হাসপাতাল রোগ সারায়, মনও জুড়ায়
হাসপাতালের চত্বরজুড়ে বাহারি ফুল আর সবুজের সমারোহ। ঝকঝকে তকতকে হাসপাতালটির ভেতরে বিভিন্ন ওয়ার্ডের সামনের বারান্দায় টবে ও গ্রিলে এবং ভবনের ছাদেও শোভা পাচ্ছে বাহারি ফুল, পাতাবাহার ও সৌন্দর্যবর্ধনকারী বিভিন্ন গাছ। এ ছাড়া হাসপাতাল চত্বরে মিনি শিশু পার্ক ও শিশু ওয়ার্ডের পাশে রয়েছে শিশুদের খেলার স্থান কিডস জোন। এই দৃশ্য নওগাঁর সাপাহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের। হাসপাতালটিতে সেবা নিয়েও এলাকার মানুষ সন্তুষ্ট।
সাপাহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিত্র কিছুদিন আগেও এ রকম ছিল না। হাসপাতাল চত্বরে খোলা জায়গা পতিত অবস্থায় ছিল। ওই সব স্থানে সারা বছর ময়লা-আবর্জনা ও কাদা-পানিতে ভরে থাকত। তবে এখন হাসপাতালের পতিত জায়গাগুলো যেন হেসে উঠেছে। হাসপাতালের ভেতরে বিভিন্ন ওয়ার্ড ও বারান্দা প্রায় সময়ই অপরিচ্ছন্ন থাকত। এখন হাসপাতালের ভেতরের পরিবেশ হয়ে উঠেছে ঝকঝকে, তকতকে। এই পরিবর্তনের জন্য যে মানুষটির অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি হচ্ছেন সাপাহার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. রুহুল আমিন। তাঁর নেতৃত্বে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও সুন্দর ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি করে স্বাস্থ্যসেবার মানকে যে চমৎকারভাবে বদলে দেওয়া যায়, তারই নজির সৃষ্টি করেছে সাপাহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
পরিবেশগত উন্নতি ছাড়াও স্বাস্থ্যসেবা অনন্য অবদান রেখে চলেছে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি। সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেই সেবার ক্ষেত্রেও যুগান্তকরী পরিবর্তন এসেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাসিক প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ (হেলথ সিস্টেম স্ট্রেংদেনিং-এইচএসএস) রেটিংসে গত ডিসেম্বরে সাপাহার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সারা দেশে ষষ্ঠ এবং রাজশাহী বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। স্বাভাবিক প্রসব, সিজারিয়ান অপারেশন, প্রসব পূর্ব ও পরবর্তী সেবা, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য সেবা দেওয়ার জন্য এ রেটিং অর্জন করে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সারা দেশে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোকে বিভিন্ন ইনডিকেটর বা পরিমাপক দ্বারা পর্যালোচনা করে এই রেটিং করে থাকে।
সম্প্রতি হাসপাতালের ফটক দিয়ে ঢুকতেই হাসপাতাল চত্বরে চোখ পড়তেই মনে হলো এ যেন এক আনন্দলয়। যে দিকেই তাকাই পরিচ্ছন্ন রাস্তা, সবুজ চত্বর ও ফুল বাগান দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ঠিক সামনেই গড়ে তোলা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন থিম পার্ক। সেখানে বাহারি সব ফুল, ঝাউ, পাতাবাহারসহ শোভাবর্ধক গাছ সুসজ্জিতভাবে লাগানো রয়েছে। এ ছাড়া থিম পার্কে পরিত্যক্ত বোতল, গাড়ির টায়ারের নান্দনিক ব্যবহার বাগানের সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। হাসপাতালের উত্তর চত্বরে দোলনায় চড়ে দোল খাচ্ছিল দুই শিশু। তারা খেলা করছে। তার পাশেই খড় ও কাঠ দিয়ে তৈরি দৃষ্টিনন্দন বিশ্রামাগার। সেখানে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনেরা বসে রয়েছেন। ওই ছাউনির সাথেই একটি স্থানে করা হয়েছে ভেষজ উদ্যান। যেখানে ৩৬ প্রকারের ঔষধি গাছ লাগানো হয়েছে। হাসপাতাল চত্বরের দক্ষিণ দিকে বহির্বিভাগে যাওয়ার রাস্তার দুই পাশে সুসজ্জিতভাবে লাগানো দৃষ্টিনন্দন বাহারি ফুল ও বিভিন্ন শোভাবর্ধক গাছ।
জরুরি বিভাগের সামনে লেখা শিশুবান্ধব হাসপাতাল। তার পাশেই বিশাল এক মানচিত্রে পুরো সাপাহার উপজেলার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্র দেওয়া রয়েছে। উপজেলার কোথায় কোন ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক, সেই তথ্য ও জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে ওই মানচিত্রে।
৫০ শয্যার হাসপাতালের মূল ভবনের ভেতরেও পরিচ্ছন্নতার ছাপ। প্রতিটি ভবনের বারান্দায় টবে ও গ্রিলে শোভা পাচ্ছে বাহারি ফুল ও শোভাবর্ধক গাছ। সব কক্ষ, বারান্দা, ওয়ার্ড ও টয়লেটের মেঝে ও দেয়াল ঝকঝকে-তকতকে। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দিনে পাঁচ থেকে ছয়বার তাঁরা হাসপাতাল ঝাড়ু দেন, টয়লেট পরিষ্কার করেন।
হাসপাতালের দোতলায় ওঠার সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ, দেয়াল ও করিডরে লেখা রয়েছে বিভিন্ন স্বাস্থ্যবার্তা। এ ছাড়া বিভিন্ন ওয়ার্ড ও কক্ষের দেয়াল এবং করিডরের দেয়ালে আলপনা আর প্রাসঙ্গিক চিত্রকর্ম পুরো হাসপাতালের পরিবেশকে করেছে দৃষ্টিনন্দন। হাসপাতালের দোতলায় শিশু ওয়ার্ডের সামনে একটি জায়গায় তৈরি করা হয়েছে কিডস জোন। সেখানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিশু ছাড়াও রোগী ও তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে আসা শিশুরা খেলাধুলা করে। প্রতিটি ওয়ার্ডের সামনে খাবার জন্য নির্দিষ্ট স্থান (ডাইনিং স্পেস) করা হয়েছে। যেখানে টেবিল চেয়ারে বসে খাবার ব্যবস্থা রয়েছে।
নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত চার বছরের শিশু জিয়াদকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছেন পত্নীতলার দিবর গ্রামের বাসিন্দা নার্গিস আক্তার। তিনি বলেন, ‘বেশ কয়েক বছর আগে এই হাসপাতালে এসেছিলাম। তখন হাসপাতালের যেখানে-সেখানে অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন দেখেছিলাম। এবার এসে দেখি সব কিছু পাল্টে গেছে। সব ঝকঝকে-তকতকে। বারান্দায় ফুল ও পাতাবাহারি গাছ। আবার বাচ্চাদের জন্য খেলার জায়গা আছে। আর হাসপাতাল চত্বর দেখলে তো মনে হয় যেন পার্কে এসেছি। বাচ্চাটাকে গত সোমবার থেকে এখানে আছি। যখন ও একটু ভালো থাকছে তখন কিডস জোনে গিয়ে খেলাধুলা করছে। এই পরিবেশে থাকলে আমার বিশ্বাস ছেলেটি দ্রুত সেরে উঠবে।’
উপজেলার শিরন্টি এলাকা থেকে প্রসবজনিত ব্যথা নিয়ে গত ২৬ জানুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি হন গৃহবধূ সাবিনা ইয়াসমিন (৩২)। তাঁর স্বামী জিয়াউল হক বলেন, ‘এখানে আমার স্ত্রীর নরমাল ডেলিভারির মাধ্যমে সন্তান প্রসব হয়েছে। বাচ্চা ও মা দুজনেই ভালো আছে। এখানকার সিস্টার ও মিডওয়াইভ আপারা খুব ভালোভাবে নরমাল ডেলিভারি করে থাকেন।’
হাসপাতালটিতে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, মাত্র তিন বছর আগেও জোড়াতালি দিয়ে চলছিল হাসপাতালটি। তবে এখন হাসপাতালের কর্মপরিবেশ সুন্দর হওয়ায় স্বাস্থ্যকর্মীদের কর্মস্পৃহা বেড়ে গেছে। রোগীরাও স্বাস্থ্যকর্মীদের সেবায় সন্তোষ প্রকাশ করে থাকেন। তাঁরা হাসপাতালের এই সুন্দর কর্মপরিবেশ তৈরির জন্য সবচেয়ে অবদান দিচ্ছেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. রুহুল আমিনকে।
হাসপাতাল পরিসংখ্যান কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ভর্তি, জরুরি বিভাগ ও বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেওয়া রোগীর সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজার ৯৮ জন। ২০২১ সালে এক লাখ ছয় হাজার ৭৩৭ জন। দুই বছরের ব্যবধানে সেবা গ্রহীতার সংখ্যা বেড়েছে ২৩ হাজার ৬৩৯ জন।
হাসপাতালের এই পরিবর্তন সম্পর্কে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. রুহুল আমিন বলেন, ‘২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি এখানে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেই। তখন থেকেই আমি ও আমার টিম তিনটি কর্মপরিকল্পনা ঠিক করি। সেগুলো হচ্ছে, সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন কর্মপরিবেশ তৈরি, অচল, অর্ধসচল যন্ত্রপাতি ও লজিস্টিক্সের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং মানসম্মত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে আধুনিক সরঞ্জামের ব্যবহার। আমাদের হাসপাতালের পরিবেশ উন্নত করতে আমি যোগদানের প্রথম দিক থেকেই কাজ করি। এ ছাড়া ধাপে ধাপে অন্যান্য লক্ষ্য অর্জন করার চেষ্টা করেছি।’
ডা. রুহুল আমিন আরও বলেন, ‘এই হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে অপারেশন থিয়েটার অচল ছিল। এখন সেটি চালু হয়েছে। গত নভেম্বর থেকে এখানে সিজারিয়ানসহ অন্যান্য অপারেশন হচ্ছে। করোনা মহামারি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লে ২০২০ সালের শেষের দিকে উপজেলা পরিষদের অর্থায়নে হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম ব্যবস্থা চালু করা হয়। দেশে আমরাই প্রথম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা চালু করি। হাসপাতালের সার্বিক উন্নয়নে স্থানীয় সাংসদ খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, উপজেলা প্রশাসনসহ আমি সবার সহযোগিতা পেয়েছি। ’
এ ব্যাপারে নওগাঁর সিভিল সার্জন আবু হেনা মোহাম্মদ রায়হানুজ্জামান বলেন, ‘সাপাহার উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ যেভাবে কাজ করছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। সাপাহার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিবর্তনের কথা জেনে ইতোমধ্যে জেলার অন্যান্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোও পরিবর্তন হতে শুরু করেছে। সদিচ্ছা এবং সঠিক কর্মপরিকল্পনা থাকলেও সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও ভালো কর্মপরিবেশ তৈরি ও সেবা দেওয়া সম্ভব। সাপাহার স্বাস্থ্যবিভাগ সেটিই করে দেখিয়েছে।’