ও বন্ধু আমার
‘বন্ধু’ শব্দটি শুনলে মনের ভেতর কেমন যেন অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করে। শব্দটির উচ্চারণের সময়কাল কয়েক সেকেন্ডের হলেও এর ব্যাপ্তি রয়েছে সমগ্র জীবনব্যাপী। এই ব্যাপ্তিকাল মূলত জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। এই সময়ের ভেতর মানুষকে নানা রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। জন্মের পর থেকে পরিবারের কাছে বেড়ে ওঠা এক রকম অভিজ্ঞতা। আবার পরিবারের গণ্ডি পেরিয়ে বাইরের সম্পূর্ণ অচেনা অজানা জগতে পা রাখা অন্যরকম অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতাগুলো একেকটি প্রক্রিয়া। প্রতিটি মানুষকে এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। প্রথম প্রক্রিয়ায় পরিবার সঙ্গে থাকলেও দ্বিতীয় প্রক্রিয়ায় সেই জায়গায় ভাগ বসায় বন্ধুরা।
বন্ধুত্বের শুরুটা হয় সাধারণত স্কুল জীবন থেকে। তারপর কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, চাকরি সব জায়গায় কারো না কারো সঙ্গে নিজের অজান্তেই বন্ধুত্ব হয়ে যায়। সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ কখনো একা থাকতে পারে না। প্রতিদিন তাকে অন্য কারো মুখাপেক্ষী হতে হয়। কাউকে আপন করে নিতে হয়। তবে এটা ঠিক, বন্ধুত্বে কোনো স্বার্থ লুকিয়ে থাকে না। থাকে না কোনো পাওয়া না পাওয়ার জটিল হিসাব। আর সে কারণেই হয়তো পৃথিবীর অন্য সব সম্পর্কের থেকে বন্ধুত্বের সম্পর্কটি সম্পূর্ণ আলাদা।
বন্ধুত্বের কোনো বয়স হয় না। ধর্ম হয় না। বন্ধুত্ব শুধুই বন্ধুত্ব। তবে সে ক্ষেত্রে একজন বন্ধুকে অবশ্যই ন্যায়নিষ্ঠ হওয়া প্রয়োজন। কেননা একজন সৎ, নিষ্ঠাবান বন্ধুই পারে বিপদে পাশে থাকতে। সাহস জোগাতে। দুঃখ কষ্ট ভোলাতে। এটা ঠিক বন্ধু চেনা খুব কঠিন একটি কাজ। সঠিক বন্ধু নির্বাচনের জন্য সময় নেওয়া প্রয়োজন।
কখনো কখনো কোনো খারাপ বন্ধু বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আবার এটাও ঠিক, ভালো বন্ধু নির্বাচনের আগে নিজের কথাও ভাবতে হবে। ভাবতে হবে, আমি কতটা ভালো বন্ধু হতে পারব!
একজন ভালো বন্ধু হতে হলে অবশ্যই স্বার্থটাকে একপাশে রেখে দিতে হবে আজীবনের জন্য। তাকে কখনোই উসকে দেওয়া যাবে না। বন্ধুত্বে স্বার্থ বাসা বাঁধলে কিছু সময়ের জন্য উপকৃত হলেও একটা সময় নিঃসঙ্গতা আঁকড়ে ধরতে পারে অক্টোপাসের মতো। তাই বন্ধুত্বে কোনো ধরনের রিপুকে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়। কখনো কখনো বন্ধুর সঙ্গে মানসিকতার মিল নাও থাকতে পারে। সব বিষয়ে মিল থাকবে এমনটা ভাবাও বোকামি। মতের অমিল হলে সহনশীল হতে হবে। কেবলমাত্র সহনশীলতাই পারে একটি নির্ভেজাল বন্ধুত্ব গড়ে দিতে।
মাঝে মাঝে নতুন কারো সঙ্গে পরিচয় হয়। বন্ধুত্ব হয়ে যায়। নতুন বন্ধুত্ব হতেই পারে। তবে লক্ষ রাখতে হবে যেন পুরোনো বন্ধু গুরুত্বহীন না হয়ে যায়। তাকে সব সময় প্রাধান্য দিতে হবে।
একটা সময় বন্ধুত্ব হতো ছেলের সঙ্গে ছেলের এবং মেয়ের সঙ্গে মেয়ের। ছেলের সঙ্গে মেয়ের বন্ধুত্ব হতে পারে এমন ধারণাই ছিল না। এর প্রধান কারণ লিঙ্গবৈষম্য।
লিঙ্গবৈষম্যই এই তফাতটা গড়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন সময় বদলেছে। মানুষের ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। ছেলে এবং মেয়ের বন্ধুত্বকে সমাজ বেশ ভালোভাবে মেনে নিয়েছে। বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য অনেকাংশে কমেছে। এখন ছেলেমেয়ে একসঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে, ভ্রমণ করছে, মনের কথা শেয়ার করছে, বিপদে আপদে এগিয়ে আসছে।
বন্ধুত্ব নিয়ে অনেক কথাই বলা হলো। এবার বন্ধুত্বের সংজ্ঞা সম্পর্কে আলোচনা করা যাক। প্রকৃতপক্ষে বন্ধুত্বের নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা হয় না। তা ছাড়া বন্ধুত্বকে কোনো নিক্তি দিয়ে পরিমাপও করা যায় না। তবে বন্ধুত্ব সম্পর্কে মনীষীরা বিভিন্ন রকম উক্তি করেছেন। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল বন্ধুত্বকে এভাবে দেখেছেন, ‘বন্ধু হতে চাওয়া একটি ক্ষণিকের কাজ, কিন্তু এটি এমন ফল যা খুব ধীরে পাকে।’ এ ছাড়া তাঁর বন্ধুত্ব নিয়ে করা জনপ্রিয় উক্তিটি এমন, ‘বন্ধুত্ব হচ্ছে দুই দেহে বাস করা এক আত্মা।’
এদিকে জর্জ হার্ভার্ট বলেছেন, ‘একজন বন্ধু হলো সর্বোৎকৃষ্ট আয়না।’ তাঁর কথার ব্যাখ্যা করলে দাঁড়ায়, এই আয়নাতে সে প্রতিদিন নিজেকে দেখতে পাবে। বন্ধুত্বের আয়নায় বাহ্যিক অবয়বের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ অবয়বটাও দেখা যায়।
বন্ধুত্ব সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তিটি বেশ ব্যতিক্রম। তিনি বলেন, ‘বন্ধুত্ব বলিতে তিনটি পদার্থ বুঝায়। দুইজন ব্যক্তি ও একটি জগৎ। অর্থাৎ দুইজন সহযোগী হইয়া জগতের কাজ সম্পন্ন করা।”
সত্যি কথা বলতে একজন মানুষের জীবনে বন্ধু কতটা নতুন মাত্রা যোগ করে সেটা বলে বোঝানো যাবে না। বলে বোঝানোর ভাষা হয়তো কোনো অভিধানে নেই। শেষ করব। তার আগে মনে মনে গুন গুন করে গানের কয়েকটি লাইন আওড়াতে চাই, ‘তুমি আমার পাশে বন্ধু হে বসিয়া থাকো, একটু বসিয়া থাকো/আমি মেঘের দলে আছি, আমি ঘাসের দলে আছি/তুমিও থাকো বন্ধু হে, বসিয়া থাকো, একটু বসিয়া থাকো।’