আমি মালালা বলছি
দীর্ঘাঙ্গী হওয়ার প্রার্থনা
তেরো বছর বয়সে আমার বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে গেল। আমাকে সব সময়ই বড় দেখাত, কিন্তু হঠাৎ করেই আমার বন্ধুরা আমার চেয়ে লম্বা হয়ে গেল। ত্রিশজনের ক্লাসে আমি ছিলাম সবচেয়ে খাটো, তিনজনের একজন। বন্ধুদের সামনে বিব্রত বোধ করতাম আমি। প্রতি রাতে আমি আল্লাহর কাছে লম্বা হওয়ার জন্য প্রার্থনা করতাম। শোবার ঘরের দেয়ালে আমি স্কেল এবং পেন্সিল দিয়ে নিজের উচ্চতা মেপে রাখলাম। প্রতিদিন সকালে সেখানে দাঁড়িয়ে দেখতাম লম্বা হয়েছি কি না। কিন্তু পেন্সিলের দাগটা যেন জেদ করেই পাঁচ ফুটেই বসে রইল। আমি আল্লাহকে কথাও দিলাম যে তিনি আমাকে একটুখানি লম্বা করে দিলে আমি একশ’ রাকাত নফল নামাজ পড়ব, পাঁচটা বাধ্যতামূলক দৈনিক প্রার্থনার পাশাপাশি ঐচ্ছিক প্রার্থনাই করব।
আমি অনেক ব্যাপারে কথা বলতে চাইতাম, কিন্তু খাটো হওয়ায় এসব ব্যাপারে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা সহজ হতো না। মাঝেমধ্যে আমি ডায়াসের ওপাশে দেখতেই পেতাম না। হাইহিল জুতা পছন্দ না হলেও সেগুলো পরা শুরু করলাম।
সে বছর আমার ক্লাসের এক মেয়ে স্কুলে ফিরল না। বয়ঃসন্ধিকালে প্রবেশ করায় তাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বয়সের তুলনায় সে দেখতে বড় হলেও তার বয়স ছিল মাত্র তেরো। কদিন পরই শুনলাম, তার দুটো সন্তান। ক্লাসে রসায়নের হাইড্রোকার্বন সূত্র আবৃত্তি করার সময় আমি দিবাস্বপ্ন দেখতাম, স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়ে স্বামীর দেখাশোনা করতে আমার কেমন লাগবে।
তালেবানের বাইরেও আমরা অনেক কিছু চিন্তা করছিলাম, কিন্তু তা একেবারে ভুলে যাওয়াও সম্ভব ছিল না। আমাদের সেনাবাহিনী, যাদের কর্নফ্লেকস্ এবং সার উৎপাদন কারখানার মতো আজব আজব পার্শ্ববাণিজ্যও আছে, তারা সোপ অপেরাও নির্মাণ করা শুরু করল। সারা পাকিস্তানের লোক ‘বিয়ন্ড দ্যা কল অব ডিউটি’ নামে প্রাইম টিভিতে চলা এক ধারাবাহিকে আসক্ত হয়ে গেল, যেখানে সোয়াতে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সৈনিকদের জীবনের সত্য কাহিনী দেখাল হচ্ছে। শতাধিক সৈন্য সামরিক অভিযানে মারা গিয়েছিল এবং ৯০০ আহত হয়েছিল, এবং তারা নিজেদের বীর হিসেবে উপস্থাপন করতে চাইল। কিন্তু যেখানে তাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণ ফিরে আসার কথা, সেখানে আমরা তখনো আইনের শাসনের জন্য অপেক্ষা করছি। অনেক দিন বিকেলে বাসায় এসে দেখতাম অশ্রুসজল চোখ নিয়ে মহিলারা আমাদের বাসায় এসেছে। সামরিক অভিযানে শত শত লোক নিখোঁজ হয়েছে, সম্ভবত আর্মিই তুলে নিয়ে গেছে, কিন্তু কেউই মুখ খুলতে রাজি নয়। মহিলারা কোনো তথ্যই পাচ্ছিল না, তাদের স্বামী-পুত্র বেঁচে আছে কি মারা গেছে তা-ও জানত না। কেউ কেউ অত্যন্ত গুরুতর অবস্থায় আছে, নিজেদের সহায়তার জন্য তাদের কিছুই ছিল না। স্বামী মারা গেলেই কেবল নারীরা বিয়ে করতে পারে, নিখোঁজ হলে নয়।
মা তাদের খাবার এবং চা দিতেন, কিন্তু তারা সে জন্য আসত না। তারা আমার বাবার সাহায্য চাইত। তিনি সোয়াত ক্বওমি জিরগার মুখপাত্র হওয়ায় সাধারণ মানুষ এবং সেনাবাহিনীর মাঝে এক ধরনের যোগাযোগ রক্ষাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখতেন।
‘আমি শুধু জানতে চাই আমার স্বামী বেঁচে আছে কি নেই,’ আমার দেখা এক নারী অনুনয় করছিলেন। ‘তারা তাকে মেরে ফেলে থাকলে আমি বাচ্চাদের এতিমখানায় রেখে আসতে পারি। কিন্তু এখন আমি বিধবাও নই, আবার বিবাহিতও নই।’ আরেকজন মহিলা জানাল তার ছেলে নিখোঁজ। মহিলারা বলছিল যে তাদের নিখোঁজ ছেলেরা তালেবানের রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কাজে সহযোগিতা করেনি, হয়তো তাদের আদেশমতো এক গ্লাস পানি বা রুটি খেতে দিয়েছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে তালেবান নেতাদের ছাড়া পেয়ে গেছে, সেসব নির্দোষ মানুষকে বন্দি করে রাখা হয়েছে।
আমাদের বাসা থেকে দশ মিনিটের পায়ে হাঁটা দূরত্বে স্কুলের এক শিক্ষিকার বাসা ছিল। তাঁর ভাইকে সেনাবাহিনী তুলে নিয়েছিল, পায়ে লোহা বেঁধে অত্যাচার করে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ফ্রিজে রেখে দিয়েছিল। সে তালেবানের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত ছিল না। সে ছিল সামান্য একজন দোকানদার। পরে সেনাবাহিনী সেই শিক্ষিকার কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বলে যে তারা তার নাম নিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে ভুল লোককে ধরেছিল।
শুধু গরিব মহিলারাই আমাদের বাসায় আসত না। উপসাগরে মুসকাত থেকে একদিন এক ধনী ব্যবসায়ী এলেন। তিনি আমার বাবাকে বললেন যে তাঁর ভাই এবং চার-পাঁচজন ভাতিজা নিখোঁজ, তিনি জানতে চান তাদের হত্যা করা হয়েছে নাকি ধরে রাখা হয়েছে, যাতে তাদের স্ত্রীদের জন্য নতুন স্বামী খোঁজা লাগবে কি না সে বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন মাওলানা এবং বাবা তাকে ছাড়িয়ে আনতে সক্ষম হলেন।
এটা শুধু সোয়াতেই ঘটছিল না। আমরা শুনলাম, পাকিস্তানে হাজার হাজার লোক নিখোঁজ। অনেকেই আদালতের বাইরে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানালেন এবং হারানো স্বজনদের পোস্টার টানালেন; কিন্তু কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না।
এদিকে, আমাদের আদালত তখন আরেক প্রসঙ্গ নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইন বলে এক ব্যাপার আছে, যেটা পবিত্র কোরআনকে সংস্কারদূষণ থেকে রক্ষা করে। জেনারেল জিয়ার ইসলামায়নের সময় এই আইন অনেক কড়া করা হয়, যাতে কেউ ‘মহানবীর নামকে কলুষিত করলে’ মৃত্যুদণ্ড বা কারাদণ্ড ভোগ করবে।
২০১০ সালের নভেম্বর আসিয়া বিবি নামের এক খ্রিস্টান নারীর ফাঁসির দণ্ডের কথা খবরে প্রকাশ পেল। পাঁচ সন্তানের দরিদ্র মা আসিয়া পাঞ্জাবের এক গ্রামে জীবিকার জন্য ফল কুড়াত। এক গরমের দিনে সে তার সহকর্মীদের জন্য পানি আনল, কিন্তু তারা বলল যে সে খ্রিস্টান হওয়ায় পানিটা ‘অপবিত্র’, তারা বিশ্বাস করত যে মুসলিম হয়ে খ্রিস্টানের সঙ্গে পানি পান করলে তারা অপবিত্র হয়ে যাবে। তাদের মধ্যে একজন ছিল আসিয়া বিবির প্রতিবেশী, সে অভিযোগ করল, আসিয়ার ছাগল তার গবাদিপশুর পানাহারের জন্য সংরক্ষিত অগভীর জলাশয় নষ্ট করে ফেলেছে। তারা ঝগড়া করতে লাগল। এই ঝগড়া সম্পর্কে একেকজন একেক রকম গল্প বলতে লাগল, আমাদের স্কুলের ঝগড়ার সময় যেমনটা হয়। একজন বলল, প্রতিবেশীরা আসিয়া বিবিকে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিতে বলেছিল। আসিয়া জবাব দিয়েছিল, যিশুখ্রিস্ট খ্রিস্টানদের পাপের ফলে ক্রুশে ঝুলেছিলেন, নবী মুহাম্মদ মুসলিমদের জন্য কী করেছেন? ফলকুড়ানিদের একজন এ ঘটনা স্থানীয় ইমামকে জানাল এবং তিনি তা পুলিশকে জানালেন। মামলাটা আদালতে যাওয়ার আগে আসিয়া এক বছরেরও বেশি সময় জেলে ছিলেন এবং পরে তিনি মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন।
মোশাররফ স্যাটেলাইট টিভির অনুমতি দেওয়ায় আমাদের এখন অনেক চ্যানেল। হঠাৎই আমরা টিভিতে এসব ঘটনা চাক্ষুস করতে পারলাম। সারা পৃথিবীতে তীব্র নিন্দা হলো, এ ঘটনা নিয়ে টক শো হলো। যে অল্প কজন পাকিস্তান থেকে আসিয়া বিবির পক্ষে দাঁড়ালেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন পাঞ্জাবের গভর্নর সালমান তাসির। তিনি নিজেও একসময় রাজনৈতিক বন্দি হয়েছিলেন এবং বেনজিরের নিকটতম মিত্র ছিলেন। পরে তিনি একজন ধনী মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন। তিনি জেলে আসিয়া বিবিকে দেখতে যান এবং বলেন যে প্রেসিডেন্ট জারদারির তাঁকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। তিনি ব্লাসফেমি আইনকে ‘কালো আইন’ বলে অভিহিত করেছিলেন, এবং ব্যাপারটা উসকে দিতে কোনো কোনো টিভি উপস্থাপক এই কথাটা ব্যবহার করলেন। এরপর রাওয়ালপিন্ডির সবচেয়ে বড় মসজিদের ইমামরা শুক্রবারের প্রার্থনায় গভর্নরের নিন্দা করল।
এর দুদিন পরে, ২০১১ সালের ৪ জানুয়ারি ইসলামাবাদের এক শৌখিন কফি বারে মধ্যাহ্নভোজের পর সালমান তাসির তাঁর নিজ দেহরক্ষীদের একজনের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে খুন হন। লোকটা তাঁকে ছাব্বিশবার গুলি করেছিল। সে বলল যে রাওয়ালপিন্ডিতে শুক্রবারের প্রার্থনা শোনার পর স্রষ্টার জন্য সে এই কাজ করেছে। খুনিটার প্রতি মানুষের প্রশংসার বহর দেখে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। সে আদালতে এলে আইনজীবীরাও তাকে গোলাপের পাপড়ি দিয়ে স্বাগত জানায়। ওদিকে আবার মরহুম গভর্নরের মসজিদের ইমাম তাঁর জানাজা পড়াতে রাজি হলেন না এবং প্রেসিডেন্ট তাঁর জানাজায় অংশ নেননি।
দেশটা পাগল হয়ে যাচ্ছে। এটা কীভাবে সম্ভব যে আমরা এখন খুনিদেরও মাল্যভূষিত করছি। এর অল্পদিন পরই আমার বাবা আরেকটা মৃত্যুর হুমকি পেলেন। তিনি হাজি বাবা উচ্চ বিদ্যালয়ে বোমা বিস্ফোরণের তিন বছর পূর্তি উপলক্ষে বক্তব্য রেখেছিলেন। বাবা ক্রুদ্ধ ও আবেগি হয়ে বলেছিলেন, ‘ফজলুল্লাহ সব শয়তানের পালের গোদা!’ এ কথা তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘কেন তাকে ধরা হলো না?’ এরপর লোকজন তাঁকে খুব সাবধান থাকতে বলল। এরপর বাবাকে উদ্দেশ করে আমাদের বাসায় এক উড়োচিঠি এলো। শুরুতে লেখা ছিল ‘আসসালামু আলাইকুম’, ‘আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক’; কিন্তু সেটা মোটেও শান্তিপূর্ণ ছিল না। সেখানে লেখা ছিল, ‘আপনি একজন ধর্মনেতার পুত্র; কিন্তু আপনি ভালো মুসলিম নন। আপনি যেখানেই যান না কেন, মুজাহিদীন আপনাকে খুঁজে নেবে।’ চিঠিটা পাওয়ার পরবর্তী দুই সপ্তাহ তাঁকে চিন্তিত মনে হলো, কিন্তু তিনি তাঁর কাজ বন্ধ করতে অস্বীকৃতি জানালেন এবং দ্রুতই অন্যান্য বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
এই সময় মনে হলো, সবাই যেন আমেরিকাকে নিয়ে কথা বলছে। যেখানে আমরা সবকিছুতে আমাদের আজন্ম শত্রু ভারতকে দোষারোপ করতাম, এখন সেখানে করছি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। প্রায় প্রতি সপ্তাহে ফাতায় ঘটতে থাকা ড্রোন হামলার ব্যাপারে সবাই অভিযোগ করতে থাকল। প্রচুর বেসামরিকের মৃত্যুর খবর শোনা গেল। এরপর সিআইএ এজেন্ট রেমন্ড ডেভিস লাহোরে তাঁর মোটরবাইকের দিকে এগিয়ে আসতে থাকা দুজন ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করেন। তিনি দাবি করেন, তারা তাঁকে ছিনতাই করতে আসছিল। মার্কিনরা দাবি করল যে সে সিআইএ নয়, বরং সাধারণ কূটনৈতিক, যা সবার সন্দেহের উদ্রেক করল। আমরা স্কুলছাত্রীরাও জানি সে সাধারণ কূটনৈতিকরা অচিহ্নিত গাড়িতে করে গ্লক পিস্তল নিয়ে ঘুরে বেড়ায় না।
আমাদের গণমাধ্যম দাবি করল যে, আমাদের ইন্টেলিজেন্স সার্ভিসের ওপর আস্থা না থাকায় যুক্তরাষ্ট্র যে গোপন সেনাবাহিনী পাঠিয়েছে, ডেভিস তারই সদস্য। বলা হলো যে সে লাহোরভিত্তিক জঙ্গি দল লস্কর-ই-তাইবার ওপর গোয়েন্দাগিরি করছে, এই দল ভূমিকম্প এবং বন্যার সময় আমাদের মানুষকে অনেক সাহায্য করেছে। বলা হয় যে ২০০৮ সালে মুম্বাইতে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে এরাই জড়িত। এই দলের মূল উদ্দেশ্য ছিল কাশ্মীরের মুসলমানদের ভারতীয় শাসনের হাত থেকে রক্ষা করা, কিন্তু তারা সম্প্রতি আফগানিস্তানে সক্রিয় হয়ে উঠছিল। অন্য লোকজন বলছিল যে ডেভিস আসলে আমাদের পারমাণবিক অস্ত্রের ওপর নজরদারি করতে এসেছে।
অতিদ্রুত রেমন্ড ডেভিস পাকিস্তানের সবচেয়ে বিখ্যাত মার্কিন ব্যক্তি হয়ে উঠল। সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে গেল। মানুষ কল্পনা করতে লাগল আমাদের বাজার রেমন্ড ডেভিসে ভর্তি, তারা গোপন তথ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাবে। এরপর ডেভিসের গুলি করা দুজন লোকের একজনের বিধবা স্ত্রী বিচার না পেয়ে ইঁদুর মারার বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করল।
সপ্তাহের পর সপ্তাহ ওয়াশিংটন ও ইসলামাবাদ পক্ষান্তরে রাওয়ালপিন্ডির আর্মি হেডকোয়াটার্সের মাঝে আসা-যাওয়া চলতে লাগল এবং এরপর ঘটনার চূড়ান্ত মীমাংসা হলো। তারা আমাদের ঐতিহ্যবাহী জিরগাগুলোর মতোই কাজ করল-মার্কিনরা ‘রক্তের মূল্য’ ২৩ লক্ষ ডলার পরিশোধ করল, ডেভিস দ্রুতই আদালতের বাইরে এবং এই দেশেরও বাইরে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হলো। পাকিস্তান তখন দাবি করল যেন সিআইএ কন্ট্রাক্টরদের অনেককে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো এবং ভিসা প্রত্যয়ন করা বন্ধ করে দিল। পুরো ঘটনাটা একটা অশুভ অনুভূতির উদ্রেক ঘটাল, বিশেষত কারণ ডেভিস মুক্তি পাবার পরদিন ১৭ই মার্চে উত্তর ওয়াজিরিস্তানের উপজাতীয় এলাকায় ড্রোন হামলায় অন্তত চল্লিশজন মারা যায়। মনে হলো যেন এই আক্রমণের মাধ্যমে সিআইএ বার্তা দিচ্ছে যে তারা আমাদের দেশে যেকোনো কিছুই করতে পারে।
এক সোমবার আমি দেয়ালে নিজেকে মেপে দেখছিলাম যে রাতে অভাবনীয়ভাবে হঠাৎ লম্বা হয়ে গেছি কিনা, তখনই পাশের ঘরে উচ্চস্বরে কথার আওযাজ শুনতে পেলাম। বাবার বন্ধুরা এক অবিশ্বাস্য খবর নিয়ে এসেছেন। রাতের বেলা ‘নেভি সিলস’ নামের বিশেষ মার্কিন বাহিনী আমাদের উদ্বাস্তু থাকাকালে আশ্রয় নেওয়া স্থানগুলোর একটি—অ্যাবোটাবাদে ঝটিকা হামলা পরিচালনা করে এবং ওসামা বিন লাদেনকে খুঁজে বের করে হত্যা করে। সে আমাদের সামরিক একাডেমির এক মাইলেরও কম দূরত্বে একটি বিশাল দেয়ালঘেরা কম্পাউন্ডে থাকত। আমাদের বিশ্বাস হলো না যে সেনাবাহিনী বিন লাদেনের অবস্থান সম্পর্কে অজ্ঞ ছিল। খবরের কাগজে লেখা হলো যে তার বাড়ির লাগোয়া মাঠে ক্যাডেটরা প্রশিক্ষণও নিত। কম্পাউন্ডে ছিল ওপরে কাঁটাতার দেওয়া ১২ ফুট উঁচু দেয়াল। বিন লাদেন সবচেয়ে উঁচুতলায় তাঁর সর্বকনিষ্ঠ স্ত্রী ইয়েমেনি নারী আমালকে নিয়ে থাকত। অন্য দুই স্ত্রী এবং তার এগারো সন্তান নিচেই থাকত। একজন মার্কিন সিনেটর মন্তব্য করলেন যে বিন লাদেনের গুপ্তস্থানে কেবল নিয়ন চিহ্ন ছাড়া সবকিছুই ছিল।
সত্যি কথা বলতে, পশতুন এলাকাতে প্রচুর লোক পর্দা এবং নিরাপত্তার কারণে দেয়ালঘেরা কম্পাউন্ডে থাকে, তাই বাড়িটা খুব একটা অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। অস্বাভাবিক ব্যাপারটা ছিল যে বাড়ির লোকজন কখনোই বাইরে যেত না এবং তাদের কোনো ফোন বা ইন্টারনেট সংযোগ ছিল না। তাদের খাবার আনত সেই কম্পাউন্ডেরই সস্ত্রীক বসবাস করা দুই ভাই। তারা বিন লাদেনের সংবাদবহণকারী হিসেবে কাজ করত। একজন স্ত্রীর বাড়ি ছিল সোয়াতে।
সিলস বিন লাদেনকে মাথায় গুলি করেছিল এবং হেলিকপ্টারে করে দেহ বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মনে হলো না যে কোনো লড়াই হয়েছিল। অন্য দুই ভাই এবং বিন লাদেনের প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদের একজনকেও হত্যা করা হয়, কিন্তু তার স্ত্রী এবং অন্য সন্তানদের বেঁধে রেখে পরে পাকিস্তানের জিম্মায় দেওয়া হয়। মার্কিনরা বিন লাদেনের দেহ সমুদ্রে ফেলে দেয়। প্রেসিডেন্ট ওবামা খুব খুশি হলেন এবং টিভিতে আমরা হোয়াইট হাউসের বাইরে অনেক উদযাপনের চিত্র দেখলাম।
প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম, আমাদের সরকার এই মার্কিন অভিযান সম্পর্কে অবগত ছিল এবং এতে জড়িত ছিল। কিন্তু শিগগিরই জানা গেল, কাজটা সম্পূর্ণ মার্কিনদের একার। মানুষ এটাকে সহজভাবে নিল না। আমাদের মিত্র হিসেবেই বসবাস করার কথা এবং তাদের ‘আতঙ্কের যুদ্ধ’-তে আমরা তাদের চেয়ে বেশি সৈন্য হারিয়েছি। তারা নিচু দিয়ে উড়ে বিশেষ ধরনের শব্দহীন হেলিকপ্টার ব্যবহার করে অনাহূতভাবে বৈদ্যুতিক উপায়ে আমাদের রাডার ব্লক করে রাতের বেলা দেশের সীমান্তে প্রবেশ করেছে। ঘটনার পরে তারা কেবল আমাদের সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক কায়ানি এবং প্রেসিডেন্ট জারদারির কাছে মিশনের কথা প্রকাশ করেছে। সেনাবাহিনীর বেশির ভাগ নেতাই টিভির বদৌলতে এটা জানতে পেরেছে।
মার্কিনরা বলল যে, এভাবে কাজটা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না, কারণ সত্যিকার অর্থে কেউই জানত না আইএসআই কোন পক্ষে এবং তারা পৌঁছবার আগেই হয়তো কেউ সাবধান করে দিত। সিআইএ পরিচালক বললেন যে, পাকিস্তান ‘হয় জড়িত না হয় অনুপযুক্ত। কোনোটাই ভালো নয়।’
আমার বাবা বললেন যে এটা একটা লজ্জাজনক দিন। ‘কী করে এমন দাগি সন্ত্রাসী এত বছর ধরে অচিহ্নিত অবস্থায় পাকিস্তানে লুকিয়ে থাকতে পারে?’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন। অন্যরাও একই কথাই বলছিল।
বোঝাই যাচ্ছে কেন সবাই মনে করছিল যে আমাদের ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস বিন লাদেনের অবস্থান জানত। আইএসআই একটি বিশাল সংস্থা, সবখানেই এর প্রতিনিধি। কীভাবে সে রাজধানীর এত নিকটে থাকতে পারল—মাত্র ষাট মাইল দূরে? এবং এত দিন। হয়তো সবার মাঝে থাকাই হলো লুকানোর সবচেয়ে ভালো স্থান, কিন্তু সে ২০০৫ সালের ভূমিকম্পের পর থেকেই ওই বাড়িতে থাকত। তার দুজন সন্তানও অ্যাবোটাবাদ হাসপাতালে জন্ম নিয়েছে। এবং সে নয় বছরেরও বেশি সময় ধরে পাকিস্তানে থেকেছে। অ্যাবোটাবাদের আগে সে হরিপুরে থেকেছে, তারও আগে আমাদের সোয়াত উপত্যকায়, যেখানে ৯/১১ এর মূল হোতা খালিদ শেখ মোহাম্মদের সঙ্গে তার দেখা হয়।
বিন লাদেনকে খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারটা আমার ভাই খুশালের পছন্দের গোয়েন্দা ছবিগুলোর মতো। চিহ্নিত হওয়া এড়াতে সে ফোনকল বা ই-মেইলের বদলে মানুষ সংবাদবাহক ব্যবহার করেছে। কিন্তু মার্কিনরা তার এক সংবাদবাহককে চিহ্নিত করে তার গাড়ির নাম্বারপ্লেট ট্র্যাক করে পেশাওয়ার থেকে অ্যাবোটাবাদ পর্যন্ত সেটাকে অনুসরণ করে। এরপর তারা এক্সরে ভিশনসম্পন্ন একটি দানবাকৃতির ড্রোন দিয়ে তার বাড়ি পর্যবেক্ষণ করে, সেখানে দেখা যায় অনেক লম্বা এক দাড়িওয়ালা লোক কম্পাউন্ডে হাঁটাহাঁটি করছে। তাকে তারা ‘সেসার’ বলে আখ্যায়িত করেছিল।
প্রতিদিনের নতুন নতুন তথ্য সম্পর্কে মানুষ উৎসুক হয়ে উঠল, কিন্তু বিশ্বের বৃহত্তম সন্ত্রাসী আমাদের মাটিতে থেকেছে এর চাইতে বরং মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের আকস্মিক হামলা নিয়েই বেশি রাগান্বিত বলে মনে হচ্ছে। কোনো কোনো পত্রিকায় কাহিনী এল যে মার্কিনরা এর বহু বছর আগেই বিন লাদেনকে হত্যা করে তার দেহ একটি ফ্রিজারে রেখেছিল। কাহিনীটা ছিল যে তারা অ্যাবোটাবাদের মাটিতে তাকে পুঁতে দিয়ে পাকিস্তানকে বিব্রত করতে ঝটিকা হামলা নাটক সাজিয়েছে।
আর্মির পক্ষে র্যালি করার জন্য অনরোধ সম্বলিত খুদেবার্তা পেলাম আমরা। ‘১৯৪৮, ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ এ আমরা তোমাদের পাশে ছিলাম,’ একটা বার্তায় লেখা ছিল, ভারতের সঙ্গে আমাদের তিন যুদ্ধের ইঙ্গিত দিয়ে বলা হয়েছিল। ‘এখন আমরাই আঘাত পাচ্ছি, আমাদের পাশে থাকো।’ কিন্তু সেনাবাহিনীকে নিয়ে উপহাস করা বার্তাও ছিল। মানুষ জিজ্ঞেস করতে লাগল, যদি মার্কিনরা আমাদের রাডার ফাঁকি দিয়ে নিঃশব্দে ঢুকেই পড়তে পারে, তবে সামরিক বাহিনীর জন্য কেন আমরা বছরে ৬ বিলিয়ন ডলার (শিক্ষা খাতের ব্যয়ের ৭ গুণ) ব্যয় করব? আর এরকম হলে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতকেই বা থামাবো কীভাবে? ‘দয়া করে প্যাঁ-পোঁ কোরো না, সেনাবাহিনী ঘুমাচ্ছে,’ এক বার্তায় লেখা ছিল। আরেকটায় লেখা ছিল, ‘সেকেন্ড হ্যান্ড পাকিস্তানি রাডার বিক্রি হবে... যুক্তরাষ্ট্রের হেলিকপ্টার ধরতে পারে না, ক্যাবল টিভির চ্যানেল ঠিকই আনতে পারে।’
আইএসআই-এর প্রধান জেনারেল কায়ানী এবং জেনারেল আহমেদ সুজা পাশাকে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য সংসদে তলব করা হলো, যা আগে কখনোই ঘটেনি। আমাদের দেশ লাঞ্ছিত হয়েছে এবং এর কারণ আমরা জানতে চাই।
আমরা জানতে পারলাম, যেখানে মার্কিনরা এতদিন ভেবেছে বিন লাদেনের গুহায় লুকিয়ে আছে, সেখানে সে আমাদের নাকের ডগায় থেকেছে জেনে মার্কিন রাজনীতিবিদরা অগ্নিশর্মা। তাদের অভিযোগ, তারা প্রায় আট বছরেরও বেশি সময় ধরে সহযোগিতামূলক মনোভাব সৃষ্টির জন্য আমাদের ২০ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে এবং আমরা কোন পক্ষে তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে। মাঝে মধ্যে মনে হত, পুরোটাই অর্থের খেলা। এর সিংহভাগই গেছে সেনাবাহিনীর পকেটে সাধারণ মানুষ কিছুই পায়নি।
এর ক’মাস পর ২০১১ সালের অক্টোবরে বাবা আমাকে বললেন যে, আমস্টারডামভিত্তিক শিশু অধিকার বিষয়ক সংগঠন ‘কিডস রাইটসে’র আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত পাঁচজনের একজন আমি- এই মর্মে তাঁর কাছে একটি ই-মেইল এসেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু আমার নামটি পেশ করেন। বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়েরে কারণে আমার বাবার কাছে তিনি এক মহান বীর। আমি পুরস্কারটা না পাওয়ায় বাবা হতাশ হলেন কিন্তু আমি তাঁকে বুঝিয়ে বললাম যে আমি শুধু কথাই বলেছি, পুরস্কারপ্রাপ্তদের মতো ব্যবহারিক কাজ করার জন্য কোনো সংগঠন আমাদের নেই।
এর অল্পদিন পরই পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ আমাকে লাহোরে এক শিক্ষা উৎসবে বক্তব্য রাখতে আমন্ত্রণ জানালেন। দানিশ স্কুলস নামে তিনি নতুন স্কুলের এক টেওয়ার্ক নির্মাণ করছিলেন এবং অন করার পর তাঁর ছবি পর্দায় থাকা সত্ত্বেও তিনি শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে ল্যাপটপ দিচ্ছিলেন। সব প্রদেশের শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতে তিনি পরীক্ষায় ভালো করা ছেলেমেয়েদের অনুপ্রাণিত করতে তিনি পরীক্ষায় ভালো করা ছেলেমেয়েদের নগদ অর্থ পুরস্কার দিচ্ছিলেন। আমি নারী অধিকার আন্দোলনের জন্য প্রায় পাঁচ লাখ রুপি বা ৪,৫০০ ডলারের এক চেক পেলাম।
আমি উৎসবে গোলাপি পোশাক পরলাম এবং তালেবান অধ্যাদেশ অমান্য করে গোপনে স্কুল চালিয়ে যাওয়ার ঘটনাটা প্রথমবারের মতো জনসমক্ষে প্রকাশ করলাম। ‘আমি শিক্ষার গুরুত্ব জানি, কারণ আমার কলম এবং বই কেড়ে নেওয়া হয়েছিল,’ আমি বললাম। ‘কিন্তু সোয়াতের মেয়েরা কাউকে ভয় পায় না। আমরা পড়ালেখা চালিয়ে গেছি।’
এরপর একদিন আমি ক্লাসে থাকা অবস্থায় আমার সহপাঠীরা বলল, ‘তুমি পাঁচ লাখ রুপি এবং বড় একটা পুরস্কার পেয়েছ।’ বাবা আমাকে বললেন যে সরকার আমাকে পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করেছিল। অনেক সাংবাদিক ভিড় করায় সেদিন স্কুলটা নিউজ স্টুডিওতে পরিণত হলো।
অনুষ্ঠানটা হলো ২০০১ সালের ২০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর দাপ্তরিক বাসভবনে, কনস্টিটিউশন এভিনিউর শেষে পাহাড়ের ওপর একটা বড় সাদা অট্টালিকায় ইসলামাবাদ সফরে তা আমি দেখেছিলাম। তত দিনে আমি রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলে অভ্যস্ত। প্রধানমন্ত্রী গিলানি পীর পরিবার থেকে এসেছেন বলে বাবা আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করলেও আমি ভীত হলাম না। প্রধানমন্ত্রী আমাকে অ্যাওয়ার্ড এবং চেকটা তুলে দিলেন। আমি তাঁকে আমাদের দাবির এক লম্বা তালিকা দিলাম। বললাম যে আমাদের স্কুলগুলোর পুনর্নির্মাণ এবং সোয়াতে মেয়েদের একটা বিশ্ববিদ্যালয় চাই। জানতাম যে তিনি আমার দাবি অতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন না। তাই বেশি চাপও দিইনি। আমি ভাবলাম, ‘একদিন আমি নিজেই রাজনীতিবিদ হয়ে এ কাজগুলো করব।’
সিদ্ধান্ত হলো যে এই পুরস্কার প্রতিবছর আঠারো বছরের নিচে শিশুদের দেওয়া হবে এবং আমার সম্মানে এর নাম হবে মালালা পুরস্কার। খেয়াল করলাম যে বাবা এ ব্যাপারে খুব বেশি খুশি হলেন না। বেশির ভাগ পশতুনের মতোই তিনি কিছুটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন। পাকিস্তানে আমাদের জীবিত মানুষদের সম্মান জানানোর সংস্কার নেই, কেবল মৃতদেরই তা করা হয়। তাই তিনি একে অশুভ সংকেত বলে মনে করলেন।
আমি জানতাম মা আমার এসব অ্যাওয়ার্ড পাওয়াটাকে ভালো চোখে দেখছেন না, কারণ আমি যতই পরিচিত হব ততই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হব। তিনি নিজে কখনো জনসমক্ষে আসতেন না, ছবি তুলতেও রাজি হতেন না। তিনি খুবই রক্ষণশীল নারী এবং এটা আমাদের শতবর্ষের পুরাতন ঐতিহ্য। তিনি এই প্রথা ভাঙার চেষ্টা করলেই নারী-পুরুষ সবাই তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলবে, বিশেষত পরিবারের সদস্যরা। আমি আর বাবা যা করছি, তার জন্য তাঁর অনুতাপ আছে এটা তিনি কখনো বলেননি বটে, কিন্তু আমি পুরস্কার পর তিনি বললেন, ‘আমি এসব অ্যাওয়ার্ড চাই না, আমি আমার মেয়েকে চাই। পুরো পৃথিবীর বিনিময়ে হলেও আমি আমার মেয়ের চোখের একটা পাপড়িও দেব না।’
বাবা যুক্তি দেখাতে লাগলেন যে তিনি কেবল একটা স্কুল বানাতে চেয়েছেন, যেখানে শিশুরা শিখতে পারবে। এখন শিক্ষার জন্য প্রচারাভিযান চালানো ছাড়া আমাদের জন্য আর কোনো পথ খোলা নেই। ‘আমার একমাত্র লক্ষ্য’ তিনি বললেন, ‘আমার যতটুকু সামর্থ্য আছে, ততটুকু দিয়েই আমার সন্তান এবং জাতিকে শিক্ষা দেওয়া। কিন্তু অর্ধেক নেতা যখন মিথ্যা কথা বলে আর বাকি অর্ধেক যখন তালেবানের সঙ্গে সমঝোতায় ব্যস্ত থাকে, তখন আর কোথাও যাওয়ার থাকে না। কাউকে না কাউকে রুখে দাঁড়াতেই হবে।’
বাড়ি ফেরার পরই আমাকে সুসংবাদ দেওয়া হলো যে, একদল সাংবাদিক স্কুলে আমার সাক্ষাৎকার নিতে চায় এবং আমার একটা সুন্দর জামা পরতে হবে। প্রথমে আমি অনেক সুন্দর কোনো জামা পরতে চাইলাম, কিন্তু পরে ভাবলাম যে আমি চাই মানুষ আমার পোশাক নয়, বার্তার প্রতি মনোযোগ দিক, তাই শালীন এবং সাধারণ একটা পোশাক পরার সিদ্ধান্ত নিলাম। স্কুলে পৌঁছে দেখলাম, আমার বন্ধুরা বেশ সাজগোজ করেছে। আমি ভেতরে ঢুকতেই ওরা আমাকে চমকে দিল। চমকটা হলো ওরা চাঁদা তুলে আমার জন্য পার্টির আয়োজন করেছে। একটা বড় কেক এনেছে তারা, সেটার ওপর চকলেট দিয়ে লেখা ‘সাফল্য চিরজীবী হোক’। বন্ধুদের এই আয়োজন দেখে আমার খুবই ভালো লাগল। আমার মনে হয়, আমার এই সফলতা আমার বন্ধুরাও পেতে পারে, যদি তাদের বাবা মা তাদের সহায়তা করে।
পার্টি শেষে ক্লাসে ফেরার কথা বললেন ম্যাডাম মরিয়ম। তিনি বললেন, ‘মার্চে কিন্তু পরীক্ষা।’
বছরটা শেষ হলো একটা খারাপ খবর দিয়ে। পুরস্কার পাওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় আমার আপন বড় খালা হঠাৎ করেই মারা গেলেন। তাঁর বয়স পঞ্চাশও হয়নি। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। খালুকে নিয়ে কার কাছ থেকে যেন ঝাড়ফুঁকও করিয়েছিলেন অসুস্থতার জন্য। এই ঝাড়ফুঁকের সময় ভুল চিকিৎসা হয় খালার। এ কারণে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন খালা ও মৃত্যুবরণ করেন। আব্বা বলেন, এই চিকিৎসক ছিলেন হাতুড়ে ডাক্তার। এসব কারণেই আমাদের অশিক্ষা ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে লড়ে যেতে হবে বলে জানান আব্বা।
বছর শেষ হওয়ার পর দেখি আমার অনেক অর্থ সঞ্চিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী, পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও আমাদের রাজ্য খাইবারপাখতুনখোয়ার মুখ্যমন্ত্রী এবং সিন্ধু প্রদেশের সরকার—প্রত্যেকে পাঁচ লাখ রুপি করে দিয়েছেন। স্থানীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডার মেজর জেনারেল গুলাম ক্বামার আমাদের স্কুলে বিজ্ঞান গবেষণাগার এবং পাঠাগার তৈরির জন্য এক লাখ রুপি দিলেন। কিন্তু আমার লড়াই শেষ হয়নি। ইতিহাসের শিক্ষা আমার মনে ছিল, সেখানে আমরা পড়েছি যুদ্ধে জিতলে বিজয়ী পক্ষ কীভাবে গনিমতের মাল ভোগ করে। পুরস্কার এবং স্বীকৃতিগুলোকে আমি সেই দৃষ্টিতেই দেখলাম। এগুলো হলো কমদামি রত্নপাথর। যুদ্ধে জেতার ব্যাপারে মনোযোগ দিতে হবে।
বাবা কিছু অর্থ দিয়ে আমার জন্য নতুন খাট কিনলেন, মায়ের দাঁত প্রতিস্থাপন করালেন এবং শাংলায় এক টুকরো জমি কিনলেন। বাকি অর্থ আমরা অভাবী মানুষের জন্য ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি একটা শিক্ষা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করতে চাইলাম। সেই আবর্জনার পর্বতের শিশুদের দেখার পর থেকেই এটা আমার মাথায় আছে। সেখানকার কালো ইঁদুরগুলোর দৃশ্য আমি মন থেকে মুছে ফেলতে পারি না। জটাওয়ালা চুলের ময়লাকুড়ানো ওই মেয়েটাকে ভুলতে পারি না। আমরা একুশজন মেয়ের একটি সমাবেশ করে সোয়াতের প্রতিটা মেয়ের জন্য শিক্ষার অগ্রাধিকার ঘোষণা করলাম এবং পথশিশু ও শিশুশ্রমে নিয়োজিত বাচ্চাদের প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করলাম।
মালাকান্দ গিরিপথ পেরোনোর সময় কমলা বিক্রি করতে থাকা এক কমবয়সী মেয়েকে দেখলাম। লেখাপড়া না জানায় বিক্রি হওয়া কমলার হিসাব রাখতে সে একটা কাগজে পেন্সিল দিয়ে দাগ কাটছিল। আমি তার ছবি তুলে রাখলাম এবং আমার ক্ষমতায় এই মেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার জন্য যা করা সম্ভব তাই করব বলে শপথ করলাম। আমি এই যুদ্ধের সৈনিক।
(চলবে)