পৌরসভা নির্বাচন
নৌকা-ধানের শীষের যুদ্ধ ও আমাদের বিস্মৃতি
পৌরসভা নির্বাচনের তোড়ে গণমাধ্যমে অঘটনের খবর কমে গেছে। এ নির্বাচনের কারণে হোক আর কাকতালীয়ভাবেই হোক গত কিছুদিন ধরে দেশে অঘটনের হার তুলনামূলক কম। গণমাধ্যমে গুম, খুন, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, ধরপাকড়, দুর্নীতি, দুর্ঘটনা, শোকের খবরগুলোর গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছে ২৩৪ পৌর নির্বাচনের খবরাখবর। তো চলমান এসব অপরাধের ধারায় হঠাৎ ছন্দপতনের মতো। এ ছাড়া সুখকর বা ভালো খবরগুলোও ঢেকে যাচ্ছে পৌরসভা নির্বাচনের খবরের আড়ালে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে গত কিছুদিনের পত্রিকা, টেলিভিশন অনলাইনসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমগুলোর নিউজ ট্রিটমেন্টের দিকে চোখ বুলালে তা কারো নজর এড়ানোর মতো নয়।
তাপ, উত্তাপ-উত্তেজনা থাকলেও পৌর নির্বাচনের মাঠে সহিংসতা এখন পর্যন্ত বেশ কম। বিভিন্ন জায়গায় সন্ত্রাসী ঘটনায় হতাহতের ঘটনাও হাতে গোনা। এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য নিহতের তালিকায় দুই প্রার্থী ও এক প্রার্থীর মাসহ তিনজন। এ খবরগুলোর কোনোটাই সংবাদমাধ্যমে তেমন গুরুত্ব পায়নি। টাঙ্গাইলের গোপালপুরে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এনামুল হক মারা গেছেন মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ার দুঃখে। সমর্থক ভোটারের স্বাক্ষর গরমিল হওয়ায় তিনি যাচাই-বাছাইতে বাদ পড়েন। খবরটি শুনে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসক জানান হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন এনামুল হক। এদিকে, মনোনয়ন পাওয়ার সুখে বেসামাল হয়ে মারা গেছেন রাজশাহীর আড়ানী পৌরসভায় আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী বাবলু ইসলাম। সুসংবাদটি শুনে আর স্থির থাকতে না পেরে মদ নিয়ে বসে যান সঙ্গী-সাথীদের সঙ্গে। অতিরিক্ত মদপানে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তাঁর মৃত্যুর সনদে চিকিৎসক লিখেছেন, আননোন পয়জোনিং অর্থাৎ অজ্ঞাত বিষক্রিয়ার কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। সম্পর্কে বাবলু পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সম্বন্ধী। ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে এক প্রার্থীর মা মরেছেন আরেক প্রার্থীর পিটুনিতে। উল্লেখযোগ্য সহিংসতার মধ্যে আরো রয়েছে কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীকে হাতুড়িপেটা করা। একটি হত্যা বা সহিংসতাও কারো কাম্য নয়। সেই সঙ্গে এখন পর্যন্ত সংঘটিত নির্বাচনী সহিংসতাগুলো মাত্রাগতভাবে উদ্বেগের চরমে নয়- এ কথাও অস্বীকার করা যায় না।
গণমাধ্যমগুলোতে পৌর নির্বাচনের খবরাখবর বেশি গুরুত্ব পাওয়ায় বড় রকমের অন্য খবরগুলো গুরুত্ব হারাচ্ছে। তা যে একেবারে অকারণে বা শুধুই হুজুগে তাও নয়। এবারের পৌর নির্বাচন বিভিন্ন কারণে তাৎপর্যময়। সাত বছর পর মানুষ নৌকা-ধানের শীষের ভোটযুদ্ধ দেখছে। এত বছর পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকারের সকল নির্বাচন হয়েছে নির্দলীয়ভাবে। এবারই পৌর নির্বাচনে এর ব্যতিক্রম। মেয়র নির্বাচনটি হচ্ছে দলীয় ভিত্তিতে, দলীয় প্রতীকে। কাগজে-কলমে না হলেও কাউন্সিলর প্রার্থীরাও নির্দলীয় নয়। সব মিলিয়ে তা পৌর নির্বাচনের চরিত্র পাল্টানোর পাশাপাশি সাম্প্রতিক পরিস্থিতিও পাল্টে দিয়েছে। দলীয় প্রতীকের লড়াইটা শুধু প্রার্থীদেরই নয়, বড় দুই দল আওয়ামী লীগ-বিএনপিরও। রূপ নিয়েছে দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার লড়াইয়েও। আওয়ামী লীগের সব মেয়র প্রার্থীকে প্রত্যয়নপত্র দিয়েছেন স্বয়ং দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রার্থী। প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি প্রার্থী দেওয়ার গুরুত্ব অন্যমাত্রার হওয়াই স্বাভাবিক।
মানুষই গণমাধ্যমের টার্গেট। আর মানুষ মানে পাঠক, দর্শক, শ্রোতা, বিজ্ঞাপনদাতা। গত কদিনের আলামতে স্পষ্ট, পৌর নির্বাচন ছাড়া দেশে আর কোনো ঘটনা আছে, ছিল বা হতে পারে- অনেকের ভাবনার জগৎ থেকে তা হারিয়ে গেছে। পৌর নির্বাচন মানুষকে কদিন আগের অনেক ঘটনা ভুলিয়ে দিয়েছে। মানুষ নিজ থেকেও ভুলে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষকে ভুলিয়ে দেওয়া খুব সহজ। হুযোগেও মাতিয়ে দেওয়া যায়। বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এ দেশে অস্থিরতাকে স্থিরে আনতে তত অপেক্ষা করতে হয় না। আবার স্থির, শান্ত পরিবেশকে অস্থির করে দিতেও সময় লাগে না। চরম উদ্বেগকে বেগশূন্য করতে বড় কোনো আয়োজন করতে হয় না। মোটামুটি একটা ইস্যু তুলে দেওয়া গেলে সন্তান হত্যার বিচারের আশা ছেড়ে দেওয়া মা-বাবাকে দিয়েও আশার কথা বলানো সম্ভব। ক্রিকেটের মাঠে কয়েকটা ছক্কা শীতলক্ষ্যায় সাত লাশ গুম করে ফেলার ঘটনা ভুলিয়ে দিতে যথেষ্ট। গোরস্তানমুখী মিছিলকে নিমিষেই ছুটিয়ে নেওয়া যায় স্টেডিয়ামের দিকে। টানা তিন মাসের অবরোধ, পেট্রলবোমা, প্রতিদিন ডজনে ডজনে লাশ পড়ার ঘটনা ভুলতে কদিন লেগেছে? জোর করে ভোলাতে হয়নি।
নতুন অঘটন ঘটলে সচরাচর মানুষ আগের অঘটনের কথা ভুলে যায়। কিন্তু ঘটনার ঘনঘটা ছাড়াই শুধু পৌর নির্বাচন মোটামুটি নিকট অতীতকেও ভুলিয়ে দিয়েছে। নতুন অঘটন যে কমে এসেছে এর প্রমাণ- রাজধানীর কূটনৈতিকপাড়ায় আর কোনো ইতালীয় তাভেলা সিজার বা রংপুরে জাপানি হোসি কুনিওর লাশ পড়েনি। অস্ট্রেলিয়া বা কোনো দেশের খেলোয়াড়দের জন্য বাংলাদেশ সফর বিপজ্জনক বলা হয়নি। বাংলাদেশ ভ্রমণে নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের চলাফেরায় সতর্কতা জারি করেনি। মহিলা এমপি পিনু খানের ছেলে বখতিয়ার রনির মতো কেউ মাতলামি করে একসঙ্গে দুজনের লাশ ফেলেনি। সিলেটে শিশু রাজনের মতো আর কোনো জ্যান্ত শিশুকে পিটিয়ে লাশ করা হয়নি। অথবা খুলনায় আরেক শিশু রাকিবের মতো কাউকে পায়ুপথে কম্প্রেসার মেশিন দিয়ে বাতাস ঢুকিয়ে বীভ্ৎসভাবে হত্যা করা হয়নি। গাইবান্ধার সংসদ সদস্য লিটনের মতো কেউ শিশু সৌরভের পায়ে গুলি করেননি। হত্যাকাণ্ডের শিকার হননি কোনো ব্লগার-প্রকাশক। সরকারকেও বলতে হচ্ছে না- এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বিরোধী দল বলতে পারছে না, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে গেছে, সরকারের ক্ষমতায় থাকার কোনো অধিকার নেই। স্বয়ং তথ্যমন্ত্রী নিজের ওপরও হামলার আশঙ্কা নতুন করে আর ব্যক্ত করছেন না। বাংলাদেশে আইএস আছে বা নেই- এ বিতর্কও আপাতত পানসে। বিশ্বের কোনো উপকূলে বাংলাদেশের আর কী পরিমাণ অভিবাসনপ্রত্যাশী আটকে রয়েছে, না খেয়ে মরছে বা কোথাও তাদের গণচাপা দেওয়া গণকবরের খবরও নেই। ঘটে যাওয়া এসব খবরের তেমন ফলোআপ সংবাদও নেই। যেন কিছুই হয়নি। হয়ে থাকলেও মামুলি। চট্টগ্রামে নৌ-ঘাঁটির মসজিদে জুমার নামাজে গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনাও তেমন নিউজ ভ্যালু পায়নি। বরং ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া বা এ ইস্যুতে মুখ না খুলে পাস কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টাই বেশি। বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নানা কাণ্ড, ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা গণমাধ্যমে এসেছে সংক্ষেপে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ছাড়া অন্যদের হয়তো তা মনেও পড়ছে না। নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর মূল কাজ শুরুর সংবাদও একদিনের বেশি দুদিন জায়গা পায়নি সংবাদ মাধ্যমগুলোতে। এমন ফাঁকা ময়দানে ঘটে চলছে বা ঘটিয়ে দেওয়া হচ্ছে বহু ঘটনা। সব তলানিতে পড়ে যাচ্ছে পৌর নির্বাচনের খবর ও আমাদের ভোলা রোগের সুযোগে। অনেকেই ভুলে গেছি কত কবরে ঘাস উঠে গাছও গজিয়েছে।
হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। পাশাপাশি বাড়ছে ভুলে যাওয়ার রোগটিও। ডাক্তারি বিদ্যায় ভোলা রোগের লক্ষণ হচ্ছে- গতকাল কী ঘটেছে, কী নিয়ে মাতামাতি করেছে সেটা ভুলে যায়। মনে করিয়ে দিলে ক্ষেপে যায়। চিকিৎসাবিজ্ঞানে একে আলঝেইমার্স, ডিমেনশিয়া, অ্যামনেশিয়া, মেমোরি লস বা পারসিসটেন্ট ফেইলর বলা হয়ে থাকে। বাংলা তরজমায় দাঁড়ায় ‘স্মৃতিভ্রংশতা’। তা রোগীকে সাম্প্রতিক স্মৃতি, আদর্শজ্ঞান ও দক্ষতার স্থান থেকে ক্রমশ সরিয়ে দেয়। চিকিৎসকরা বলছেন, বিভিন্নভাবে ভুলে যাওয়ার রোগ বা সমস্যা দেখা দিতে পারে। যেমন- ব্রেনে বড় রকমের আঘাত, থাইরয়েডের সমস্যা, ডায়াবেটিকস, হাই কোলেস্টেরল, ক্লান্তি, বিষণ্ণতা, নিঃসঙ্গতা ইত্যাদি। তবে, ভুলবশত ভুলে যাওয়াকে রোগ বলেন না চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। অশিক্ষা, অপুষ্টির কারণে স্মৃতিশক্তি হারানোর রোগে পায়। হরলিক্স, কমপ্ল্যান খাওয়া উচ্চশিক্ষিত, সামর্থ্যবানদের স্মৃতিকোষও সতেজতা হারিয়ে দুর্বল হয়, হচ্ছে। সেটা যত না স্মৃতিভ্রম, তারচেয়ে বেশি মতিভ্রম।
চিকিৎসাবিজ্ঞান যা-ই বলুক, ইতিহাস বলছে- বহু সুনাম ও বন্দনার বিপরীতে ‘অল্পতেই ভুলে যাওয়া’র অপবাদটি নিয়েই এগুতে হবে আমাদের। এ বদনাম নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হতে পারে। হচ্ছেও। এর ফাঁক গলে যে স্মৃতিভ্রমের সঙ্গে যে মতিভ্রমও যোগ হয়েছে তার জেরও সইছি আমরা। মতিভ্রমের মাত্রা নির্ণয় বা তা নিয়ে সতর্ক হওয়ার পর্বটা ভুলেই যেতে বসেছি। আমরা শুধু ভুলে যাই না। আমাদের সহজে ভুলিয়েও দেওয়া যায়। অনেক আগের কথা নয়, একেবারে সাম্প্রতিক ঘটনাও। তা আবার ভালো-মন্দ দুটাই। ভোলা রোগে ব্ল্যাক আউট হয়ে গেছে মাত্র কদিন আগের সাড়া জাগানো ব্লগার আন্দোলন ও সিরিজ হত্যার কথা। আস্তিক-নাস্তিক ঝড়ে কত প্রাণ ঝরে যাওয়ার কথা। সারা দেশে আগুন জ্বলেছে, কত মানুষ মরেছে, কত সম্পদ ছাঁই হয়েছে মনে করিয়ে দিলেও মেনে নিতে সময় লাগে। পেট্রলবোমা, গুলিতে রক্তের স্রোত, হতাহতের সংখ্যা তেমন মনে নেই অনেকেরই। পিলখানা, রানা প্লাজা, তাজরীন ফ্যাশনস ট্র্যাজেডি তো ভুলে গেছি সেই কবেই। এর আগে ভুলেছি ওয়ান-ইলেভেন, দুই নেত্রীর কারাবাস, ব্রিফকেসে করে তিন কোটি টাকার ঘুষ নেওয়া, এতিমের টাকা মেরে খাওয়ার অভিযোগ, রিলিফের বিস্কুট-শাড়ি চুরির অভিযোগে বড় বড় নেতাদের গ্রেফতারের কথা। অনেকটা গোল্ড ফিশের মতো। বাম থেকে ডানে কাত হলেই বামে কী ছিল মনে করতে না পারার মতো।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন