আছে তাদের মধ্যে হাঁপানি অনেক বেশি হারে দেখা দেয়। চর্বি জমা হওয়ার কারণে শ্বাসযন্ত্রের কার্যকারিতা কমে যাওয়ায় ফলে শ্বাসকষ্টের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়।
অ্যারিথমিয়া বা অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ন্ত্রণে বেশ কার্যকরী একটি ওষুধ ক্যাটাগরি বিটা ব্লকার। মূলত প্রথম হার্ট অ্যাটাকের পরে দ্বিতীয় অ্যাটাক থেকে হার্টকে রক্ষা করতে এগুলো ব্যবহৃত হয়। এগুলোর মধ্যে বিশেষ করে প্রোপ্রানোলল সেবনকারী রোগীদের হাঁপানি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। এছাড়া অন্যান্য হাঁপানি সৃষ্টিকারী ওষুধগুলোর মধ্যে সর্বাধিক পরিচিত হলো অ্যাস্পিরিন। গর্ভাবস্থায় অ্যাসিড-প্রতিরোধী ওষুধ ব্যবহারের ফলে পরবর্তীতে শিশুর শ্বাসকষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
অ্যাজমা রোগের লক্ষণসমূহ
প্রাথমিক পর্যায়ে ঘন ঘন নিশ্বাস টানা, শ্বাসকষ্ট, বুকে চাপ অনুভব করা এবং ঘন ঘন কাশি হয়। ব্রঙ্কি থেকে উৎপন্ন কাশিতে শ্লেষ্মা থাকতে পারে, যা বের করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য। শ্বেত রক্তকণিকার উচ্চমাত্রার কারণে হাঁপানির আক্রমণের প্রতিরোধ করার সময় পুঁজের সৃষ্টি হতে পারে। সংক্রমণের সময় প্রদাহের জায়গায় তৈরি হওয়া সাদা-হলুদ, হলুদ বা হলদে-বাদামী বর্ণের এই পুঁজকে ইওসিনোফিল্স বলা হয়। সাধারণত রাতে এবং ভোরে ব্যায়াম করা বা ঠান্ডা বাতাসের প্রতিক্রিয়ায় লক্ষণগুলোর অতি মাত্রায় বিকাশ ঘটে।
অ্যাজমার ধারাবাহিকতায় গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্ল্যাক্স ডিজিজ বা জিইআরডি, রাইনোসাইনুসাইটিস ও অবস্ট্রাকটিভ স্লিপ অ্যাপ্নিয়ার মতো ব্যাধিগুলো দেখা দিতে পারে। অধিকাংশ রোগীদের ক্যাভিটি দেখা যায়। এছাড়া এ সময় বিভিন্ন ধরনের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধির মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যেরও বিপর্যয় ঘটে। হাঁপানির রেশ ধরে পরবর্তীতে হৃদরোগ ও ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ বা সিওপিডি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
হাঁপানি প্রতিরোধে করণীয়
অ্যাজমার কোনো প্রতিকার নেই, তাই এই ব্যাধির আক্রমণ এড়াতে এর কারণগুলোর দিকে খেয়াল রাখতে হবে। সেগুলো থেকে যথাসম্ভব নিজেকে দূরে রাখার মাধ্যমেই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হতে পারে। এক্ষেত্রে খাদ্যাভ্যাসে সতর্কতাসহ পরিবর্তন আনতে হবে নিয়মিত জীবনধারণে।
কোন খাবারগুলো খাওয়া উচিত
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন সি এবং ই-এর মধ্যে রয়েছে প্রদাহ-বিরোধী বা অ্যান্টি-অ্যালার্জিক প্রভাব। শরীরে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি প্রবেশ করলে তা হাঁপানির বিরুদ্ধে অনাক্রম্য হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া সেলেনিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়ামের মতো খনিজ উপাদান অ্যাজমার গুরুতর লক্ষণগুলো কমাতে সাহায্য করে। বিশেষ করে শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ সেলেনিয়াম অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে।
ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে রয়েছে মরিচ, কমলা, স্ট্রবেরি, ফুলকপি ও আপেল। ভিটামিন ই-র জন্য খাওয়া যেতে পারে সূর্যমুখী বীজ, বাদাম, হ্যাজেলনাট তেল ও চিনাবাদাম। ভিটামিন এ ও বিটা ক্যারোটিনসমৃদ্ধ খাবারগুলো হলো গাজর, মিষ্টি আলু, লেটুস শাক, বাধাকপি ও পালং শাক। ভোরের টাটকা সূর্যালোক ছাড়াও ভিটামিন ডি পাওয়া যেতে পারে সামুদ্রিক মাছের তেল, দুধ, কমলার রস ও ডিমে। তবে দুধ বা ডিমে অ্যালার্জি থাকলে তা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। খনিজ পুষ্টির মধ্যে সেলেনিয়ামযুক্ত খাবারের তালিকায় আছে মাছ, মুরগির মাংস, গরুর মাংস, টার্কি, বাদামি চাল ও কলা। অপরদিকে, ডার্ক চকলেট, কুমড়া বীজ ও সামুদ্রিক মাছ ম্যাগনেসিয়ামের আদর্শ উৎস।
কোন কোন খাবার খাওয়া যাবে না
সালফাইটের মতো প্রিজারভেটিভগুলো হাঁপানির অবস্থায় আরও অবনতি ঘটাতে পারে। এই প্রিজারভেটিভ যেসব খাবারে থাকে, সেগুলো হলো শুকনো ফল, আচারযুক্ত খাবার, চিংড়ি ও লেবুর রস। গ্যাস সৃষ্টিকারী ভারী খাবার ডায়াফ্রামের ওপর চাপ বাড়ায়, বিশেষ করে যাদের অ্যাসিডিটি রয়েছে। এর ফলে বুকে প্রচণ্ড চাপ অনুভূত হয়, যা হাঁপানি প্রধান উপসর্গগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ ধরনের খাবারগুলো হলো মটরশুঁটি, কার্বনেটেড পানীয়, পেঁয়াজ, রসুন ও ভাজাপোড়া খাবার।
প্রিজারভেটিভ, কৃত্রিম স্বাদ ও রঙ প্রায়ই প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং ফাস্ট ফুডে পাওয়া যায়। অ্যাজমা আক্রান্ত রোগীদের এই কৃত্রিম উপাদানগুলোর প্রতি অ্যালার্জি থাকতে পারে।
অভ্যাসগত পরিবর্তন
সর্বপ্রথম দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় সঠিক ফল ও শাকসবজি রাখার মাধ্যমে একটি সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। তারপরেই গুরুত্ব দিতে হবে পরিমিত পরিমাণে শরীরচর্চার প্রতি। যোগব্যায়াম অ্যাজমার জটিলতা উপশমে যথেষ্ট উপযোগী।
হাঁপানিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের উদ্বেগ, মানসিক চাপ ও বিষণ্নতার হার বেশি থাকে। এক্ষেত্রে মানসিক অবস্থা উন্নয়নের জন্য প্রতিদিন হালকা শরীর চর্চার পাশাপাশি কার্যকর হতে পারে মেডিটেশন।
যাদের ধূমপান ও অ্যালকোহলের প্রতি আসক্তি রয়েছে, তাদের অ্যাজমার ঝুঁকি এড়াতে এই আসক্তি ত্যাগ করা অপরিহার্য। কেননা এগুলোর নেতিবাচক প্রভাবগুলো কাজ করে সরাসরি ফুসফুসকে ঘিরে। আর শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানির উৎপত্তিস্থল হচ্ছে ফুসফুস।
দেহ ও মনের সুস্থা বজায় রাখতে স্বাস্থ্যকর ঘুমের কোনো বিকল্প নেই। এই অভ্যাস গড়ে তুলতে প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যেতে হবে। অতঃপর পর্যাপ্ত ঘুমের পর জেগে ওঠার সময়টিকেও প্রতিদিনই বজায় রাখতে হবে।
অ্যাজমা প্রতিরোধকল্পে এর কারণ ও লক্ষণগুলোর ব্যাপারে সঠিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। বংশগতি সম্পর্কিত বিষয়গুলো আয়ত্ত্বের বাইরে থাকলেও পরিবেশগত কারণগুলো এড়িয়ে চলা সম্ভব। ক্ষতিকর খাবারগুলো বাদ রেখে পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা হাঁপানির বিরুদ্ধে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সেই সাথে দীর্ঘ মেয়াদে সুফল পেতে ধূমপান ত্যাগ, পরিমিত শরীরচর্চা ও পর্যাপ্ত ঘুমের মাধ্যমে একটি সুস্থ জীবনধারা বজায় রাখা জরুরি। উপরন্তু, উপসর্গগুলো গুরুতর অবস্থায় পৌঁছানোর আগেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া আবশ্যক।