আমি মালালা বলছি
একটি কন্যার আবির্ভাব
প্রথম অধ্যায় : তালেবানের আগে
যুদ্ধক্ষেত্রে কাপুরুষতার চেয়ে বরং তোমার গুলিতে ঝাঁঝরা দেহ সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করব। —ঐতিহ্যবাহী পশতু শ্লোক
১
একটি কন্যার আবির্ভাব
আমার জন্মের পর গ্রামের লোকজন আমার মাকে সমবেদনা জানায় এবং কেউই বাবাকে অভিনন্দন জানায়নি। ভোরের শেষ নক্ষত্র ডুবে যাওয়ার পর আমার জন্ম। আমরা পশতুনরা একে শুভ লক্ষণ মনে করি। হাসপাতালে নেওয়া বা দাই রাখার মতো সামর্থ্য বাবার ছিল না, তাই আমাদের এক প্রতিবেশী সে সময় সাহায্য করেছিলেন। আমার বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান মৃত অবস্থায় জন্মগ্রহণ করেছিল, কিন্তু আমি হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে, চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে এসেছিলাম। আমি সেই দেশের মেয়ে যে দেশে ছেলেসন্তানের জন্ম উদযাপন করতে রাইফেল থেকে গুলি ছোড়া হতো, যেখানে মেয়েদের পর্দার আড়ালে লুকিয়ে রাখা হতো এবং জীবনে তাদের কর্তব্য কেবল খাবার তৈরি করা আর সন্তান জন্ম দেওয়া।
বেশির ভাগ পশতুনের কাছেই কন্যাসন্তানের জন্ম হলো দুঃখের সংবাদ। যে অল্প কয়জন আমার জন্ম উদযাপন করতে এসেছিল তার মাঝে ছিলেন আমার বাবার চাচাতো ভাই জেহান শের খান ইউসুফজাই এবং তিনি এমনকি বড় অঙ্কের অর্থ দিয়েছিলেন উপহার হিসেবে। এবং হ্যাঁ, তিনি আমাদের গোত্র দালোখেল ইউসুফজাইয়ের একটি পরিবার বৃক্ষ এনেছিলেন, আমার দাদার দাদা থেকে শুরু করে সেখানে শুধু পুরুষদের পরম্পরাই চিহ্নিত করা ছিল। আমার বাবা জিয়াউদ্দিন ছিলেন বেশির ভাগ পশতুন পুরুষ থেকে আলাদা। তিনি বৃক্ষটি নিলেন, নিজের নাম থেকে ললিপপের মতো একটি দাগ টেনে দাগের শেষে লিখলেন, ‘মালালা’। তাঁর চাচাতো ভাই বিস্ময়ে হেসে উঠেছিলেন। বাবা পাত্তা দেননি। তিনি বলেন, আমার জন্মের পর আমার চোখের দিকে তাকিয়েই তাঁর মনে গভীর ভালোবাসার জন্ম হয়েছিল। তিনি লোকজনকে বলতেন, ‘আমি জানি এই শিশুটির মাঝে অন্য কিছু আছে।’ বাবা এমনকি তাঁর বন্ধুদের আমার দোলনায় শুকনো ফল, মিষ্টি ও পয়সা ছুড়ে দিতে বলেছিলেন, যেটা আমরা সাধারণত ছেলেসন্তানের জন্মেই করে থাকি।
আফগানিস্তানের নারীযোদ্ধা মাইওয়ান্দের মালালাইয়ের নামানুসারে আমার নাম রাখা হয়। পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানে মিলিয়ে বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত পশতুনরা একটি গর্বিত জাতি। শত শত বছর ধরে আমরা ‘পশতুনওয়ালি’ নামের একটি নিয়ম অনুসরণ করে থাকি, যেটার কারণে আমরা সকল অতিথিকে আপ্যায়ন করতে বাধ্য এবং ‘নাং’ বা সম্মানই সেখানে সবচেয়ে বড় মূল্যবোধ। সম্মানহানি একজন পশতুনের জীবনে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ঘটনা। আমাদের একটি প্রবাদ আছে, ‘পৃথিবীতে সম্মান ছাড়া কোনো মূল্য নেই।’ আমরা নিজেদের মধ্যে এত যুদ্ধ করি যে আমাদের ভাষায় মামাতো-খালাতো-চাচাতো-ফুপাতো ভাই এবং শত্রু –এর প্রতিশব্দ একই – তারবুর। কিন্তু বহিরাগত কেউ আমাদের ভূমি দখল করতে এলে আমরা একতাবদ্ধ থাকি। ১৮৮০ সালে দ্বিতীয় অ্যাংলো-আফগানযুদ্ধের অন্যতম বৃহৎ লড়াইয়ে মালালাই কীভাবে ব্রিটিশদের হারাতে আফগান সেনাবাহিনীকে উদ্দীপ্ত করেছিল, সেই আখ্যান শুনে পশতুন শিশুরা বেড়ে ওঠে।
মালালাই ছিল মাইওয়ান্দের এক মেষপালকের মেয়ে। মাইওয়ান্দ হলো কান্দাহারের খরাপীড়িত সমতল অঞ্চলের ছোট্ট এক মফস্বল। সে যখন কিশোরী ছিল, তখন ব্রিটিশ দখলদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরতদের মধ্যে তার বাবা এবং হবু স্বামীও ছিল। গ্রামের অন্য মহিলাদের সঙ্গে আহতদের চিকিৎসা এবং পানি পান করানোর জন্য মালালাইও যুদ্ধক্ষেত্রে গেল। সে দেখল আফগানিস্তান হেরে যাচ্ছে এবং পতাকাবাহকও যখন ঢলে পড়ল, তখন সে তার সাদা অবগুণ্ঠন তুলে ধরল এবং সৈন্যদলগুলোর সামনে দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করল।
‘তরুণ যোদ্ধা!’ সে চিৎকার করে উঠল। ‘মাইওয়ান্দের যুদ্ধে যদি তুমি ঝাঁপিয়ে না পড়ো, আল্লাহর কসম, কেউ একজন তোমাকে লজ্জার প্রতীক হিসেবেই স্মরণ করবে।’
মালালাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল, কিন্তু তার কথা এবং সাহসিকতা যুদ্ধটির মোড় ঘোরাতে সৈন্যদের উদ্দীপ্ত করেছিল। তারা একটি সম্পূর্ণ ব্রিগেড ধ্বংস করে ফেলে, ব্রিটিশদেরকে ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ পরাজয়ের মুখোমুখি হতে হয়। আফগানরা এত গর্বিত ছিল যে শেষ আফগান রাজা কাবুলের মধ্যখানে মাইওয়ান্দ বিজয়সৌধ স্থাপন করেন। উচ্চ বিদ্যালয়ে আমি শার্লক হোমস পড়ে হাসতাম, কারণ এই মহান গোয়েন্দার সহযোগী হওয়ার আগে ড. ওয়াটসন এই যুদ্ধেই আহত হয়েছিলেন। আমরা পশতুনরা আমাদের নিজস্ব জোয়ান অব আর্ককে মালালাইয়ের মাঝেই খুঁজে পাই। আফগানিস্তানের অনেক বালিকা বিদ্যালয় তাঁর নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে। কিন্তু আমার দাদা, যিনি ধর্মবিশারদ এবং গ্রামের ধর্মনেতা ছিলেন, আমার বাবার দেওয়া এ নামটি পছন্দ করেননি। ‘এটি একটি বিমর্ষ নাম,’ তিনি বলতেন। ‘এর অর্থ দুঃখ-ভারাক্রান্ত।’
আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমার বাবা পেশোয়ারের বিখ্যাত কবি রহমত শাহ সায়েলের লেখা একটি গান আমাকে শোনাতেন। শেষ অংশটি হলো–
হে মাইওয়ান্দের মালালাই,
পশতুনদের সম্মানের সুর বোঝাতে তুমি আরো একবার জাগো,
তোমার কাব্য পৃথিবীকে পাল্টে দেয়,
কাতর অনুরোধ মোর, আবারও জাগো।
আমাদের বাসায় যে-ই আসত, বাবা তাকেই মালালাইয়ের গল্পটা বলত। বাবার বলা গল্প আর গাওয়া গান শুনতে আমি খুব ভালোবাসতাম, মানুষ আমার নাম ধরে ডাকলে নামটি যেভাবে ভেসে আসত, ভালোবাসতাম সেটিকেও।
আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গায় থাকতাম। আমার উপত্যকা, সোয়াত উপত্যকা হলো পর্বতের স্বর্গরাজ্য, যেখানে আছে স্ফটিক-স্বচ্ছ হ্রদ এবং প্রবল গতিতে ছুটে চলা জলপ্রপাত। উপত্যকায় ঢুকতেই চোখে পড়বে ফলকে লেখা, ‘স্বর্গে স্বাগতম’। আগেকার দিনে সোয়াতকে বলা হতো ‘উদ্যান’। আমাদের বুনোফুলে ভর্তি মাঠ আছে, রসাল ফলের বাগান আছে, পান্নার খনি আর টাকি মাছে ভর্তি নদী আছে। সোয়াতকে বলা হয় পুবের সুইজারল্যান্ড– পাকিস্তানের প্রথম স্কি রিজোর্টও আমাদেরই। পাকিস্তানের বড়লোকেরা ছুটিতে আমাদের বিশুদ্ধ বায়ু সেবন ও প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে আসে, উপভোগ করে নাচে-গানে ভরপুর সুফি উৎসব। আসত বিদেশিরাও এবং তারা যেখান থেকেই আসুক না কেন, আমরা তাদের বলতাম ‘আংরেজান’ বা ইংরেজ। এখানে ইংল্যান্ডের রানিও এসেছেন এবং সোয়াতের প্রথম ওয়ালির স্থাপিত ‘হোয়াইট প্যালেস’-এ থেকেছেন, যেটি তাজমহলের মতোই একই ধরনের মর্মর পাথরে তৈরি।
আমাদের বিশেষ ইতিহাসও আছে। আজ সোয়াত হলো খাইবার পখতুনখোয়া, বা, কেপিকে প্রদেশের অংশ কিন্তু আগে সোয়াত পাকিস্তানের বাকি অংশ থেকে আলাদা ছিল। আমরা আগে রাজকীয় অবস্থায় ছিলাম, চিত্রল এবং দির-এর তিন প্রতিবেশীর একটি। ঔপনিবেশিক শাসনের সময় আমাদের রাজারা ব্রিটিশদের অনুগত ছিলেন কিন্তু নিজেদের এলাকা নিজেরাই শাসন করতেন। ব্রিটিশরা যখন ১৯৪৭-এ ভারতকে স্বাধীন করে ভাগ করে দিয়ে গেল, আমরা নবজাতক পাকিস্তানের অংশ হয়ে গেলাম কিন্তু স্বায়ত্তশাসিতই থাকলাম। আমরা পাকিস্তানি রুপি ব্যবহার করতাম তবে পাকিস্তান সরকার কেবল পররাষ্ট্রনীতিতেই হস্তক্ষেপ করতে পারত। ওয়ালি বিচার প্রতিষ্ঠা করতেন, যুদ্ধরত গোত্রের মাঝে শান্তি রক্ষা করতেন এবং আয়ের ১০ শতাংশ কর ‘উশোর’ আদায় করতেন, যা দিয়ে রাস্তা, হাসপাতাল ও স্কুল নির্মাণ করা হতো।
কাকের ওড়াপথের মতো আমরা ছিলাম ইসলামাবাদ থেকে মাত্র একশ মাইল দূরে; কিন্তু মনে হতো ওটা যেন বিদেশ। মালাকান্দ গিরিপথ ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মোল্লা সাইদুল্লাহ (ব্রিটিশদের কাছে পাগলা ফকির নামে পরিচিত) নামের একজন সাধকের অনুসারীদের উঁচু পর্বতাবৃত যুদ্ধক্ষেত্র। ওই রাস্তা দিয়ে যেতেও কমপক্ষে পাঁচ ঘণ্টা লাগে। সেই যুদ্ধের মাঝে ছিলেন উইনস্টন চার্চিল, যিনি এটা নিয়ে বইও লিখেছেন এবং একটি চূড়াকে আমরা এখনো ‘চার্চিলের দল’ বলি, যদিও তিনি আমাদের লোকদের খুব বেশি প্রশংসা করেননি। গিরিপথের শেষে ছিল গম্বুজসংবলিত তীর্থ, যেখানে মানুষ নিরাপদে বাড়ি ফেরার জন্য শুকরিয়া আদায় করে পয়সা ছুড়ে ফেলত। আমার পরিচিত কেউ কখনো ইসলামাবাদ যায়নি। সমস্যাগুলো শুরু হওয়ার আগে আমার মায়ের মতো বেশিরভাগ মানুষ কখনো সোয়াতের বাইরেই যায়নি।
আমরা থাকতাম মিঙ্গোরায়, যেটা উপত্যকার সবচেয়ে বড় শহর, সত্যিকার অর্থে একমাত্র শহর। এটা একটা ছোট জায়গা ছিল, কিন্তু আশপাশের গ্রাম থেকে অনেক লোক এসে এখানে থাকা শুরু করলে জায়গাটা জনবহুল এবং নোংরা হয়ে যায়। আমাদের হোটেল, কলেজ, একটি গলফ কোর্স এবং একটি নামকরা বাজার ছিল, যেখানে ঐতিহ্যবাহী সূচিশিল্প, দামি পাথর ও প্রয়োজনীয় সবকিছু কিনতে পাওয়া যেত। মারঘাজার জলপ্রপাতটা বাজারের ভেতর দিয়ে গেছে, ওর ভেতর ফেলা ময়লা আর প্লাস্টিক ব্যাগের কারণে পানিটা ঘোলাটে বাদামি হয়ে গেছে। পাহাড়ি ঝর্ণার মতো এটা অতটা স্বচ্ছ নয়, বৃহত্তর সোয়াত নদীর মতো পরিষ্কারও না। শহরের ঠিক বাইরে সোয়াত নদীতে মানুষ টাকি মাছ ধরত, যেখানে আমরা বেড়াতে যেতাম। আমাদের বাসা ছিল গুলকারা, যার অর্থ ফুলের স্থান, কিন্তু আগে একে বলা হতো বাটকরা বা বৌদ্ধমূর্তির জায়গা। আমাদের বাসার কাছে ছিল রহস্যময় ধ্বংসাবশেষ ছড়ানো এক মাঠ—বসে থাকা সিংহের মূর্তি, ভাঙা খুঁটি, মস্তকবিহীন মূর্তি আর সবচেয়ে বিশ্রী ব্যাপার—শত শত পাথরের ছাতা।
আমাদের উপত্যকায় ইসলাম এসেছিল একাদশ শতকে, যখন গজনির সুলতান মাহমুদ আফগানিস্তান থেকে এসে আমাদের শাসক হয়ে বসলেন। কিন্তু প্রাচীনকালে সোয়াত ছিল বৌদ্ধদের রাজ্য। বৌদ্ধরা দ্বিতীয় শতকে এখানে এসে ৫০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শাসন করেছিল। চীনা পর্যটকদের গল্পে ফুটে ওঠে, সোয়াত নদীর তীরে এক হাজার ৪০০টি মঠ ছিল এবং কীভাবে বৌদ্ধমন্দিরের ঘণ্টার জাদুময়ী শব্দ উপত্যকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ত। মন্দিরগুলো অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে, কিন্তু তুমি সোয়াতের যেখানেই যাবে, সেখানেই বাসন্তীকুসুম এবং অন্যান্য বুনো ফুলের মাঝে তাদের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যাবে। আমরা পদ্মাসনে বসে থাকা হাস্যোজ্জ্বল ভগবান বুদ্ধের প্রস্তরমূর্তির আশপাশে প্রায়ই বনভোজনে যেতাম। প্রচলিত আছে, ভগবান বুদ্ধ নিজে এ শান্তিময় জায়গায় এসেছিলেন এবং এই উপত্যকায় একটি বিশালিকৃতি স্তূপার নিচে তাঁর ভস্মের কিছু অংশ পোঁতা আছে বলেও জনশ্রুতি আছে।
বাটকরার ধ্বংসাবশেষ ছিল লুকোচুরি খেলার এক জাদুকরি স্থান। একসময় কতিপয় বিদেশি প্রত্নতাত্ত্বিক এখানে কাজ করতে এসে বলেছিলেন, অতীতে এটি ছিল বৌদ্ধ রাজাদের কবর এবং স্বর্ণের গম্বুজসংবলিত বৌদ্ধমূর্তিতে উদ্ভাসিত এক তীর্থস্থান। আমার বাবা ‘বাটকরার পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন’ নামে একটি কবিতা লিখেছেন, যেখানে খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল মসজিদ ও মন্দির কীভাবে পাশাপাশি অবস্থান করতে পারে, ‘মিনারে যখন সত্যের ভাষণ জাগে/ বুদ্ধ তখন হাসেন/ এবং ছেদ পড়া ইতিহাস জোড়া লাগে।’
যেখানে পুরুষরা বাঁকানো শিংওয়ালা বুনো ছাগল আর সোনালি মোরগ ধরতে যেত, সেই হিন্দুকুশ পর্বতের ছায়ায় আমরা থাকি। আমাদের বাড়িটা ছিল একতলা এবং আসল কংক্রিটের তৈরি। বাঁয়ে ছিল বাচ্চাদের ক্রিকেট খেলার জায়গার সমান বড় মসৃণ ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি। ওটা আমাদের খেলার মাঠ। সন্ধ্যায় বাবা মাঝেমধ্যেই তাঁর বন্ধুদের নিয়ে সেখানে চা খেতেন। মাঝেমধ্যে আমিও ছাদে বসে আশপাশের বাড়ির রান্নার ধোঁয়া দেখতাম এবং ঝিঁঝিপোকার রাতের আলাপ শুনতাম।
আমাদের উপত্যকা ছিল ফলের বৃক্ষে ভর্তি। সবচেয়ে মিষ্টি ডুমুর, ডালিম, নাশপাতি সেসব গাছে ধরত। আমাদের বাগানে ছিল আঙুর, পেয়ারা ও খেজুর গাছ। বাড়ির সামনের উঠানে ছিল এক আলুবোখারা গাছ—ওটার ফল ছিল সবচেয়ে সুস্বাদু। সব সময়ই ওই গাছের ফল নিয়ে আমাদের সঙ্গে পাখিদের প্রতিযোগিতা হতো। পাখিরা ওই গাছ ভালোবাসত, এমনকি কাঠঠোকরাও।
যতদূর মনে পড়ে, আমার মা পাখিদের সঙ্গে কথা বলতেন। বাড়ির পেছনে একটি বারান্দায় মহিলারা জড়ো হতো। আমরা ক্ষুধার জ্বালা বুঝতাম, তাই মা সব সময়ই কিছু অতিরিক্ত রান্না করে রেখে দরিদ্র পরিবারদের দিতেন। কিছু বাকি থাকলে তা পাখিদের খাওয়াতেন। পশতু ভাষায় আমরা ‘টাপে’ বা দুই চরণের গীতিকবিতা গাইতে ভালোবাসি। ভাত ছিটাতে ছিটাতে মা গাইতেন, ‘বাগানের ঘুঘুদের মেরো না/ একটাকে মারলে বাকিগুলোও আসবে না।’
ছাদে বসে পর্বত এবং স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতাম আমি। পিরামিড-আকৃতির ইলাম পর্বতটাই ছিল সর্বোচ্চ। আমাদের কাছে এটা ছিল পবিত্র। এটা এতই উঁচু ছিল যে এর চূড়া সব সময় পেঁজা তুলোর মতো মেঘের একটি মালা পরে থাকত। গ্রীষ্মকালেও এটি বরফে জমে থাকে। স্কুলে পড়েছি, সোয়াতে বৌদ্ধরাও আসার আগে খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ সালে মহাবীর আলেকজান্ডার আফগানিস্তান থেকে ইন্ডাজ যাওয়ার পথে হাজার হাজার সৈন্য এবং হাতি নিয়ে এ উপত্যকা আক্রমণ করেছিলেন। সোয়াতি লোকজন ইলামে উঠে লুকাল, কারণ তাদের ধারণা ছিল যে এটি উঁচু বলে দেবতারা তাদের রক্ষা করবেন। কিন্তু আলেকজান্ডার ছিলেন একরোখা এবং ধৈর্যশীল নেতা। তিনি কাঠ দিয়ে একটি ঢালু পথ নির্মাণ করে সেখান থেকে পাহাড়ের চূড়ায় গুলতি আর তীর ছুড়তে থাকেন। তার পর তিনি তাঁর ক্ষমতার নিদর্শন হিসেবে বৃহস্পতিকে ধরার জন্য পর্বতে আরোহণ করেন।
ঋতুর পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পর্বতগুলোর পরিবর্তন আমি ছাদ থেকে লক্ষ করতাম। ঠান্ডা বাতাস শরৎকাল থেকেই আসা শুরু করত। শীতকালে বরফে সব সাদা হয়ে যেত, ছাদ থেকে ছোড়ার মতো বরফখণ্ড ঝুলে থাকত, সেগুলো আমরা খাবলে ছিঁড়তে পছন্দ করতাম। আমরা চারপাশে দৌড়ে বেড়াতাম, তুষারমানব আর মেরুভল্লুক তৈরি করতাম আর তুষারখণ্ড ধরার চেষ্টা করতাম। সোয়াত সবচেয়ে প্রাণবন্ত থাকত বসন্তকালে। ইউক্যালিপটাস ফুল বাসায় উড়ে পড়ত, সবকিছু সাদা আবরণে ঢেকে যেত। বাতাসে ধানের গন্ধ ভেসে আসত। আমার জন্ম গ্রীষ্মকালে, হয়তো বা তাই মিঙ্গোরায় গ্রীষ্ম খুব গরম আর শুষ্ক এবং জলধারাটি মানুষের ফেলা ময়লা-আবর্জনায় দুর্গন্ধ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও গ্রীষ্ম আমার প্রিয় ঋতু ছিল।
আমার জন্মের সময় আমরা খুব দরিদ্র ছিলাম। আমার বাবা এবং তাঁর এক বন্ধু তাঁদের প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং স্কুলঘরের উল্টোদিকে দুটো শ্রীহীন ঘরে আমরা থাকতাম। এক ঘরে আমি মা-বাবার সঙ্গে ঘুমাতাম এবং অন্যটি অতিথিদের জন্য ছিল। আমাদের কোনো শৌচাগার বা রান্নাঘর ছিল না। মা মাটিতে লাকড়ি জ্বালিয়ে রান্না করতেন এবং স্কুলের একটি ট্যাপের পানিতে আমাদের জামাকাপড় ধুতেন। গ্রাম থেকে বেড়াতে আসা অতিথি দিয়ে আমাদের বাসা সব সময় ভরা থাকত। পশতুনদের ঐতিহ্যে আপ্যায়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
আমার জন্মের দুই বছর পর আমার ভাই খুশালের জন্ম। আমার মতো সেও বাড়িতেই জন্মগ্রহণ করে, কারণ তখনো আমাদের হাসপাতালের খরচ চালানোর মতো সামর্থ্য ছিল না। পশতুন বীর যোদ্ধা এবং কবি খুশাল খান খাত্তাকের নামানুসারে আমার বাবার স্কুলের নাম রাখা হয় এবং স্কুলের নামানুসারে আমার ভাইয়ের নাম রাখা হয়। আমার মা একটি পুত্রসন্তানের জন্য অপেক্ষা করছিলেনেবং খুশালের জন্মের পর আনন্দ ধরে রাখতে পারেননি। আমার চোখে খুশাল ছিল রোগা ছোট খড়কুটোর মতো, যে বাতাসে উড়ে যেতে পারে, কিন্তু সে ছিল মায়ের চোখের মণি, তাঁর ‘লাদলা’। আমার কাছে মনে হতো, খুশালের প্রতিটি ইচ্ছা ছিল মায়ের জন্য অবশ্যপালনীয় আদেশ। সে সারাক্ষণ এলাচি, দুধ আর চিনি দিয়ে তৈরি ঐতিহ্যবাহী চা খেতে চাইত; কিন্তু মা এটা বানাতে বানাতে বিরক্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং কয়েকবার এত তেতো করে বানালেন যে খুশালের রুচি নষ্ট হয়ে গেল। মা তার জন্য নতুন দোলনা কিনতে চাইলেন, কিন্তু বাবা রাজি হলেন না—আমার জন্মের সময় বাবা নতুন দোলনা কিনতে পারেননি, প্রতিবেশীদের কারো থেকে পুরনো কাঠের তিন-চারবার হাতবদলকৃত একটা দোলনা নেওয়া হয়েছিল। বাবা বললেন, ‘মালালা এটায় দুলে বেড়ে উঠেছে, খুশালও পারবে।’ প্রায় পাঁচ বছর পর উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত চোখ এবং কাঠবিড়ালির মতো কৌতূহলসমৃদ্ধ অতলের জন্ম। এরপর বাবা বললেন, আমরা পরিপূর্ণ হয়ে গেছি। সোয়াতের মানদণ্ড অনুসারে তিন সন্তান মানে খুব ছোট পরিবার, কারণ বেশির ভাগ পরিবারেই সাত-আটজন থাকে।
খুশাল আমার চেয়ে মাত্র দুই বছরের ছোট বলে বেশিরভাগ সময় তার সঙ্গেই খেলতাম, কিন্তু আমরা সারাক্ষণ মারামারি করতাম। সে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে যেত আর আমি যেতাম বাবার কাছে। বাবা জিজ্ঞেস করতেন, ‘কী হয়েছে, জানি?’ আমি তাঁর মতই আঙুলে দুটো করে জোড়া নিয়ে জন্মেছি এবং আঙুলগুলো বাঁকা করে সেই একই আঙুলের গোড়ায় ডগাটা রাখতে পারি। আমি হাঁটার সময় আমার গোড়ালিতে শব্দ হয়, যা শুনে বড়রা অস্বস্তিতে ভোগেন।
আমার মা খুবই সুন্দরী ছিলেন এবং বাবা তাঁর সঙ্গে এমন আচরণ করতেন যেন তিনি এক ভঙ্গুর চীনামাটির পাত্র, এবং অন্যান্য পশতুন পুরুষের থেকে তিনি আলাদা ছিলেন—স্ত্রীর গায়ে কখনো হাত তুলতেন না। তাঁর নাম ‘তর পেকাই’-এর অর্থ ‘কাকের মতো কালো চুল’, যদিও তাঁর চুল বাদামি। মায়ের জন্মের ঠিক আগে আমার নানা রেডিও আফগানিস্তানে নামটা শুনেছিলেন। আমি চাইতাম মায়ের পদ্মশুভ্র ত্বক, সুন্দর বৈশিষ্ট্য ও সবুজ চোখ, কিন্তু তার পরিবর্তে পেয়েছি বাবার শ্যামলা রং, চ্যাপ্টা নাক ও বাদামি চোখ। আমাদের সমাজে সবারই কোনো না-কোনো ডাকনাম থাকে—‘পিশো’ বাদে (যা আমার মা আমাকে ছোটবেলা থেকে ডাকতেন)। মামাতো-ফুপাতো-খালাতো-চাচাতো ভাইবোনেরা আমাকে ‘লাচি’ বা এলাচি ডাকত, কালো মানুষদের সাদা ডাকা হতো এবং খাটোদের ডাকা হতো লম্বা। আমাদের রসবোধ প্রখর। আমার বাবাকে পরিবারে ‘খাইস্তা দাদা’ ডাকা হতো, যার অর্থ সুন্দর।
প্রায় চার বছর বয়সে আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাবা, তোমার গায়ের রং কী?’ বাবা বললেন, ‘জানি না, কিছুটা সাদা, কিছুটা কালো।’
‘চায়ের সঙ্গে দুধ মেশালে যা হয়, তোমার গায়ের রং তেমন।’ আমি বললাম।
তিনি খুব হেসেছিলেন, কিন্তু ছোটবেলায় তিনি কালো চামড়ার অধিকারী হওয়ায় এতই আত্মসচেতন ছিলেন যে ফর্সা হওয়ার জন্য রোজ মাঠে গিয়ে মুখে মহিষের দুধ মাখতেন। কিন্তু মায়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর এ রং নিয়েও তিনি স্বস্তি পেলেন। এত সুন্দর একটি মেয়ের ভালোবাসা তাঁকে আত্মবিশ্বাস দিয়েছিল।
আমাদের সমাজে সাধারণত পরিবারের মাধ্যমেই বিয়ে হয়, কিন্তু আমার বাবা-মায়েরটা ছিল প্রেমের বিয়ে। তাঁদের প্রথম দেখা হওয়ার কথা আমি অবিরাম শুনতে পারতাম। তাঁরা সোয়াতের ওপর দিকে শাংলা উপত্যকার প্রতিবেশী দুটো গ্রামে থাকতেন। আমার বাবা তাঁর চাচার বাসায় পড়তে যেতেন, যেটা আমার মায়ের খালার বাসার পাশে। তাঁরা একে অপরকে দেখেছিলেন এবং প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন; কিন্তু এসব কথা প্রকাশ করাটা আমাদের সমাজে নিষিদ্ধ। এর পরিবর্তে তিনি মাকে এমন সব কবিতা লিখে পাঠাতেন যা মা পড়তে পারতেন না।
‘আমি তার মনটাকে ভালোবাসেছিলাম,’ মা বলেন।
‘আর আমি, ওর সৌন্দর্য,’ বাবা হাসেন।
একটা বড় সমস্যা ছিল। আমার দাদা-নানা কেউই এটাকে ভালো চোখে দেখেননি। সুতরাং বাবা যখন মাকে বিয়ে করার ইচ্ছা পোষণ করেন, কোনো পক্ষই এই বিয়েকে স্বাগত জানাল না। দাদা বাবাকে তাঁর ইচ্ছামতো করতে বললেন এবং পশতুনদের ঐতিহ্য হিসেবে একজন ক্ষৌরকারকে দূত হিসেবে পাঠাতে রাজি হলেন। মালিক জানসের খান প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন; কিন্তু বাবা ছিলেন একগুঁয়ে এবং তিনি দাদাকে আবারো নাপিতটিকে পাঠাতে অনুরোধ করলেন। জানসের খানের ‘হুজরা’ ছিল মানুষের মিলিত হওয়ার জায়গা এবং সবাই রাজনীতি নিয়ে কথা বলত। বাবা প্রায়ই সেখানে যেতেন এবং এভাবেই নানার সঙ্গে পরিচিত হলেন। বাবাকে নয় মাস অপেক্ষা করিয়ে রেখে অবশেষে নানা রাজি হলেন।
প্রভাবশালী পুরুষের পাশাপাশি আমার মায়ের পরিবারে শক্তিশালী মহিলারাও ছিল। মায়ের নানা মারা গিয়েছিলেন তাঁর সন্তানরা ছোট থাকতেই এবং অন্য গোত্রের একটি পরিবারের সঙ্গে শত্রুতা হওয়ায় তারা নয় বছর বয়সী জানসের খানকে বন্দি করে রাখে। আমার মায়ের নানি তাঁকে মুক্ত করার জন্য চল্লিশ মাইল দূরে পাহাড় পেরিয়ে একাই এক প্রভাবশালী চাচাতো ভাইয়ের কাছে গিয়েছিলেন। আমার মনে হয়, আমাদের মাও আমাদের জন্য এমনটা করবেন। যদিও মা লিখতে-পড়তে পারতেন না, বাবা তাঁর সারা দিনের ভালো-মন্দ সবকিছু নিয়ে তাঁর সঙ্গে শলাপরামর্শ করতেন। মা বাবাকে অনেক ক্ষেপাতেন এবং কাকে প্রকৃত বন্ধু মনে হয় আর কাকে না, সে ব্যাপারে উপদেশ দিতেন। বাবা বলতেন, মা সব সময়ই ঠিক বলেন। বেশিরভাগ পশতুনই এটা করে না, কারণ স্ত্রীর সঙ্গে সমস্যা আলোচনা করাটাকে দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়। মানুষ অপমান করে বলত, ‘সে এমনকি তার স্ত্রীর সঙ্গেও পরামর্শ করে!’ আমার বাবা-মা খুব সুখী এবং অনেক হাসিখুশি। মানুষ আমাদের দেখলে বলে, ‘নির্ঝঞ্ঝাট সুখী পরিবার।’
আমার মা অত্যন্ত ধার্মিক এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, মসজিদ পুরুষদের জন্য বলে মসজিদে যান না। তিনি নাচকে ভালো মনে করেন না, কারণ তিনি ভাবেন আল্লাহ এটা পছন্দ করবেন না; কিন্তু সুন্দর সুন্দর অলংকারে নিজেকে সাজাতে ভালোবাসতেন, নকশা করা পোশাক পরতেন এবং সোনার হার ও সোনার চুড়ি পরতেন। আমার ধারণা, আমাকে নিয়ে তিনি কিছুটা হতাশ, কারণ আমি বাবার মতই পোশাক আর অলংকার নিয়ে মাথা ঘামাই না। আমি বাজারে গেলে বিরক্ত হয়ে যাই; কিন্তু স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে দরজা বন্ধ করে নাচতে পছন্দ করি।
বাড়ন্ত শিশু হিসেবে আমাদের বেশিরভাগ সময় মায়ের সঙ্গে কেটেছে। বাবা ব্যস্ততার কারণে বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকতেন। শুধু স্কুল নয়, সাহিত্যিক সমাজ এবং জিরগা, এমনকি পরিবেশ সংরক্ষণ আন্দোলন নিয়েও তিনি ব্যস্ত থাকতেন। তিনি আমাদের উপত্যকাকে বাঁচাতে চেষ্টা করছিলেন। যদিও বাবা একটি পশ্চাৎপদ গ্রাম থেকে এসেছিলেন, শিক্ষা এবং ব্যক্তিত্বের জোরে তিনি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি আমাদের ভালো জীবিকার ব্যবস্থা করেছিলেন।
মানুষ বাবার কথা শুনতে ভালোবাসত এবং সন্ধ্যার অতিথির আগমন ঘটার সময়টা আমি খুব পছন্দ করতাম। মায়ের বিছিয়ে দেওয়া লম্বা প্লাস্টিকের চাদরে খাবার রেখে মেঝেতে তার চারপাশে বসতাম এবং আমাদের ঐতিহ্য অনুযায়ী ডান হাতে ভাত ও মাংস মেখে খেতাম। রাত হলে তেলের কুপি জ্বালিয়ে বসে পড়তাম, দেয়ালে আমাদের নানা আকৃতির ছায়া নড়াচড়া করত আর আমরা মাছি তাড়াতাম। গ্রীষ্মকালে প্রায়ই বজ্রপাতের শব্দ শোনা যেত এবং আমি বাবার হাঁটুর কাছে জড়োসড়ো হয়ে বসতাম।
আমার বাবা আমাকে যুদ্ধরত পশতুন সিদ্ধপুরুষদের গোত্রের কথা বলতেন। তিনি এসব কাহিনী আমাকে পড়ে শুনিয়েছেন কবিতায়, ছন্দে। পড়তে পড়তে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়তেন। আমি বিমোহিত হয়ে শুনতাম। সোয়াতের বেশিরভাগ মানুষের মতো আমরাও ইউসুফজাই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। এর বানানেরও ভিন্নতা আছে। আমরা এসেছি কান্দাহার থেকে এবং আমরাই পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে ছড়িয়ে থাকা সর্ববৃহৎ পশতুন গোত্র।
আমাদের পূর্বপুরুষরা কাবুলে একজন তিমুরিদ শাসককে তাঁর সিংহাসন ফিরে পেতে সাহায্য করেছিল। তাঁর নিজ গোত্রই তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করেছিল। সেখান থেকে তাঁরা ষোড়শ শতাব্দীতে সোয়াতে আসেন। সম্রাট তাঁদের সেনাবাহিনী এবং রাজসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন করে পুরস্কৃত করলেন, কিন্তু তাঁর বন্ধুরা তাঁকে সাবধান করে দিল যে ইউসুফজাইরা শক্তিশালী হয়ে যাচ্ছে এবং যেকোনো সময় সিংহাসন দখল করতে পারে। তাই এক রাতে তিনি সব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে ভোজের দাওয়াত দিলেন এবং খাওয়ার সময় নিজের লোক লেলিয়ে দিলেন। ৬০০ জনের মতো কর্মকর্তা নিহত হলেন, মাত্র দুজন রক্ষা পেলেন। তাঁরা নিজ গোত্রের মানুষকে নিয়ে পেশাওয়ার পালিয়ে গেলেন। এরপর সমর্থক জোগাড় করার উদ্দেশ্যে সোয়াতের অন্য গোত্রের লোকজনের কাছে আসতে লাগলেন, যাতে তাঁরা আফগানিস্তানে ফিরে যেতে পারেন। কিন্তু সোয়াতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে তাঁরা এতই মুগ্ধ হয়ে গেলেন যে অন্য গোত্রদের তাড়িয়ে দিয়ে নিজেরাই থাকা শুরু করলেন।
ইউসুফজাইরা তাদের পুরুষ সদস্যদের মধ্যে জমি বণ্টন করে দিল। ‘ওয়েশ’ নামের এক উদ্ভট নিয়মে প্রতি পাঁচ বা দশ বছর পর পর সব পরিবার তাদের গ্রাম অদলবদল করত এবং নতুন করে জমি বণ্টন করত, যাতে সবাই ভালো ও খারাপ—দুই রকম জমিতেই কাজ করার সুযোগ পায়। ভাবা হতো যে এটা যুদ্ধ থামাতে সাহায্য করবে। খানরা গ্রাম শাসন করত, আর প্রজা ছিল সাধারণ মানুষ, শ্রমিক, কারিগররা। ফসলের একটি অংশ তারা কর হিসেবে প্রদান করত। খানের বেসামরিক বাহিনী গঠনের জন্য তারা প্রতি খণ্ড জমির জন্য একজন করে সশস্ত্র ব্যক্তি নিয়োগ করেছিল। প্রতিটি খানের যুদ্ধ নিরসন এবং অন্য গ্রাম আক্রমণ ও লুট করার জন্য শত শত সশস্ত্র ব্যক্তি ছিল।
যেহেতু সোয়াতে ইউসুফজাইদের কোনো শাসক ছিল না, সেখানকার খানদের মধ্যে নিয়মিত যুদ্ধ হতো, এমনকি নিজেদের পরিবারের মধ্যেও। আমাদের সব লোকেরই রাইফেল আছে, যদিও অন্য পশতু এলাকার মতো এখানকার লোকজন এখন সেগুলো নিয়ে ঘুরে বেড়ায় না। আমার বাবার দাদা তাঁর ছেলেবেলায় দেখা বন্দুকের লড়াইয়ের কথা বলতেন। গত শতকে তাঁরা ব্রিটিশদের নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন, তারা আশপাশের সবকিছুই দখল করে ফেলেছিল। পশতুনরা অবিরাম রক্তপাতে বিরক্তও হয়ে পড়েছিল। তাই তারা পুরো এলাকা শাসন এবং বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে খুঁজতে লাগল।
দুজন অযোগ্য শাসককে উচ্ছেদ করার পর ১৯১৭ সালে কর্মকর্তারা মিয়াঙুল আবদুল ওয়াদুদকে রাজা নিযুক্ত করে। আমরা তাঁদের সম্মান করে ‘বাদশাহ সাহিব’ ডাকি। সম্পূর্ণ নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও তিনি উপত্যকায় শান্তি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হন। একজন পশতুনের হাত থেকে রাইফেল কেড়ে নেওয়ার অর্থ তার জীবন কেড়ে নেওয়ার মতই, তাই গোত্রগুলোকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্র করা সম্ভব হয়নি। তার পরিবর্তে তিনি সোয়াতের সব পর্বতে দুর্গ তৈরি করলেন এবং একটি সেনাবাহিনী গঠন করলেন। ব্রিটিশরা তাঁকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে স্বীকৃতি দিল এবং ১৯২৬ সালে তাঁকে ওয়ালি বা শাসক হিসেবে নিযুক্ত করা হলো। তিনিই প্রথম টেলিফোন ব্যবস্থা চালু করেন এবং প্রথম প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ওয়েশ পদ্ধতিরও বিলোপ ঘটান, কারণ এ পদ্ধতিতে গ্রাম থেকে গ্রামে আসা-যাওয়ার ফলে কোনো জমি বিক্রি করা সম্ভব হতো না অথবা ভালো বাড়ি নির্মাণ বা ফলের গাছ রোপণ করা যেত না।
পাকিস্তানের জন্মের দুই বছর পর ১৯৪৯ সালে তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র মিয়াঙুল আবদুল হক জেহানযেবের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। আমার বাবা বলেন, ‘বাদশাহ সাহিব শান্তি এনেছিলেন আর তাঁর পুত্র এনেছিলেন সমৃদ্ধি।’ জেহানযেবের শাসনকালকে আমরা সোনালি সময় বলে মনে করি। তিনি পেশাওয়ারের একটি ব্রিটিশ স্কুলে লেখাপড়া করেছিলেন। তাঁর বাবা নিজে নিরক্ষর ছিলেন, তাই জেহানযেব স্কুলের প্রতি আলাদাভাবে আবেগপ্রবণ ছিলেন এবং অনেক স্কুল, হাসপাতাল এবং রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন। ১৯৫০ সালে তিনি খানদের কাছে কর দেওয়ার প্রথাটার বিলোপ ঘটান। কিন্তু কারো বাকস্বাধীনতা ছিল না, এবং কেউ ওয়ালির সমালোচনা করলে উপত্যকা থেকে বহিষ্কৃত হতো। ১৯৬৯-এ আমার বাবার জন্মের বছর ওয়ালি ক্ষমতা ছেড়ে দিলেন এবং সোয়াত পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের অংশ হয়ে গেলাম, যার নাম কয়েক বছর আগে খাইবার পাখতুনখোয়ায় রূপান্তরিত হয়।
এভাবেই আমি পাকিস্তানের একজন গর্বিত কন্যা হিসেবে জন্মেছি, যদিও অন্য সোয়াতিদের মতো আমি সর্বাগ্রে নিজেকে একজন সোয়াতি মনে করি, তারপর ভাবি পশতুন এবং এরপর পাকিস্তানি।
সাফিনা নামে আমার বয়সী একটি মেয়ের পরিবার আমাদের গলিতে থাকত। বাবর ও বাসিত নামে আমাদের ভাইদের বয়সী দুটি ভাইও তাদের ছিল। আমরা একসঙ্গে রাস্তায় অথবা ছাদে ক্রিকেট খেলতাম। কিন্তু আমি জানতাম যে মেয়েরা বড় হলে তাদের অন্তপুরে থাকাটাই সমীচীন। সবাই চাইবে আমরা যেন রান্না করে আমাদের বাবা ও ভাইকে খাওয়াই। যেখানে ছেলেরা স্বাধীনভাবে সারা শহর ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমি আর আমার মা একজন পুরুষ আত্মীয় ছাড়া কোথাও যেতে পারি না, হোক সে পাঁচ বছরের একটি ছেলে! এটাই রীতি।
আমি অনেক আগেই ঠিক করেছিলাম, আমি সে রকম হব না। আমার বাবা বলেন, ‘মালালা হবে পাখির মতো মুক্ত।’ আমি আলেকজান্ডারের মতো ইলাম পর্বতে উঠে জুপিটারকে ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখতাম, উপত্যকার বাইরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু আমি আমার ভাইদের যতই ছাদে ছোটাছুটি করতে দেখতাম, দক্ষ হাতে ঘুড়ি উড়িয়ে একে অপরের সুতো কেটে দিতে দেখতাম, আমি কেবলই ভাবতাম—একজন মেয়ে কতটুকু স্বাধীন হতে পারে।
(চলবে)