অফিসে কাজের ফাঁকে ক্ষুধা মেটাতে পুষ্টিকর শুকনো খাবার
খুব সকালে নাস্তার পর দীর্ঘক্ষণ না খাওয়া অবস্থায় থাকলে দুপুরের খাবারের আগেই মস্তিষ্ক পাকস্থলি থেকে ক্ষুধার সংকেত পেতে থাকে। একই ব্যাপার মধ্যাহ্ন ভোজ আর রাতের খাবারের মাঝের সময়ের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই সময়টা যখন মানসিক বা শারীরিক পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই খাদ্য গ্রহণের তাড়না একটু বেড়ে যায়। কর্মক্ষেত্রে একটানা দীর্ঘক্ষণ কাজ করার কারণে প্রত্যেকেই হালকা ক্ষুধার পাশাপাশি কর্মস্পন্দন ফিরে পাওয়ার তাগিদ অনুভব করেন। তাই এই হালকা ভোজে এমন কিছু থাকা প্রয়োজন যা শুধু ক্ষুধাই মেটাবে না, সেই সঙ্গে নতুন উদ্যমে কাজে যোগ দেওয়ার শক্তিও যোগাবে। তাই চলুন, অফিসে কাজের ফাঁকে ক্ষুধা নিবারণের জন্য কিছু স্বাস্থ্যকর খাবারের ব্যাপারে জেনে নেওয়া যাক।
অফিসে ব্যস্ততার ফাঁকে হালকা ক্ষুধা নিবারণের জন্য ১০ স্বাস্থ্যকর খাবার
শুকনো ফল
প্রোটিন, ভিটামিন ই, রাইবোফ্ল্যাভিন, ট্রেস খনিজ ও স্বাস্থ্যকর চর্বিতে ভরপুর বাদাম সবচেয়ে জনপ্রিয় শুকনো ফলগুলোর একটি। নিয়মিত বাদাম খাওয়া ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং সারাদিন ধরে শক্তি ধরে রাখতে সাহায্য করে। এই উপযোগিতার নেপথ্যে রয়েছে ফাইবার, প্রোটিন এবং চর্বিগুলো। ক্যালরি কম হওয়ায় বেশি খাওয়াতেও স্থূলতার আশঙ্কা নেই।
সর্বাধিক প্রচলিত চীনাবাদাম অপেক্ষা কাজু, পেস্তা, আখরোট ও কাঠবাদামের গুণাগুণ আরও বেশি। এগুলোর রয়েছে এলডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানোর ক্ষমতা, যা হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। কেক, বিস্কুট, ফল বা অন্যান্য মিষ্টিজাত খাবারে স্বাদের আলাদা মাত্রা যোগ করতে ব্যবহৃত হয় বাদাম। ভারী খাবারের বিকল্প হিসেবে সুপরিচিত শুকনো ফলটি হচ্ছে খেজুর। এতে আছে কার্বোহাইড্রেট, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, আয়রন, ভিটামিন বি-৬, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ফাইবার এবং কপার। শরীরকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে সতেজ রাখতে আকারের বিবেচনায় খেজুরের কোনো জুড়ি নেই। এই ছোট্ট ফলটি মস্তিষ্কের কার্যকারিতা, হাড়ের স্বাস্থ্য এবং রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
বীজ
স্বাদের বিচারে খুব একটা এগিয়ে না থাকলেও পুষ্টিগুণের দিক থেকে এটি একটি সর্বোৎকৃষ্ট খাবার। চিয়া, শন, তিল, সূর্যমুখী ও কুমড়ার বীজ শরীর গঠনের জন্য সাধারণ খাদ্যাভ্যাসে রাখা হয়। এগুলো মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট, উদ্ভিদজাত প্রোটিন, স্বাস্থ্যকর চর্বি এবং সহজে হজমযোগ্য ফাইবার সমৃদ্ধ। এই পুষ্টিগুলো যে কোনো কাজের ক্ষেত্রে কর্মোদ্দীপনা ফিরিয়ে আনতে যথেষ্ট। অল্প পরিমাণে বেশি ক্যালরি থাকাতে স্বল্প আহারেই কয়েক ঘণ্টা ভরপেট অনুভূতি পাওয়া যায়। অন্যান্য সুস্বাদু খাবার বা সালাদের সঙ্গে মেশানো হলে আরও মুখরোচক হয়ে ওঠে। তবে সেক্ষেত্রে ক্যালরির পরিমাণে সতর্ক থাকা দরকার।
আপেল
কোলেস্টেরল কমানো নিয়ে যারা চিন্তায় থাকেন, তাদের ডেস্কে সর্বদা আপেল রাখা উচিত। এর বহিরাবরণে থাকে ফেনোলিক নামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যৌগ, যা দেহের কোষগুলোর কার্যক্ষমতা ও রক্ত প্রবাহকে সমুন্নত করতে সহায়তা করে। স্বাদ আরও বাড়াতে আপেলের সঙ্গে মাখন বা দই মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
গাজর
কাজ ও খাওয়া একসঙ্গে করতে চাইলে গাজর হতে পারে স্বাস্থ্যসম্মত পছন্দ। এই সবজি বিটা-ক্যারোটিন, ফাইবার, ভিটামিন কে-১, পটাসিয়াম এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। হজম, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, চোখ, হৃদপিণ্ড, ত্বক ও হাড়ের স্বাস্থ্য বাড়ানোতে গাজরের ভূমিকা অপরিসীম। প্রতিদিন কাজের পাশাপাশি গাজর খাওয়ার অভ্যাস গড়লে কোলেস্টেরলের মাত্রা, রক্তচাপ এবং ওজন নিয়ে আর ভয় থাকবে না।
ছোলা-মুড়ি
বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলোর মধ্যে খুব কমই এমন রয়েছে, যেখানে একটির নাম বললে সঙ্গে সঙ্গেই অপরটির নাম চলে আসে। কেবল সহজলভ্যই নয়, স্বতন্ত্রভাবে দুটি খাবারেই রয়েছে যথেষ্ট পুষ্টি। ছোলাতে আছে ফলেট, খাদ্য আঁশ, আমিষ, ট্রিপ্ট্যোফান, কপার, ফসফরাস এবং আয়রন। এতে থাকা ফ্যাটের বেশিরভাগই পলি আনস্যাচুরেটেড, যা রক্তের চর্বি কমাতে অংশ নেয়। এর পটাসিয়াম, ভিটামিন 'সি' এবং ভিটামিন বি-৬ পুষ্টি উপাদান হৃদযন্ত্র ভালো রাখে। এছাড়াও ছোলার রয়েছে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, কোষ্ঠকাঠিন্য সারানোর ক্ষমতা। এছাড়া ছোলা বয়ঃসন্ধি পরবর্তীকালে মেয়েদের হার্ট ভালো রাখতেও সাহায্য করে। ছোলায় থাকা ফলিক এসিড রক্তের অ্যালার্জির পরিমাণ কমিয়ে অ্যাজমার প্রকোপ কমিয়ে দেয়। এতে থাকা পর্যাপ্ত ম্যাগনেসিয়াম ও ক্যালসিয়াম হাড় মজবুত করে।
অন্যদিকে, মুড়ির পুষ্টিগুলো হলো নিয়াসিন, ভিটামিন ডি, ক্যালশিয়াম, ফাইবার, আয়রন, থিয়ামিন ও রাইবোফ্ল্যাভিন। এতে সোডিয়াম ও অস্বাস্থ্যকর ফ্যাটের পরিমাণ খুবই কম থাকায় রক্তচাপ বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে না। তবে এই উপকার শতভাগ পেতে হলে মুড়িতে তেল ও লবণ মেশানো যাবে না। তবে ছোলা-মুড়ির সঙ্গে বাদাম ও শসা যোগ করা যেতে পারে। অন্যান্য কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবারের মতো এটিও শরীরে দ্রুত শক্তি জোগাতে পারে।
ওটমিল বিস্কুট
ময়দা, চিনি, ডিম, তেল, চর্বি ও মাখনের সমন্বয়ে তৈরি এই বিস্কুটের প্রধান উপাদান ওটস। তবে কিশমিশ, চকলেট বা বাদামের সন্নিবেশে স্বাদ ও পরিবেশনে দারুণ মাত্রা যোগ হয়। কোনো কোনো ব্র্যান্ড কলা, বাদাম, মাখন ও ওমেগা -৩ সমৃদ্ধ শন ও চিয়া বীজের মতো প্রাকৃতিক উপাদান দিয়েও তৈরি করে থাকে। ওটমিল কুকির ওট্স যেহেতু একটি সম্পূর্ণ শস্য, তাই এর মাধ্যমে ফাইবার এবং কার্বোহাইড্রেট পাওয়া যায়। ফাইবারে গুণাগুণের মধ্যে রয়েছে হজমের উন্নতি ও ওজন কমানো। কার্বোহাইড্রেট দীর্ঘস্থায়ী শক্তি সরবরাহ করে, ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যে কোনো কাজে সক্রিয় থাকা যায়। অধিকাংশ বিস্কুটের মত এটিও প্রোটিন সরবরাহের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকর পেশি গঠনে সাহায্য করে। এছাড়াও এটি ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম এবং পটাসিয়ামের মতো খনিজ উপাদানে ভরপুর।
পপ কর্ন
শুধুমাত্র অফিসেই নয়, কাজের যে কোনো বিনোদনের মূহূর্তে সেরা নাস্তা পপ কর্ন বা খৈ ভাজা। প্রধান কাঁচামাল ভূট্টা হওয়ায় ভূট্টার সব পুষ্টিই পাওয়া যায় এতে। অর্থাৎ এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন, ফাইবার, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, ম্যাঙ্গানিজ ও জিঙ্কে পরিপূর্ণ। পপ কর্ন রক্ত সঞ্চালন ও হজম উন্নত করতে এবং হৃদরোগ, স্থূলতা এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি এড়াতে সাহায্য করে।
ডার্ক চকলেট
এই মিষ্টান্ন খাবারটি মূলত শুকনো ফলের ভান্ডার। তবে বেশি পরিমাণে থাকে বিভিন্ন ধরনের বাদাম। অধিকাংশ ডার্ক চকলেটের প্রতি দেড় আউন্সে থাকে ১৯০ ক্যালরি, ১২ গ্রাম ফ্যাট, ২৪ গ্রাম কার্ব, ৩ গ্রাম ডায়েটারি ফাইবার, ২ গ্রাম প্রোটিন, ৭ গ্রাম ক্যালসিয়াম, এবং ২০৩ গ্রাম পটাসিয়াম। এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের প্রদাহ, ডায়াবেটিস এবং জীবাণু প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী। তবে কেনার সময় ডার্ক চকলেটের মোড়কে লিপিবদ্ধ উপাদানগুলো ভালোভাবে দেখে নেওয়া উচিত। অনেক সময় এগুলোতে কৃত্রিম রাসায়নিক অ্যাল্কালি প্রসেসিং থাকে, যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টকে সরিয়ে দেয়।
সিদ্ধ ডিম
স্বল্প পরিমাণে হলেও মানবদেহের প্রয়োজনীয় সবগুলো পুষ্টি একসঙ্গে পেতে হলে খাদ্যতালিকায় যুক্ত করতে হবে সিদ্ধ ডিম। ৫০ গ্রামের একটি বড় ডিমে ৬ গ্রামেরও বেশি প্রোটিন থাকে। চর্বিহীন এই প্রোটিন অনেক বেশি ক্যালোরি না দিয়েও দীর্ঘক্ষণ যাবৎ পাকস্থলি পরিপূর্ণ রাখবে, যা ওজন কমানোর জন্য সহায়ক। অন্যান্য পুষ্টিগুণগুলো হলো লোহা, ক্যালসিয়াম, কোলিন, ভিটামিন এ, বি-৬, বি-১২ এবং ডি। এতে থাকা লুটেইন এবং জেক্সান্থিনে আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও প্রদাহবিরোধী বৈশিষ্ট্য, যা চোখের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সক্ষম।
চিড়া
স্বল্প আহারে অধিক স্বাস্থ্যগুণের অধিকারী হওয়ার জন্য অন্যতম সুষম খাদ্য চিড়া। প্রোটিন ও ফাইবারসমৃদ্ধ এই খাবার রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, কেননা পাকস্থলি নিঃসৃত অ্যাঞ্জাইম ফাইবার শোষণ করতে ও ভেঙে ফেলতে পারে না। একদিকে ক্যালোরি, চর্বি ও চিনির পরিমাণ যথেষ্ট কম, অন্যদিকে খনিজ ও ভিটামিনের মাত্রা বেশি। এই কারণে চিড়া শরীর থেকে অতিরিক্ত ক্যালরি পুড়িয়ে ওজন কমানোর প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
অফিসের নিত্যদিনের কর্মব্যস্ততার ফাঁকে এই শুকনো খাবারগুলো শুধু ক্ষুধাই মেটাবে না, পাশাপাশি পূরণ করবে দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা। তন্মধ্যে ডেস্কে হাতের কাছেই রাখা যেতে পারে ওটমিল বিস্কুট, ডার্ক চকলেট, বাদাম, পপকর্ন ও কিছু ফলমূল। জনপ্রিয় সান্ধ্যকালীন খাবার ছোলা-মুড়িকে কর্মদিবসের কোনো কোনো দিনে সিদ্ধ ডিমের সঙ্গে বদলে নেওয়া যায়। উপরন্তু, সুষম খাবার হিসেবে উৎকৃষ্ট সংযোজন হতে পারে গাজর, বীজ, বা চিড়া। সর্বোপরি, ফলমূল, গাজর, বাদাম, চিড়া, ছোলা বা বীজের মধ্যে থেকে পছন্দ মতো যেকোনো সন্নিবেশে সালাদ বানিয়েও তৈরি করা যায় মুখরোচক খাবার।