আমি মালালা বলছি
অজানার পথে যাত্রা
মঙ্গলবারে দুপুরের খাবারের সময় আমি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলাম। বৃহস্পতিবার সকালের মধ্যে আমার মৃত্যু সম্বন্ধে বাবা এত নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে ফয়েজ মোহাম্মদ মামাকে বলেছিলেন, গ্রামের মানুষের উচিত আমার শেষ কৃত্যের জন্য প্রস্তুত হওয়া, আমাকে কৃত্রিমভাবে কোমায় রাখা হয়েছে। আমার মৌলিক সংকেতগুলোর অবনতি ঘটছে, আমার দেহ ও চেহারা ফুলে গেছে, আমার কিডনি এবং যকৃতের কর্মক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। বাবা পরে বলেছিলেন সেই ছোট কাচের কক্ষে এত টিউবের সঙ্গে আমার সংযুক্ত দেহ দেখতে খুবই ভয়াবহ ছিল। যতদূর তিনি দেখছিলেন আমি ছিলাম মেডিকেল ডেড। তিনি বিধ্বস্তপ্রায়। এটা খুবই আগে আগে হয়ে যাচ্ছে। তার বয়স মাত্র ১৫ বছর। তিনি ভাবতে থাকলেন, তার জীবন কি এতই সংক্ষিপ্ত?
মা খুব কমই ঘুমাতেন তখনো প্রার্থনা করছিলেন ফয়েজ মোহাম্মদ তাঁকে কোরআন শরিফের সুরা হজ পড়তে বলেছিলেন এবং তিনি আল্লাহর গুণ নিয়ে লিখিত বারোটি আয়াতই (৫৮-৭০) বারবার পড়ছিলেন। কর্নেল জুনাইদ আমাকে দেখতে এলে বাবা তাঁক আবারও জিজ্ঞেস করলেন, ও কি বেঁচে যাবে?
ডাক্তার তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আল্লাহকে বিশ্বাস করেন? ‘হ্যাঁ’ বাবা জবাব দিলেন। মনে হলো যে কর্নেল জুনাইদ বেশ আধ্যাত্মিক গভীরতাসম্পন্ন মানুষ। তিনি পরামর্শ দিলেন আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাতে, তাতে আল্লাহ আমাদের প্রার্থনা মঞ্জুর করতে পারেন।
বুধবার শেষরাতের দিকে নিবিড় পরিচর্যা বিশেষজ্ঞা দুজন সামরিক ডাক্তার ইসলামাবাদ থেকে সড়কপথে এলেন। ব্রিটিশ ডাক্তাররা জেনারেল কায়ানিকে জানিয়েছিলেন যে আমি পেশোয়ারে থাকলে ব্রেন ড্যামেজে আক্রান্ত হতে পারি বা যন্ত্রের মান এবং সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকির কারণে মারাও যেতে পারি, তাই জেনারেল কায়ানি তাঁদের পাঠিয়েছিলেন, তাঁরা আমাকে সরিয়ে নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু সেটুকু সময়ের মাঝে কোনো শ্রেষ্ঠ ডাক্তারকে দিয়ে পরীক্ষা করানোর প্রস্তাব করেন। কিন্তু মনে হচ্ছিল তাঁরা অনেক দেরি করে ফেলেছেন।
হাসপাতালের কর্মীরা ডা. ফিওনার প্রস্তাবিত কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি, এবং রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার অবনতি ঘটতে থাকল। সংক্রমণ শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার সকালে বিশেষজ্ঞদের একজন, ব্রিগেডিয়ার আসলাম ডা. ফিওনাকে ফোন করলেন, মালালা এখন খুবই অসুস্থ, তিনি ডা. ফিওনাকে জানালেন, আমার ডিসেমিনেটেড ইন্ট্রাভ্যাসকিউলার কোয়াগুলেশন (ডিআইসি) নামের কিছু একটা হয়েছে, যার অর্থ আমার রক্ত জমাট বাঁধতে পারছে না, রক্তচাপ অনেক কমে গেছে এবং রক্তের অম্লত্ব বেড়ে গেছে। আমি মূত্রত্যাগ করছিলাম না, তাই কিডনি ফেইলিওর হচ্ছিল এবং ল্যাক্টেটের মাত্রা বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছিল সবকিছুই বিপক্ষে চলে যাচ্ছে ডা. ফিওনা বার্মিংহাম ফেরার প্লেন ধরতে বিমানবন্দরে যাওয়ার জন্য রওনা দিচ্ছিলেন এবং তাঁর ব্যাগ এরই মধ্যে বিমানবন্দরে ছিল, কিন্তু এই খবর শোনার পর তিনি সাহায্য করতে চাইলেন এবং বার্মিংহামে তাঁর হাসপাতালের দুজন সেবিকা তাঁকে সঙ্গ দিলেন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে তিনি পেশাওয়ারে ফিরলেন। তিনি বাবাকে বললেন যে আমাকে আকাশপথে রাওয়ালপিন্ডির একটি হাসপাতালে নিতে হবে, যেখানকার নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রটা সবচেয়ে ভালো। বাবা বুঝতেই পারছিলেন না। এত অসুস্থ বাচ্চা কীভাবে আকাশপথে যাত্রা করবে। কিন্তু ডা. ফিওনা বললেন যে তিনি এটা সব সময়েই করেন তাই দুশ্চিন্তার কিছুই নেই। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, আমার বাঁচার কোনো আশা আছে কি না। ডা. ফিওনা উত্তর দিলেন কোনো আশা না থাকলে আমিও এই মুহূর্তে এখানে থাকতাম না। বাবা বলেন, সেই মুহূর্তে তিনি অশ্রু ধরে রাখতে পারেননি।
পরে সেদিনই এক সেবিকা এসে আমার চোখে ড্রপ দিয়ে গেলেন। দেখো, খাইস্তা, মা বললেন ডা. ফিওনা ঠিকই বলেছেন, কারণ সেবিকারা মালালার চোখে ড্রপ দিয়েছে। কোনো আশা না থাকলে তাঁরা ড্রপ দিতেন না। গুলিবিদ্ধ অন্য দুটো মেয়ের একজন, শাজিয়াকেও একই হাসপাতালে আনা এবং ডা. ফিওনা তাকেও দেখতে গেলেন। তিনি বাবাকে বললেন যে শাজিয়া ভালো আছে এবং তাঁকে অনুরোধ করেছেন মালালার যত্ন নেবেন।
মোটরসাইকেল আরোহী রক্ষাদল আর একটু পরপর জ্বলে ওঠা নীল আলোর নিরাপত্তাবলয়ের মাধ্যমে অ্যাম্বুলেন্সে করে আমাদের হেলিপ্যাডে নেওয়া হলো। হেলিকপ্টারের যাত্রাটা ছিল সোয়া এক ঘণ্টার। ডা. ফিওনা খুব কমই বসতে পারলেন, সারা দিন তিনি বিচিত্র যন্ত্রপাতি নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিলেন যে বাবার দেখে মনে হচ্ছিল তিনি ওসবের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন। বছরের পর বছর যা করেছেন ডা. ফিওনা এখানেও তাই করছিলেন। যুক্তরাজ্যে তাঁর অর্ধেক কাজ ছিল আশঙ্কাজনকভাবে অসুস্থ বাচ্চাদের ব্যবস্থা করা, এবং বাকি অর্ধেক ছিল নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে তাদের চিকিৎসা করানো। কিন্তু এটার মতো অবস্থায় তিনি আর কখনোই পড়েননি। পশ্চিমাদের জন্য পেশোয়ার যে শুধু বিপজ্জনক হবে, তাই নয়, আমাকে নিয়েও অনেক কথা হবে। আমার এটা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। ফিওনা একসময় বললেন, ‘যদি সে মারা যায় তো বলা হবে, পাকিস্তানের মাদার তেরেসাকে আমি হত্যা করেছি।’
রাওয়ালাপিন্ডিতে অবতরণ করেই আবারও সাময়িক নিরাপত্তাবলয়ে আমাদের অ্যাম্বুলেন্সে করে আর্মড ফোর্সেস ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওলজিতে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার বাবা বেশ অবাক হলেন, তারা মাথার ক্ষতের ব্যাপারে কী বুঝবে? কিন্তু ডা. ফিওনা তাঁকে আশ্বস্ত করলেন যে এই হাসপাতাল হলো স্টেট অব দ্য আর্ট যন্ত্রপাতি এবং প্রশিক্ষণ ডাক্তারসমৃদ্ধ। পাকিস্তানের সর্বশ্রেষ্ঠ নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রবিশিষ্ট হাসপাতাল। বামিংহাম থেকে আগত তাঁর নিজের নার্সরা সেখান ছিলেন এবং কার্ডিওলজির নিজের নার্সরা সেখানে ছিলেন। তাঁরা কার্ডিওলজির নার্সদের মস্তিষ্কের ক্ষতের চিকিৎসা করার বিশেষ ধাপগুলো বুঝিয়ে দিয়েছেন। পরবর্তী তিন ঘণ্টা তাঁরা আমার অ্যান্টিবায়োটিক এবং রক্ত রেখা অদলবদল করে কাটালেন, কারণ আমার দেহে রক্ত দেওয়া হলে তার প্রতিক্রিয়া খারাপ হচ্ছিল। অবশেষে তাঁরা জানালেন যে আমার অবস্থা স্থিতিশীল।
পুরো হাসপাতালটায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছিল। সৈনরা পুরো একটি ব্যাটালিয়ন সেটার পাহারায় নিয়োজিত ছিল এবং ছাদে স্নাইপারও ছিল। কারোই ভেতরে ঢোকার অনুমতি ছিল না। ডাক্তারদের ইউনিফর্ম পরতে হতো এবং রোগীদের কেবল নিকটাত্মীয়রা দেখতে আসতে পারতেন, তাঁদের কঠোর তল্লাশির মধ্য দিয়ে আসতে হতে। একজন আর্মির মেজরকে আমার বাবা-মায়ের দায়িত্ব দেওয়া হলো, তিনি সবখানেই তাঁদের সঙ্গে ছিলেন।
আমার বাবা ভীত ছিলেন এবং আমার মামা বলতে থাকলেন, খুবই সাবধানে থাকবে, এদের কেউ কেউ সিক্রেট এজেন্টও হতে পারে। আমার পরিবারকে অফিসার্স হোস্টেলে তিনটি কক্ষ দেওয়া হয়েছিল। সবার মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল, যেটা বলা হয়েছিল যে নিরাপত্তার জন্য করা হয়েছে কিন্তু বাবাকে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলা থেকে বিরত রাখার জন্যও হতে পারে।
বাবা-মা হেঁটে হোস্টেল থেকে হাসপাতালে চাইলে ওয়াকিটকির মাধ্যমে অনুমতি নিতে হতো, যাতে অন্তত আধঘণ্টা লাগত। হোস্টেলের উঠান থেকে ডাইনিং হল পর্যন্ত যেতে ও তাঁদের পাহারায় রাখা হয়েছিল। কোনো দর্শনার্থীই ঢুকতে পারেননি এমনকি প্রধানমন্ত্রী আমাকে দেখতে এলে তখন তাঁকেও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। নিরাপত্তাব্যবস্থাটা আর্শ্চযজনক মনে হতে পারে, কিন্তু গত তিন বছর ধরে তালেবানরা সর্বোচ্চ নিরাপত্তাবিশিষ্ট সামরিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তাব্যবস্থার ফাঁক গলিয়েও আক্রমণ করতে পেরেছে মেহরানের নেভাল বেস, কামরা-তে এয়ারফোর্স বেস এবং রাস্তার ওদিকেই সেনাবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে।
আমরা সবাই তালেবান হামলার ঝুঁকিতে ছিলাম। বাবাকে বলা হয়েছিল, আমার ভাইদেরও ছাড় দেওয়া হবে না। ওই সময় খুশাল মিঙ্গেরায় থেকে যাওয়ার তিনি যথেষ্ট উদ্ধিগ্ন হলেন, যদিও পরবর্তীতে তাকে রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে আসা হয়, সেই হোস্টেল কোনো কম্পিউটার বা ইন্টারনেট না থাকলে বন্ধু পরায়ন বাবুর্চি ইয়াসিম মামা আমার বাবা-মাকে খবরের কাগজসহ প্রয়োজনীয়সহ সমস্ত কিছু এনে দিতেন। ইয়াসিম তাঁদের বলতেন যে তাঁদের রান্না করে খাওয়াতে পেরে তিনি গর্বিত। তাঁরা তার দয়ায় অভিভূত হয়ে আমাদের কাহিনীটা তাঁকে জানান। তিনি খাবার দিয়ে তাঁদের আরো মজাদার খাবার, কাস্টার্ড এবং মিষ্টি দিয়ে তাঁদের প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করতেন। একদিন খাবার সময় খুশাল বলেছিল, মাত্র চারজন থাকায় ডাইনিং টেবিলটা খালি খালি লাগে। আমার শূন্যতাটা তারা অনুভব করত।
ইয়াসিমের আনা একটি খবরের কাগজেই বাবা আমাকে গুলি কবার ঘটনায় বিশ্বব্যাপী অবিশ্বাস্য প্রতিক্রিয়ার চিত্রটা প্রথমবারের মতো দেখতে পান। পুরো পৃথিবীই যেন ক্রোধানলে পুড়ছে। জাতিসংঘা মহাসচিব বান কি মুন একে ঘৃনা এবং কাপুরুষোচিত কাজ কলে আখ্যা দিলেন। প্রেসিডেন্ট ওবামা একে তিরস্কারযোগ্য ও বিরক্তির এবং ট্রাজিক বলে মন্তব্য করলেন। কিন্তু পাকিস্তানের কারো কারো প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক ছিল। কোনো কোনো খবরের কাগজে আমাকে শান্তির প্রতীক বলে উল্লেখ করা হলো, অন্যরা গতানুগতিক ষড়যন্ত্র তত্ত্বই তুলে ধরল, এমনকি কোনো কোনো ব্লগার প্রশ্নও তুলল যে আমি আসলেই গুলিবিদ্ধ হয়েছি কি না। সমস্ত কাহিনীই বানানো ছিল, বিশেষ করে উদু প্রেস, যেমন এক পত্রিকায় লিখল, আমি নাকি দাড়ি রাখার নিন্দা করেছি। আমার বিরুদ্ধে সবচেয়ে সক্রিয় একজন ছিলেন ধর্মীয় জামাআন-এ ইসলামী দলের মহিলা এমপি ডা. রাহিলা কাজী। তিনি আমাকে মার্কিন সাগরেদ আখ্যা দিয়ে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত রিচার্ড হলব্রুকের পাশে আমার বসে থাকার একটা ছবি। মার্কিন সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমার মাখামাখির প্রমাণ হিসেবে প্রকাশ করলেন।
ডা. ফিওনা আমাদের অনেক স্বস্তি দিয়েছিলেন। আমার মা কেবল পশতুই বোঝেন। তাই ডা. ফিওনার বলা কোনো কথাই বুঝতে পারেননি, কিন্তু ডা. ফিওনা আমার ঘর থেকে বেরিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুলির ইশারা দিয়ে বলতেন, ভালো। শুধু ডাক্তারই না, তিনি আমার বাবা-মায়ের কাছে বার্তাবাহকরূপেও আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি ধৈর্য ধরে আমার বিষয়ে মাকে বুঝিয়ে দিতেন। আমার বাবা অবাক এবং খুশি দুটিই হয়েছিলেন আমাদের দেশে একজন নিরক্ষর মহিলাকে খুব কম ডাক্তারই রোগীর অবস্থা বোঝায়। তাঁরা শুনলেন যে বিভিন্ন দেশ থেকে আমার চিকিৎসা করানোর প্রস্তাব আসছে, আমেরিকার জন হপকিন্স নামের এক প্রথম সারির হাসপাতাল বিনামূল্যে আমার চিকিৎসা করানোর প্রস্তাব দিয়েছে। একক মার্কিনিও আমার চিকিৎসার প্রস্তাব দিচ্ছে, যেমন অনেকবার পাকিস্তানে সফরে আসা ধনী সিনেটর জন কেরি এবং আরিজোনার শপিংমলে নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্যদের সঙ্গে দেখা করার সময় মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়া কংগ্রেসওম্যান গ্যাব্রিয়েল গিফোডর্স। জার্মানি, সিঙ্গাপুর, আরব আমিরাত এবং ব্রিটেন থেকে ও প্রস্তাব এসেছিল।
আমার কী ব্যবস্থা হবে সে ব্যাপারে আমার মা-বাবার সঙ্গে কেউ পরামর্শ করল না, সব সিদ্ধান্তই সেনাবাহিনী গ্রহণ করল। জেনারেল কায়ানি ডা. জাভেদকে জিজ্ঞেস করলেন আমাকে বিদেশে পাঠানো প্রয়োজন কি না। এই ব্যাপারে সেনাপ্রধান একটি আশ্চর্যজনক পরিমাণ সময় ব্যয় করছিলেন। ডা. জাভিদ বলেন, তাঁরা আমার ব্যাপারে ছয় ঘণ্টা আলোচনা করেছেন। হয়তো আমি মারা গেলে কী কী রাজনৈতিক সমস্যা দেখা দেবে তা তিনি অন্য কোনো রাজনীতিবিদের চেয়ে ভালো বুঝতেন। তালেবাদনদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তিনি রাজনৈতিক ঐক্য আশা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা বলেন, তিনি খুব দয়াশীল একজন ব্যক্তি। তাঁর বাবা ছিলেন একজন সাধারণ সৈনিক এবং অল্প বয়সেই মারা যান। এবং আট বছর বয়সের কায়ানিকে জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসেবে পুরো পরিবারের হাল ধরতে হয়। সেনাপ্রধান হওয়ার পর জেনারেল কায়ানি অফিসারদের আগে সাধারণ সৈনিকদের বাসস্থান, খাবারের রেশন এবং শিক্ষার উন্নয়ন ঘটান।
ডা. ফিওনা বলেছিলেন যে আমার বাকপ্রতিবন্ধিতা দেখা দিতে পারে এবং ডান হাত ও ডান পা দুর্বল হয়ে যেতে পারে, তাই আমার ব্যাপক পুনর্বাসন সুবিধা প্রয়োজন। যার ব্যবস্থা পাকিস্তানে নেই। আপনারা যদি সর্বোচ্চ সুফলটা পেতে চান, তাহলে তাকে বিদেশে পাঠান, তিনি পরামর্শ দিলেন।
রেমন্ড ডেভিসের ঘটনা, বিন লাদেনের ব্যাপারে গোপন হামলা এবং মার্কিন হেলিকপ্টারের আক্রমণের সীমান্ত খুঁটিতে কজন পাকিস্তানি সৈনিক নিহত হওয়ার জের ধরে দুই দেশের চলমান খারাপ সম্পর্কের কারণে আমার চিকিৎসায় মার্কিনিদের জড়াতে না দেওয়ার ব্যাপারে জেনারেল কায়ানি অনড় ছিলেন। ডা. জাভিদ লন্ডনের গ্রেট অরমন্ড স্ট্রিট এবং এডিনবরা ও গ্লাসগোতে বিশেষজ্ঞ হাসপাতালের নাম প্রস্তাব করলেন। জেনারেল কায়ানি জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নিজের হাসপাতালের কেন নয়?
ডা. জাভিদ জানতেন এই প্রশ্নটা আসবে। ইরাক ও আফগানিস্তানে আহত ব্রিটিশ সৈন্যদের চিকিৎসার ব্যাপারে বার্মিংহামের কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালের সুনাম আছে। শহরের কেন্দ্রের বাইরে এর অবস্থান। হাসপাতালের প্রধান পরিচালক বোলজারকে তিনি ফোন করলেন, তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা কেউই কল্পনা করতে পারিনি ওকে এই হাসপাতালে আনতে কতটা সমস্যা হবে।’ আমার মত অপ্রাপ্তবয়স্ক কাউকে কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে স্থানান্তর করা কোনো সহজ কাজ ছিল না। এবং বোলজার নিজেকে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তানের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় জড়ানো অবস্থায় খুঁজে পেলেন। এদিকে সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। আমার অবস্থা স্থিতিশীল হলেও তাঁরা বুঝতে পারছিলেন আমাকে আটচল্লিশ ঘণ্টা এবং সর্বোচ্চ বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যেই স্থানান্তর করতে হবে।
অবশেষে সব ব্যবস্থা হল এবং আমাকে কে নিয়ে যাবে এবং খরচ কে জোগাবে সেই প্রশ্ন নিয়ে ডাক্তাররা মাথা ঘামানো শুরু করলেন। ডা. জাভিদ রয়েল এয়ারফোর্সের প্রস্তাব গ্রহণ করতে চাইলেন। কারণ তারা আফগানিস্তান থেকে সৈন্য স্থানান্তর করে থাকে, কিন্তু জেনারেল কায়ানি রাজি হলেন না। জেনারেল অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করেন। তিনি ডা. জাভিদকে একটি মাঝরাতের মিটিং-এ ডেকে তাঁর অভ্যাসজনিত কারণে চেইন-স্মোকিং করতে করতে জানালায় যে তিনি এখানে কোনো বিদেশি সাময়িক বাহিনীকে জড়িত দেখতে চান না, আমার গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় এরই মধ্যে অনেক ষড়যন্ত্র তত্ত্বের জন্ম হয়েছে। মানুষ আমাকে সিআইএ প্রতিনিধি ভাবছে এবং সেনাপ্রধান তাদের আর কথা বলার সুযোগ দিতে চান না। এটা ডা. জাভিদকে একটা জটিল পরিস্থিতিতে ফেলে দিলেন। ব্রিটিশ সরকার সহায়তার প্রস্তাব দিলেও পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক আবেদনের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু মানসম্মান হারানোর ভয়ে আমাদের সরকার আবেদন করতে অপরাগ। সৌভাগ্যবশত এই পর্যায়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শাসক পরিবার শাসনকর্তারূপে আবির্ভূত হলো। অন-বোর্ড হাসপাতাল সমৃদ্ধ তাঁদের ব্যক্তিগত জেট প্লেনটা আমাদের ব্যবহার করতে দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন তাঁরা। ১৫ অক্টোবর সোমবারের শুরুর দিকে জীবনে প্রথমবারের মতো আমার বিদেশযাত্রা হওয়ার কথা ঠিক করা হলো।
আমাকে বিদেশে নেওয়ার আলোচনা চলছে জানলেও এসব আপসের ব্যাপারে আমার মা-বাবা কিছুই জানতেন না। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা ভেবেছিলেন আমাকে যেখানেই নেওয়া হোক তাঁরা আমার সঙ্গে থাকবেন। আমার মা ও ভাইদের কোনো পাসপোর্ট বা দলিল ছিল না। রোববার বিকেলে কর্নেল বাবাকে জানালেন যে পরদিন সকালেই আমি যুক্তরাজ্যে রওনা দিচ্ছি এবং মা বা ভাই নয়। একমাত্র বাবাই আমার সঙ্গে যেতে পারবেন। তাঁকে বলা হয়েছিল যে পাসপোর্টের ব্যবস্থা করতে সমস্যা হয়েছে এবং তিনি যে যাচ্ছেন তা নিরাপত্তার স্বার্থে পরিবারের সদস্যদের বলাও যাবে না।
বাবা, মায়ের সঙ্গে সব কথা ভাগাভাগি করেন এবং এরকম একটা ব্যাপার গোপন রাখার কোনো মানে হয় না। ভারী হৃদয়ে তিনি মাকে এই কথা জানালেন। ফয়েজ মোহাম্মদ মামার সঙ্গে বসে ছিলেন, তিনি বাবার কথা শুনেই মা এবং ভাইদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত এবং রাগান্বিত হয়ে পড়লেন। সে যদি একা একা দুটা ছেলে নিয়ে মিঙ্গোরায় থাকে তাহলে তো যে কোনো কিছুই ঘটে যেতে পারে।
বাবা কর্নেলকে ফোন করলেন। আমি আমার পরিবারকে জানিয়েছি এবং তারা খুবই অখুশি। আমি তাদের রেখে যেতে পারব না। আমি গৌণ ব্যক্তি হওয়ায় আমাকে একলা পাঠানো সম্ভব না, তাই অনেকে মিলে আমার বাবাকে যাওয়ার জন্য রাজি করতে চেষ্টা করলেন, যাঁদের মধ্যে ছিলেন কর্নেল জুনাইদ ডা. জাভিদ এবং ডা. ফিওনা।
জোরাজুরি করায় বাবা ভালো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না এবং তার সিদ্ধান্ত বিপর্যয় ডেকে আনছে জেনেও তিনি অনড় থাকলেন। তিনি ডা. জাভিদকে বুঝিয়ে বললেন, আমার মেয়ে এখন নিরাপদ আছে এবং একটা নিরাপদ দেশে যাচ্ছে। এখানে আমি আমার স্ত্রী-সন্তানকে একা ফেলে যেতে পারি না। তারা ঝুঁকিতে আছে। আমার মেয়ের সঙ্গে যা হয়েছে, তা হয়েই গেছে এবং এখন আল্লাহর হাতে আমি একজন বাবা-আমার ছেলেরা ও আমার কাছে মেয়ের মতই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
ডা. জাভিদ বাবার সঙ্গে একান্তে দেখা করতে চাইলেন। আপনি কি নিশ্চিত এটাই আপনার না আসার একমাত্র কারণ? তিনি জিজ্ঞেস করলেন! তিনি নিশ্চিত হতে চাইছিলেন যে কেউ তাঁর ওপর চাপ প্রয়োগ করছে না।
বাবা বললেন, ‘আমার স্ত্রী আমাকে বলেছে, তুমি আমাদের ফেলে যেতে পারো না। ডাক্তার বাবার কাঁধে হাত রেখে তাঁকে আশ্বস্ত করলেন যে আমার যথাযথ যত্ন নেওয়া হবে এবং তার ওপর বাবা বিশ্বাস রাখতে পারেন। এটা কি অলৌকিক নয় যে মালালা গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময়ই আপনারা সবাই এখানে ছিলেন? বাবা বললেন।
ডা. জাভিদ উত্তর দিলেন, আমার বিশ্বাস, আল্লাহ আগে সমাধান পাঠিয়ে পরে সমস্যা দেন।
এরপর আমার যুক্তরাজ্য সফরে ডা. ফিওনাকে অভিভাবক বানান আমার বাবা। একটি ইন লোকে প্যারেন্টিস দলিলে সবই করলেন। চোখে পানি নিয়ে তিনি ডা. ফিওনাকে আমার পাসপোর্টটা দিয়ে তাঁর হাত ধরলেন।
ডা. ফিওনা আমি আপনাকে বিশ্বাস করি। দয়া করে আমার মেয়ের যত্ন নেবেন।
এরপর বিদায় দিতে আমার মা-বাবা আমার বিছানার পাশে এলেন। রাত-১১টার দিকে পাকিস্তানে তাঁরা শেষবারের মতো আমার সঙ্গে দেখা করলেন। আমি কথা বলতে পারছিলাম না। আমার চোখ বন্ধ ছিল এবং আমার নিশ্বাসই তাঁদের জানান দিচ্ছিল যে আমি বেঁচে আছি। মা কাঁদছিলেন, কিন্তু বাবা অনুভব করছিলেন আমি বিপদসীমার বাইরে তাই তিনি মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। শুরুতে তাঁরা অনেক ডেডলাইন দিয়েছিলেন-পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টা বিপজ্জনক, আটচল্লিশ ঘন্টা সংকটপূর্ণ এবং পরবর্তী বাহাত্তর ঘণ্টা আরো সংকটপূর্ণ সব ডেডলাইনই নিরাপদ পেরিয়ে গেছে। স্ফীতিটা চলে গেছে, রক্তের পদার্থের মাত্রার উন্নতি ঘটেছে। আমার পরিবারের বিশ্বাস ছিল ডা. ফিওনা এবং ডা. জাভিদ সম্ভাব্য সর্বোচ্চ যত্নই নেবেন।
আমার পরিবার তাদের কক্ষে ফিরে গেলেও ঘুম আসতে দেরি হচ্ছিল। ঠিক মাঝরাতের পরপর কেউ একজন দরজায় ঠকঠক করল। মাকে রেখে যুক্তরাজ্যে ভ্রমণ করতে বাবাকে রাজি করানোর চেষ্টা করা এক কর্নেল আবার এসেছেন। তিনি বাবাকে বললেন, তিনি আমার সঙ্গে না গেলে আমাকে একেবারেই নেওয়া হবে না।
‘গত রাতেই আমি আপনাকে জানিয়েছি ব্যাপারটি সমাধান হয়ে গেছে, বাবা উত্তর দিলেন। কেন আপনি আমাকে জাগালেন? আমি আমার পরিবার ফেলে কোথাও যাচ্ছি না।
আবারও আরেক কর্মকর্তা তাঁর সঙ্গে কথা বলতে এলেন। আপনাকে যেতেই হবে। আপনি তার বাবা, আপনাকে ছাড়া যুক্তরাজ্যের হাসপাতাল তাকে গ্রহণ নাও করতে পারে। তিনি বললেন।
‘যা হয়ে গেছে তা হয়ে গেছে, বাবা জেদ ধরে রেখে বললেন। আমি আমার মতামত পাল্টাচ্ছি না। দলিলগুলো তৈরি হলেই কয়েক দিনের মধ্যে আমরা সবাই যাব।
কর্নেল তখন বললেন, আরো দলিলে আপনার সই করা লাগবে, হাসপাতালে চলুন।
বাবার সন্দেহ হলো। তখন মাঝরাত পার হয়ে গেছে এবং তিনি ভয় পাচ্ছিলেন। তিন কর্মকর্তার সঙ্গে একা বাবা। এত চিন্তিত ছিলেন যে সারাক্ষণ কোরআনের একটি আয়াত জপ করছিলেন। এটা হলো তিমির পেটে যাওয়া ইউনুসের কাহিনী যেটা বাইবেলে জোনাহ-এর কাহিনীর মতোই। তিমির পেটে থাকা অবস্থায় ইউনুস এই আয়াত পড়েছিলেন। এর মাধ্যমে এটাই বোঝা যায় যে বিশ্বাস বা ইমান রাখলে সবচেয়ে জঘণ্য বিপদ থেকেও রক্ষা পাওয়া যায়।
হাসপাতালে যাওয়ার পর কর্নেল বাবাকে বললেন যে আরো কিছু দলিল সবই করার পর আমাকে যুক্তরাজ্য যেতে দেওয়া হবে। বাবা এত অস্বস্তি এবং ভীতি বোধ করছিলেন কারণ সব ব্যবস্থায় এত গোপনীয়তা ছিল, সবখানে ইউনিফর্ম পরা লোক এবং আমাদের পরিবারের অবস্থা এত ঝুঁকিপূর্ণ, তিনি ঘটনাটাকে সংগতির বাইরে নিয়ে গিয়েছিলেন। পুরো ঘটনাটা ছিল খারাপ আমলাতন্ত্রের ব্যাপার।
শেষ পর্যন্ত একটা ভারী বুক নিয়ে আমার পরিবার হোস্টেলে ফিরল। বাবা চাননি যে পরিবারবিহীন অবস্থায় অমন অদ্ভুত দেশে আমার সংজ্ঞা ফিরুক। তিনি ভাবছিলেন আমি কী পরিমাণ বিভ্রান্ত হব। আমার সর্বশেষ স্মৃতি হবে স্কুলবাসটা নিয়ে, এবং তাঁদের দ্বারা আমি নিজেকে ... ক্ষেত মনে করব এটা বুঝতে পেরেই তিনি বিহবল হয়ে গেলেন।
সশস্ত্র নিরাপত্তার মাধ্যমে ১৫ অক্টোবর সোমবার ভোর ৫টায় আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। বিমানবন্দরের রাস্তা করে দেওয়া হয়েছিল এবং সেই পথের সব দালানের ছাদে স্নাইপার ছিল। সংযুক্ত আরব আমিরাতের জেটপ্লেন অপেক্ষা ছিল। আমাকে বলা হয়েছে এতে মখমলের বিলাস বহুল বিছানা, ষোলটি প্রথম শ্রেণির আসন এবং জার্মান ডাক্তারের নেতৃত্বে ইউরোপীয় নার্সবিশিষ্ট মিনি হাসপাতাল এর পেছনে স্থাপন করা হয়েছে, আমার কেবল খারাপ লাগছে, সেটা উপভোগ করার মতো সংজ্ঞা আমার ছিল না।
জ্বালানি ভরতে সেটা আবুধাবিতে গেল এবং সেখান থেকে শেষ বিকেলে বার্মিংহামে অবতরণ করল।
হোস্টেলে আমার বাবা-মা অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁরা অনুমান করছিলেন তাঁদের পাসপোর্ট এবং ভিসা ব্যবস্থা করা হচ্ছে, কদিনের মাঝেই তাঁরা আমার কাছে যেতে পারবেন।
কিন্তু তাঁরা কিছুই শুনলেন না। আমার অবস্থা জানার জন্য তাঁদের কাছে কোনো ফোন বা কম্পিউটার ছিল না। এ যেন অনন্তকালের অপেক্ষা।
(চলবে)