আমি মালালা বলছি
নারী ও সমুদ্র
নাজমা খালার চোখে পানি। তিনি আগে কখনোই সমুদ্র দেখেননি। আমি আমার পরিবারের সঙ্গে পাথরের ওপর বসে জলরাশির দিকে তাকিয়ে আরব সাগরের তীব্র নোনা গন্ধে শ্বাস নিচ্ছি। এই বিস্তৃত জলরাশির সীমানা কোথায় শেষ তা নিশ্চয়ই কেউ জানে না। সেই মুহূর্তে আমার মনে ছিল অনেক আনন্দ। ‘আমি একদিন এই সমুদ্র পাড়ি দিতে চাই,’ আমি বললাম।
‘সে কী বলছে?’ খালা এমন ভাবে জিজ্ঞেস করলেন যেন আমি কোনো অসম্ভব কথা বলছি। আমি তখনো আমার মাথায় ব্যাপারটা ঢোকানোর চেষ্টা করছি যে তিনি সাগরপাড়ের শহর করাচিতে ত্রিশ বছর ধরে থাকা সত্ত্বেও সত্যিকার অর্থে সমুদ্রের দিকে কখনো চোখ রাখেননি। তাঁর স্বামী তাঁকে সমুদ্রতীরে নিয়ে যাবেন না, আর তিনিও যদি কখনো কোনোভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তেন তবুও রাস্তার চিহ্ন অনুসরণ করে সমুদ্রে পৌঁছাতে পারতেন না কারণ তিনি পড়তে জানেন না।
পাথরের ওপর বসে বসে আমি ভাবতে লাগলাম, জলরাশির ওপারেই স্বাধীন নারীদের বসবাস। এ দেশে একসময় নারী প্রধানমন্ত্রী ছিল এবং ইসলামাবাদে এত এত চিত্তাকর্ষক নারীকর্মী থাকা সত্ত্বেও এ দেশের প্রায় সব নারী পুরোপুরি পুরুষদের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের প্রধান শিক্ষিকা ম্যাডাম মারিয়াম একজন শক্তিশালী এবং শিক্ষিত নারী হওয়া সত্ত্বেও এ সমাজে তিনি নিজের মতো করে থাকতে এবং কর্মস্থলে আসতে পারেন না। তাঁকে স্বামী, ভাই বা বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতে হচ্ছে।
যখনই পাকিস্তানে আমরা নারীরা স্বাধীনতার কথা বলি, মানুষ মনে করে যে এর অর্থ হলো আমরা আমাদের বাবা, ভাই বা স্বামীদের অমান্য করতে চাই। কিন্তু এর অর্থ তা নয়। এর অর্থ, আমরা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা নিতে চাই। আমরা স্কুলে বা কর্মস্থলে স্বাধীনভাবে যেতে চাই। কুরআনের কোথাও লেখা নেই যে নারীকে পুরুষের ওপর নির্ভর করে থাকতে হবে। এমন কোনো কথা স্বর্গ থেকে নাজিল হয়নি, যেখানে বলা আছে যে পুরুষের কথা শুনতে নারী বাধ্য।
‘তুমি লাখ লাখ মাইল দূরে, সেটি জানি,’ আমার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে বাবা বললেন। ‘কিসের স্বপ্ন দেখছো?
‘তেমন কিছু না, কেবল মহাসমুদ্র পাড়ি দেওয়া নিয়ে আবা,’ আমি জবাব দিলাম।
‘ওসব ভুলে যাও।’ আমার ভাই অতল চেঁচিয়ে উঠল।’ আমরা সমুদ্রতীরে আছি এবং আমি এখন উটের পিঠে চড়তে চাই।’
সিন্ধু প্রদেশের সরকার মিশন রোডের একটি স্কুল আমার সম্মানে পুনর্নামকরণ করার ঘোষণা দেওয়ার পর ২০১২ সালের জানুয়ারিতে আমরা জিও টিভির অতিথি হিসেবে করাচি যাই। খুশাল এখন অ্যাবোটাবাদের স্কুলে পড়ে, তাই কেবল আমি, বাবা-মা আর অতল গেলাম। মাত্র দুই ঘণ্টার যাত্রাটা ছিল সত্যিই বিস্ময়কর। বাসে করে যেতে আমাদের অন্তত দুদিন লাগত। বিমানে আমরা দেখলাম, বর্ণ এবং সংখ্যা পড়তে না পারায় অনেক লোক তাদের আসন খুঁজে পাচ্ছিল না। আমার আসন ছিল জানালার পাশে এবং তা দিয়ে আমি নিচে রয়ে যাওয়া আমাদের মরুভূমি এবং পর্বত দেখতে লাগলাম। দক্ষিণে অগ্রসর হতেই রোদে-তাপে শুকিয়ে যাওয়া এলাকা বিস্তৃত হয়ে উঠল। সোয়াতের শ্যামলতার জন্য আমার খারাপই লাগছে। সেখানে আমি বুঝতে পারলাম, কেন আমাদের মানুষ করাচিতে কাজের খোঁজে গিয়েও আমাদের উপত্যকার শীতল ছায়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত হতে চায়।
বিমানবন্দর থেকে হোস্টেলের পথে আমি লোকের সংখ্যা, বাড়ি এবং গাড়ির সংখ্যা দেখে অবাক হয়ে গেলাম। করাচি বিশ্বের বড় শহরগুলোর একটি। ভাবতেই অবাক লাগে, পাকিস্তানের সূচনালগ্নে এটি মাত্র তিন লাখ মানুষের এক বন্দরনগরী। জিন্নাহ সেখানে থাকতেন এবং সেটাকে পাকিস্তানের প্রথম রাজধানী ঘোষণা করেন, এবং শিগগিরই ভারত থেকে লাখ লাখ উর্দুভাষী মুসলিম শরণার্থী, যাঁদের ‘মুহাজির’ বা অভিবাসী বলা হতো, তাঁরা এসে জায়গাটা ভরিয়ে ফেললেন। আজ এখানে প্রায় দুই কোটি লোক। এটা আমাদের থেকে দূরে হলেও বিশ্বের সর্ববৃহৎ পশতুন শহর, পঞ্চাশ থেকে সত্তর লাখ পশতুন এখানে কাজ করে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, করাচি ভীষণ সহিংস শহরে পরিণত হয়েছে, সারাক্ষণই পশতুন এবং মুহাজিরদের মাঝে যুদ্ধ বেধে থাকে। আমাদের দেখা মুহাজির এলাকাগুলো ছিল অত্যন্ত সংগঠিত এবং পরিচ্ছন্ন, যেখানে পশতুন এলাকাগুলো ছিল নোংরা এবং বিশৃঙ্খল, বেশির ভাগ মুহাজিরই এমকিউএম নামের একটি দলকে সমর্থন করে এর নেতা আলতাফ হুসেইন লন্ডন থেকে তাঁর লোকজনের সঙ্গে স্কাইপের মাধ্যমে যোগাযোগ করেন। এমকিউএম খুবই সংগঠিত একটি আন্দোলন এবং পুরো মুহাজির সমাজ সব সময় একজোট থাকে। অন্যদিকে আমরা পশতুনরা বেশ বিভক্ত, কেউ ইমরান খানের অনুসারী কারণ সে পশতুন, খান একজন বড় ক্রিকেটার। কেউ মাওলানা ফজলুর রেহমানের অনুসারী কারণ তাঁর ‘জামায়াতে উলামা-ই-ইসলাম’ একটি ইসলামপন্থী দল। কেউ ধর্মনিরপেক্ষ ‘আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি’র পক্ষে, কারণ একটি পশতুন জাতীয়তাবাদী দল। কেউ আবার বেনজির ভুট্টোর পিপিপি বা নওয়াজ শরিফের পিএমএল (এন) সমর্থক।
আমরা সিন্ধু সমাবেশে গেলাম, সেখানে সব সদস্য হর্ষধ্বনির মাধ্যমে আমাকে স্বাগতম জানাল। এরপর আমার নামে নামকরণ করা স্কুলটাসহ কয়েকটি স্কুল পরিদর্শন করলাম। এরপর আমি শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে একটা বক্তৃতা দিলাম এবং এটা বেনজির ভুট্টোর শহর হওয়ায় তাঁকে নিয়েও কথা বললাম। ‘মেয়েদের অধিকারের জন্য আমাদের সবার একসঙ্গে কাজ করা উচিত,’ আমি বললাম। বাচ্চারা আমার জন্য গান গাইল এবং আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি- এমন একটা ছবি আমাকে উপহার দেওয়া হলো। মাইওয়ান্দের মালালা নামে আফগানিস্তানের অনেক স্কুল নামকরণ করা হয়েছিল, তাঁর মতো আমার নামেও স্কুলের নাম দেখা বেশ অদ্ভুত লাগত। স্কুলের পরবর্তী ছুটিতে বাবা আর আমি সোয়াতের দুর্গম পাহাড় এলাকায় মা-বাবা এবং বাচ্চাদের সঙ্গে লেখাপড়া শেখার গুরুত্ব নিয়ে কথা বলার পরিকল্পনা করলাম। ‘আমরা শিক্ষার প্রচারক হব,’ আমি বললাম।
সেদিনের শেষদিকে আমরা আমার খালা এবং খালুর বাসায় বেড়াতে গেলাম। তাঁরা খুব ছোট একটা বাসায় থাকতেন এবং অবশেষে তখন বাবা বুঝতে পারলেন যে ছাত্রাবস্থায় কেন তাঁরা বাবাকে আশ্রয় দিতে চাননি। পথে আমরা আশিকান-এ-রাসুল চত্বর পেরোলাম এবং গভর্নর সালমান তাসিরের খুনির একটা ছবি কোনো সাধু দরবেশের মতো করে গোলাপের পাপড়ির মালা পরানো দেখে আমরা স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। বাবা রেগে গেলেন। ‘দুই কোটি মানুষের শহরে এই ছবি নামানোর মতো একজনও কি নেই?’
মায়ের বস্তা বস্তা জামাকাপড় কেনার জায়গা বাজারে যাওয়া বা সাগরে বেড়াতে যাওয়া ছাড়াও করাচিতে আমাদের আরো গুরুত্বপূর্ণ এক জায়গায় যাওয়ার ছিল। আমাদের প্রতিষ্ঠাতা এবং মহান নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সমাধিতে যাওয়া প্রয়োজন ছিল। এটা সাদা মর্মর পাথরের খুব শান্তিময় একটা অট্টালিকা এবং কীভাবে কীভাবে যেন শহরের পবিত্র মনে হলো। পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের পর এখানেই বেনজির তাঁর প্রথম ভাষণ দিতে এসেছিলেন এবং আসার পথে তাঁর বাস উড়িয়ে দেওয়া হয়।
পাহারাদার আমাদের বুঝিয়ে বললেন, চীন থেকে আনা বিশাল ঝাড়বাতির নিচে অবস্থিত মূল কক্ষের সমাধিতে জিন্নাহর দেহ নেই। তাঁর মৃতদেহ নিচের তলায় একটি সমাধিতে রাখা, যেখানে তাঁর পাশে আছে তাঁর বোন ফাতিমার সমাধি, যিনি অনেক পরে মারা যান। এর পাশেই আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের। তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল।
এরপরে আমরা পেছনের ছোট জাদুঘরে গেলাম। যেখানে ডিসপ্লেতে রাখা আছে প্যারিস থেকে আনা জিন্নাহর ব্যবহৃত সাদা বো-টাই, লন্ডনে তৈরীকৃত থ্রি-পিস স্যুট, তাঁর গলফ খেলার লাঠি, বারো জোড়া জুতা রাখার জন্য ড্রয়ারওয়ালা বিশেষ ভ্রমণ-বাক্স এবং চামড়ার ওপর নকশা করে তৈরি করা তাঁর প্রিয় দুই রঙের শক্ত জুতা প্রদর্শনীর জন্য রাখা ছিল। দেয়ালে ছিল ছবি। পাকিস্তানের সূচনালগ্নের দিনগুলোর ছবিতে জিনাহর আঁধার হয়ে আসা মুখটা দেখেই বোঝা যায়, তিনি মরণাপন্ন। তাঁর চামড়া কাগজের মতো পাতলা দেখাত। কিন্তু সে সময় এটা গোপন রাখা হয়েছিল। জিন্নাহ দিনে পঞ্চাশটি সিগারেট খেতেন। ভারতের শেষ ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেল যতদিনে পাকিস্তানের স্বাধীনতার মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তান আলাদা করে দিতে রাজি হলেন, ততদিনে জিন্নাহর দেহে বাসা বেঁধেছে ফুসফুসের ক্যানসার ও যক্ষ্মা। পরে ভাইসরয় বলেছিলেন যে তিনি যদি জানতেন যে জিন্নাহর অবস্থা এত খারাপ, তিনি সিদ্ধান্ত দিতে দেরি করতেন এবং তাতে আর পাকিস্তান সৃষ্টি হতো না। যেভাবে ভাবা হয়েছিল, এই ঘোষণার প্রায় এক বছর পরেই ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই তিনি মারা গেলেন। এর তিন বছরেরও কিছু পরে আমাদের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নিহত হন। শুরু থেকেই আমরা একটি দুর্ভাগ্যকবলিত দেশ।
জিন্নাহর কিছু বিখ্যাত ভাষণও প্রদর্শন করা হয়েছিল। একটা ভাষণে ছিল নবসৃষ্ট পাকিস্তানের সব ধর্মের মানুষের উপাসনা করার স্বাধীনতার কথা। অন্য একটাতে তিনি নারীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কথা বলেছেন। আমি তাঁর জীবনের নারীদের ছবি দেখতে চেয়েছিলাম। তাঁর স্ত্রী অল্পবয়সে মারা যান এবং তিনি একজন পার্সি ছিলেন। তাঁদের একমাত্র মেয়ে দিনা ভাতে- থাকতেন এবং তিনিও একজন পার্সিকে বিয়ে করেন, যাঁকে এই মুসলমান প্রধান দেশ ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি। এখন তিনি কিউ ইয়র্ক থাকেন। তাই আমি যেসব ছবি পেলাম তার বেশির ভাগই তাঁর ভগ্নি ফাতিমার।
জিন্নাহ এই পাকিস্তানকে দেখলে কতটা হতাশ হতেন সেটা ভেবে জাদুঘরে যাওয়া এবং জিন্নাহর বাণী পড়া বেশ কঠিন কাজ। তিনি হয়তো বলতেন, এই পাকিস্তান তিনি চাননি। তিনি স্বাধীন হতে চেয়েছিলেন, সহিষ্ণু হতে চেয়েছিলেন, অপরের প্রতি দয়াশীল হতে চেয়েছিলেন। তিনি সবাইকে যার যার বিশ্বাসের জায়গায় স্বাধীন করে দিতে চেয়েছিলেন।
‘আমরা যদি স্বাধীন না হয়ে ভারতের অংশ থাকতাম তাহলে কি ভালো হতো?’ আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম। আমার মনে হলো পাকিস্তান সৃষ্টির আগে হিন্দু ও মুসলমানদের মাঝে সীমাহীন লড়াই হতো। এখন নিজেদের দেশ হওয়ার পরও এই লড়াই চলছে তো চলছেই। কিন্তু লড়াইটা হলো মুহাজির ও পশতুনের মধ্যে এবং শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে। একে অপরকে সহযোগিতা না করে আমাদের চারটি প্রদেশ স্বতন্ত্র হওয়ার জন্য একে অপরের সঙ্গে লড়াই করছে। সিন্ধিরা প্রায়ই আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা বলে এবং বেলুচিস্তানেও যুদ্ধ চলছে যদিও জায়গাটা দুর্গম হওয়ায় সেটা নিয়ে তেমন কথা হয় না। এর অর্থ কী? আমাদের দেশটাকে আবার ভাগ করতে হবে?
জাদুঘর থেকে বেরিয়ে দেখি, পতাকাধারী কিছু তরুণ বাইরে প্রতিবাদ করছে। তারা আমাদের জানাল, তারা দক্ষিণ পাঞ্জাব থেকে আসা শিরইকি ভাষার লোক এবং তারা তাদের নিজেদের আলাদা প্রদেশ চায়।
মানুষের লড়াই করার জন্য আরো অনেক কিছু আছে। যদি অনেকের কথামতো খ্রিস্টান, হিন্দু বা ইহুদিরা আমাদের শত্রুই হয়ে থাকে, তাহলে মুসলমানরা কেন একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করছে? আমাদের মানুষ পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। তাদের ধারণা, ইসলামকে রক্ষা করাই তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং তালেবানদের মতো ইচ্ছাকৃতভাবে কোরআনের ভুল ব্যাখ্যাকারীদের পাল্লায় পড়ে ভুল পথে যায়। আমাদের প্রায়োগিক বিষয়ে দৃষ্টিপাত করা উচিত। আমাদের দেশে নিরক্ষর মানুষের সংখ্যা অনেক, অনেক মহিলার শিক্ষাদীক্ষার বালাই নেই। মেয়েদের পড়ালেখার সুযোগ কম। বোমা মেরে স্কুল উড়িয়ে দেওয়া হয় আমাদের দেশে। আমরা কোনো নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ পাই না। অন্তত একজন পাকিস্তানি হত্যার খবর ছাড়া কোনো একটা দিন কাটে না।
একদিন শেহলা আনজুম নামের এক নারী আমাদের হোস্টেলে এলেন। তিনি আলাস্কা প্রবাসী পাকিস্তানি এবং নিউইয়র্ক টাইমসের ওয়েবসাইটে আমাদের প্রামাণ্যচিত্রটা দেখে আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। তিনি কিছুক্ষণ আমার সঙ্গে কথা বললেন, এরপর বাবার সঙ্গে । আমি তাঁর চোখে পানি লক্ষ করলাম। এরপর তিনি আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘জিয়াউদ্দিন তুমি কি জানো, তালেবানরা যে এই নিষ্পাপ মেয়েটিকে হুমকি দিয়েছে?’ আমরা তাঁর কথা বুঝতে না পারায় তিনি ইন্টারনেটে গিয়ে আমাদের দেখালেন, তালেবান দুজন নারীর প্রতি হুমকি জারি করেছে- একজন শাদ বেগম, দিরের একজন আন্দোলনকর্মী এবং অন্যজন আমি, মালালা। ‘এই দুজন ধর্মনিরপেক্ষতা ছড়াচ্ছে এবং এদের মেরে ফেলা উচিত’, সেখানে এটা লেখা ছিল। আমি একে অত গুরুত্ব দিলাম না, কারণ ইন্টারনেটে অনেক কিছুই থাকে এবং এটা সত্য হলে আমরা অন্য সূত্র থেকেই জানতে পারতাম।
সেদিন সন্ধ্যায় আঠারো মাস ধরে আমাদের সঙ্গে একই বাড়িতে থাকা একটি পরিবারের কাছ থেকে বাবা ফোনকল পেলেন। তাদের বাড়ির মাটির ছাদ চুইয়ে বৃষ্টির পানি পড়ছিল এবং আমাদের দুটো অতিরিক্ত ঘর ছিল, তাই নামমাত্র ভাড়ায় তাদের আমরা থাকতে দিয়েছিলাম এবং তাদের বাচ্চারা বিনা বেতনে আমাদের স্কুলে পড়ালেখা করত। তাদের তিন সন্তান, আমরা তাদের সঙ্গে থাকতে পছন্দ করতাম এবং ছাদে চোর-পুলিশ খেলতাম। তারা আমার বাবাকে বলল, পুলিশ আমাদের বাসায় এসে জানতে চেয়েছে, আমরা কোনো হুমকি পেয়েছি কিনা। বাবা এটা শুনে ডেপুটি সুপারিন্টেনডেন্টেকে ফোন করলে তিনিও একই কথাই জিজ্ঞেস করলেন। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন, আপনাদের কাছে কি কোনো তথ্য আছে?’ অফিসার বাবাকে বললেন সোয়াতে ফেরার পর তাঁর সঙ্গে দেখা করতে।
এরপর বাবা খুব অস্থির হয়ে গেলেন এবং করাচিকে উপভোগ করতে পারলেন না। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, আমার বাবা-মা দুজনেই বিষণ্ণ। আমি জানতাম মা এখনো খালার মৃত্যুতে শোকাহত এবং আমি এত অ্যাওয়ার্ড পাওয়ায় তাঁরা অস্বস্তিতে ভুগছেন, কিন্তু ঘটনা তার চেয়ে বেশি বলে মনে হলো। ‘তোমরা এমন কেন?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।’ আমরা কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত কিন্তু আমাদেরকে কিছুই জানাচ্ছ না।’
তখন তাঁরা আমাকে বাসা থেকে আসা কলটার কথা জানিয়ে বললেন, তাঁরা এই হুমকিকে গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছেন। আমি জানি না কেন, আমি টার্গেট হয়েছি এটা জানার পরও আমি দুশ্চিন্তা করিনি।
আমার শুধু মনে হলো, সবাই জানে তাকে একদিন মৃত্যুবরণ করতে হবে। আমার মনে হচ্ছিল কেউ মৃত্যুকে থামাতে পারে না, সেটা তালিবান দ্বারা না ক্যানসার দ্বারা সেটা কোনো ব্যাপার না। তাই আমি যা চাই আমার তাই করা উচিত।
‘আমাদের অভিযান মনে হয় কিছুদিন বন্ধ রাখা উচিত, কিছুদিনের জন্য শীতনিদ্রায় যাওয়া উচিত,’ বাবা বললেন।
‘সেটা কীভাবে সম্ভব?’ আমি প্রশ্ন করলাম। ‘তুমিই তো বলেছিলে যে আমরা যদি কোনো কিছুকে আমাদের জীবনের চেয়ে মূল্যবান মনে করি, মৃত্যুবরণ করলে আমাদের কণ্ঠস্বরের তেজ তাহলে বৃদ্ধিই পাবে। নিজেদের অভিযান তো আর আমরা বর্জন করতে পারি না।’
মানুষজন বিভিন্ন উপলক্ষে আমাকে বক্তব্য রাখতে অনুরোধ করছিল। কীভাবে নিরাপত্তা সমস্যার কথা বলে আমি তাঁদের দাবি অমান্য করতে পারি? বিশেষত গর্বিত পশতুন হিসেবে এটা আমরা করতেই পারি না। আমার বাবা সব সময়ই বলেন, পশতুনদের ডিএনএতেই বীরত্ব আছে।’
তবুও, ভারী হৃদয় নিয়ে আমরা সোয়াতে প্রবেশ করলাম। বাবা পুলিশের কাছে গেলে তাঁরা আমার নামে একটি ফাইল দেখালেন। তাঁরা বাবাকে বললেন, আমার জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূতির অর্থ এই যে আমি তালেবানদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছি, আর জীবনের প্রতি হুমকি ডেকে এনেছি। এতে আমার নিরাপত্তা প্রয়োজন। পুলিশ আমার জন্য দেহরক্ষী দিতে চাইলেও আব্বা রাজি হলেন না।
কারণ সোয়াতে অনেক গুণী মানুষ নিহত হয়েছেন, দেহরক্ষী থাকার পরও। পাঞ্জাবের গভর্নর তো নিজের দেহরক্ষীর হাতেই খুন হয়েছেন। তিনি এটাও ভাবলেন যে সশস্ত্র দেহরক্ষী দেখে স্কুলের অন্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা ভয় পাবে। আর তিনি অন্য কাউকে ঝুঁকিতে ফেলতে চাননি। এর আগে তিনি নিজে যখনই হুমকি পেয়েছেন, তখনই বলেছেন, ‘তারা আমাকে হত্যা করবে, কিন্তু আমি যেন একাই মারা যাই।’
তিনি আমাকে খুশালের মতো অ্যাবোটাবাদে বোর্ডিং স্কুলে পাঠাতে চাইলেন কিন্তু আমি যেতে চাইনি। তিনি স্থানীয় সেনাবাহিনীর কর্নেলের সঙ্গে দেখা করলেন, তিনিও বললেন যে অ্যাবোটাবাদও সোয়াতের চাইতে কোনো দিক দিয়ে বেশি নিরাপদ নয় এবং যতদিন আমি কম প্রচার করছি ততদিন সোয়াত আমার জন্য নিরাপদ। তাই কেপিকে সরকার যখন আমাকে শান্তি প্রতিনিধি হওয়ার প্রস্তাব দিল, বাবা বললেন, এটা ফিরিয়ে দেওয়াই উত্তম।
বাসায় আমি রাতের বেলা মূল ফটকের ছিটকিনি লাগানো আরম্ভ করলাম। ‘সে বিপদের গন্ধ পাচ্ছে,’ মা বাবাকে বললেন। বাবা খুবই অখুশি ছিলেন। তিনি রাতে আমার ঘরের পর্দা টানিয়ে রাখতে বলতেন কিন্তু আমি তা করতাম না।
‘আব্বা, এটা খুবই আজব পরিস্থিতি,’ আমি তাকে বললাম। তালেবানরা যখন ছিল তখন আমরা নিরাপদ ছিলাম, এখন তালেবান নেই আর এখনই আমরা অনিরাপদ।
‘হ্যাঁ, মালালা,’ তিনি উত্তর দিলেন। ‘এখন তালেবানিকরণ বিশেষভাবে আমাদের জন্য, তোমার আর আমার মতো যারা এখনো প্রতিবাদ চালিয়ে যাচ্ছি তাদের জন্য। সোয়াতের বাকিরা ঠিক আছে। রিকশাচালক, দোকানির সবাই নিরাপদ। এই তালেবানিকরণ কিছু বিশেষ মানুষের জন্য, আমরা তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।’
এসব অ্যাওয়ার্ড লাভের আরেকটা কুফল দেখা গেল- আমার স্কুলে অনেক পড়াই করতে পারছিলাম না। তাই মার্চ মাসে যে কাপটা আমার নতুন কেবিনেটে স্থান পেল তা ছিল দ্বিতীয় স্থানের জন্য।
(চলবে)