শারীরিক গড়ন নিয়ে ৭০ শতাংশ নারী কটাক্ষের শিকার : জরিপ
আমাদের দেশের শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র ও বিভিন্ন প্রয়োজনে নারীরা গণপরিবহণ ব্যবহার করে থাকেন। সমীক্ষা বলছে, ৪৫.২৭ শতাংশ তরুণী গণপরিবহণে যৌন হয়রানির শিকার হন। গণপরিবহণ হিসেবে সর্বাধিক ব্যবহৃত বাস বা বাসস্ট্যান্ডে যৌন হয়রানির মতো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন ৮৪.১০ শতাংশ তরুণী। এছাড়াও রেল বা রেল স্টেশনে ৪.৫৮ শতাংশ এবং রাইড শেয়ারিং সার্ভিসে ১.৫৩ শতাংশ তরুণী যৌন হয়রানির শিকার হন। অপরদিকে ৬৯.৯২ শতাংশ তরুণী শারীরিক গড়ন নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হন।
‘তরুণীদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং মানসিক স্বাস্থ্যে এর প্রভাব’ শীর্ষক এক সমীক্ষার প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আজ শনিবার সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানায় আঁচল ফাউন্ডেশন।
ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহীন মোল্লা, সিটি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের সহকারী পুলিশ কমিশনার সুরঞ্জনা সাহা, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের মিডিয়া কম্যুনিকেশনের সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর শাহানা হুদা রঞ্জনা এবং আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ।
আগামী ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে সামনে রেখে আঁচল ফাউন্ডেশন শুধু নারীদের নিয়ে একটি জরিপের আয়োজন করেছে। এই জরিপে অংশগ্রহণকারী এক হাজার ১৪ জন শিক্ষিত তরুণীদের থেকে তারা কতটা বৈষম্য, লাঞ্ছনা, যৌন হয়রানি, সমাজ ও পরিবারে প্রতিবন্ধকতা, নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি বিষয়ের সম্মুখীন হয়েছেন ও এই সকল বিষয় তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর কেমন প্রভাব ফেলেছে, তা নিয়ে সমন্বয়কৃত তথ্যের ভিত্তিতে গবেষণালব্ধ পরিসংখ্যান সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরা হয়।
জরিপে অংশগ্রহণ করেছেন সারা দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগের ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণীরা। অংশগ্রহণকারী তরুণীদের ভেতর অবিবাহিত ৮৮.১৭ শতাংশ ও বিবাহিত ১০.৯৫ শতাংশ এবং বাকিরা আর সংসার করছেন না। মানসিক সমস্যার পিছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী পারিবারিক টানাপোড়েন।
সমীক্ষার ফলাফল থেকে জানা যায়, পারিবারিক টানাপোড়েন তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর সর্বাধিক প্রভাব ফেলে যা ৩১.৮৫ শতাংশ। আর্থিক অস্বচ্ছলতা অংশগ্রহণকারীদের ২৪.৪৬ শতাংশের মনে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। বেকারত্বের কারণে ১৪.৭৯ শতাংশ মানসিকভাবে বিপর্যস্ততার শিকার হন। ১৪.৪০ শতাংশ সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার মাধ্যমে ও ২.৩৭ শতাংশ তরুণী যৌন নিপীড়নের কারণে মানসিকভাবে প্রভাবিত হন।
পারিবারিক টানাপোড়েনের পিছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, পারিবারিক আর্থিক অস্বচ্ছলতা ৩০.৭২ শতাংশ তরুণীদের মনে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বাবা মা বা স্বামী স্ত্রীর মাঝে ঝগড়া ২৭.৩২ শতাংশের মনে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। সেই সাথে পরিবার থেকে অযাচিত চাপের কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ততার শিকার হয়েছেন ২৩.৯২ শতাংশ নারী।
বাড়ছে বিয়ের জন্য অযাচিত চাপ
জরিপে অংশগ্রহণকারী তরুণীদের মধ্য থেকে ২৩.৭৭ শতাংশ তরুণী নিজেদের অসম্মতি থাকা সত্ত্বেও পরিবার থেকে বিয়ের চাপের সম্মুখীন হন। যারা এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন তাদের মধ্যে ১০৯ জনের পরিবার পরবর্তীতে বিয়ে না হওয়ার ভয় থেকে এমন চাপের সৃষ্টি করেন বলে জানা যায়। কমবয়সী মেয়েদের ভালো বর হয় এরূপ ধারণার কারণে ৮৬ জনের উপর পারিবারিকভাবে বিয়ের চাপ আসে। করোনা মহামারির কারণে শিক্ষাবর্ষ দীর্ঘায়িত হওয়ায় ৮৫ জনকে বিয়ের চাপ মোকাবেলা করতে হয়েছে।
বডি শেমিং করায় এগিয়ে আত্মীয়রা
পরিসংখ্যানের তথ্য ও উপাত্ত অনুযায়ী, ৬৯.৯২ শতাংশ তরুণী শারীরিক অবয়ব নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে, ৩৭.২৪ শতাংশ তরুণী জানিয়েছেন তাদের শরীরের আকৃতি, গঠন এবং অবয়ব নিয়ে তাদের আত্মীয়রাই কথায় ও ইঙ্গিতে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। বন্ধুবান্ধবের কাছে বডি শেমিংয়ের শিকার হয়েছেন ২২ শতাংশ। এমনকি পরিবার থেকে এ ধরনের মন্তব্য শুনেছেন বলে জানিয়েছেন ১৪.২৫ শতাংশ। পথচারীর মাধ্যমে শারীরিক অবয়ব নিয়ে নেতিবাচক কথা শুনতে হয়েছে ১১.৮৫ শতাংশ তরুণীর। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিনিয়ত হেয় প্রতিপন্ন হলে একজন মানুষের আত্মবিশ্বাস কমে যায় এবং হীনমন্যতা কাজ করে। পরবর্তীতে যেটা আত্মহত্যার পিছনে অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রাখে।
যৌন হয়রানির শিকার ৬৫.৫৮ শতাংশ তরুণী
সমীক্ষার তথ্যে দেখা যায়, ৬৫.৫৮ শতাংশ তরুণী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এর মাঝে ৩৫.৪৯ শতাংশ তরুণী জানিয়েছেন যে, তারা বিকৃত যৌন ইচ্ছার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বা কুদৃষ্টির মাধ্যমে নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। ২৯.৬২ শতাংশ তরুণীকে আপত্তিকর স্পর্শের ভুক্তভোগী হতে হয়েছে। আর বিভিন্ন জায়গায় ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছেন ২২.২৬ শতাংশ।
গণপরিবহণে আপত্তিকর স্পর্শের শিকার বেশি
গণপরিবহণে যৌন হয়রানির মধ্যে আপত্তিকর স্পর্শের শিকার হন ৬৪.৯২ শতাংশ তরুণী। ২০.০৪ শতাংশ কুদৃষ্টি ও অনুসরণের শিকার হয়েছেন বলে জানা যায়। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, তরুণীরা সবচেয়ে বেশি এ ধরনের নিপীড়নের শিকার হন একাকী চলার সময়ে, যা ৭৫.৬০ শতাংশ। তবে ২১.৫৭ শতাংশ মা, বোন, বান্ধবী বা অন্য নারী সঙ্গী থাকা অবস্থায় এবং ২.৮৩ শতাংশ বাবা, স্বামী, ভাই বা অন্য পুরুষ সঙ্গী থাকা অবস্থায় নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বলে সমীক্ষায় উঠে আসে।
মতামত মূল্যহীন পরিবারেও
একজন তরুণী পরিবার ও সমাজে পুরুষের মতই সমান গুরুত্ব পাওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু ২২.২৯ শতাংশ তরুণী জানিয়েছেন, তাদের মতামতকে পরিবারে মূল্যায়ন করা হয় না। শুধু নারী হওয়ার কারণে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হতে হয় ৪৬.২৫ শতাংশকে। নারীদের প্রতি প্রথম বাধা আসে পরিবার থেকেই।
নারীদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট তাদের জীবনে কতটুকু প্রভাব ফেলছে সে বিষয়ে আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, ‘একুশ শতাব্দীতে এসে নারীরা যখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছেন তখনও আমাদের দেশের নারীদের নানাবিধ কারণে থমকে দাঁড়াতে হয়। আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবার প্রতিষ্ঠিত নারীদের সাথে মানিয়ে নিতে এখনো যথাযথভাবে প্রস্তুত নয়। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে পিছনে রেখে দেশের সত্যিকারের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাঁদেরকে স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের সকলের দায়িত্ব এবং কর্তব্য।’