কেন ইউক্রেনে নো-ফ্লাই জোন ঘোষণা করেনি ন্যাটো?
ইউক্রেনে ন্যাটোর পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করতে জোটের ৩০টি সদস্য দেশ স্থানীয় সময় শুক্রবার বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে বৈঠক করেছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর সেনাবাহিনীকে ইউক্রেনে হামলার নির্দেশ দেওয়ার আট দিন পর সে দেশে সৃষ্ট যুদ্ধ পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
ইউক্রেনের বর্তমান পরিস্থিতির সহসা উন্নতির সম্ভাবনা নেই বলে মনে হচ্ছে। ইউক্রেনীয় যোদ্ধারা দেশটির মূল অঞ্চলগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার কারণে রাজধানী কিয়েভের দিকে রওনা হওয়া ৪০ মাইল দীর্ঘ রুশ সেনা বহর কয়েকদিন ধরে পথে আটকে আছে। তবে রুশ সেনারা ইউক্রেনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত এলাকা দখলে নিয়েছে। এবং শুক্রবার জাপোরিঝিয়া শহরে ইউরোপের সর্ববৃহৎ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দখল করেছে রুশ বাহিনী।
এমন গুরুতর পরিস্থিতি সত্ত্বেও ন্যাটো ইউক্রেনের আকাশসীমাকে উড়োজাহাজ উড্ডয়ন নিষিদ্ধ এলাকা (নো-ফ্লাই জোন) ঘোষণা করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। কারণ, ন্যাটো সরাসরি রুশ-ইউক্রেন সংকটে জড়াতে ইচ্ছুক নয়। নিরপরাধ বেসামরিক লোকজনের প্রাণ চলে যাচ্ছে—এমন হামলার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের প্রতিরোধকে সমর্থন করা ছাড়া অন্য কোনো পদক্ষেপ নিতে নারাজ ন্যাটো।
ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ গতকাল শুক্রবার বলেন, ইউক্রেনের আকাশসীমাকে ‘নো-ফ্লাই জোন’ ঘোষণা করা জোটের বিবেচনাধীন নয়। তিনি বলেন, ‘আমরা একমত হয়েছি যে, ইউক্রেনের আকাশসীমার ওপর দিয়ে ন্যাটোর কোনো উড়োজাহাজ যাওয়া উচিত নয় কিংবা ইউক্রেনের ভূখণ্ডে ন্যাটো সেনা যাবে না।’
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তাঁর দেশের আকাশসীমায় নো-ফ্লাই জোন ঘোষণা করতে ন্যাটোর প্রতি অনুরোধ জানান। এ নিয়ে গতকাল ব্রাসেলসে বৈঠক করেন ন্যাটো জোটের নেতারা। সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে এ বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
বৈঠকের পর ন্যাটোর মহাসচিব বলেন, ‘রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ও বিমান হামলা থেকে ইউক্রেনকে সুরক্ষা দিতে গেলে ন্যাটো বাহিনীকে রুশ উড়োজাহাজ ভূপাতিত করতে হবে। এ পদক্ষেপ নিলে ইউরোপে পুরোদমে যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। সে যুদ্ধে আরও অনেক দেশ জড়িত হবে। আমরা এ সংঘাতের অংশ নই।’
ন্যাটোর মহাসচিব আরও বলেন, ‘ন্যাটো জোট হিসেবে তাদের বড় দায়িত্ব হলো এ যুদ্ধের বিস্তার ঠেকানো। যুদ্ধ বিস্তৃত হলে তা অনেক বেশি ভয়াবহ ও বিধ্বংসী পরিণাম বয়ে আনবে। তাতে মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।’
ন্যাটো কী?
‘নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অরগানাইজেশন’ বা ন্যাটো হলো উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ৩০ দেশের একটি সামরিক সহযোগিতার জোট। ন্যাটো বলে তাদের উদ্দেশ্য—‘রাজনৈতিক ও সামরিক পন্থায় জোটের সদস্যদের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ‘স্নায়ুযুদ্ধ’ শুরু হলে ১৯৪৯ সালে ন্যাটোর জোটের জন্ম। জোটের মূল উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের হুমকি থেকে পশ্চিমাদের রক্ষা করা। স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের পর থেকে অনেক সাবেক সোভিয়েত দেশ ন্যাটোতে যোগদান করেছে, যা পুতিনের বিরক্তির কারণ।
ন্যাটোর সদস্যেরা কী করে?
ন্যাটোর অংশ হওয়ার অর্থ হলো জোটের স্বার্থ রক্ষায় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক দৈনন্দিন আলোচনায় সক্রিয় ভূমিকা রাখা।
এ ভূমিকার মধ্যে রয়েছে—সাইবার-যুদ্ধের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কৌশলগত পদক্ষেপ থেকে শুরু করে অন্যান্য সদস্যের সুরক্ষার জন্য ন্যাটোর সীমানার মধ্যে সৈন্য পাঠানো, ঠিক যেমন বর্তমান সংকটের সময় ঘটেছে।
ন্যাটোর সদস্যদের প্রতি বছর জাতীয় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় করার কথা। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খুব কম সদস্যই তা করেছে।
জোটের সবচেয়ে পরিচিত দিক হলো—চুক্তির পাঁচ নম্বর অনুচ্ছেদ। এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘কোনো মিত্র দেশের ওপর হামলাকে জোটের সব সদস্যের বিরুদ্ধে হামলা হিসেবে বিবেচনা করা হবে।’
এখন পর্যন্ত কেবল একবার—২০১১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলার প্রতিক্রিয়ায় ‘আর্টিকেল ফাইভ’ বা পঞ্চম অনুচ্ছেদটি আহ্বান করা হয়েছিল।
তবে, পঞ্চম অনুচ্ছেদ ছাড়াও ন্যাটো সম্মিলিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিতে পারে। এবং সম্প্রতি ইউক্রেনে রুশ হামলার পরিপ্রেক্ষিতে জোট সে পদক্ষেপ নিয়েছে।
নো-ফ্লাই জোন কী?
নো-ফ্লাই জোন এমন এলাকাকে ধরে নেওয়া হয়, যার মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট কোনো উড়োজাহাজ কোনোভাবেই চলাচল করতে পারবে না। তবে, রাশিয়া-ইউক্রেনের সংঘাতের মধ্যে নো-ফ্লাই জোন ঘোষণা করা হলে এর অর্থ হবে—এর আওতায় পড়া এলাকা দিয়ে রাশিয়া ইউক্রেনের ওপর বিমান হামলা চালাতে পারবে না। ন্যাটো এর আগে বসনিয়া ও লিবিয়াসহ জোটের সদস্য নয় এমন দেশগুলোতে নো-ফ্লাই জোন আরোপ করেছিল।
ন্যাটো নো-ফ্লাই জোন আরোপ করলে কী হবে?
সামরিক নো-ফ্লাই জোনগুলোর সমস্যা হলো, এর আওতায় পড়া এলাকায় সামরিক বাহিনী শক্তি প্রয়োগ করতে পারবে। যদি কোনো রুশ উড়োজাহাজ ন্যাটো’র নো-ফ্লাই জোনে ওড়ে, তাহলে ন্যাটো বাহিনী সে উড়োজাহাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে। উড়োজাহাজটির দিকে গুলিবর্ষণ করাও এ ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। ন্যাটো যদি ইউক্রেনে নো-ফ্লাই জোন ঘোষণা করে, তাহলে রাশিয়ার চোখে তা হবে ন্যাটো বাহিনীর যুদ্ধে অংশ নেওয়ার মতো আচরণ, যা সংঘাতকে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
ন্যাটো কেন নো-ফ্লাই জোন ঘোষণা করেনি?
রাশিয়া ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশ নয়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মূলত ন্যাটোকে সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখেন। রাশিয়ার দিকে ন্যাটো’র বিস্তৃতির সমালোচনা করে আসছেন পুতিন অনেক দিন ধরেই। ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর সেনা অভিযানের কারণ হিসেবে ন্যাটোর বিস্তৃতিকেও দায়ী করেন তিনি। এর ফলে ন্যাটো প্রতিদ্বন্দ্বী এ পারমাণবিক শক্তিধর দেশের বিরুদ্ধে ইউক্রেন সংঘাত ইস্যুতে সরাসরি জড়িত হতে চায় না।
তবে, রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে ইউক্রেনের প্রতিরোধকে সমর্থন করে ন্যাটো। এ ছাড়া পুতিনের পদক্ষেপকে সার্বভৌম রাষ্ট্রের ওপর আক্রমণ বলেও মনে করে তারা। তবে, ন্যাটো এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে চায় না, যে পদক্ষেপকে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার মতো মনে হতে পারে। এবং যা পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার উসকে দিতে পারে।
রাশিয়া কেন ন্যাটোকে হুমকি মনে করে?
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়াকে ‘২০ শতকের সবচেয়ে বড় ভূরাজনৈতিক বিপর্যয়’ বলে মনে করেন ভ্লাদিমির পুতিন। তাঁর অভিযোগ—ন্যাটো সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোকে নিজেদের জোটে ভিড়িয়েছে, যে দেশগুলো এক সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। এর অর্থ—একদিকে রাশিয়া, আর অন্যদিকে বিশ্বের বৃহত্তম সামরিক জোট, যাদের সঙ্গে রাশিয়াকে সীমানা ভাগাভাগি করতে হয়েছে। আর, রাশিয়া মনে করে—ন্যাটোর কারণে তার ভূ-রাজনৈতিক শক্তি কমে গেছে, যা একসময় মস্কোর প্রভাব বলয় ছিল।