আমি মালালা বলছি
জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে
কী ঘটেছে, তা বোঝার সঙ্গে সঙ্গেই উসমান ভাইজান সর্বোচ্চ গতিতে ডানে মোড় ঘুরে সোয়াত সেন্ট্রাল হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। অন্য মেয়েরা চিৎকার করে কাঁদছিল। আমি মনিবার কোলে শুয়ে ছিলাম। আমার মাথা ও বাঁ কান থেকে রক্ত বেরোচ্ছে। অল্প একটু রাস্তা যেতেই এক পুলিশ আমাদের মূল্যবান কিছু সময় নষ্ট করে, মাঝরাস্তায় ভ্যান থামিয়ে প্রশ্ন করতে লাগল। এক মেয়ে আমার ঘাড়ে নাড়ির গতি দেখল, ‘সে বেঁচে আছে,’ সে চিৎকার করে বলল, ‘ওকে এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে। আমাদের ছেড়ে দিয়ে যে এটা ঘটিয়েছে তাকে ধরুন।’
আমাদের মনে হতো মিঙ্গোরা একট বড় শহর, কিন্তু আসলে এটা একটা ছোট জায়গা এবং খবরটা দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ল। বাবা অ্যাসোসিয়েশন অব প্রাইভেট স্কুলের সভার জন্য সোয়াত প্রেসক্লাবে ছিলেন এবং যখন তার মোবাইল ফোন বাজল, তখন তিনি মাত্র বক্তৃতা দিতে মঞ্চে উঠেছেন। তিনি খুশাল স্কুলের নম্বর চিনতে পারলেন। ফোনটা ধরার জন্য তিনি তার বন্ধু আহমেদ শাহের কাছে দেন। তিনি জরুরিভাবে ফিসফিসিয়ে বাবাকে বললেন।
মুহূর্তেই বাবার চেহারা থেকে রক্ত সরে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি ভাবলেন, ওই বাসে তো মালালাও থাকতে পারে। এরপর তিনি নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন, ভাবলেন ওটা ঈর্ষাকাতর প্রেমিকের কাজ। ভালোবাসা জানানোর জন্য গুলি ছুড়েছে। সারা সোয়াত থেকে আসা ৪০০ অধ্যক্ষের এক গুরুত্বপূর্ণ সভায় ছিলেন তিনি। সরকার যে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ গঠন করার পরিকল্পনা করছে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতেই এখানে এসেছেন। বাবার মনে হলো, এই সংগঠনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি এত লোককে নিরাশ করতে পারেন না, তাই তিনি পরিকল্পনামাফিক ভাষণ শেষ করলেন। কিন্তু তাঁর কপালে ছিল ফোঁটা ফোঁটা ঘাম এবং সেবার তাঁকে বক্তৃতা শেষ করার জন্য কাউকে ইঙ্গিত দিতে হয়নি।
বক্তৃতা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে বাবা দর্শকসারির লোকদের প্রশ্নের অপেক্ষা না করেই আহমেদ শাহ ও আরেক বন্ধু গাড়ির মালিক রিয়াজের সঙ্গে হাসপাতালে ছুটলেন। হাসপাতাল ছিল মাত্র পাঁচ মিনিটের দূরত্বে। এসে দেখেন, বাইরে ফটোসাংবাদিক এবং টিভি ক্যামেরায় ঠাসাঠাসি। তখনই তিনি নিশ্চিত হলেন যে আমি সেখানে আছি। বাবার বুকে ধক করে উঠল। তিনি ঠেলে ক্যামেরার ফ্লাশের মাঝ দিয়েই হাসপাতালে দৌড়ে ঢুকলেন। ভেতরে মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা, চোখ বন্ধ, চুল ছড়ানো অবস্থায়, আমি ট্রলিতে শুয়ে।
‘আমার মেয়ে, তুমি আমার সাহসী মেয়ে, আমার সুন্দরী মেয়ে,’ বারবার এ কথা বলে তিনি আমার কপাল আর গালে এবং নাকে চুমু খাচ্ছিলেন। তিনি জানতেন না, তিনি কেন আমার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলছিলেন। আমার মনে হয়, চোখ বন্ধ থাকা সত্ত্বেও আমি কীভাবে যেন বুঝতে পেরেছিলাম বাবা এসেছেন। বাবা পরে বলেছিলেন, ‘আমি ব্যাখ্যা করতে পারব না। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল যে তুমি সাড়া দেবে।’ কেউ একজন বলল, আমি মুচকি হেসেছিলাম। কিন্তু বাবার কাছে সেটা শুধু একটা সুন্দর মুহূর্ত, কারণ তিনি জানতেন তিনি আমাকে চিরদিনের জন্য হারাননি। আমাকে ওই অবস্থায় দেখাটা ছিল তাঁর জীবনের নিকৃষ্টতম ঘটনাগুলোর একটি। প্রতিটি সন্তান মা-বাবার জন্য বিশেষ কিছু। কিন্তু আমার বাবার কাছে আমি তাঁর মহাবিশ্ব। আমি তাঁর বহু পুরোনো সহযোদ্ধা, প্রথমে গোপনে গুল মাকাই হিসেবে, এরপর খোলাখুলিভাবেই মালালা হিসেবে। তিনি সব সময়ই বিশ্বাস করতেন যে তালেবান এলে আমাকে নয়, তাঁকে মারতেই আসবে, তিনি বলেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল যে তিনি বজ্রাহত। বাবা বলেছিলেন, ‘তারা এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিল। মালালাকে হত্যা করে আমাকে চিরকালের মতো থামিয়ে দিতে চেয়েছিল।’
তিনি খুব ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু কাঁদেননি, সবখানেই লোকজন। সভা থেকে সব অধ্যক্ষই হাসপাতালে চলে এসেছেন। এবং গণমাধ্যমে আর আন্দোলনকর্মীতে জায়গাটি ভর্তি ছিল। যেন গোটা দুনিয়াটাই সেখানে চলে এসেছে। ‘মালালার জন্য প্রার্থনা করো,’ তিনি তাদের বললেন। ডাক্তাররা তাঁকে আশ্বস্ত করেন যে সিটি স্ক্যানে দেখা গেছে, গুলিটা আমার মগজের কাছে যায়নি। তাঁরা ক্ষতটা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন।
‘ও জিয়া উদ্দিন! তিনি কী করছে?’ ম্যাডাম মারিয়াম ঝড়ের গতিতে দরজা দিয়ে ঢুকলেন। তিনি সেদিন, স্কুলে ছিলেন না, বাচ্চার শুশ্রূষা করছিলেন, এখন তাঁর দেবর তাঁকে ফোন করে নিশ্চিত হয়ে নিলেন যে তিনি নিরাপদ আছেন। শঙ্কিত হয়ে তিনি টিভি খুলে শিরোনামে দেখলেন যে খুশাল স্কুলের বাসে গুলি করা হয়েছে। আমি গুলিবিদ্ধ হয়েছি শুনেই তিনি তাঁকে স্বামীকে ফোন করেন। তিনি তাঁর মোটরবাইকের পেছনে করে ম্যাডাম মারিয়ামকে হাসপাতালে আনেন, একজন সম্ভ্রান্ত পশতুন নারীর পক্ষে যেটা ছিল অত্যন্ত বিরল। ‘মালালা, মালালা, তুমি আমাকে শুনতে পাচ্ছো?’ তিনি ডাক দিলেন।
আমি গোঁ গোঁ করে উঠলাম।
মারিয়াম আরো ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করলেন কী হচ্ছে, তাঁর পরিচিত এক ডাক্তার বললেন যে গুলিটি আমার মগজের ভেতর দিয়ে না গিয়ে কপালের ভেতর দিয়ে গেছে। এবং আমি নিরাপদ। তিনি গুলিবিদ্ধ হওয়া খুশাল স্কুলের অন্য মেয়ে দুজনকেও দেখলেন। শাজিয়ার গায়ে দুবার গুলি লেগেছে, কলারবোন এবং হাতের তালুতে এবং আমার সঙ্গে তাকেও হাসপাতালে আনা হয়েছে। কায়নাত প্রথমে বুঝতেই পারেনি তার গায়ে গুলি লেগেছে, সে বাসায় চলে গিয়েছিল, তখন আবিষ্কার করা হলে তার ডান হাতের উপরিভাগে গুলি ছুঁয়ে গেছে, তাই তার পরিবার তাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে।
আমার বাবা জানতেন, তাঁর উঠে গিয়ে ওদের দেখে আসা উচিত, কিন্তু তিনি এক মিনিটের জন্যও আমাকে চোখের আড়াল করতে রাজি হননি। তাঁর ফোন বাজতেই থাকল। কেপিকের মুখ্যমন্ত্রীই প্রথম ফোন করলেন। ‘আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না, আমরা সবকিছু গুছিয়ে দেব,’ তিনি বললেন, ‘পেশাওয়ারের লেডি রিডিং হাসপাতাল আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে।’ কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণ করল সেনাবাহিনী। বিকেল ৩টায় স্থানীয় সেনা কমান্ডার এসে ঘোষণা দিলেন যে তাঁরা আমাকে এবং আমার বাবাকে পেশাওয়ার নিয়ে যেতে একটি সামরিক হেলিকপ্টার পাঠাচ্ছেন। আমার মাকে আনার মতো সময় ছিল না, তাই ম্যাডাম মারিয়াম আমার সঙ্গে যেতে চাইলেন, কারণ একজন নারীর সাহায্যও আমার প্রয়োজন হতে পারে। মারিয়ামের পরিবার এটা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল না, কারণ তিনি তখনো তাঁর শিশুপুত্রের শুশ্রূষা করতেন, বাচ্চাটির কদিন আগেই ছোট একটি অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে গেছে। কিন্তু তিনি আমার দ্বিতীয় মায়ের মতো।
আমাকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলার পর বাবা ভয় পেলেন যে তালেবান আবার আক্রমণ করবে। তাঁর কাছে মনে হলো, ভেতরে যে আছে সবাই যেন তা জানে। হেলিপ্যাডটা মাত্র এক মাইল দূরে, গাড়িতে পাঁচ মিনিটের রাস্তা, কিন্তু সারা রাস্তা তিনি আতঙ্কে ছিলেন। আমরা যখন পৌঁছলাম, তখনো হেলিকপ্টার এসে পৌঁছেনি এবং আমাদের অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরের অপেক্ষাটা বাবার কাছে মনে হলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অবশেষে সেটা অবতরণ করল। তখন বাবা, আমার জ্ঞাতিভাই খানজি, আহমেদ শাহ এবং মারিয়ামের সঙ্গে আমাকে তুলে নেওয়া হলো। তাঁরা কেউই আগে হেলিকপ্টারে ওঠেননি। সেটা উড়াল দিতেই আমরা সেনাবাহিনীর ক্রীড়া উৎসবের স্থানের ওপর দিয়ে উড়ে গেলাম। সেখানে স্পিকারে দেশাত্মবোধক সংগীত বাজছিল। বাবা গান পছন্দ করলেও সে সময় তাঁর ওই দেশাত্মবোধক গান বোধ হয় ভালো লাগছিল না। কারণ, মাথায় গুলিবিদ্ধ মৃতপ্রায় ১৫ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার সময় দেশাত্মবোধক গান মোটেও জুতসই নয়।
নিচে, আমার মা বাড়ির ছাদ থেকে সবকিছু দেখছিলেন। মিস উলফাতের কাছে যখন ইংরেজি শিখছিলেন, তখনই তিনি আমার আঘাত পাওয়ার কথাটা জানতে পারেন। খবরটা প্রথমে তালগোল পাকানো ছিল এবং প্রথমে তিনি বুঝেছিলেন যে আমি দুর্ঘটনায় পায়ে আঘাত পেয়েছি। তিনি দৌড়ে গিয়ে তখন আমাদের সঙ্গে থাকা নানিকে খবরটা দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে প্রার্থনা করার অনুরোধ করেন। আমরা বিশ্বাস করি, যাদের চুল সাদা আল্লাহ তাঁদের কথাই বেশি শোনেন। মা যখন আমার নাশতার আধখাওয়া ডিমটা লক্ষ করলেন, সবখানেই ছিল আমার পুরস্কার নেওয়ার ছবি, যা তিনি অগ্রাহ্য করে এসেছেন। চারপাশে সবখানেই ছিল মালালা, মালালা।
মুহূর্তেই অনেক মহিলা এসে বাসাটা ভরে ফেলল। আমাদের সংস্কৃতিতে কেউ মারা গেলে মহিলারা মৃত ব্যক্তির বাসায় আসে এবং পুরুষরা যায় হুজরায়। শুধু পরিবারের সদস্য এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু নয়, প্রতিবেশী সবাই।
মা এত লোক দেখে অবাক হয়ে গেলেন। তিনি জায়নামাজে বসে কোরআন পড়া শুরু করলেন। তিনি মহিলাদের বললেন, কেঁদো না, প্রার্থনা করো। এরপর আমার ভাইয়েরা ঝড়ের গতিতে ঘরে ঢুকল। স্কুল থেকে বাসায় হেঁটে আসা অতল টিভি খুলে আমার গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবরটা দেখেছে। সে খুশালকে ডেকেছে, এবং তারাও কান্নার মিছিলে শামিল হয়েছে। সেটা থামছিল না। মানুষ মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল যে আমি মাথায় গুলিবিদ্ধ হলেও বুলেটটা আমার কপাল ঘেঁষে চলে গেছে। মা এত রকম কাহিনী শুনে বিভ্রান্ত হয়ে গেছেন, প্রথমে শুনলেন পায়ে গুলি লেগেছে, এর পর শুনলেন মাথায়। তিনি ভাবলেন, তিনি আমাকে দেখতে না গেলে আমি অবাক হব, কিন্তু মানুষ তাঁকে যেতে না করল, কারণ আমি হয় মৃত না হয় আমাকে এক্ষণই সরিয়ে নেওয়া হবে। বাবার এক বন্ধু তাঁকে ফোন করে জানাল যে আমাকে হেলিকপ্টারে করে পেশাওয়ার নেওয়া হচ্ছে এবং তাঁকে পশ্চিম সড়কে আসতে হবে। তাঁর নিকৃষ্টতম মুহূর্তে ছিল যখন কেউ একজন বাসায় এসে আমার সামনের দরজার চাবিগুলো দিল, যেগুলো ঘটনাস্থলে পাওয়া গিয়েছিল, আর মা চেঁচিয়ে উঠলেন, আমি চাবি চাই না। আমি আমার মেয়েকে চাই। মালালাকে ছাড়া চাবির কী দাম? তখন তাঁরা হেলিকপ্টারের শব্দ শুনলেন।
হেলিপ্যাড আমাদের বাড়ির মাত্র এক মাইল দূরে ছিল এবং মহিলারা সবাই ছাদে দৌড় দিলেন। ওটা নিশ্চয়ই মালালা! তাঁরা বললেন। মাথার ওপর দিয়ে হেলিকপ্টার উড়ে যেতে দেখে মা পশতুন নারীর পক্ষে খুবই বিরল একটা কাজ করে বসলেন, মাথার ওড়না খুলে সেটা দুহাতে ধরে আকাশের দিকে তুলে ধরলেন, যেন কারো প্রতি নিবেদন করছেন, আল্লাহ, আমি তোমার হাতে ওকে সঁপে দিলাম, তিনি স্বর্গের উদ্দেশ করে বলতে থাকলেন। আমরা নিরাপত্তারক্ষী গ্রহণ করিনি—তুমিই আমাদের রক্ষাকর্তা। সে তোমার জিম্মায় ছিল এবং তুমিই তাকে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য।
হেলিকপ্টারের ভেতর আমি রক্তবমি করছিলাম। বাবা আতঙ্কিত হয়ে ভাবলেন, মস্তিষ্কের ভেতরে রক্তরক্ষণ হচ্ছে। তিনি আশা হারাতে শুরু করেন। কিন্তু তখনই ম্যাডাম মারিয়াম লক্ষ করলেন, আমি ওড়না নিয়ে মুখ মোছার চেষ্টা করছি। দেখ, যে সাড়া দিচ্ছে। তিনি বললেন, ‘এটা চমৎকার ব্যাপার।’
পেশাওয়ারে অবতরণের পর তাঁরা অনুমান করলেন, আমাকে রিডিং হসপিটালে নেওয়া হবে। যেখানে ড. মুমতাজ নামের এক উৎকৃষ্ট নিউরোসার্জনের কথা আমাদের সুপারিশ করা হয়েছিল। তাঁর পরিবর্তে তাঁদের বলা হলো কম্বাইন্ড মিলিটারি হসপিটাল বা সিএমএইচে যেতে। সিএমএইচ ছিল ব্রিটিশ শাসনমলে প্রতিষ্ঠিত ৬০০ শয্যাবিশিষ্ট এলোমেলো ইট দ্বারা গঠিত এক হাসপাতাল। নতুন একটি বিল্ডিং ব্লক তৈরির জন্য নির্মাণকাজ চলছিল। পেশাওয়ার ছিল ফাতায় ঢোকার রাস্তা এবং ২০০৪ সালে সেনাবাহিনী যখন জঙ্গিদের ওপর ফাতায় গিয়ে হামলা চালায়, এই হাসপাতালেই আহত সেনাসদস্য এবং সারা শহরের আত্মঘাতী বোমা হামলায় আহত লোকজনের চিকিৎসা হয়েছিল। আমাদের দেশের বেশিরভাগ অংশের মতই আত্মঘাতী বোমারুদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সিএমএইচের চারদিকে কংক্রিটের ব্লক এবং চেকপয়েন্ট ছিল।
আমাকে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে নেওয়া হলো, যেটা আলাদা একটা ভবনে অবস্থিত। নার্স স্টেশনের ঘড়িতে দেখাচ্ছিল, বিকেল ৫টার কিছুটা বেশি বাজে। আমাকে কাচের দেয়ালঘেরা আইসোলেশন ইউনিটে নেওয়া হলো এবং একজন সেবিকা আমাকে শুইয়ে দিলেন। পাশের ঘরেই ছিলেন এক সৈনিক, যিনি একটি আইইডি হামলায় ভয়াবহভাবে পুড়ে গেছেন এবং তাঁর একটি পা উড়ে গেছে। এক তরুণ এসে নিজেকে নিউরোসার্জন কর্নেল জুনাইদ বলে পরিচয় দিল। বাবা আরো বিরক্ত হলেন। তাঁর মনে হলো না যে কর্নেল জুনাইদ একজন ডাক্তার, কারণ তাঁর বয়স এত কম দেখাচ্ছিল। ডাক্তার জিজ্ঞেস করল, ‘সে কি আপনার মেয়ে?’ মারিয়াম আমার মা হবার ভান করলেন, যাতে ভেতরে আসতে পারেন।
কর্নেল জুনাইদ আমাকে পরীক্ষা করে দেখলেন। আমি সজ্ঞান এবং অস্থির ছিলাম, কিন্তু কোনো কথা বলছিলাম না এবং কোনো বিষয়ে জ্ঞাত ছিলাম না, আমার চোখ পিটপিট করছিল। কর্নেল আমার বাঁ ভ্রূর ওপরে গুলি প্রবেশের স্থানটি সেলাই করে দেন, কিন্তু স্ক্র্যানে কোনো বুলেট দেখতে না পেয়ে অবাক হয়ে গেলেন। প্রবেশপথ থাকলে বহির্গমনের স্থানও থাকবে, তিনি বললেন। তিনি আমার মেরুদণ্ড পরীক্ষা করে বুঝলেন, বুলেটটা আমার বাঁ কাঁধের পাশে অবস্থিত। ‘সে নিশ্চয়ই ঝুঁকে পড়েছিল, তাই গুলিটা ঢোকার সময় তার ঘাড়ে চলে যায়,’ তিনি বললেন।
আমার আরেকটা সিটি স্ক্যান করা হলো। কর্নেল একটি পর্দায় স্থানের ফলাফল এনে রেখে বাবাকে তাঁর অফিসে ডাকলেন। তিনি বললেন যে সোয়াতে করা স্ক্যানটি কেবল একটি অ্যাঙ্গেল থেকে করা হয়েছিল, কিন্তু এই নতুন স্ক্যানটিতে বোঝা যাচ্ছে, ক্ষতটি আরো গুরুতর। ‘দেখুন, জিয়াউদ্দিন,’ তিনি বললেন। এই সিটি স্ক্যানে বোঝা যাচ্ছে যে গুলিটা তার মগজের খুব কাছ দিয়ে গেছে। তিনি বললেন যে, ‘হাড়ের কণা মস্তিষ্কের পর্দা ধ্বংস করে দিয়েছে। আমরা স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করতে পারি। অপেক্ষা করে দেখি কী হয়।’ তিনি বললেন, ‘এই অবস্থায় আমরা অস্ত্রোপচার করব না।’
বাবা আরো বেশি উত্তেজিত হয়ে গেলেন। সোয়াতে ডাক্তাররা তাঁকে বলেছিলেন যে এটা তেমন কিছু না। এখন ব্যাপারটা গুরুতর মনে হচ্ছে। আর গুরুতর হলে অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে না কেন? সাময়িক হাসপাতালে তিনি বেশ অস্বস্তি বোধ করলেন। আমাদের দেশে সেনাবাহিনী এতবার ক্ষমতা দখল করেছে যে মানুষ প্রায়ই সাময়িক বাহিনীর ব্যাপারে সতর্ক হয়ে ওঠে। বিশেষ করে সোয়াতে, যেখানে সেনাবাহিনী তালেবানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে এত সময় নিয়েছে। বাবার এক বন্ধু তাঁকে ফোন করে বললেন, ওকে এই হাসপাতাল থেকে সরাও। আমরা তাকে লিয়াকত আলী খানের মতো শহীদ মিল্লাত (জাতীয় শহীদ) হতে দিতে চাই। বাবা বুঝতে পারলেন না, তাঁর কী করা উচিত।
‘আমি বিভ্রান্ত’, তিনি কর্নেল জুনাইদকে বললেন, ‘আমরা এখানে কেন? আমি ভেবেছিলাম আমরা বেসাময়িক হাসপাতালে যাব।’ এর পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি দয়া করে ড. মুমতাজকে আনতে পারবেন?’
‘সেটা কেমন দেখাবে?’ স্বাভাবিকভাবেই অসন্তুষ্ট হয়ে কর্নেল জুনাইদ বললেন।
পরবর্তী সময়ে আমরা জানতে পেরেছিলাম যে তারুণ্যপূর্ণ চেহারা হলেও সেই কর্নেল ১৩ বছর ধরে নিউরোসার্জন হিসেবে কাজ করছেন এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সবচেয়ে অভিজ্ঞ এবং সম্মানিত নিউরোসার্জন তিনি। তিনি তাঁর আর্মি নিউরোসার্জন চাচার পদচিহ্ন অনুসরণ করে সেনাবাহিনীর প্রকৃষ্ট সুযোগ-সুবিধার কারণেই এই বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। পেশাওয়ার সিএমএইচ ছিল তালেবানের সঙ্গে যুদ্ধের প্রথম সারিতে এবং জুনাইদ প্রতিদিন গুলির ক্ষত ও বিস্ফোরণের আহতদের চিকিৎসা করেছেন। তিনি পরে বলেছিলেন, ‘আমি হাজার হাজার মালালার চিকিৎসা করেছি।’
কিন্তু তখন বাবা এতসব জানতেন না এবং বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন। ‘আপনার যা ভালো মনে হয় করুন,’ তিনি বললেন, ‘আপনিই তো ডাক্তার।’
পরবর্তী কয়েক ঘণ্টা ছিল অপেক্ষা করে দেখার সময়, নার্সরা আমার হৃদস্পন্দন এবং মৌলিক চিহ্নগুলো নজরে রাখছিলেন। হঠাৎ হঠাৎ আমি মৃদুস্বরে গুঙিয়ে উঠতাম এবং হাত নাড়াতাম বা চোখ পিটপিট করতাম। তখন মারিয়াম বলতেন, ‘মালালা, মালালা।’ একবার আমি পুরোপুরি চোখ খুলেছিলাম। ‘আমি আগে কখনোই খেয়াল করিনি ওর চোখ দুটো কত সুন্দর,’ মারিয়াম বললেন। আমি খুব অস্থির ছিলাম এবং আঙুল থেকে মনিটা সরাবার চেষ্টা করছিলাম। ‘ওটা কোরো না,’ মারিয়াম বললেন।
‘মিস, আমাকে বকবেন না,’ আমি ফিসফিসিয়ে বললাম, যেন স্কুলে আছি। প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে ম্যাডাম মারিয়াম বেশ কড়া।
সন্ধ্যার শেষে মা অতলকে নিয়ে এলেন। আমার বাবার বন্ধু মোহাম্মদ ফারুক সড়কপথে চার ঘণ্টার যাত্রা করে তাঁদের নিয়ে এসেছেন। আসার আগে ম্যাডাম মারিয়াম তাঁকে ফোনে সতর্ক করে দিলেন, মালালাকে দেখে কাঁদবেন না বা চিৎকার করবেন না। আপনি মনে করবেন সে আপনাকে শুনতে পাচ্ছে না, আসলে ঠিকই শুনছে। বাবাও তাঁকে ফোনে সবচেয়ে খারাপটার জন্য প্রস্তুত হতে বললেন। তিনি তাঁকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন।
মা এলে তাঁরা আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলেন এবং চোখের পানি ধরে রাখলেন। ‘এই তো অতল এসেছে,’ মা আমাকে বলেছিলেন, ‘সে তোমাকে দেখতে এসেছে।’
অতল বিহ্বল হয়ে গিয়েছিল, সে অনেক কাঁদল। ‘মাম্মা’ সে কাঁদল, ‘মালালা অনেক ব্যথা পেয়েছে।’
মা হতভম্ব অবস্থায় ছিলেন এবং ডাক্তাররা কেন বুলেটটা সরানোর জন্য অস্ত্রোপচার করছে না, তা বুঝতে পারছিলেন না। আমার সাহসী মেয়ে, আমার সুন্দরী,’ চিৎকার করে তিনি কাঁদলেন। অতল এত শব্দ করে কাঁদছিল যে একপর্যায়ে এক আর্দালি এসে তাদের হাসপাতালের সামরিক হোস্টেলে নিয়ে গেল, যেখানে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
বাবা বাইরে ভিড় করে থাকা এত মানুষকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন। রাজনীতিবিদ, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, প্রাদেশিক গভর্নর—সবাই সমবেদনা জানাতে এসেছেন। গভর্নর আমার চিকিৎসার জন্য বাবাকে এক লাখ রুপি দিলেন। আমাদের সমাজে কেউ মারা গেলে কোনো সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সে বাড়িতে গেলে সেটা খুব সম্মানের ব্যাপার হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু তখন বাবা বিব্রত বোধ করছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল, ‘এ লোকগুলো আমার জন্য কিছুই না করে আমার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে।’
রাতে খাওয়ার সময় অতল টিভি চালালে বাবা তৎক্ষণাৎ সেটা অফ করে দেন। তিনি সেই মুহূর্তে আমার ওপর আক্রমণের খবরটাও মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি রুম থেকে বেরোতেই মারিয়াম টিভিটা আবার চালু করলেন। প্রতিটা চ্যানেলেই প্রার্থনার ধারাভাষ্য এবং কবিতা সহযোগে আমার ফুটেজ দেখানো হচ্ছে, যেন আমি মারা গেছি। আমার মায়ের, ‘আমার মালালা, আমার মালালা,’ বিলাপে মারিয়ামও শামিল হলেন।
মাঝরাতের কাছাকাছির সময়ে কর্নেল জুনাইদ বাবাকে আইসিইউর বাইরে দেখা করতে বললেন। ‘জিয়াউদ্দিন, মালালার মস্তিষ্ক স্ফীত হয়ে উঠছে।’ বাবা এর অর্থটা বুঝতে পারলেন না। ডাক্তার তাঁকে বোঝালেন যে আমার অবনতি ঘটছে, আমার সংজ্ঞা লোপ পাচ্ছে এবং আমি রক্তবমি করছি। কর্নেল জুনাইদ তৃতীয়বারের মতো সিটি স্ক্যানের নির্দেশ দিয়ে দেখলেন, আমার মস্তিষ্ক বিপজ্জনকভাবে ফুলে উঠছে। ‘কিন্তু আমি তো ভেবেছিলাম যে গুলিটা ওর মগজে প্রবেশ করেনি,’ বাবা বললেন।
কর্নেল জুনাইদ ব্যাখ্যা করে বললেন যে, ‘হাড় ভেঙে তার টুকরোগুলো আমার মগজে চলে গেছে, প্রচণ্ড ধাক্কা সৃষ্টি করেছে এবং মস্তিষ্কটা ফুলে গেছে।’ আমার খুলির কিছু অংশ সরিয়ে মগজটাকে ফুলে ওঠার জায়গা দিতে হবে, নইলে চাপটা অসহনীয় হয়ে উঠবে। ‘আমাদের এখনই একটা অস্ত্রোপচার করে ওকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত।’ তিনি বললেন, ‘তা না হলে সে মারাও যেতে পারে। আমি চাই না যে আপনি পরে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে অনুতপ্ত হন।’
খুলির কিছু অংশ কেটে নেওয়ার ব্যাপারটা বাবার কাছে আকস্মিক ধাক্কার মতো শোনাল। ‘সে কি বাঁচবে?’ তিনি মরিয়া হয়ে জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু তাঁকে সে সময় খুব কমই আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল।
কর্নেল জুনাইদের এই সিদ্ধান্ত ছিল খুবই সাহসী, তাঁর অগ্রজ চিকিৎসকরা এতে সন্তুষ্ট হননি এবং অন্য লোকজন তাঁদের বলছিল, আমাকে যাতে বিদেশে পাঠানো হয়। এই সিদ্ধান্তই আমার জীবন বাঁচাতে পারে। আমার বাবা তাঁকে আগাতে বললেন, এবং কর্নেল জুনাইদ বললেন যে তিনি সাহায্যের জন্য ড. মুমতাজকে আনবেন। কাগজে সই করার সময় বাবার হতে কাঁপছিল। সাদা-কালো অক্ষরে লেখা ‘রোগী মারা যেতে পারে’।
রাত দেড়টার দিকে অস্ত্রোপচার শুরু হলো। মা এবং বাবা অপারেটিং থিয়েটারের বাইরে বসে ছিলেন। ‘হে আল্লাহ দয়া করে মালালাকে সুস্থ করে দাও,’ বাবা প্রার্থনা করছিলেন। তিনি আল্লাহকে বললেন, ‘আমাকে সাহারা মরুভূমিতে থাকতে হলেও ওর চোখ আমি খোলা দেখতে চাই, ওকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। হে আল্লাহ, আমি অনেক দিন বেঁচেছি, আমার জীবনের বাকিটুকু ওকে দিয়ে দাও, ও আহত হলেও ওকে তুমি কেবল বেঁচে থাকতে দাও।’
অবশেষে মা তাকে বাধা দিলেন, ‘আল্লাহ কৃপণ নন,’ তিনি বললেন। আমার মেয়েকে তিনি যেমন ছিল, সেভাবেই ফিরিয়ে দেবেন। তিনি দেয়ালের দিকে ফিরে পবিত্র কোরআন হাতে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টার আয়াতগুলো পড়ে পড়ে প্রার্থনা করতেন।
‘উনার মতে করে প্রার্থনা করতে আমি কাউকে দেখিনি,’ ম্যাডাম মারিয়াম বলেছিলেন। আমি নিশ্চিত ছিলাম আল্লাহ এমন প্রার্থনা মঞ্জুর করবেন।
বাবা অতীত নিয়ে ভাবার চেষ্টা করলেন না, আমাকে প্রতিবাদ জানাতে বা প্রচারাভিযান চালাতে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে তিনি ভুল করেছেন কি-না, তা মনে করার চেষ্টা করলেন না।
থিয়েটারের ভেতর কর্নেল জুনাইদ আমার খুলির ওপর বাঁ পাশ হতে একটি আট থেকে দশ সেন্টিমিটার বর্গক্ষেত্র করাত দিয়ে অপসারণ করে আমার মস্তিষ্ককে স্ফীত হওয়ার জায়গা করে দিলেন। এর পর তিনি আমার পাকস্থলীর সাবকিউটেনিয়াস টিস্যু কেটে সেই হাড়ের টুকরোটি সংরক্ষণ করার জন্য সেখানে রাখলেন। তিনি ভয় পাচ্ছিলেন যে ফোলাটা আমার বায়ুসঞ্চালনের রাস্তাকে বাধাগ্রস্ত করছে, তাই একটি পথ তৈরি করলেন। আমার মস্তিষ্ক থেকে রক্তপিণ্ড এবং কাঁধ থেকে বুলেটটিও সরালেন তিনি। এসব কার্যপ্রণালি শেষে আমাকে একটি ভেন্টিলেটরে রাখা হলো। অস্ত্রোপচারটা প্রায় পাঁচ ঘণ্টা চলেছিল।
মায়ের প্রার্থনা সত্ত্বেও বাবার মনে হচ্ছিল, বাইরের নব্বই শতাংশ লোক আমার মৃত্যুসংবাদের জন্য অপেক্ষা করছে। বাবার বন্ধু এবং সমব্যথীরা বিচলিত হলেও তিনি ভাবছিলেন যে, অন্যরা আমাদের উচ্চ মর্যাদার জন্য ঈর্ষান্বিত ছিল এবং তারা বিশ্বাস করে যে আমাদের এই দুর্ভাগ্যের জন্য আমরাই দায়ী।
বাবা অপারেটিং থিয়েটারের প্রবলতা থেকে কিছুক্ষণের বিরতি নিতে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তখনই এক সেবিকা এসে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি মালালার বাবা?’ আরো একবার বাবার বুক ধক্ করে উঠল। তখন সেবিকা তাঁকে একটি কক্ষে নিয়ে গেলেন।
বাবা ভাবলেন যে সেবিকা বলবেন, ‘আমরা দুঃখিত, কিন্তু আমরা ওকে বাঁচাতে পারিনি। তবে ভেতরে গিয়ে তাঁকে বলা হলো, ‘ব্লাড ব্যাংক যাওয়ার জন্য আমাদের কাউকে প্রয়োজন।’ তিনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেও হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন, তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘এটা আনার জন্য আমিই কি একমাত্র ব্যক্তি?’ তার পরিবর্তে বাবার এক বন্ধু গেলেন। সার্জনরা প্রায় ভোর সাড়ে ৫টার দিকে বেরোলেন।
অন্যরা কথার মাঝে বাবাকে জানালেন যে মাথার খুলির একটা অংশ সরিয়ে তলপেটে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের সংস্কৃতিতে ডাক্তার রোগী বা রোগীর আত্মীয়দের কিছু বুঝিয়ে দেন না এবং বাবা নম্রভাবে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা কিছু মনে না করলে আমি খুব নির্বোধ একটি প্রশ্ন করব। সে কি বাঁচবে, আপনাদের কী মনে হয়?’
চিকিৎসাবিজ্ঞানে দুইয়ে দুইয়ে সব সময় চার হয় না। কর্নেল জুনাইদ বললেন, ‘আমরা আমাদের কাজ করেছি, খুলির হাড়টা সরিয়েছি। এখন অপেক্ষা করতে হবে।’
‘আমার আরেকটি নির্বোধ প্রশ্ন আছে,’ বাবা বললেন, ‘হাড়টির কী অবস্থা? ওটা দিয়ে আপনারা কী করবেন?’
‘তিন মাস পর আমরা সেটা একই জায়গায় বসিয়ে দেব,’ ড. মুমতাজ উত্তর দিলেন, ‘খুব সোজা, ঠিক এটার মতো।’ এই বলে তিনি হাততালি দিলেন।
পরদিন সকালে সুখবর এলো। আমি হাত নাড়িয়েছিলাম। এরপর প্রদেশের তিন শ্রেষ্ঠ শল্যচিকিৎসক আমাকে পরীক্ষা করতে এলেন। তাঁরা বললেন, ‘কর্নেল জুনাইদ এবং ড. মুমতাজ দারুণ কাজ করেছেন এবং অস্ত্রোপচারটা ভালোই হয়েছে, কিন্তু এখন আমাকে কৃত্রিমভাবে কোমায় রাখা উচিত, কারণ এখন জ্ঞান থাকলে মস্তিষ্কে চাপ পড়বে।’
যখন আমি জীবন ও মৃত্যুর মাঝে দুলছিলাম, তালেবান আমাকে গুলি করার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছে; কিন্তু সেটা যে আমার শিক্ষার পক্ষে আন্দোলনের জন্য, তা অস্বীকার করেছে। আমরা হামলাটা পরিচালনা করেছি এবং আমাদের বিপক্ষে যে কথা বলে তাকেও একই পরিণতির শিকার হতে হবে। টিটিপির এক মুখপাত্র এহসানউল্লাহ এহসান বলেছিলেন, ভ্রমনিরপেক্ষতার প্রচারে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করায় মালালাকে গুলি করা হয়েছে, সে ছিল কম বয়সী, কিন্তু সে পশতুন এলাকায় পশ্চিমা সংস্কৃতি চালু করছিল। সে পশ্চিমাদের সমর্থক, সে তালেবানের বিরুদ্ধে কথা বলছিল, সে প্রেসিডেন্ট ওবামাকে নিজের আদর্শ বলে প্রচার করছিল।
বাবা জানতেন, তালেবান কিসের ইঙ্গিত করছে। এর আগের বছর জাতীয় শান্তি পুরস্কার লাভের পর আমি অনেক টিভি সাক্ষাৎকার দিয়েছি এবং একটাতে আমাকে আমার প্রিয় রাজনীতিবিদদের নাম বলতে বলা হয়েছিল, আমি খান আবদুল গাফফার খান, বেনজির ভুট্টো এবং প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে বেছে নিয়েছিলাম। আমি ওবামাকে নিয়ে পড়ালেখা করেছিলাম এবং তাঁকে শ্রদ্ধা করি, কারণ একটি সংগ্রামী পরিবারের কৃষ্ণাঙ্গ সদস্য হয়েও তিনি তাঁর লক্ষ্য এবং স্বপ্ন পূরণ করেছেন। কিন্তু পাকিস্তানের আমেরিকার ভাবমূর্তি খারাপ ছিল ড্রোন, আমাদের ভূখণ্ডে গোপন হামলা এবং রেমন্ড ডেভিসের কারণে।
তালেবানের এক মুখপাত্র জানাল যে দুই মাস আগের এক সভায় ফজলুল্লাহ এই আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিল। ‘যেই আমাদের বিরুদ্ধে সরকারের সঙ্গে হাত মেলাবে, সেই আমাদের হাতে মারা যাবে,’ সে বলল, ‘আপনারা দেখবেন, গুরুত্বপূর্ণ লোকও দ্রুতই আমাদের শিকারে পরিণত হবে।’ সে আরো যোগ করল যে তারা দুজন লোককে দিয়ে আমার এবং আমার স্কুলে যাওয়ার পথ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছে এবং তারা যে সবখানেই আক্রমণ করতে পারে, সেটা দেখানোর জন্যই সেনাবাহিনীর চেকপয়েন্টের কাছে হামলাটা চালিয়েছে।
সেই সকালে, আমার অস্ত্রোপচারের মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই হঠাৎ কাজকর্মের হিড়িক পড়ে গেল, লোকজন ইউনিফর্ম ঠিকঠাক করে চারপাশ পরিষ্কার করতে লাগল। সেনাপ্রধান জেনারেল কায়ানি ভেতরে এলেন। ‘জাতির প্রার্থনা তোমার এবং তোমার মেয়ের সঙ্গে আছে,’ তিনি আমার বাবাকে বললেন। তালেবানের বিরুদ্ধে অভিযানটার পরে ২০০৯ সালের শেষে জেনারেল কায়ানি একটি বড় সভায় সোয়াতে এসেছিলেন এবং তখনই তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল।
‘আপনি একটি দারুণ কাজ করেছেন এবং এতে আমি খুশি,’ সেই সভায় আমি বলেছিলাম, ‘এখন আপনাদের শুধু ফজলুল্লাহকেই ধরা দরকার।’ এ কথায় হলঘর আনন্দধ্বনিতে ভরপুর হয়ে উঠেছিল এবং জেনারেল কায়ানি উঠে এসে পিতৃস্নেহে, আমার মাথায় হাত রেখেছিলাম।
কর্নেল জুনাইদ অস্ত্রোপচারের পরের অবস্থা সংক্ষেপে বুঝিয়ে বললেন, প্রস্তাবিত চিকিৎসা পরিকল্পনার কথাও বললেন জেনারেলকে। জেনারেল কায়ানি তাঁকে বললেন যে সিটি স্ক্যানের রিপোর্টগুলো বিদেশে শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠিয়ে পরামর্শ নেওয়া উচিত। তার পরে সংক্রমণের ঝুঁকির কারণে আমার শয্যার পাশে আর কাউকেই আসার অনুমতি দেওয়া হলো না। কিন্তু অনেকেই আসতে থাকলেন। ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদে রূপান্তরিত ইমরান খান, প্রাদেশিক তথ্যমন্ত্রী এবং তালেবানের কঠোর সমালোচক মিয়া ইফতেখার হুসেইন। যাঁর একমাত্র ছেলে তালেবানের গুলিতে নিহত হয়েছিল এবং আমাদের প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হায়দার হোতি, যাঁর সঙ্গে আমি টকশো আলোচনায় অংশ নিতাম, কাউকেই ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হলো না।
‘আশ্বস্ত থাকুন মালালা মারা যাবে না,’ হোতি মানুষকে বলল, ‘ওর এখনো অনেক কিছু করার বাকি আছে।’
এরপর বিকেল ৩টার দিকে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে রাওয়ালপিন্ডি থেকে দুজন ব্রিটিশ ডাক্তার এসে পৌঁছলেন। ড. জাভিদ কায়ানি ও ড. ফিওনা রেনোল্ডস বার্মিংহামের হাসপাতালের ডাক্তার ছিলেন এবং সে সময় এ দেশের প্রথম যকৃৎ প্রতিস্থাপন কর্মসূচি কীভাবে পরিচালনা করা যায়, সে ব্যাপারে সেনাবাহিনীকে পরামর্শ দিতেই পাকিস্তানে এসেছিলেন। আমাদের দেশ হতবুদ্ধিকর পরিসংখ্যানে ভর্তি, কেবল শিক্ষায়ই নয় এবং এর মধ্যে একটা হলো যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নোংরা সুই ব্যবহারেই ফলেই প্রতি সাতজনে একজন পাকিস্তানি শিশু হেপাটাইটিসে মারা যায়। এবং অনেকেই যকৃতের রোগে মারা যায়। জেনারেল কায়ানি এটার পরিবর্তন ঘটাতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। সিভিলিয়ানরা যেখানে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে আরো একবার সেনাবাহিনী দায়িত্ব নিল।
বিদেশি ডাক্তাররা ফিরে যাওয়ার আগে তাঁদের ডাক্তারদের উন্নতির ব্যাপারে তাঁকে ব্রিফিং দেওয়ার জন্য তাঁদের তিনি ডেকেছিলেন, যেটা আমি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরদিন সকালেই ঘটেছিল। বিদেশি ডাক্তাররা তাঁর সঙ্গে যখন দেখা করতে যান, তখন তাঁর ঘরে দুটো টিভি চালু ছিল—একটা স্থানীয় উর্দু চ্যানেল আর অন্যটায় ইংরেজি স্কাই নিউজ, যেটায় আমার গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবরটা দেখাচ্ছিল।
পদবি এক হওয়া সত্ত্বে ও সেনাপ্রধান এবং ডাক্তারের মাঝে কোনো ধরনের আত্মীয়তা ছিল না; কিন্তু একে-অপরকে ভালোভাবেই চিনতেন, তাই সেনাপ্রধান ড. জাভিদকে বললেন যে, ‘আমার ব্যাপারে পরস্পরবিরোধী রিপোর্টগুলো দেখে তিনি চিন্তিত।’ যুক্তরাজ্যে ফিরে এলিজাবেথ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কনসালট্যান্ট ড. জাভেদ বার্মিংহাম শিশু হাসপাতালের শিশু নিবিড় পরিচর্যার বিশেষজ্ঞ ড. ফিওনাকে সঙ্গে আনতে চাইলেন। বিদেশিদের জন্য প্রায় নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া পেশাওয়ারে যাওয়ার ব্যাপারে ড. ফিওনা কিছুটা ভীত থাকলেও আমি নারীশিক্ষার আন্দোলনকর্মী শুনে তিনি খুশি হলেন, কারণ তিনি নিজে ভালো একটি স্কুলে পড়া এবং ডাক্তার হওয়ার মতো প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ লাভ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন।
কর্নেল জুনাইদ এবং হাসপাতালের পরিচালক তাঁদের দেখে সন্তুষ্ট হলেন। না, ড. জাভিদ বুঝিয়ে দিলেন যে তিনি তাঁদেরকে পাঠিয়েছেন, তার আগ পর্যন্ত তর্ক-বিবাদ চলল। যা ঘটল তা নিয়ে ব্রিটিশ ডাক্তাররাও খুশি হলেন না। প্রথমে তাঁরা হাত ধোয়ার জন্য পানির কল খুলে দেখেন, তাতে পানি নেই। এরপর ড. ফিওনা যন্ত্রপাতি এবং লেভেলগুলো পরীক্ষা করে গজগজ করে ড. জাভিদকে কিছু একটা বললেন। তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন যে শেষ কখন আমার রক্তচাপ মাপা হয়েছিল। উত্তর এলো, দুই ঘণ্টা আগে। তিনি বললেন যে এটা সব সময়ই মেপে রাখতে হবে এবং ধমনি রেখা কেন নেই, সে ব্যাপারে একজন সেবিকাকে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি আরো অভিযোগ করলেন যে আমার অক্সিজেনের মাত্রা অতিরিক্ত কম।
ড. জাভিদকে বলা ড. ফিওনার কথাগুলো শোনেননি বলে বাবা খুশিই হয়েছিলেন। ড. ফিওনা বলেছিলেন যে আমি উদ্ধারযোগ্য সঠিক সময়ে আমার সঠিক অস্ত্রোপচারই হয়েছে; কিন্তু পরবর্তী সময়ের যত্নের মানের কারণে আমার সেরে ওঠার সম্ভাবনা কমে আসছে। নিউরোসার্জারির পরে শ্বাস-প্রশ্বাস লক্ষ রাখা জরুরি এবং কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রা স্বাভাবিক রাখা দরকার। টিউব এবং মেশিন দিয়ে তাই করা হচ্ছিল, ড. জাভিদ বলেছিলেন, এটা একটা উড়ন্ত উড়োজাহাজের মতো—কেবল সঠিক যন্ত্রপাতি দিয়েই এটা পরিচালনা করা যায় এবং সেগুলো হাসপাতালে থাকা সত্ত্বেও সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছিল না। তাঁরা হেলিকপ্টারে করে চলে গেলেন, কারণ আঁধার নেমে আসার পরে পেশাওয়ারে থাকা খুবই বিপজ্জনক।
ভেতরে আসার অনুমতি না পাওয়া অতিথিদের মধ্যে একজন ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রেহমান মালিক। তিনি আমার জন্য একটি পাসপোর্ট এনেছিলেন। বাবা তাঁকে ধন্যবাদ দিলেন, কিন্তু বেশ বিষণ্ণ ছিলেন। সেই রাতে তিনি সেনা হোস্টেলে ফিরে পকেট থেকে পাসপোর্টটা বের করে মায়ের হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটা মালালার, কিন্তু এটা কি বিদেশ যাওয়ার জন্য নাকি ওপারে যাওয়ার জন্য, তা জানি না।’ তাঁরা দুজনই কাঁদলেন। হাসপাতালের এসব পরিকল্পনার মাঝে তাঁরা জানতেও পারেননি যে আমার ঘটনাটা সারা পৃথিবীর মানুষ জেনে গেছে এবং বিদেশে চিকিৎসা করানোর জন্য আমাকে ডাকা হচ্ছে।
আমার অবস্থার অবনতি হচ্ছিল এবং বাবা খুব কমই ফোন ধরতে লাগলেন। যে কটা ধরতেন, তার একটি হলো আরফা করিম নামে এক পাঞ্জাবি কম্পিউটার প্রতিভাবানের মা-বাবার, যার সঙ্গে আমি ফোরামে কথা বলেছি। মেয়েটি তার প্রোপ্রামিং দক্ষতার কারণে নয় বছর বয়সেই মাইক্রোসফট স্বীকৃত সর্বকনিষ্ঠ পেশাদার হয়ে গিয়েছিল এবং সিলিকন ভ্যালিতে বিল গেটসের সঙ্গেও দেখা করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনভাবে হার্ট অ্যাটাক এবং পরবর্তীকালে মৃগীরোগের আক্রমণে সে ওই জানুয়ারিতে মৃত্যুবরণ করেছিল। তার বয়স ছিল মাত্র ১৬, আমার চেয়ে কেবল এক বছরের বড়। তার বাবা ফোন করলেই আমার বাবা কেঁদে কেঁদে বলতেন, ‘নিজের মেয়েকে হাড়া কীভাবে বেঁচে থাকতে হয় আমাকে শেখাও।’
(চলবে)