আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয় : মহসিন খানের ‘সুইসাইড নোট’
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লাইভে এসে মাথায় গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করা আবু মহসিন খানের লাশের পাশে একটি ‘সুইসাইড নোট’ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। ‘সুইসাইড নোটে’ তিনি লিখেছেন, ‘আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।’
গতকাল বুধবার রাত ৯টার দিকে ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করেন ৫৮ বছর বয়সি আবু মহসিন খান। ঘটনাটি ঘটে রাজধানীর ধানমণ্ডি এলাকার ৭ নম্বর সড়কের ২৫ নম্বর বাড়ির মহসিন খানের নিজ বাসায়। ঘটনাস্থলে পিস্তলের লাইসেন্স এবং কাফনের কাপড়ও পেয়েছে পুলিশ।
পুলিশ জানিয়েছে, আবু মহসিন খান পেশায় ব্যবসায়ী এবং চিত্রনায়ক রিয়াজের শ্বশুর। গতকাল রাতে তাঁর আত্মহত্যার ভিডিও খুব দ্রুত ফেসবুকে ভাইরাল হয়। খবর পেয়ে ধানমণ্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ পুলিশের রমনা বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান।
আবু মহসিন খানের লাইভে এসে আত্মহত্যার বিষয়ে রমনা বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘তাঁর (মহসিন) স্ত্রী ও ছেলে অস্ট্রেলিয়া থাকেন। ধানমণ্ডির বাসায় তিনি একা থাকতেন (যা মহসিন নিজেও লাইভে বলেছেন)। তিনি কয়েক বছর আগে ক্যানসারে আক্রান্ত হন। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে অনেক লোকসানের মুখে পড়েন। এ সব কারণে তিনি আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন বলে পুলিশের প্রাথমিক ধারণা।’
এর আগে ফেসবুক লাইভে মহসিন খান নিঃসঙ্গতা নিয়ে কথা বলেন। সাম্প্রতিককালে তাঁর দুই খালার মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি বাসায় একাই থাকি। আমার এক ছেলে থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। আমার ভয় করে যে, আমি বাসায় মরে পড়ে থাকলে, লাশ পচে গেলেও কেউ হয়তো খবর পাবে না।’
আত্মহত্যার আগে যা বলে গেলেন মহসিন খান
‘আমি মহসিন। ঢাকায় থাকি। আমার বয়স ৫৮ বছর। কোনো এক সময়ে আমি ভালো ব্যবসায়ী ছিলাম। বর্তমানে আমি ক্যানসারে আক্রান্ত। তাই, আমার ব্যবসা কিংবা কোনো কিছুই নেই। ভিডিও লাইভে আসার উদ্দেশ্য হলো—মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং আমার যে এক্সপেরিয়েন্স, সেটা শেয়ার করলে হয়তো সবাই জানতে পারবে, সবাই সাবধানতা অবলম্বন করবে।’
‘গত ৩০ তারিখ আমার খালা মারা যান। তাঁর একটি ছেলে আমেরিকায় থাকে। মা মারা গেল অথচ ছেলেটি আসল (এলো) না। এটা আমাকে অনেক দুঃখ দিয়েছে। কষ্ট লেগেছে।
‘আজকে আমার আরেকজন খালা মারা গিয়েছেন। তাঁরও একটি ছেলে আমেরিকায় ছিল। অবশ্য তাঁর তিনটা ছেলে ইঞ্জিনিয়ার। তিনজনই বর্তমানে বাংলাদেশে আছেন। তারা হয়তো দাফন–কাফনের কাজ সম্পন্ন করছে। সেদিক দিয়ে বলব, এ খালা অনেকটা লাকি।
‘আমার একটামাত্র ছেলে। সে অস্ট্রেলিয়াতে থাকে। আমার বাসায় আমি সম্পূর্ণ একা থাকি। আমার খালা মারা যাওয়ার পর থেকে আমার ভেতরে খুব ভয় করছে। আমি যদি আমার বাসায় মরে পড়েও থাকি, আমার মনে হয় না যে এক সপ্তাহ কেউ জানতে পারবে, আমি মারা গেছি।
‘ছেলে–মেয়ে, স্ত্রী—যাদের জন্য যা–ই কিছু আমরা করি। আমরা সব কিছু করি সন্তান ও ফ্যামিলির জন্য। আপনি যদি একশ টাকা ইনকাম করেন, আয় করেন; তার টোয়েন্টি পারসেন্ট টাকাও আপনি নিজের জন্য ব্যয় করেন না। যদি টোয়েন্টি পারসেন্ট টাকা আপনি নিজের জন্য ব্যয় করেন, তাহলে ৮০ পারসেন্ট টাকা আপনার ফ্যামিলির জন্য ব্যয় হয়।
‘গত করোনা শুরুর আগে থেকে আমি বাংলাদেশে আছি। একা থাকা যে কী কষ্ট—যাঁরা একা থাকেন, তাঁরাই একমাত্র বলতে পারেন বা বোঝেন।
‘যাদের জন্য আমি বেশি করছি, প্রত্যেকটা লোকের কাছে আমি প্রতারিত হয়েছি। আমার এক বন্ধু ছিল, নাম কামরুজ্জামান বাবু। আমি নিজে না খেয়ে তাকে খাইয়েছি। সে আমার ২৩ থেকে ২৫ লাখ টাকা মেরে দিয়েছে।’
মহসিন খান আরও বলেন, ‘পিতা-মাতা যা উপার্জন করে, তার সিংহভাগ সন্তানদের পেছনে খরচ করে। প্রকৃত বাবারা না খেয়েও সন্তানদের খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। পরিবারকে দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পরিবার অনেক সময় বুঝতে চায় না। নিজেকে আর মানিয়ে নিতে পারলাম না। যারা দেখছেন, তাঁদের সঙ্গে হয়তো এটাই শেষ দেখা। সবাই ভালো থাকবেন।’
এরপর নিজের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করেন মহসিন।
এর আগে মহসিন বলেন, ‘আমি যেটা দিয়ে সুইসাইড করার চিন্তা করছি, সেটি অবৈধ কোনো কিছু নয়। এই হলো আমার পিস্তলের লাইসেন্স। এক বছরের রিনিউ করা আছে। আমি এ মুহূর্তে চলে যাব। আত্মীয়-স্বজন যারা আছো... আমি যে কবরস্থানটা করেছি, সেখানে আমাকে দাফন করো না। আমাকে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধে যে একটা কবরস্থান হয়েছে, তোমরা ওইখানে দাফন করে দিও। ওটাই আমার জন্য ভালো হবে। কারণ, প্রত্যেকটা লোক আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে- আমার বাবা-মা, ভাইরা, প্রত্যেকটা লোক। সবাই ভালো থাকো।’