আমি মালালা বলছি
আমার বাবা, বাজপাখি
২
আমার বাবা, বাজপাখি
আমি সব সময়ই জানতাম, আমার বাবার কথা বলতে সমস্যা হয়। মাঝেমধ্যেই তিনি আটকে যেতেন এবং একই ধ্বনি বারবার উচ্চারণ করতেন– আটকে যাওয়া রেকর্ডের মতো এবং পরের কথাটা শোনার জন্য আমরা সবাই অপেক্ষা করতাম। তিনি বলেছেন, তাঁর মনে হতো যে গলা দিয়ে একটি দেয়াল নেমে আসছে। ম, প এবং ক ছিল তাঁর শত্রু। আমি তাঁর সঙ্গে মশকরা করতাম যে তিনি আমাকে ‘জানি’ বলে ডাকতেন, কারণ এটার উচ্চারণ মালালার চেয়ে সহজ। কবিতাপ্রেমী একজন মানুষের জন্য তোতলামি এক বিরাট সমস্যা। তাঁর এক মামা ও চাচার একই সমস্যা ছিল। কিন্তু তাঁর বাবার কারণে নিজের সমস্যা প্রকটতর মনে হতে লাগল, কারণ আমার দাদার নিজের কণ্ঠ ছিল এক তরঙ্গিত যন্ত্র, যা দিয়ে কথাগুলো বজ্রের মতো বেরোত বা নেচে বেড়াত।
‘বলে ফেল!’ আমার বাবা বাক্যের মাঝে আটকে গেলেই তিনি গর্জে উঠতেন। দাদার নাম ছিল ‘রুহুল আমিন’, যার অর্থ ‘সৎ আত্মা’ এবং এটা ফেরেশতা জিব্রাঈলের (আ.) নাম। তিনি নামটি নিয়ে এতই গর্বিত ছিলেন যে তাঁর নামসংবলিত কবিতার চরণ আবৃত্তি করতেন মানুষের সামনে। তিনি সময়ে সময়ে খুব অধৈর্য হয়ে পড়তেন এবং একটি মুরগি উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাফেরা করলে বা একটি কাপ ভাঙলেও প্রচণ্ড রেগে যেতেন। তাঁর মুখ লাল হয়ে যেত এবং তিনি কেতলি-বাটি চারপাশে ছুড়ে মারতেন। আমি আমার দাদিকে দেখিনি, কিন্তু বাবার কাছে শুনেছি দাদি মজা করে দাদাকে বলতেন, ‘আল্লাহর কসম, তুমি তো শুধু ভ্রু কুঁচকে আমাদের সম্ভাষণ জানাও, আমার মৃত্যুর পরে তোমার কপালে যেন এমন স্ত্রী জোটে যে কখনো হাসে না।’
বাবার তোতলামি নিয়ে দাদি এত চিন্তিত ছিলেন যে একদিন তিনি বাবাকে এক পীরের কাছে নিয়ে গেলেন। বাসে চড়ার পর পাহাড়ের ওপর দিয়ে এক ঘণ্টা হেঁটে সেই যাত্রা করলেন তাঁরা। দাদির ভাতিজা ফজলে হাকিম বাবাকে কাঁধে নিয়েছিলেন। পীরটিকে বলা হতো ‘লেওয়ানো পীর’ বা পাগলের পীর কারণ তিনি মানসিক রোগ উপশম করতেন বলে জনশ্রুতি ছিল। তাঁরা যখন পীরের কাছে গেলেন, পীর বাবাকে হাঁ করতে বললেন এবং তাঁর মুখের ভেতর থুতু দিলেন। এরপর তিনি কিছু গুড় নিয়ে চুষলেন এবং সেই গুড় দাদিকে দিয়ে বললেন, বাবাকে যেন প্রতিদিন একটু একটু করে খাওয়ানো হয়। এই চিকিৎসায় বাবার তোতলামি একটুও কমেনি, বরং কেউ কেউ বলে বেড়েছে। তাই তেরো বছর বয়সে বাবা যখন দাদাকে জানালেন তিনি একটি উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছেন, দাদা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তিনি হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি? কী করে সম্ভব? তোমার তো একটা বাক্য উচ্চারণ করতেই এক-দুই মিনিট লাগে।’
‘চিন্তা করো না,’ বাবা বললেন। ‘তুমি বক্তৃতাটা লিখে দাও, আমি শিখে ফেলব।’
আমার দাদা তাঁর বক্তৃতার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তিনি শাহপুর গ্রামের সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ধর্মতত্ত্ব পড়াতেন। স্থানীয় মসজিদের ইমামও ছিলেন তিনি। তিনি ছিলেন একজন সম্মোহনকারী বক্তা। তাঁর জুমার নামাজের খুতবা এতই জনপ্রিয় ছিল যে পাহাড় থেকে গাধায় চড়ে বা পায়ে হেঁটে তাঁর বক্তব্য শুনতে আসত।
আমার বাবার পরিবারটা ছিল বিশাল। সাঈদ রমজান নামে অনেক বড় একজন ভাই, যাঁকে আমি ‘খান দাদা’ চাচা বলে ডাকি, আর পাঁচজন বোন ছিল বাবার। বারকানা গ্রামটি ছিল একেবারে আদিম এবং তারা একটি জরাজীর্ণ একতলা বাড়িতে গাদাগাদি করে থাকত, যার ছাদ থেকে বৃষ্টি বা তুষারপাতের সময় পানি পড়ত। অন্যান্য পরিবারের মতোই ছেলেরা স্কুলে যেত আর মেয়েরা ঘরে থাকত। আমার বাবা বলেছিলেন, তাঁরা কেবল তাঁদের বিয়ে হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতেন।
আমার ফুপুরা কেবল স্কুলে যাওয়া থেকেই বঞ্চিত হননি। সকালে বাবাকে যখন দই বা দুধ দেওয়া হতো, ফুপুদের দেওয়া হতো দুধ ছাড়া চা। ডিম শুধু ছেলেরাই পেত। রাতের খাবারের জন্য মুরগি রান্না হলে মেয়েরা পেত পাখনা আর ঘাড়ের মাংস, আর ছেলেদের জন্য বরাদ্দ ছিল লোভনীয় বুকের মাংস যা আমার বাবা, চাচা আর দাদা খেতেন। বাবা বলতেন, ‘অনেক আগে থেকেই নিজেকে আমার বোনদের চাইতে আলাদা মনে হতো।’
গ্রামে বাবার করার মতো তেমন কিছুই ছিল না। ক্রিকেট খেলার পক্ষে রাস্তাগুলো খুবই সরু ছিল এবং একটিমাত্র বাসায় টেলিভিশন ছিল। শুক্রবারে ভাইরা মসজিদে যেত এবং দাদা কীভাবে বেদিতে উঠে দাঁড়িয়ে সমাবেশে খুতবা দেন তা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখত, এবং তাঁর কণ্ঠ কখন উচ্চ হয়ে আক্ষরিক অর্থেই কাঠের গুঁড়ি কাঁপিয়ে দেবে, তার জন্য অপেক্ষা করত।
দাদা ভারতে পড়ালেখা করেছিলেন, সেখানে তিনি মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ (পাকিস্তানের জাতির পিতা), মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু এবং খান আবদুল গাফফার খান (স্বাধীনতাকামী মহান পশতুন নেতা)-এর মতো মহান নেতা এবং বক্তাদের দেখেছিলেন। বাবা (আমি দাদাকে বাবা বলে সম্বোধন করে থাকি) ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের পাওয়ার মুহূর্তটিকেও ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাঁর পুরনো রেডিওতে তিনি খবর শুনতেন, ওটা আমার চাচার কাছে আছে। তাঁর খুতবা ছিল বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, ঐতিহাসিক ঘটনা, কুরআনে উল্লিখিত ঘটনা ও হাদিস দ্বারা সমৃদ্ধ। তিনি রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে ভালবাসতেন। আমার বাবার জন্মসন ১৯৬৯, এ সালেই সোয়াত পাকিস্তানের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। অনেক সোয়াতি এটা নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিল; তারা পাকিস্তানের বিচারব্যবস্থা নিয়ে অখুশি ছিল, তারা বলত যে গোত্রীয় বিচারের চেয়ে এতা অনেক ধীরগতিসম্পন্ন এবং প্রভাব বিস্তারকারী নয়। দাদা শ্রেণিপ্রথার নিন্দা করতেন– খানদের ক্ষমতার বড়াই, আর ধনী-গরিবের পার্থক্য তিনি পছন্দ করতেন না।
আমাদের দেশের বয়স খুব বেশি নয় কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর বেশকিছু সেনা অভ্যুত্থানের ইতিহাস তৈরি হয়ে গেছে। আমার বাবার বয়স যখন আট, তখন জিয়াউল হক নামের একজন জেনারেল ক্ষমতায় বসেন। এখনো আশেপাশে তার অনেক ছবি আছে। তিনি ছিলেন চোখের চারপাশে কালিমাখা এক ভয়ংকর লোক, বড় বড় দাঁত দেখে মনে হয় খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং চুলগুলো পোমেড দিয়ে মাথার সঙ্গে চ্যাপ্টা করে লাগিয়ে রাখা হয়েছে। তিনি আমাদের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোকে গ্রেফতার করে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে অভিযুক্ত করার চেষ্টা করেন এবং রাওয়ালপিন্ডি জেলে তাঁকে ফাঁসি দেন। আজও মানুষ ভুট্টোকে উৎসাহ সঞ্চারের ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধা করে। তিনি সাধারণ মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো প্রথম পাকিস্তানি নেতা, যদিও তিনি নিজেই ছিলেন বিশাল আমবাগানের মালিক এবং সামন্ত নেতা। তাঁর ফাঁসি সবাইকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল এবং পাকিস্তানের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খারাপ হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য পাঠানো বন্ধ করে দেয়।
দেশের জনগণের সমর্থন আদায় করতে জেনারেল জিয়া ইসলামীকরণের একটি অভিযান চালু করলেন, যাতে আমাদের দেশ একটি পরিপূর্ণ মুসলিম দেশে পরিণত হয় এবং সেনাবাহিনীকে দেশের ভাবাদর্শগত এবং ভৌগোলিক সীমানার রক্ষক হিসেবে নিয়োগ করলেন। তিনি বলেছিলেন, তাঁর সরকারকে মান্য করা আমাদের কর্তব্য কারণ তাঁরা ইসলামি তত্ত্ব অনুসরণ করতে আদেশ দিচ্ছেন। আমরা কীভাবে প্রার্থনা করব তাও জিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন, এবং প্রতি জেলায় তিনি ‘সালাত’ বা প্রার্থনা কমিটি স্থাপন করেন। এমনকি আমাদের দুর্গম গ্রামেও তিনি ১,০০,০০০ প্রার্থনা পরিদর্শক নিয়োগ দেন। এর আগে মোল্লারা ছিলেন হাসির পাত্র– বাবা বলতেন, বিয়ের অনুষ্ঠানে তাঁরা এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকতেন বা ইতস্তত ঘোরাফেরা করে তাড়াতাড়ি চলে যেতেন। কিন্তু জিয়ার অধীনে তাঁরা প্রভাবশালী হয়ে উঠলেন এবং খুতবা পরিচালনা করতে তাঁদের ইসলামাবাদ নিয়ে যাওয়া হতো। আমার দাদাও গিয়েছেন।
জিয়ার শাসনামলে নারীদের জীবন আরো বেশি কড়া শাসনের অধীনে চলে গিয়েছিল। জিন্নাহ বলেছিলেন, ‘নারীরা পুরুষদের পাশাপাশি অংশগ্রহণ না করলে কোনো সংগ্রামই সফল হবে না। পৃথিবীতে দুটো শক্তি আছে– একটি তলোয়ার এবং অন্যটি কলম। তৃতীয় শক্তিটি এই দুটোর চেয়েও শক্তিশালী, সেই শক্তি হলো নারী।’ কিন্তু জিয়া ইসলামী আইন নিয়ে এলেন, যাতে আদালতে একজন নারীর সাক্ষ্য একজন পুরুষের সাক্ষ্যের অর্ধেক হিসেবে গণ্য হতো। অতিদ্রুত আমাদের আদালত বিভিন্ন উদ্ভট মামলায় ভরে গেল। ১৩ বছর বয়সী এক মেয়েকে ধর্ষণ করার ফলে সে গর্ভবতী হয়ে পড়ে, কিন্তু ব্যাভিচারের অভিযোগে সে কারাগারে যায়, কারণ ঘটনাটিকে অপরাধ বলে প্রমাণ করতে সে চারজন পুরুষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি। পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া একজন নারী ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খুলতে পারে না। হকিতে আমরা সব সময়ই ভালো ছিলাম, কিন্তু জেনারেল জিয়া আমাদের নারী হকি খেলোয়াড়দের ঢোলা পাজামা পরতে বাধ্য করলেন এবং শর্টস পরার অনুমতি না থাকায় নারীদের বেশকিছু ক্রীড়া বন্ধই হয়ে গেল।
সে সময় আমাদের অনেক মাদ্রাসা বা ধর্মশিক্ষার স্কুল চালু হয়েছিল। স্কুলের ধর্মীয় শিক্ষা বা ‘দীনিয়াত’-কে ‘ইসলামিয়াত’ বা ইসলামী শিক্ষায় পরিবর্তন করা হলো, যা আজো বহাল আছে। ইতিহাস বইগুলো পুনর্লিখন করে সেখানে পাকিস্তানকে ‘ইসলামের দুর্গ’ বলে পরিচিত করানো হলো। এতে মনে হতে লাগল, আমরা ১৯৪৭ সালেরও আগে থেকে ‘পাকিস্তান’ হিসেবে আছি এবং এতে হিন্দু ও ইহুদিদের অস্বীকার করা হলো। যে কেউ এই বইগুলো পড়লে ভাববে, আমাদের চিরশত্রু ভারতের কাছে হেরে যাওয়া যুদ্ধ তিনটিতে আমরা জিতেছি।
আমার বাবার বয়স যখন ১০, তখনই সবকিছু পালটে গেল। ১৯৭৯ সালের বড়দিনের ঠিক পরেই রাশিয়া আমাদের প্রতিবেশী আফগানিস্তানকে আক্রমণ করল। লক্ষ লক্ষ আফগান সীমান্ত দিয়ে পলায়ন করল এবং জেনারেল জিয়া তাদের শরণার্থী হিসেবে গ্রহণ করলেন। পেশাওয়ারের চারপাশে সাদা তাঁবুর বিশাল বিশাল ঘাঁটি গড়ে উঠতে লাগল, যার কিছু কিছু এখনো আছে। আমাদের সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ছিল সেনাবাহিনীর অধীন। তারা আফগান শরণার্থীদের প্রতিরোধ যোদ্ধা বা মুজাহিদ হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বিশাল কার্যক্রম শুরু করল। কার্যক্রমের প্রধান পরিচালক কর্নেল ইমাম অভিযোগ করেছিলেন যে তাঁদের সংগঠিত করা এ প্রচেষ্টা ছিল ‘ব্যাঙদের ওজন করার’ মতো।
রাশিয়ার এই আক্রমণ জেনারেল জিয়াকে রাতারাতি ‘ইন্টারন্যাশনাল ব্ল্যাক শিপ’ থেকে ঠান্ডাযুদ্ধের মুক্তিকামীতে পরিণত করে দিল। যুক্তরাষ্ট্র আবার আমাদের মিত্র হয়ে গেল, কারণ তখন রাশিয়া ছিল তাদের প্রধান শত্রু। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ইরানে অভ্যুত্থানে মাস কয়েক আগে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন শাহ, ফলে সিআইএ ওই এলাকায় তাদের মূল ভিত্তি হারিয়েছিল। পাকিস্তান সে স্থান দখলে নিল।
যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের কোটি কোটি ডলারে আমাদের সরকারি বাজার ও দপ্তর ভরে যেতে লাগল এবং আফগানদের ‘কমিউনিস্ট রেড আর্মি’র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে সহায়তা করতে আইএসআই-এর জন্য অস্ত্রও আসতে থাকল। হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান এবং ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সঙ্গে দেখা করার জন্য আমন্ত্রণ জাননো হলো জেনারেল জিয়াকে। তাঁরা তাঁকে প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিল।
প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো জিয়াকে তাঁর সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন, কারণ তিনি জিয়াকে চালাক মনে করেননি এবং নিজের জন্য হুমকিও মনে করেননি। তিনি জিয়াকে তাঁর ‘বানর’ বলে ডাকতেন। কিন্তু পরে দেখা গেল, জিয়া অত্যন্ত চালাক। তিনি আফগানিস্তানকে শুধু পশ্চিমাদের জন্যই না, বরং সুদান ও তাজিকিস্তানের মুসলমানদের জন্যও নিজেকে পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ব্যবহার করেছেন। মুসলিমরা পাকিস্তানকে বিধর্মীদের আক্রমণে আক্রান্ত মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে লাগল আর পশ্চিমারা সোভিয়েত ইউনিয়নের মাধ্যমে কমিউনিজমের বিস্তার রোধ করতে চাইল। আরব বিশ্ব থেকে অর্থ ভেসে আসতে লাগল, বিশেষত সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাহায্য পাঠাতে লাগল। আসতে লাগল স্বেচ্ছাসেবী যোদ্ধারা, যাঁদের মধ্যে ওসামা বিন লাদেন নামের এক সৌদি ধনকুবের ছিলেন।
আমরা পশতুনরা পাকিস্তান ও আফগানিস্তান– দুই দেশের মাঝে বিভক্ত হয়ে আছি এবং ১০০ বছরেরও বেশি সময় আগে ব্রিটিশদের ভাগ করে দেওয়া সীমান্তরেখাটা ঠিক সেভাবে মানি না। তাই সোভিয়েত আক্রমণের ফলে ধর্মীয় ও জাতীয়– উভয় কারণেই আমাদের রক্ত টগবগিয়ে উঠেছিল। মসজিদের ইমামরা তাঁদের খুতবায় প্রায়ই আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলের কথা বলতে লাগলেন, এবং রাশিয়ানদের বিধর্মী আখ্যা দিয়ে পরিপূর্ণ মুসলমান হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে জিহাদে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানাতে লাগলেন। ব্যাপারটা এমন যে জিয়ার অধীনে ইমান, সালাত (দৈনিক প্রার্থনা), জাকাত, সাওম (রমজান মাসে ভোর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সংযম পালন) এবং হজের পাশাপাশি জিহাদও ইসলামের ষষ্ঠ স্তম্ভ হয়ে উঠেছে। হজ হলো মক্কায় তীর্থযাত্রা, যা প্রত্যেক সক্ষম মুসলিমের জন্য জীবনে অন্তত একবার করা বাধ্যতামূলক। বাবা বলেন যে আমাদের জনগোষ্ঠী মূলত সিআইএ-এর কারণে জিহাদে উৎসাহিত হচ্ছে। শরণার্থী শিবিরের শিশুদের আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত পাঠ্যবই দেওয়া হতো, যেখানে যুদ্ধের মাধ্যমে মৌলিক গণিত শেখানো হতো। সেখানে উদাহরণ হিসেবে ছিল, ‘যদি ১০ জন রুশ বিধর্মীর মধ্যে পাঁচজন বিধর্মী একজন মুসলিমের হাতে নিহত হয়, তাহলে আরো পাঁচজন বিধর্মী বাকি থাকে’ অথবা ‘১৫টি বুলেট - ১০টি বুলেট = ৫টি বুলেট’।
আমার বাবার জেলার কিছু ছেলে আফগানিস্তানে যুদ্ধে গিয়েছিল। বাবার মনে পড়ে, সুফি মোহাম্মদ নামের এক মাওলানা তাঁদের গ্রামে এসে ইসলামের শপথ নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আহ্বান জানালেন। অনেকেই গেল, তাদের ছিল পুরোনো রাইফেল, কুড়াল বা বাজুকা। আমরা বুঝতেই পারিনি এই মাওলানার সংগঠনই পরবর্তীকালে সোয়াত তালেবান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। ওই সময় আমার বাবার বয়স ছিল মাত্র ১২, যুদ্ধে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট ছোট। কিন্তু রুশরা ১০ বছর ধরে আফগানিস্তানে রয়ে গেল এবং ১৯৮০-এর দশকে কৈশোরে পদার্পণ করার পর বাবাও জিহাদি হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। যদিও পরে তিনি নামাজে অনিয়মিত হয়ে পড়ছিলেন, তিনি প্রতিদিন ভোরে বাড়ি ছেড়ে অন্য গ্রামের এক মসজিদে এক জ্যেষ্ঠ তালিবের কাছে কোরআন শিখতেন। তখন ‘তালিব’ বলতে কেবল ‘ধার্মিক ছাত্র’ বোঝাত। একসঙ্গে তাঁরা ৩০ পারা কোরআন পড়তেন– কেবল আউড়ে যাওয়া নয়, সঙ্গে ব্যাখ্যাটাও শিখতেন– যা খুব কম লোকেই করে।
সেই তালিব এত মোহনীয়ভাবে জিহাদের কথা বলতেন যে বাবা মোহগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। তিনি বারবার বাবাকে বোঝাতেন যে দুনিয়ার জীবন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এবং গ্রামের যুবকদের জন্য খুব স্বল্প সুযোগ-সুবিধা থাকে। আমাদের পরিবারের জমি-জমা ছিল খুব কম এবং বাবা তাঁর আর দশজন সহপাঠীর মতো কয়লার খনিতে কাজ করতে চাননি। সেটা ছিল কঠিন এবং বিপজ্জনক কাজ এবং সেখান থেকে বছরে বেশ কয়েকবার মৃত শ্রমিকদের কফিন গ্রামে ফিরে আসত। গ্রামের বেশিরভাগ ছেলের উচ্চাশা বলতে ছিল, সৌদি আরব বা দুবাইয়ে ভবন নির্মাণের কাজে যোগ দেওয়া। তাই বাহাত্তরজন কুমারীসমৃদ্ধ স্বর্গের কথা বেশ আকর্ষণীয়ই শোনাত। প্রতি রাতে বাবা প্রার্থনা করতেন, ‘হে আল্লাহ, তুমি মুসলিম এবং বিধর্মীদের মাঝে যুদ্ধের আগুন জ্বালাও, যাতে আমি তোমার রাস্তায় শহীদ হতে পারি।’
কিছুকালের জন্য তাঁর কাছে পৃথিবীর সবকিছুর চেয়ে মুসলিম পরিচয়ই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। তিনি নিজেকে ‘জিয়াউদ্দিন পাঁচপীরি’ নামে পরিচয় দেওয়া শুরু করলেন এবং মুখে দাড়ির প্রথম আভাস দেখা দিল। তাঁর ভাষায়, ওটা এক ধরনের ‘মগজ ধোলাই’। তাঁর ধারণা, ওই সময় আত্মঘাতী বোমার প্রচলন থাকলে তিনি আত্মঘাতী হামলাকারী হতেন। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই তিনি বেশ কৌতূহলী ব্যক্তি ছিলেন, কোনো কিছুকেই তিনি দেখতে যেমন মনে হয় তেমনভাবে গ্রহণ করতেন না; যদিও আমাদের সরকারি স্কুলে না বুঝে মুখস্থ করতে শেখানো হতো এবং শিক্ষকদের প্রশ্ন করার অনুমতি ছাত্রদের ছিল না।
শহীদ হিসেবে বেহেশতে প্রবেশ করার জন্য প্রার্থনা করার দিনগুলোতেই বাবার সঙ্গে মায়ের ভাই ফয়েজ মোহাম্মদের সঙ্গে দেখা হয় এবং তিনি তাদের পরিবারের সঙ্গে মেলামেশায় অভ্যস্ত হন ও আমার নানার হুজরায় যাওয়া শুরু করেন। তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী দলের হয়ে স্থানীয় রাজনীতি শুরু করলেন এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিপক্ষে চলে গেলেন। আমার নামে নাম মালালাই– এর সম্পর্কে যিনি কবিতা লিখেছেন, পেশাওয়ারের সেই কবি রহমত শাহ সায়েল, সে সময় একটি বিখ্যাত কবিতা লিখেছিলেন।
আফগানিস্তানের ঘটনাকে ‘দুই হাতির যুদ্ধ’ আখ্যায়িত করে লিখেছিলেন, যুদ্ধটা যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের, আমাদের নয়। তিনি এটাও বলেছেন, আমরা পশতুনরা ‘দুই হিংস্র জন্তুর পদদলিত ঘাসের মতো।’ আমি ছোট থাকতে বাবা প্রায়ই কবিতাটি আমাকে শুনাতেন, কিন্তু এর অর্থ আমি তখন বুঝতাম না। বাবা ফয়েজ মোহাম্মদের প্রতি খুব সন্তুষ্ট ছিলেন এবং ভাবলেন, ফয়েজ অনেক ভেবেচিন্তে কথা বলেন এবং তিনি আমাদের দেশের পুঁজিবাদী শাসন ও অশান্তি থামাতে চান– যেখানে বছরের পর বছর একই পরিবার বা বংশ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে এবং গরিবরা হয়ে পড়ে আরো গরিব। বাবা নিজেকে দুই চরমপন্থার মাঝে হারিয়ে ফেলতেন– একটি হলো ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমাজতন্ত্র, অন্যটা হলো ইসলামী জঙ্গিবাদ। আমার ধারণা, তিনি মাঝামাঝি কোনো একটা পন্থা বেছে নিয়েছিলেন।
দাদার প্রতি বাবার এক ধরনের ভয় ও শ্রদ্ধামিশ্রিত সম্মানবোধ ছিল, তিনি আমাকে নানা চমকপ্রদ কাহিনী শোনাতেন, কিন্তু সঙ্গে এটাও বলতেন যে একজন মানুষকে ভালো বলার জন্য দাদা যেসব মানদণ্ড ঠিক করেছিলেন, তিনি নিজে সেই মানদণ্ড ছুঁতে পারেননি। তিনি একজন জনপ্রিয় এবং আবেগপ্রবণ বক্তা ছিলেন। তিনি যদি আরো একটু কূটনীতির আশ্রয় নিতেন, আর মামাতো-চাচাতো ভাইদের উন্নতি দেখে ঈর্ষাকাতর না হতেন, কলহে না জড়াতেন, তবে তিনি একজন নেতা হতে পারতেন। পশতুন সমাজে মামাতো-চাচাতো-খালাতো-ফুপাতো ভাইরা যদি কারো চেয়ে কেউ বেশি জনপ্রিয়, ধনী বা প্রভাবশালী হয়ে পড়ে, অন্যদের পক্ষে সেটা সহ্য করা কঠিন।
দাদার এক জ্ঞাতিভাই তাঁর স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। চাকরির সময় তিনি সার্টিফিকেটে নিজের বয়স দাদার চেয়ে কম দিয়েছিলেন। আমাদের লোকজন তাদের সঠিক জন্মতারিখ জানে না, উদাহরণস্বরূপ আমার মাও জানেন না। আমরা বিভিন্ন ঘটনা, যেমন ভূমিকম্পের মাধ্যমে সাল মনে রাখি। কিন্তু দাদা জানতেন যে তাঁর জ্ঞাতিভাই আসলে তাঁর চেয়ে বড়। তিনি এতই রেগে গেলেন যে পুরো একদিন ধরে বাসে ভ্রমণ করে মিঙ্গোরায় গিয়ে সোয়াতের শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলেন। তিনি বললেন, ‘সাহেব, আমার এক জ্ঞাতিভাই আমার চেয়ে ১০ বছরের বড়, কিন্তু আপনার সনদ অনুযায়ী সে আমার ১০ বছরের ছোট।’ তাই মন্ত্রী বললেন, ‘ঠিক আছে, মাওলানা, আপনার জন্য আমি কি লিখতে পারি? কুয়েটার ভূমিকম্পের সালে আপনার জন্মসাল হলে আপত্তি আছে?’ দাদা রাজি হলেন, ফলে তাঁর নতুন জন্মসাল হলো ১৯৩৫, যার ফলে তিনি তাঁর জ্ঞাতিভাইয়ের তুলনায় বেশ তরুণ হয়ে গেলেন।
এই পারিবারিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে বাবা তাঁর জ্ঞাতিভাইদের দ্বারা উৎপীড়িত হতেন। তারা জানত, বাবা তাঁর চেহারা নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগতেন, কারণ স্কুলের শিক্ষকরা সুদর্শন ছেলেদের ফর্সা রঙের জন্য তাদের পক্ষপাতিত্ব করত। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে ভাইরা বাবাকে থামিয়ে তাঁর খাটো উচ্চতা এবং শ্যামলা রঙের জন্য হয়রানি করত। আমাদের সমাজে এসব ছোটখাটো ব্যাপারের জন্য প্রতিশোধ নিতে হয়, কিন্তু বাবা তাদের তুলনায় অনেক ছোট ছিলেন।
বাবা সব সময় ভাবতেন, তিনি দাদাকে সন্তুষ্ট করার মতো যথেষ্ট ভালো কিছু কখনোই করতে পারবেন না। দাদার হাতের লেখা খুবই সুন্দর ছিল, কিন্তু বাবা অনেক যত্ন নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাতের লেখা অনুশীলন করলেও দাদা কখনোই তাঁর প্রশংসা করেননি।
দাদি সব সময় বাবাকে উজ্জীবিত রাখতেন– তিনি দাদির প্রিয় সন্তান ছিলেন এবং দাদি ভাবতেন, তাঁর জন্য অনেক ভালো কিছু উন্মোচিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে। তিনি বাবাকে এতই ভালোবাসতেন যে নিজে না খেয়ে বাবাকে তার ভাগের চেয়ে বেশি মাংস আর ননী দিতেন। কিন্তু তখনকার দিনে গ্রামে বিদ্যুৎ না থাকায় সেখানে পড়ালেখা করা সহজ ছিল না। তিনি হুজরায় তেলের কুপি দিয়ে পড়তেন এবং এক সন্ধ্যায় তিনি ঘুমিয়ে পড়লে তেলের কুপি উল্টে যায়। সৌভাগ্যক্রমে আগুন ধরার আগেই দাদি বাবাকে উদ্ধার করেন। দাদির দৃঢ় বিশ্বাসই বাবাকে এই আত্মবিশ্বাস দিয়েছে যে তিনি নিজের চলার মসৃণ পথ নিজেই খুঁজে নেবেন। এই পথই পরে আমাকে দেখাবেন।
তবে দাদিও একদিন বাবার প্রতি অত্যন্ত রাগান্বিত হয়েছিলেন। ‘দেরাই সাইদান’ নামে এক আধ্যাত্মিক স্থান থেকে সাধুরা এসে গ্রামে গ্রামে ভিক্ষা করে আটা চাইতেন। একদিন দাদা-দাদি বাইরে ছিলেন এবং বাসায় এ রকম কিছু লোক এলো। বাবা তখন কাঠের বাক্সের সিলমোহর ভেঙে সেখান থেকে ভুট্টা নিয়ে তাদের বাটি ভরে দিলেন। দাদা-দাদি বাসায় ফিরে এ ঘটনা শুনে ভীষণ রাগান্বিত হন এবং বাবাকে মারেন।
পশতুনরা তাদের মিতব্যয়িতার জন্য বিখ্যাত (যদিও অতিথিদের প্রতি উদার), এবং দাদা অর্থ নিয়ে একটু বিশেষভাবে যত্নশীল ছিলেন। তাঁর কোনো সন্তান ভুলক্রমে খাবার ছিটালে তিনি রেগে আগুন হয়ে যেতেন। তিনি ছিলেন কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ একজন মানুষ এবং কেন তাঁর সন্তানরা তাঁর মতো হয়নি, তা বুঝতে পারতেন না। শিক্ষক হিসেবে তিনি তাঁর পুত্রের স্কুলের ক্রীড়া এবং বয় স্কাউটের ফি-তে কিছুটা ছাড় পেতেন। ছাড়টা এতই নগণ্য যে বেশির ভাগ শিক্ষকই তেমন গুরুত্ব দিতেন না, কিন্তু দাদা বাবাকে জোর করে সেই সামান্য অর্থও মওকুফের জন্য আবেদন করালেন। বাবা এই কাজটা একেবারেই পছন্দ করেননি। হেডমাস্টারের অফিসের বাইরে অপেক্ষা করতে করতে বাবা ঘেমে গেলেন এবং ভেতরে তোতলামিটা আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। তিনি বলেছিলেন, ‘মনে হচ্ছিল, পাঁচ রুপির জন্য আমার সম্মান ডুবতে বসেছে।’ দাদা কখনই তাঁকে নতুন বই কিনে দেননি; বরং তাঁর সবচেয়ে ভালো ছাত্রদের বলে দিতেন তাদের পুরোনো বইগুলো বাবার জন্য রেখে দিতে এবং বছর শেষে বাবাকে তাদের বাসায় পাঠিয়ে বইগুলো নিয়ে আসতেন। বাবার খুব লজ্জা করত, কিন্তু বিদ্যার্জন করতে হলে এভাবে পড়ালেখা করা ছাড়া বাবার সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না। তাঁর বইয়ে কখনো নিজের নাম লেখা থাকত না, থাকত অন্য ছেলেদের নাম।
‘বই পুনর্ব্যবহার করা যে খারাপ তা নয়। আমি কেবল নতুন বই চাইতাম, যেটায় অন্য কেউ দাগ দেয়নি এবং যেটা আমার বাবার টাকায় কেনা’, বাবা বলেছিলেন।
দাদার অতিরিক্ত হিসাবি মনোভাবের প্রতি বাবার অপছন্দ বাবাকে প্রাসঙ্গিকভাবে এবং আত্মিকভাবে অত্যন্ত উদার করে তুলেছিল। তিনি তাঁর জ্ঞাতিভাইদের মধ্যে ‘ঐতিহ্যবাহী’ দ্বন্দ্বটার অবসান ঘটাতে বদ্ধপরিকর হয়ে উঠলেন। তাঁর হেডমাস্টারের স্ত্রী অসুস্থ হলে পরে তিনি নিজের রক্ত দিয়ে তাঁর জীবন বাঁচান। লোকটা অবাক হয়ে গিয়েছিল এবং বাবার ওপর অত্যাচার করার দরুণ তাঁর কাছে ক্ষমা চান। বাবা যখন তাঁর ছোটবেলার কাহিনী শোনাতেন, তিনি সবসময়ই বলতেন যে যদিও দাদা কড়া প্রকৃতির লোক ছিলেন, তিনি বাবাকে সেরা উপহারটিই দিয়েছিলেন– সেটা হলো শিক্ষা। তিনি বাবাকে ইংরেজি শেখানোর জন্য মাদ্রাসার পরিবর্তে সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়েছিলেন, যদিও তিনি ইমাম হওয়ায় মানুষ এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছিল। দাদা তাঁর মনে শিক্ষা এবং জ্ঞানের প্রতি অনুরাগের জন্ম দিয়েছিলেন এবং মানবাধিকারের প্রতি সচেতন হতে শিখিয়েছিলেন, যে গুণ পরে আমিও পেয়েছি। জুমার খুতবায় দাদা গরিব মানুষ এবং জমিদারদের নিয়ে কথা বলতেন এবং বোঝাতেন যে ইসলাম কত কঠোরভাবে সামন্তবাদের বিরুদ্ধে কথা বলে। তিনি আরবি ও ফার্সিও বলতেন এবং শব্দচয়নে গভীর যত্ন নিতেন। তিনি শেখ সাদি, আল্লামা ইকবাল এবং রুমির বিখ্যাত কবিতা পড়ে শোনাতেন– এত আবেগের সঙ্গে আবৃত্তি করতেন যে মনে হতো তিনি অগ্নিঝরা কণ্ঠে তিনি পুরো মসজিদটাকেই শেখাচ্ছেন।
আমার বাবার খুব ইচ্ছা হতো বাকপটু হতে, কোথাও না আটকে ফেটে পড়ে এমন কণ্ঠের অধিকারী হতে এবং এটাও জানতেন যে দাদা তাঁকে ডাক্তার ছাড়া অন্য কিছু বানানোর কথা চিন্তাই করতে পারতেন না। কিন্তু মেধাবী ছাত্র এবং প্রতিভাবান কবি হওয়া সত্ত্বেও বাবা গণিত ও বিজ্ঞানে দুর্বল ছিলেন এবং হতাশায় ভুগতেন। তাই তিনি জেলার বার্ষিক উপস্থিত বক্তৃতায় অংশ নিয়ে দাদাকে গর্বিত করতে চাইলেন। সবাই তাঁকে পাগল ভাবল। তাঁর শিক্ষক এবং বন্ধুরা তাঁকে নিরস্ত করার চেষ্টা করল, দাদা তাঁর বক্তৃতা লিখে দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বেশ ভালো একটি বক্তৃতা লিখে দেন, বাবা ওটা অনুশীলন করতে থাকেন। পাহাড়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রতিটি শব্দ তিনি স্মৃতিতে গেঁথে নিলেন, আকাশ এবং পাখিদের কাছে বক্তৃতা শোনাতে লাগলেন, যেহেতু বাসায় কোনো গোপনীয়তা ছিল না।
যেখানে বাবারা থাকতেন, সেখানে করার তেমন কাজ ছিল না, তাই প্রতিযোগিতার দিন অনেক লোকসমাগম হলো। ভালো বক্তা হিসেবে পরিচিত কিছু ছেলেও বক্তব্য রাখল। অবশেষে বাবাকে সামনে ডাকা হলো। ‘আমি ডায়াসের সামনে দাঁড়ালাম, আমার হাত কাঁপছিল, হাঁটু বাড়ি খাচ্ছিল। আমি এতই খাটো ছিলাম যে ডায়াসের ওপর দিয়ে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না, এতই ভয় পাচ্ছিলাম যে সবার চেহারা ঝাপসা লাগছিল। আমার হাতের তালু ঘামছিল আর মুখের ভেতরটা ছিল কাগজের মতো শুকনো।’
তিনি তাঁর সামনে উপস্থিত প্রতারকসম বর্ণগুলো ভুলে যেতে চাইলেন, যেগুলো তাঁর ভেতর থেকে উঠে গলার ভেতর আটকে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু যখন তিনি কথা বলা শুরু করলেন, সুন্দর উড়ন্ত প্রজাপতির মতো কথাগুলো বাবার মুখ দিয়ে ভেসে আসতে লাগল। দাদার মতো তাঁর গলা সেভাবে খোলেনি, কিন্তু তাঁর কণ্ঠে আবেগ ফুটে উঠল এবং তিনি পড়তে পড়তে যতই এগিয়ে গেলেন, ততই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠলেন।
বক্তৃতার শেষে মানুষের প্রশংসা ও করতালিতে চতুর্দিক মুখরিত হয়ে উঠল। শ্রেষ্ঠ ব্যাপারটা ছিল– বাবা যখন প্রথম পুরস্কারের কাপটা নেওয়ার জন্য সামনে গেলেন, তিনি দাদাকে হাততালি দিতে দেখলেন। বাবার চারপাশে দাঁড়ানো সবাই তাঁর পিঠ চাপড়ে দিচ্ছিল। বাবা বলেন, ‘ওটাই ছিল আমার বাবাকে খুশি করতে পারা আমার প্রথম কাজ।’
এর পর থেকে বাবা জেলার সব প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে লাগলেন। দাদা বক্তৃতাগুলো লিখে দিতেন আর বাবা প্রায় প্রতিবারই প্রথম হতেন। স্থানীয়ভাবে বাবা একজন চিত্তাকর্ষক বক্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করলেন। বাবা তাঁর দুর্বলতাকে শক্তিতে পরিণত করেছিলেন। প্রথমবারের মতো দাদা সবার সামনে বাবার প্রশংসা করতে আরম্ভ করলেন। তিনি গর্বভরে বলতেন, ‘জিয়াউদ্দিন হলো শাহীন’—বাজপাখি, কারণ এই পাখিই অন্য সব পাখির চেয়ে উঁচু দিয়ে ওড়ে। “তোমার নাম লিখবে ‘জিয়াউদ্দিন শাহীন’,” দাদা বলেছিলেন। কিছুদিন বাবা তাই করেছিলেন। কিন্তু একসময় বুঝতে পারলেন যে যদিও বাজপাখি সবচেয়ে উঁচু দিয়ে ওড়ে, এটি একটি নিষ্ঠুর পাখি। তাই তিনি এ নাম লেখা বন্ধ করে গোত্রীয় নাম ‘জিয়াউদ্দিন ইউসসুফজাই’ লেখা শুরু করলেন।