আমি মালালা বলছি
আবর্জনার পর্বতের শিশুরা
৬.
আবর্জনার পর্বতের শিশুরা
খুশাল স্কুলের শিক্ষার্থী বাড়তেই থাকল, সঙ্গে সঙ্গে আমরাও বাসা পাল্টালাম এবং শেষমেশ আমাদের একটা টেলিভিশন হলো। আমার প্রিয় অনুষ্ঠান ছিল ‘শাকা লাকা বুম বুম’। সাঞ্জু নামের একটা ছেলেকে নিয়ে এই ভারতীয় শিশুতোষ অনুষ্ঠানের কাহিনী রচিত হয়েছিল। তার এমন একটি পেনসিল ছিল, যেটা দিয়ে সে যা-ই আঁকত তাই সত্যি হয়ে যেত। সে সবজি বা পুলিশ আঁকলে আশ্চর্যজনকভাবে সেগুলো সত্যিই এসে পড়ত। সে ভুলে একটা সাপ এঁকে ফেললে সে সাপটা মুছে ফেলত এবং সত্যিকারের সাপটাও চলে যেত। সে মানুষকে সাহায্য করত এই পেনসিলের সাহায্যে—সে তার বাবা-মাকে সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা করেছিল—এবং আমি পৃথিবীর সবকিছুর চেয়ে বেশি চাইতাম সেই জাদুর পেনসিল।
রাতে আমি প্রার্থনা করতাম, ‘আল্লাহ, আমাকে সাঞ্জুর পেনসিলটা দাও। আমি কাউকে বলব না। তুমি আমার আলমারিতে ওটা পাঠিয়ে দাও। আমি সবাইকে সুখী করতে এটা ব্যবহার করব।’ প্রার্থনা শেষ করেই আমি ড্রয়ার খুলে দেখতাম। পেনসিলটা কখনোই সেখানে থাকত না, কিন্তু আমি জানতাম ওটা পেলে প্রথমে কাকে সাহায্য করতে হবে। আমাদের নতুন বাসার রাস্তা বরাবর একখণ্ড পরিত্যক্ত জমি ভাগাড় হিসেবে ব্যবহৃত হতো—সোয়াতে কোনো নির্দিষ্ট ময়লার ভাগাড় নেই। দ্রুতই সেটা আবর্জনার পর্বত হয়ে গেল। বিশ্রী গন্ধ থাকায় আমরা ওটার আশপাশে হাঁটতে পছন্দ করতাম না। আমরা সেখানে ইঁদুর দৌড়াতে দেখতাম এবং ওপরে কাকের চক্কর দেখতাম।
একদিন আমার ভাইরা বাসায় না থাকায় মা আমাকে কিছু ডিমের ও আলুর খোসা ফেলতে পাঠালেন। যতই এগোতে থাকলাম, আমি ততই নাক কুঁচকাতে থাকলাম, মাছি তাড়ানোর জন্য চাপড় দিতে থাকলাম এবং আমার সুন্দর জুতাগুলো দিয়ে যাতে কোনো কিছু না মাড়াই, সেদিকে খেয়াল রাখতে থাকলাম। পচতে থাকা খাবারের স্তূপের ওপর আমার ময়লাটা ছুড়ে দিয়ে আমি কিছু একটা নড়তে দেখে লাফিয়ে উঠলাম। সেটা ছিল আমার বয়সী একটা মেয়ে। তার চুল ছিল জট পাকানো এবং চামড়া ছিল ক্ষতে ভরা। আমাদের গোসল করানোর জন্য শাশাকা নামের মহিলাটির কথা বলে গ্রামে ভয় দেখানো হতো; মেয়েটি ছিল আমার কল্পনার শাশাকার মতো। তার কাছে বড় একটা বস্তা ছিল এবং সে ময়লা আলাদা আলাদা করে জড়ো করছিল—স্তূপ কৌটার জন্য, একটা বোতলের ছিপির জন্য, একটা কাচের জন্য, অন্যটা কাগজের জন্য। কাছেই কিছু ছেলে সুতায় চুম্বক ঝুলিয়ে ময়লার স্তূপে ধাতু খুঁজছিল। আমি বাচ্চাগুলোর সঙ্গে কথা বলতে চাইছিলাম; কিন্তু খুব ভয় পাচ্ছিলাম।
সেদিন বিকেলে বাবা স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পর আমি তাঁকে সেই পরিত্যক্ত আবর্জনার মধ্যে খোঁজাখুঁজি করতে থাকা বাচ্চাগুলোর কথা বললাম এবং দেখতে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেন; কিন্তু তারা পালিয়ে গেল। তিনি আমাকে বোঝালেন, বাচ্চাগুলো তাদের কুড়ানো জিনিস কয়েক রুপির বিনিময়ে বিক্রি করবে এবং দোকানগুলো বেশি লাভের বিনিময়ে সেগুলো অন্য কোথাও বিক্রি করবে। বাসায় ফেরার পথে আমি খেয়াল করলাম, তাঁর চোখে পানি।
‘আবা, তোমার স্কুলে ওদেরকে বিনামূল্যে পড়তে দিতে হবে,’ আমি অনুরোধ করলাম। বাবা হাসলেন। আমি আর মা এরই মধ্যে বেশ কিছু মেয়েকে বিনা বেতনে অধ্যয়নের সুযোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করেছি।
যদিও আমার মা শিক্ষিত ছিলেন না, পরিবারে তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত, বাস্তবতা মোকাবিলায় পারদর্শী, কর্মঠ এবং সাংসারিক কাজে সিদ্ধহস্ত। বাবা ছিলেন বক্তা। মা সব সময় মানুষকে সাহায্য করতেন। মাঝেমধ্যে বাবা রেগে যেতেন—দুপুরে খাওয়ার সময় বাসায় ফিরে তিনি হাঁক দিতেন, ‘তরপেকাই, আমি বাড়ি ফিরেছি’ এবং টের পেতেন মা বাসায় নেই, তাঁর জন্য খাবারও নেই। এরপর তিনি বুঝে ফেলতেন, মা কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে হাসপাতালে গেছেন অথবা কোনো সংকটাপন্ন পরিবারকে সাহায্য করতে গেছেন। এর পর বাবার রাগ আর থাকত না। তবে মাঝেমধ্যে মা চীনাবাজারে জামা কিনতে বের হতেন এবং সেটা হতো অন্য ব্যাপার।
আমরা যেখানেই থাকি না কেন, মা সব সময় মানুষ দিয়ে ঘরটা ভরে ফেলতেন। আমার জ্ঞাতিবোন আনিসা ও আমি একই ঘরে ঘুমাতাম। সে স্কুলে যাওয়ার জন্য আমাদের সঙ্গে থাকতে এসেছিল। আমাদের বাসার একসময়কার গৃহকর্মী সুলতানার মেয়ে শেহনাজও আমার সঙ্গে থাকত। শেহনাজ ও তার বোনকেও আবর্জনা থেকে ভাঙাড়ি সংগ্রহ করতে পাঠানো হতো; তাদের খুবই দরিদ্র অবস্থায় রেখে তাদের বাবা মারা যায়। তাদের এক ভাই মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল এবং সব সময় অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ করত, যেমন কাপড়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া বা ঠান্ডা থাকার জন্য আমরা যে বৈদ্যুতিক পাখা দিয়েছিলাম, সেটা বিক্রি করে দেওয়া। সুলতানা খুবই রগচটা ছিলেন, মা তাঁকে বাসায় রাখতে চাননি, কিন্তু বাবা তাঁর জন্য অল্প ভাতা এবং শেহনাজ ও তার অন্য ভাইয়ের স্কুলে পড়ার ব্যবস্থা করলেন। শেহনাজ কখনোই স্কুলে যায়নি, তাই সে আমার চেয়ে দুই বছরের বড় হওয়া সত্ত্বেও দুই ক্লাস নিচে ভর্তি হলো এবং আমি যাতে তাকে সাহায্য করতে পারি, সে জন্য আমাদের সঙ্গে থাকতে এলো।
নুরিয়ার মা খারু আমাদের ধোয়ামোছার কিছু কাজ করে দিত এবং আলিশপার মা খালিদা আমার মাকে রান্নার কাজে সাহায্য করত। খালিদাকে এমন এক বুড়োর কাছে বিয়ের নামে বিক্রি করে দেওয়া হলো, যে তাকে মারধর করত। একপর্যায়ে সে তিন মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে এলো। তাঁর নিজ পরিবার তাঁকে গ্রহণ করেনি কারণ আমরা ধরে নিই, যে মহিলা তাঁর স্বামীকে ত্যাগ করে, সে তার পরিবারের জন্য লজ্জা বয়ে আনে। কিছুদিন তাঁর তিন মেয়েও ভাঙাড়ি সংগ্রহ করে দিনাতিপাত করে। তাঁর কাহিনীটা অনেকাংশে আমার পড়তে শুরু করা উপন্যাসগুলোর মতোই।
স্কুলটা ততদিনে অনেক বিস্তৃত হয়ে গেছে। ভবন সংখ্যা বেড়ে হয়েছে তিনটা। লান্দিকাসে মূল ভবনটা প্রাথমিক বিদ্যালয়, ইয়াহিয়া স্ট্রিটে মেয়েদের জন্য উচ্চবিদ্যালয় এবং বৌদ্ধমন্দিরের ধ্বংসাবশেষের কাছে একটি গোলাপ বাগানের সন্নিকটে বালক উচ্চ বিদ্যালয়। শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৮০০। যদিও খুব বেশি অর্থোপার্জন হচ্ছিল না, বাবা প্রায় ১০০ শিক্ষার্থীকে বিনা বেতনে পড়ালেখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি ছেলে ছিল, যার বাবা শারাফাত আলী আমার বাবাকে কানাকড়িহীন কলেজছাত্র থাকা অবস্থায় সাহায্য করেছিলেন। গ্রামে থাকার সময় থেকেই তাঁদের বন্ধুত্ব ছিল। শারাফাত আলী বিদ্যুৎ কোম্পানিতে চাকরি করতেন এবং টাকা জমাতে পারলেই বাবাকে কয়েকশ রুপি দিতেন। বাবা তাঁর ঋণ শোধ করতে পেরে খুব খুশি হয়েছিলেন। আমার ক্লাসে কাওসার নামে একটি মেয়ে ছিল। ওর বাবা কাপড় এবং গায়ে দেয়ার চাদরে নকশা তুলতেন। আমাদের এলাকা এই শিল্পের জন্য বিখ্যাত। যখন স্কুল থেকে পর্বতে বেড়াতে নেওয়া হতো, আমি নিজের হাতখরচা থেকে কাওসারের টাকাটা দিতাম, কারণ আমি জানতাম তার সামর্থ্য নেই।
গরিব ছেলেমেয়েদের বিনা বেতনে পড়তে দিয়ে বাবা যে কেবল অর্থ উপার্জনের সুযোগই হারালেন তা নয়। কোনো কোনো বড়লোক বাবা-মা যখন জানতে পারলেন যে তাদের ঘরবাড়ি পরিষ্কার করার বা জামা সেলাই করা লোকজনের বাচ্চাদের সঙ্গে তাদের বাচ্চারা পড়ালেখা করছে, তারা তাদের বাচ্চাদের স্কুল থেকে নিয়ে গেলেন। তারা ভাবল, গরিব ঘরের বাচ্চাদের সঙ্গে পড়ালেখা করা তাদের বাচ্চাদের পক্ষে লজ্জাজনক। মা বলতেন, বাসায় খেতে না পেলে দরিদ্র ছেলেমেয়েদের পক্ষে পড়ালেখা করা কঠিন। তাই কোনো মেয়ে সকালে আমাদের বাসায় নাশতা খেতে আসত। বাবা মজা করে বলতেন, আমাদের বাসাটা বোর্ডিং হাউস হয়ে গেছে।
আশপাশে এত মানুষ থাকায় আমার পক্ষে পড়ালেখা করাই কঠিন হয়ে পড়ল। নিজের রুম থাকায় আমি খুব খুশি ছিলাম, এমনকি বাবা আমার জন্য একটা ড্রেসিং টেবিলও কিনে দিয়েছিলেন। কিন্তু আরো দুটো মেয়ে আমার সঙ্গে থাকা শুরু করল। ‘আমার আলাদা জায়গা চাই’ বলে কাঁদতাম আমি। কিন্তু পরক্ষণেই অপরাধবোধে ভুগতাম, কারণ আমি জানতাম আমরা ভাগ্যবান। আমি আবর্জনার স্তূপের বাচ্চাদের কথা চিন্তা করলাম। আবর্জনার স্তূপের মেয়েটার কালিঝুলি মাখা চেহারাটা আমি থেকে থেকে দেখতে লাগলাম এবং তাদের স্কুলে বিনা বেতনে পড়াশোনার সুযোগ দেওয়ার জন্য বাবাকে বিরক্ত করতে লাগলাম।
বাবা বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে এই বাচ্চাগুলোই পরিবারের রুটির জোগানদাতা এবং সে জন্য তারা যদি বিনা বেতনে স্কুলে যায়, তাদের পরিবারকে উপোস করতে হবে। তবুও তিনি আজাদ-এ-খান নামে একজন বিত্তশালী জনহিতৈষী ব্যক্তির সহযোগিতায় একটি লিফলেট ছাপালেন। সেখানে লেখাছিল শিক্ষা কি এসব শিশুর অধিকার নয়? বাবা এসব লিফলেট হাজার হাজার ছাপালেন। স্থানীয় জনসমাবেশ এবং শহরের আশেপাশে বিতরণ করতে লাগলেন।
ততদিনে বাবা সোয়াতে একজন সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠছেন। যদিও তিনি খান বা বড়লোক ছিলেন না, মানুষ তারঁ কথা শুনত। তাঁরা জানত বাবা কর্মশালা বা সেমিনারে কৌতূহলোদ্দীপক কোনো কিছু বলবেন এবং কর্তৃপক্ষ বা সেনাবাহিনীর সমালোচনা করতে ভয় পেতেন না। তখন দেশে সেনা শাসন চলছিল। বাবা সেনাবাহিনীর কাছেও পরিচিত হয়ে উঠছিলেন এবং তাঁর বন্ধুরা বললেন যে স্থানীয় কমান্ডার তাঁকে জনসমক্ষে ‘মারাত্মক’ বলে সম্বোধন করেছে। বাবা বোঝেননি যে ব্রিগেডিয়ার আসলে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমাদের দেশে, যেখানে সেনাবাহিনী এত ক্ষমতাবান, সেখানে একথা ভালো ইঙ্গিত বহন করে না।
বাবার একটি ব্যক্তিগত ঘৃণার বিষয় ছিল ‘ভুতুড়ে স্কুল’। দূরবতী এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা স্কুল দেওয়ার নাম করে সরকারের কাছ থেকে অর্থ নিত। সেসব স্কুলে কোনোদিন কোনো ছাত্রছাত্রী আসত না। বরং তারা হুজরার জন্য সেইসব ভবন ব্যবহার করতেন, এমনকি তাদের গৃহপালিত পশুও রাখতেন। জীবনে কোনোদিন পড়াননি এমন লোক শিক্ষকের বেতন, ভাতা উত্তলন করেছেন এমন নজিরও আছে। দুর্নীতি ও অপশাসনের বাইরেও বাবার এক অন্যতম দুশ্চিন্তা ছিল পরিবেশ নিয়ে। মিঙ্গোরা দ্রুত বিস্তার লাভ করছিল—প্রায় ১,৭৫,০০০ মানুষ এখানে বসবাস করত। একদা আমাদের সতেজ বায়ুপ্রবাহ যানবাহন ও চুলার ধোঁয়ার কারণে অত্যন্ত দূষিত হয়ে পড়ছিল। আমাদের পাহাড়-পবর্তের গাছগুলো কাঠ ও লাকড়ির জন্য কেটে ফেলা হচ্ছিল। বাবা বলেছিলেন, শহরের জনসংখ্যার মাত্র অর্ধেকই নিরাপদ পানি পায় এবং আমাদের মতো অনেকেই স্যানিটেশন হতে বঞ্চিত। তাই বাবা তাঁর বন্ধুদের নিয়ে ‘গ্লোবাল পিস কাউন্সিল’ নামে কিছু একটা প্রতিষ্ঠা করলেন। এমন নাম থাকা সত্ত্বেও তাঁদের কার্যক্রম ছিল স্থানীয়। নামটা ছিল বাগাড়ম্বরপূর্ণ এবং বাবা এটা নিয়ে প্রায় হাসতেন। কিন্তু সংগঠনটির লক্ষ্য ছিল আন্তরিক; সোয়াতের পরিবেশ সংরক্ষণ করা এবং স্থানীয় জনগণের মাঝে শান্তি ও শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়া।
আমার বাবা কবিতা লিখতে ভালোবাসতেন। মাঝেমধ্যে তিনি প্রেমের কবিতাও লিখতেন। কিন্তু বেশির ভাগ সময় ‘অনার কিলিং’ এবং নারী অধিকারের মতো বিতর্কিত বিষয় নিয়ে লিখতেন। একবার তিনি কাবুল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে একটি কবিতা উৎসবে যোগ দিতে আফগানিস্তান গিয়েছিলেন এবং সেখানে শান্তি নিয়ে একটি কবিতা পাঠ করেছিলেন। সমাপনী বক্তৃতায় এই কবিতাটিকে সবচেয়ে উদ্দীপনামূলক বলে উল্লেখ করা হয়েছিল এবং কোনো শ্রোতা তাঁকে পুরো স্তবক এবং শ্লোক পুনরাবৃত্তি করতে অনুরোধ করেছিলেন। নির্দিষ্ট কোনো পঙ্ক্তি ভালো লাগলে তাঁরা ‘ওয়াহ-ওয়াহ’ বা ‘সাবাশ’ বলে চিৎকার করে উঠছিল। আমার দাদাও গর্বিত হয়ে উঠছিলেন। তিনি বলতেন, ‘বৎস, জ্ঞানের আকাশে তুমি যেন নক্ষত্র।’।
আমরাও গবিত ছিলাম, কিন্তু তাঁর উচ্চ সম্মান এবং বাহ্যিক ব্যস্ততার কারণে আমাদের আগের মতো সময় দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। মা-ই আমাদের জামাকাপড় কিনে দিতেন এবং অসুস্থ হলে হাসপাতালে নিয়ে যেতেন। যদিও আমাদের সংস্কৃতিতে এসব কাজ গ্রামের মহিলাদের একা করার কথা নয়। তাই আমার বাবার এক ভাগ্নে এসব কাজে মাকে সঙ্গ দিতেন। বাবা বাসায় থাকলে সন্ধ্যায় ছাদে বসে বন্ধুদের সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে আলাপ করতেন। সত্যিকার অর্থে তাঁরা একটি বিষয় নিয়েই কথা বলতেন—৯/১১। এটা হয়তো পুরো বিশ্বকে বদলে দিয়েছে, কিন্তু সবকিছুর মধ্যবিন্দুতে ছিলাম আমরা। আল-কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার হামলার সময় কান্দাহারে অবস্থান করছিলেন এবং আমেরিকানরা তাঁকে ধরার জন্য, তাঁকে রক্ষাকারী তালেবান শাসনব্যবস্থা তুলে দেওয়ার জন্য আফগানিস্তানে হাজার হাজার সৈন্য পাঠিয়েছিল।
পাকিস্তানে আমরা তখনো একনায়কতন্ত্রেই ছিলাম, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। যেমনটা ১৯৮০-এর দশকে আফগানিস্তানে রাশিয়ানদের মোকাবিলা করতে প্রয়োজন হয়েছিল। ঠিক যেভাবে আফগানিস্তানে রাশিয়ার অনুপ্রবেশ জেনারেল জিয়ার জন্য সবকিছু বদলে দিয়েছিল, সেভাবেই ৯/১১ জেনারেল মোশাররফকে আন্তর্জাতিক অচ্ছুত হওয়া থেকে অব্যাহতি দিল। হঠাৎই তিনি জর্জ ডব্লিউ বুশ দ্বারা হোয়াইট হাউস এবং টনি ব্লেয়ার দ্বারা ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে আমন্ত্রিত হলেন। তবু একটা বড় সমস্যা রয়েই গেল। আমাদের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-ই তালেবানের জন্মদাতা। অনেক আইএসআই কর্মকর্তা ওদের অনেক নেতার সঙ্গে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। শুধু তাই নয়, একই আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। আইএসআই কর্নেল ইমাম দম্ভভরে বলতেন, তিনি ৯০ হাজার তালেবান যোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন এবং তালেবান শাসনামলে হেরাতে পাকিস্তানের কনসাল জেনারেল হয়েছিলেন।
আমরা মোটেও তালেবানের ভক্ত ছিলাম না। কারণ আমরা শুনেছিলাম, তারা মেয়েদের স্কুল ধ্বংস করেছে এবং বিরাট বিরাট বৌদ্ধমূর্তি ধূলিসাৎ করে দিয়েছে—আমাদের বৌদ্ধমূর্তিগুলো নিয়ে আমরা গর্ববোধ করতাম। কিন্তু অনেক পশতুন আফগানিস্তানে বোমাবর্ষণ বা যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানের সাহায্য করাটা পছন্দ করত না, এমনকি আমাদের আকাশসীমা পার হয়ে তালেবানের অস্ত্র সরবরাহ করাটাও তারা পছন্দ করত না। আমরা তখন জানতাম না যে মোশাররফ যুক্তরাষ্ট্রকে আমাদের বিমানাঙ্গনও ব্যবহার করতে দিচ্ছে।
আমাদের কোনো কোনো ধার্মিক লোক ওসামা বিন লাদেনকে বীর হিসেবে দেখত। সাদা ঘোড়ার পিঠে বসা লাদেনের পোস্টার বাজারে পাওয়া যেত, তাঁর ছবিওয়ালা মিষ্টির বাক্সও ছিল। ধর্মীয় নেতারা বলত যে ৯/১১ ছিল যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যান্য মানুষের প্রতি যা করছে তার প্রতিশোধ। কিন্তু তারা এই ব্যাপারটা এড়িয়ে গেল যে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের মানুষ ছিল নিরপরাধ, এমনকি আমেরিকার নীতি নিয়ে তাদের কিছুই করার ছিল না। পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট বলা আছে, হত্যা করা মহাপাপ। আমাদের মানুষ সবকিছুতেই ষড়যন্ত্র খোঁজে, অনেকেই তর্ক করল যে হামলাটা আসলে ইহুদিরা করেছিল, মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে আমেরিকার যুদ্ধ বাধানোর জন্য। কোনো কোনো পত্রিকায় লিখেছিল যে, সেদিন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে কোনো ইহুদি কাজ করতে যায়নি। আমার বাবা বলেছিলেন, এসব ফালতু কথা।
মোশাররফ আমাদের বলেছিলেন, আমেরিকানদের সহযোগিতা না করে আমাদের কোনো উপায় নেই। তাঁরা নাকি মোশাররফকে বলেছিলেন, ‘আমাদের পক্ষে না থাকলে তুমি সন্ত্রাসী’ এবং আমাদের ‘বোমা মেরে প্রস্তরযুগে পাঠানো’র ভয় দেখিয়েছিল—যদি আমরা তাদের বিপক্ষে থাকি। কিন্তু আমরা ঠিক সহযোগিতা করছিলাম না, কারণ আইএসআই তখনো তালেবান যোদ্ধাদের অস্ত্র সরবরাহ করছিল এবং তাদের নেতাদের কুয়েটায় নিরাপদ আশ্রয় দিচ্ছিল। তারা এমনকি শত শত পাকিস্তানি যোদ্ধাকে আকাশপথে উত্তর আফগানিস্তানের বাইরে নিয়ে যেতে আমেরিকানদের রাজি করিয়ে ফেলল। আইএসআই প্রধান আমেরিকাকে আফগানিস্তানে হামলা স্থগিত রাখতে বললেন, যতদিন পযর্ন্ত না তিনি কান্দাহারে গিয়ে তালেবান নেতা মোল্লা ওমরকে অনুরোধ করেন লাদেনকে হস্তান্তর করতে; কিন্তু তিনি তার পরিবর্তে তালেবানকে সাহায্যের প্রস্তাব দিয়ে বসেন।
আফগানিস্তানে রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা মাওলানা সুফি মোহাম্মদ আমাদের প্রদেশে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করল। আমাদের পূর্বপুরুষরা যেখানে ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল, সেই মালাকান্দে তিনি বিরাট এক সভার ডাক দিলেন। পাকিস্তান সরকার তাঁকে বাধা দিল না। আমাদের প্রদেশের গভর্নর আদেশ জারি করলেন যে কেউ ন্যাটোর বিরুদ্ধে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে চাইলে করতে কোনো বাধা নেই। প্রায় বারো হাজার তরুণ সোয়াত থেকে তালেবানকে সাহায্য দিতে গেল। অনেকেই আর ফিরে এলো না। তারা খুব সম্ভবত নিহত হয়েছিলেন, কিন্তু মৃত্যুর কোনো প্রমাণ না থাকায় তাদের স্ত্রীদেরও বিধবা ঘোষণা করা যাচ্ছিল না। তাদের জন্য ব্যাপারটা খুব কঠিন ছিল। আমার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ওয়াহিদ জামানের ভাই এবং শ্যালকও অনেকের সঙ্গে আফগানিস্তানে গিয়েছিলেন। তাদের স্ত্রী-সন্তানরা এখনো তাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি তাদের দেখতে গিয়েছিলাম এবং এখনো তাদের ভেতরকার দহন-আকুল আকাঙ্ক্ষা অনুভব করি। তবুও সবকিছুকেই আমাদের শান্তিপূর্ণ উপত্যকা থেকে অনেক অনেক দূরে মনে হতো। আফগানিস্তান একশ মাইলেরও কম দূরে, কিন্তু সেখানে বাজাউর হয়ে যেতে হয়, যেটা পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমানার মধ্যে একটি উপজাতীয় এলাকা।
বিন লাদেন এবং তার লোকজন পূর্ব আফগানিস্তানে তোরাবোরার সাদা পর্বতের দিকে পালিয়েছিলেন, যেখানে তিনি রাশিয়ানদের সঙ্গে যুদ্ধ করার সময় সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন। তারা এসব সুড়ঙ্গ ও পাহাড়ের ওপর দিয়ে আরেক উপজাতীয় এলাকা কুররামে পালিয়ে গেল। তখন আমরা জানতাম না যে, বিন লাদেন সোয়াতে এসে প্রায় এক বছর ধরে ‘পশতুনওয়ালি’ নিয়মের আতিথেয়তার সুযোগ নিয়ে দুর্গম এক গ্রামে থেকেছিলেন।
সকলেই দেখছিলেন যে মোশাররফ দ্বিমুখী আচরণ করছেন আমেরিকার অর্থ নিচ্ছেন আবার জিহাদিদের সাহায্য করছেন, যেটাকে আইএসআই ‘কৌশলগত সম্পদ’ বলেছিল। আমেরিকা বলে, তারা আল-কায়েদার বিরুদ্ধে প্রচার চালানোর জন্য পাকিস্তানকে কোটি কোটি ডলার দেয়, কিন্তু আমরা কেউ এক পয়সাও দেখিনি। মোশাররফ ইসলামাবাদের রাওয়াল হ্রদের ধারে একটি বৃহৎ অট্টালিকা নির্মাণ করল এবং লন্ডনে একটি অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয় করল। প্রায়ই গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন অফিসাররা অভিযোগ করত যে আমরা যথেষ্ট কাজ করছি না, এবং হঠাৎই কোনো রাঘববোয়াল ধরা পড়ত। ৯/১১-এর মূল পরিকল্পনাকারী শেখ মোহাম্মদকে রাওয়ালপিন্ডিতে সেনাবাহিনীপ্রধানের বাসভবন থেকে মাত্র এক মাইল দূরে পাওয়া গেল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বুশ তবুও মোশাররফের প্রশংসা করতে লাগলেন এবং ওয়াশিংটনে আমন্ত্রণ জানালেন, ‘দোস্ত’ সম্বোধন করতে থাকলেন। বাবা ও তাঁর বন্ধুরা বিরক্ত হয়ে উঠলেন। তাঁরা বলতেন, আমেরিকানরা সব সময় পাকিস্তানে স্বৈরশাসকদের সঙ্গেই লেনদেন করে। ছোটবেলা থেকেই আমি রাজনীতিতে আগ্রহী ছিলাম এবং বাবার হাঁটু ধরে বসে বাবা ও তাঁর বন্ধুদের আলোচনা শুনতাম। কিন্তু আমি বাড়ির কাছের বিষয়গুলো নিয়ে বেশি সচেতন ছিলাম—ঠিক আমাদের রাস্তাটা নিয়েই। আমি স্কুলে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে সেই আবর্জনার স্তূপের বাচ্চাদের কথা আলোচনা করলাম এবং বললাম যে আমাদের সাহায্য করা উচিত। সবাই তা করতে চাইল না, কারণ তারা বলল যে, বাচ্চাগুলো নোংরা এবং সম্ভবত অসুস্থ। তাদের মা-বাবারা ও রকম বাচ্চাদের সঙ্গে স্কুলে পাঠাতে চাইবে না। আমি মেনে নিলাম না। ‘আমরা বসে বসে আশা করতে পারি সরকার সাহায্য করবে, কিন্তু তারা তা করবে না। যদি আমি এক-দুজন বাচ্চাকে সাহায্য করতে পারি এবং আরেকজন অন্য এক-দুজন বাচ্চাকে সাহায্য করে, তাহলে আমাদের মধ্যে সবাই তাদের সবাইকে সাহায্য করতে পারি।’
আমি জানতাম, মোশাররফের কাছে আবেদন জানানো নিরর্থক। আমার অভিজ্ঞতায়, বাবা এ ধরনের পরিস্থিতিতে সাহায্য করতে না পারলে একটা পথই ছিল। আমি সৃষ্টিকর্তার কাছে একটা চিঠি লিখলাম, ‘প্রিয় স্রষ্টা, আমি জানি তুমি সব দেখ, কিন্তু কিছু বিষয় আছে যেগুলো মনে হয় মাঝেমধ্যে তুমি খেয়াল করতে পারো না, যেমন এখন আফগানিস্তানে বোমাবর্ষণ। কিন্তু আমার মনে হয় না আমার বাড়ির রাস্তায় আবর্জনার স্তূপে থাকা বাচ্চাগুলোকে দেখে তুমি খুশি হবে। সৃষ্টিকর্তা, আমাকে যোগ্য হয়ে ওঠার শক্তি ও সাহস দাও, কারণ আমি এই পৃথিবীটাকে নিখুঁত সুন্দর করে তুলতে চাই। মালালা।’
সমস্যাটা হলো আমি জানতাম না তাঁকে চিঠিটা কীভাবে পাঠাব। কোনোভাবে মনে হলো এটাকে মাটির গভীরে পাঠাতে হবে, তাই প্রথমে বাগানে পুঁতে দিলাম। এরপর মনে হলো চিঠিটা নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তাই সেটা একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরলাম। কিন্তু সেটা খুব কাজের মনে হলো না। আমরা বহমান পানিতে পবিত্র আয়াত ভাসিয়ে দিই, তাই আমি সেটা প্রথমে রোল করলাম, তারপর একটা কাঠের টুকরার সঙ্গে বাঁধলাম, ওপরে একটা সিংহদন্তী ফুল বসিয়ে সোয়াত নদীতে বয়ে যাওয়া একটি শাখা নদীতে ভাসিয়ে দিলাম। সৃষ্টিকর্তা সেখানে এটা অবশ্যই খুঁজে পাবেন।
(চলবে)