আমি মালালা বলছি
বইটির পুরো নাম ‘আমি মালালা : যে মেয়েটি শিক্ষার পক্ষে আন্দোলন করে তালেবানের দ্বারা গুলিবিদ্ধ হয়েছিল’, তবে এই অনুবাদে সেটি বদলে রাখা হয়েছে ‘আমি মালালা বলছি’। বইটি প্রথম প্রকাশ হয় ২০১২ সালের ১ নভেম্বর। মালালা ইউসুফজাইয়ের লেখা বইটির সহলেখক ও সম্পাদক ছিলেন ক্রিস্টিনা ল্যাম্ব। মালালার জীবনকাহিনীনির্ভর বইটির অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করবে এনটিভি অনলাইন। আর এ বিষয়ে এরই মধ্যে অনুমতি চাওয়া হয়েছে মালালা ইউসুফজাইয়ের কাছে। নিচে লেখক, সম্পাদক ও অনুবাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেওয়া হলো।
মালালা ইউসুফজাই
পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকা থেকে আগত শিক্ষা আন্দোলনকর্মী, বিবিসি উর্দুতে তালেবানের অধীনে জীবনযাপনের দিনলিপি লেখার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। গুল মাকাই ছদ্মনামে তিনি নিজের সমাজের নারী অধিকার নিয়ে তাঁর পরিবারের সংগ্রামের কথা লিখতেন।
২০১২ সালের অক্টোবরে তালেবান তাঁকে টার্গেট করে এবং বাসে চড়ে স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে তাঁকে গুলি করে। অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়ার পর তাঁর শিক্ষা আন্দোলন চালিয়ে যান।
মালালা তাঁর সাহস ও শিক্ষার প্রতি সমর্থনের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১১ সালের পাকিস্তান জাতীয় শান্তি পুরস্কার ও ২০১৩ সালের আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৪ সালে মালালা নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। এখনও পর্যন্ত তিনিই সর্বকনিষ্ঠ নোবেল বিজয়ী। টাইম ম্যাগাজিনের বর্ষসেরা ব্যক্তিত্বের সংক্ষিপ্ত তালিকায় তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং তিনি আরো অনেক পুরস্কার অর্জন করেছেন।
সমাজভিত্তিক শিক্ষা কর্মসূচি পরিচালনাকারী অলাভজনক প্রতিষ্ঠান মালালা ফান্ডের মাধ্যমে সারা বিশ্বের শিক্ষায় আগ্রহী ব্যক্তিদের সহায়তার মাধ্যমে মালালা তাঁর শিক্ষা কার্যক্রমকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে সাফল্য অর্জনের পথে অগ্রসর হচ্ছেন।
ক্রিস্টিনা ল্যাম্ব
বিশ্বের প্রথম সারির বিদেশ সংবাদদাতাদের অন্যতম। তিনি ১৯৮৭ সাল থেকেই পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করেন। অক্সফোর্ড ও হার্ভার্ডের প্রাক্তন এই শিক্ষার্থী পাঁচটি বইয়ের রচয়িতা এবং ব্রিটেনের বর্ষসেরা বিদেশ সংবাদদাতা অ্যাওয়ার্ড (পাঁচবার) ও যুদ্ধ সংবাদদাতাদের জন্য ইউরোপের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার প্রিঁ বায়োঁসহ অনেক পুরস্কার অর্জন করেছেন। তিনি বর্তমানে সানডে টাইমসে কর্মরত এবং স্বামী-সন্তানের সঙ্গে লন্ডন ও পর্তুগালে বসবাস করেন।
রোজা শাওয়াল রিজওয়ান (অনুবাদক)
ঢাকার হলিক্রস উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী। নবম শ্রেণিতে পড়াকালে তিনি এ বই অনুবাদে হাত দেন। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখি ও ছবি আঁকার কাজ করে আসছেন এবং বিভিন্ন পুরস্কার লাভ করেছেন। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার শিশুদের পাতায় তাঁর লেখা গল্প, ছড়া ও আঁকা ছবি ছাপা হয়েছে।
শুরুর কথা : আমার পৃথিবী বদলে যাওয়ার দিন
আমি এমন একটা দেশ থেকে এসেছি, যার জন্ম মধ্যরাতে। আর আমি যখন প্রায় মারা যাচ্ছিলাম, তখন সময়টা ঠিক মধ্যাহ্নের পর।
এক বছর আগে আমি স্কুলের উদ্দেশে বাসা থেকে বেরিয়ে আর ফিরতে পারিনি। তালেবানের ছোড়া গুলিতে আমি আহত হয়ে অচেতন অবস্থায় পাকিস্তানের বাইরে চলে আসি। কিছু মানুষ বলে, আমি কখনোই বাড়ি ফিরতে পারব না। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমি পারব। যে দেশকে তুমি ভালোবাসো, সে দেশ থেকে বিছিন্ন হয়ে যাওয়া কোনো আশীর্বাদ নয়।
এখন, প্রতিদিন সকালে চোখ মেলেই আমার জিনিসপত্র, ফ্লোরে ছড়ানো জামাকাপড়, শেলফে রাখা স্কুলের পুরস্কারগুলো দেখতে ইচ্ছা করে। তার পরিবর্তে আমি এখন এমন একটা দেশে আছি, যা আমার মাতৃভূমি পাকিস্তান ও সোয়াত উপত্যকায় আমার বাড়ি থেকে পাঁচ ঘণ্টা পেছনে। কিন্তু এ দেশটা পাঁচ ঘণ্টা পিছিয়ে থাকলে কি হবে, অন্য বিষয়ে এগিয়ে আছে কয়েকশ বছর। সব সুযোগ-সুবিধাই আছে এখানে। চাবি ঘোরালেই ট্যাপ থেকে ইচ্ছামতো গরম অথবা ঠান্ডা পানি ঝরে; দিনে-রাতে সব সময় বোতাম টিপলে বাতি জ্বলে, তেলের কুপির দরকার পড়ে না, রান্না করার চুলা আছে—যেগুলোর জন্য বাজার থেকে গ্যাস সিলিন্ডার কিনতে কাউকে ছুটতে হয় না। এখানে সবকিছু এত আধুনিক যে প্যাকেটে করে তৈরি খাবারও আমরা পেতে পারি। জানালার সামনে দাঁড়ালে দেখতে পাই উঁচু উঁচু ভবন, দীর্ঘ রাস্তাজুড়ে সারিবদ্ধ যানবাহন, পরিচ্ছন্ন সবুজ ঝোপ, উঠান এবং হাঁটার জন্য পরিষ্কার ফুটপাত। মুহূর্তের জন্য চোখ বুজলেই আমি আমার উপত্যকায় ফিরে যাই—উঁচু বরফাচ্ছাদিত পাহাড়চূড়া, সবুজ লিকলিকে ঘাসসমেত মাঠ, প্রাণবন্ত নীল নদী ও সোয়াতের মানুষের দিকে তাকালেই আমার হৃদয় হেসে ওঠে। আমার মন আমাকে আমার স্কুলে ফিরিয়ে নিয়ে যায় এবং সেখানে আমি আমার বন্ধু ও শিক্ষকদের সঙ্গে পুনর্মিলিত হই। আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু মনিবার সঙ্গে দেখা হয় আর আমরা একসঙ্গে বসি, এমনভাবে গল্পে মেতে থাকি যেন আমাদের কখনই কিছু হয়নি।
তখন আমার মনে পড়ে যায়, আমি এখন ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে।
২০১২ সালের ৯ অক্টোবর, সেদিন ছিল মঙ্গলবার, দিনটিতে সবকিছু পাল্টে যায়। তখন পরীক্ষা চলছিল, তাই চিন্তামুক্ত ছিলাম না। তবে পড়ার বাইরে অনেক বই পড়তাম, তাই পরীক্ষা আমার কাছে তেমন ভীতিকর কিছু ছিল না। সেদিন সকালে আমরা অন্যদিনের মতই পাঁচ-ছয়জন ঠাসাঠাসি করে উগ্র ডিজেলের ধোঁয়া ছড়ানো উজ্জ্বল রঙে রঞ্জিত রিকশার মিছিলে করে হাজিবাবা সড়ক থেকে কিছুদূরে সরু কাদাভর্তি গলিটায় পৌঁছালাম। তালেবান আসার পর থেকে আমাদের স্কুলের কোনো বাহ্যিক চিহ্ন ছিল না; কাঠুরিয়ার উঠান পেরিয়ে সাদা দেয়ালের গায়ে কারুকার্যমণ্ডিত পিতলের তোরণটির বাইরে কী ঘটছে, তা ভেতর থেকে বোঝা যেত না।
আমরা মেয়ে বলেই ওই দরজাটা ছিল আমাদের নিজেদের বিশেষ জগতের প্রবেশপথ। লাফিয়ে যেতে যেতে আমরা সূর্যকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য মেঘের মিলিয়ে যাওয়ার মতো করে মাথার আচ্ছাদন খুলে ফেলতাম, এর পর এলোপাতাড়িভাবে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে ওপরে যেতাম। সিঁড়ির চূড়ায় ছিল এক খোলা আঙিনা এবং সব শ্রেণিকক্ষের দরজা। আমরা আমাদের পিঠের ব্যাগগুলো কক্ষে স্তূপাকারে রাখতাম এবং খোলা আকাশের নিচে, পাহাড়ের সামনে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সকালের অ্যাসেম্বলির জন্য জড়ো হতাম। একটি মেয়ে আদেশ দিত, ‘আস্সান বাশ!’ বা ‘আরামে দাঁড়াও!’ এবং আমরা মাটিতে পা ঠুকে সমস্বরে বলতাম, ‘আল্লাহ!’ এর পর সে বলত, ‘হুঁশিয়ার!’ বা ‘সোজা হও!’ এবং আমরা আবারো গোড়ালি ঠুকে সাড়া দিতাম, ‘আল্লাহ!’
আমার জন্মের আগে বাবা এ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, লাল ও সাদা অক্ষরে ‘খুশাল স্কুল’ কথাটি দেয়ালে লেখা ছিল। আমরা সপ্তাহে ছয় দিন স্কুলে যেতাম এবং পনেরো বছর বয়সী একজন মেয়ে হিসেবে নবম শ্রেণিতে আমার দিন কাটত রসায়নের সমীকরণ আবৃত্তি করে বা উর্দু ব্যাকরণ পড়ে; ‘বেশি তাড়াহুড়া করলে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যায়’ এমন শিক্ষামূলক ইংরেজি গল্প লিখে বা রক্তসঞ্চালনের চিত্র এঁকে—আমার বেশিরভাগ সহপাঠীর ইচ্ছাই ডাক্তার হওয়া। এটাকে কেউ হুমকি হিসেবে দেখবে, এমনটা কল্পনা করাই কঠিন। হ্যাঁ, স্কুলের বাইরে শুধু মিঙ্গোরার কোলাহল আর ক্ষ্যাপামিই নেই, শুধু সোয়াতের মূল শহরই নেই, আছে তালেবানও, যারা ভাবে মেয়েদের স্কুলে যাওয়া উচিত নয়।
অন্য যেকোনো দিনের মতোই সে দিনটি শুরু হয়েছিল, যদিও কিছুটা দেরিতে। পরীক্ষার সময় বলে ৮টার পরিবর্তে ৯টায় স্কুল শুরু হতো, যেটা আমার জন্য ভালোই ছিল, কারণ আমি তাড়াতাড়ি উঠতে পছন্দ করি না এবং মোরগের ডাক ও মুয়াজ্জিনের আজানের মাঝেও ঘুমাতে পারি। প্রথমে আমার বাবা আমাকে জাগানোর চেষ্টা করতেন। ‘জাগার সময় হয়েছে, জানিমান,’ তিনি বলতেন। ফার্সিতে এ শব্দের অর্থ ‘আপনজন’ এবং তিনি দিনের শুরুতে আমাকে এ নামেই ডাকতেন। ‘আব্বা, আর কয়েক মিনিট’, আমি অনুরোধ করতাম, তারপর লেপের গভীরে ঢুকে পড়তাম। এরপর মা এসে ডাকতেন, ‘পিশো’। এটা অর্থ ‘বিড়াল’ এবং তিনি আমাকে এটাই ডাকতেন। তখন আমি বুঝতাম আর চিৎকার করে উঠতাম, ‘ভাবি, দেরি হয়ে গেছে!’ আমাদের সংস্কৃতিতে প্রতিটি পুরুষ তোমার ভাই ও প্রতিটি নারী তোমার বোন। এভাবেই আমরা একে অপরকে বিবেচনা করি। যখন বাবা তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে প্রথমবার স্কুলে গেলেন, সব শিক্ষক মাকে বাবার ভাইয়ের স্ত্রী বা ভাবি বলে সম্বোধন করেছিলেন। তখন থেকেই এর শুরু। এখন আমরা সবাই তাঁকে ভাবি ডাকি।
আমাদের বাসার সামনের লম্বা কক্ষটিতে আমি ঘুমাতাম এবং তার একমাত্র আসবাব ছিল একটি বিছানা ও আলমারি, যেটা আমি উপত্যকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রচারাভিযান করার পুরস্কার হিসেবে পাওয়া অর্থ দিয়ে কিনেছিলাম। কয়েকটি তাকে ছিল স্কুলে প্রথম হওয়ার পুরস্কার হিসেবে পাওয়া সোনালি রঙের প্লাস্টিকের কাপ ও ট্রফি। কেবল দুবার আমি শীর্ষে আরোহণ করতে পারিনি—দুবারই আমার নিকটতম প্রতিযোগী মালকা-ই-নূরের কাছে পরাজিত হয়েছি। আমার দৃঢ় সংকল্প ছিল, এমনটি যেন আর কখনো না হয়।
স্কুলটি বাসা থেকে খুব দূরে ছিল না, আমি হেঁতেই যেতাম; কিন্তু গত বছরের শুরু থেকে অন্য মেয়েদের সঙ্গে একটি রিকশায় যেতে শুরু করেছিলাম এবং বাসে করে বাসায় ফিরতাম। মাত্র পাঁচ মিনিটের যাত্রা ছিল। পথে পড়ত দুর্গন্ধযুক্ত জলপ্রবাহ, ড. হুমায়ুনের হেয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট ইনস্টিটিউটের বিশাল বিলবোর্ড। আমাদের এক টাঁকমাথা পুরুষ শিক্ষকের মাথায় হঠাৎ চুল গজানো শুরু করলে আমরা ঠাট্টা করেছিলাম যে তিনি ওই ইনস্টিটিউটে গেছেন। বাসটি আমার পছন্দ ছিল, কারণ হাঁটার সময় আমি যতটা ঘর্মাক্ত হতাম, বাসে ততটা হতাম না এবং এখানে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে পারি, আর গল্প করতে পারি গাড়িচালক উসমান আলি বা উসমান ভাইজানের সঙ্গে। তাঁর আজগুবি গল্প শুনে আমরা সবাই হাসতাম।
আমি বাসে আসা-যাওয়া শুরু করেছিলাম, কারণ আমার একা আসা-যাওয়া নিয়ে মা ভয় পেতেন। সারা বছর আমরা হুমকি পেয়েছিলাম। কোনোটা খবরের কাগজে, কোনোটা মানুষের মাধ্যমে চিরকুটের আকারে। মা আমাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন, কিন্তু তালেবান কখনো কোনো মেয়ের জন্য আসেনি এবং আমি আরো নিশ্চিন্ত ছিলাম যে এরা আমার বাবাকেই লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ধরে নেবে, কারণ তিনি সব সময়ই তাদের বিপক্ষে কথা বলতেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং প্রচারাভিযানের সহযোগী জাহিদ খানকে আগস্ট মাসে নামাজ পড়তে যাওয়ার পথে মুখমণ্ডলে গুলি করা হয়েছিল এবং আমি জানতাম, সবাই আমার বাবাকে বলছে, ‘সাবধানে থেকো, পরবর্তী ব্যক্তি তুমিই।’
আমাদের বাসায় গাড়ি যেতে পারে না, তাই ফেরার সময় আমি জলধারাটির সামনে বাস থেকে নেমে যেতাম এবং লোহার গরাদের গেট দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতাম। আমি ভাবতাম, আমাকে কেউ আক্রমণ করলে এই সিঁড়িগুলোতেই করবে। বাবার মতো আমিও দিবাস্বপ্ন দেখতাম; পড়ার মাঝে আমি প্রায়ই কল্পনা করতাম, একজন সন্ত্রাসী এই সিঁড়িতে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে গুলি করছে। আমি চিন্তা করতাম, আমি কী করব। হয়তো বা আমার জুতাগুলো খুলে তাকে আঘাত করব। কিন্তু এর পর ভাবতাম, এ কাজ করলে আমার আর সন্ত্রাসীর মাঝে তো কোনো পার্থক্য থাকবে না। বরং ভালো হয় আমি যদি অনুরোধ করি, ‘ঠিক আছে, আমাকে গুলি করো, কিন্তু আগে আমার কথা শোনো। তোমরা যা করছ তা ভুল। আমি ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের বিপক্ষে নই, কিন্তু আমি শুধু চাই সব মেয়ে স্কুলে যাক।’
আমি ভীত ছিলাম না, কিন্তু রাতে গেট তালাবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে শুরু করলাম এবং সৃষ্টিকর্তার কাছে জিজ্ঞেস করতে শুরু করলাম, মৃত্যুর পরে কী হয়। আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী মনিবাকে আমি সব বলতাম। ছোট থাকতে আমরা একই পাড়ায় থাকতাম এবং প্রাইমারি স্কুল থেকেই বন্ধু ছিলাম, একে অপরকে সবকিছু বলতাম। জাস্টিন বিবারের গান ও টোয়াইলাইট মুভি এবং সবচেয়ে ভালো রং ফর্সাকারী ক্রিম—সবকিছু। যদিও সে জানত, তার পরিবার অনুমতি দেবে না এবং সবাইকে বলত সে ডাক্তার হতে চায়, তার স্বপ্ন ছিল একজন ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়া। আদৌ কাজ করতে পারলে শিক্ষক অথবা ডাক্তার ছাড়া আমাদের সমাজে মেয়েদের পক্ষে অন্য কিছু হওয়ার চিন্তা করাও কঠিন। আমি ছিলাম অন্যরকম—আমি যখন আমার জীবনের লক্ষ্য ডাক্তার থেকে আবিষ্কারক অথবা রাজনীতিবিদে পাল্টে ফেলেছি, আমি আমার মনের ইচ্ছা লুকাইনি। আমার কোনো সমস্যা হলে মনিবাই সর্বপ্রথম জানত। ‘দুশ্চিন্তা করো না,’ আমি তাকে বলতাম। ‘তালেবান এখনো কোনো ছোট মেয়েকে ধরে নিয়ে যেতে আসেনি।’
স্কুলবাস এলে আমরা সবাই সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নামতাম। অন্য মেয়েরা দরজা দিয়ে বেরোনোর সময় এবং পেছন দিয়ে ওঠার সময় মাথা ঢেকে নিত। বাসটিকে আমরা বলতাম ‘ডাইনা’, যেটা একটা সাদা টয়োটা টাউনএস ট্রাক, যাতে তিনটি সমান্তরাল বেঞ্চ ছিল—দুই পাশে দুটো আর মাঝখানে একটা। বিশজন মেয়ে ও তিনজন শিক্ষকে সারাক্ষণ ঠাসাঠাসি হয়ে থাকত। আমি বসেছিলাম বাঁয়ে, মনিবা এবং এক ক্লাস নিচের শাজিয়া রমজান নামের একটা মেয়ের মাঝে; পরীক্ষার ফোল্ডার আঁকড়ে ধরেছিলাম, স্কুলব্যাগ ছিল পায়ের নিচে।
সবকিছু একটু ঝাপসা। তবে আমার মনে আছে, ডাইনার ভেতরটা ছিল ভ্যাপসা গরম। শীতের দিন আসতে দেরি ছিল, বহুদূরের হিন্দুকুশ পর্বতে জমাট বরফ অবশ্য দেখা যেত। পেছনে আমরা যেখানে বসেছিলাম, এখানে কোনো জানালা ছিল না, ছিল শুধু পাতলা প্লাস্টিকের আবরণ, যা আলগাভাবে ঝুলে ছিল এবং কিছু দেখতে পাওয়ার জন্য খুবই নোংরা ছিল। আমরা পেছন থেকে শুধু টুকরো টুকরো নীল আকাশে সূর্যালোকের ঝিলিক দেখতাম, সূর্যটা যেন ধুলোর ভেতর হলুদ গোলক।
আমার মনে পড়ে, বাসটি মূল সড়ক থেকে ডানে আর্মি চেকপয়েন্টের দিকে বাঁক নিল, অন্যান্য দিনের মতই পরিত্যক্ত ক্রিকেট মাঠটা পেরিয়ে গেল। আমার আর কিছু মনে নেই।
গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্বপ্নটিতে আমি ভেবেছি, আমার বাবাও আমার সঙ্গে বাসে আছেন এবং আমার সঙ্গে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। সবখানে মানুষ এবং আমি আমার বাবাকে খুঁজছি।
বাস্তবে যা ঘটল তা হলো আমরা হঠাৎ থেমে পড়লাম। বাঁয়ে ছিল সোয়াতের প্রথম অর্থমন্ত্রী এবং শাসক শের মোহাম্মদ খানের ঘাসাবৃত সমাধি এবং ডানে নাশতা তৈরির কারখানা। আমরা চেকপয়েন্ট থেকে ২০০ মিটারের কম দূরে ছিলাম।
আমরা সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু হালকা রঙের কাপড় পরিহিত একজন কমবয়সী দাড়িওয়ালা লোক রাস্তার মাঝে নেমে হাত নাড়িয়ে বাস থামিয়ে দিয়েছিল।
‘এটা কি খুশাল স্কুলের বাস?’ সে চালককে প্রশ্ন করল।
উসমান ভাইজানের কাছে এটা একটা অবান্তর প্রশ্ন, কারণ বাসের পাশেই স্কুলের নাম লেখা ছিল। ‘হ্যাঁ,’ তিনি বললেন।
‘কিছু শিক্ষার্থী সম্পর্কে আমার তথ্য প্রয়োজন,’ লোকটি বলল।
‘আপনি বরং অফিসে খোঁজ করুন,’ উসমান ভাইজান বললেন।
সে কথা বলছিল, ওই সময় সাদা কাপড় পরিহিত আরেক ব্যক্তি ভ্যানের পেছনে চলে এলো। মনিবা বলল, ‘দেখ, তোমার সাক্ষাৎকার নিতে একজন সাংবাদিক এসেছেন।’ বাবার সঙ্গে আমি যখন থেকেই মেয়েদের শিক্ষার পক্ষে প্রচারাভিযান শুরু করেছি এবং আমাদের দমিয়ে রাখতে তৎপর তালেবানের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেছি, তখন থেকেই বিদেশি সাংবাদিকরা আসত। যদিও এভাবে রাস্তার মাঝে নয়।
লোকটি চোখা একটা টুপি পরেছিল, নাকে-মুখে এমনভাবে রুমাল বাঁধা ছিল যেন সে ফ্লুতে আক্রান্ত। তাকে কলেজছাত্রের মতো লাগছিল। সে এরপর পেছনের দরজা দিয়ে উঠে এসে আমাদের ওপর ঝুঁকে পড়ল।
‘মালালা কে?’ সে জোর গলায় জানতে চাইল।
কেউ কিছু বলল না, কিন্তু কিছু মেয়ে আমার দিকে তাকাল। আমিই সেখানে একমাত্র মেয়ে, যার চেহারা আবৃত ছিল না।
ঠিক তখনই সে একটি কালো পিস্তল তুলে ধরল। আমি পরে জানতে পেরেছিলাম, সেটা কোল্ট ৪৫। কোনো কোনো মেয়ে আতঙ্কে চিৎকার করেছিল। মনিবা বলেছে, আমি ওর হাত মুচড়ে দিয়েছিলাম।
আমার বন্ধুরা বলে, সে তিনটি গুলি করে, একটার পর একটা। প্রথমটা আমার বাঁ চোখের কোটর দিয়ে ঢুকে বাঁ কাঁধ দিয়ে বেরিয়ে যায়। আমি মনিবার ওপর ধপ করে পড়ে গেলাম, বাঁ কান দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। আমি পড়ে যাওয়ায় অন্য দুটো গুলি আমার পাশের মেয়েগুলোকে আঘাত করে। একটি বুলেট শাজিয়ার বাঁ হাতে লাগে। তৃতীয়টা তার বাঁ কাঁধ এবং কায়নাত রিয়াজের ডান হাতের ওপরের অংশে লাগে।
আমার বন্ধুরা আমাকে বলেছে, বন্দুকধারী আমাকে গুলি করার সময় তার হাত কাঁপছিল।
যতক্ষণে আমরা হাসপাতালে পৌঁছলাম, ততক্ষণে আমার লম্বা চুল এবং মনিবার কোল রক্তে ভরে গেছে।
কে এই মালালা? আমিই মালালা এবং এটাই আমার গল্প।
(চলবে)