ভুয়া কার্যাদেশ দেখিয়ে ৩৫-৪০ কোটি টাকা আত্মসাৎ, গ্রেপ্তার ২
৮ হাজার কোটি টাকার ভুয়া ওয়ার্ক অর্ডার (কার্যাদেশ) দেখিয়ে পণ্য সরবরাহকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই ছিল কথিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আল-তাকদীরের কাজ। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ করে গুলশানে একটি অফিস খোলে।
গুলশানের ওই অফিসে কাজের চুক্তি করতে আসা ব্যবসায়ীদের নামিদামি রেস্টুরেন্টে শত পদের খাবারে করা হতো আপ্যায়ন। কাজের চুক্তির নামে সাপ্লাইয়ারদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন আল-তাকদীরের কর্ণধার আলমগীর হোসাইন।
আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর মালিবাগে সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি ইমাম হোসেন।
গত ৮ মার্চ রাজধানীর গুলশান থানায় এ সংক্রান্ত একটি মামলা হয়। মামলাটি তদন্তের ধারাবাহিকতায় বুধবার দিবাগত রাতে রাজধানীর খিলগাঁও ও গুলশান এলাকা থেকে মূলহোতা আলমগীর হোসাইনসহ (৪৮), মো. শফিকুল ইসলাম (৪৬) ও মো. ইমরান হোসাইনকে (৪৪) গ্রেপ্তার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
এ সময় তাদের কাছ থেকে ৬টি মোবাইল ফোন, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক বই, ভুয়া ওয়ার্ক অর্ডারের কপি, সাপ্লাইয়ারদের সঙ্গে চুক্তিপত্রের কপি ও একটি দশ কোটি টাকা কাবিনের ফটোকপি জব্দ করা হয়।
ইমাম হোসেন বলেন, প্রতারক আলমগীর নিজেকে বড় মাপের ঠিকাদার প্রমাণের জন্য গুলশানে অফিস নিয়ে প্রায় দেড় কোটি টাকা খরচ করে অফিসের ডেকোরেশন করেন। গুলশানের রেস্টুরেন্টে ১১০ আইটেমের খাবার পরিবেশন করে সাপ্লাইয়ারদের আপ্যায়ন করে বিশ্বাস অর্জন করেন। বড় সাপ্লাইয়ারদের নিয়ে বিভিন্ন রিসোর্টে কয়েকবার বড় ধরনের পার্টিরও আয়োজন করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সবশেষ ২০২১ সালে সিরাজগঞ্জ-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে ব্রিজ প্রজেক্টের ৩০০ কোটি সিএফটি বালি সরবরাহের ওয়ার্ক অর্ডার পেয়েছে বলে প্রচারণা চালান। তার নিজস্ব অনলাইন টিভি (Takdir TV) চ্যানেলে ব্যাপকভাবে এই প্রচারণা চালানো হয়। এসব প্রচারণা দেখে প্রলুব্ধ হয়ে দেশের বিভিন্ন জেলার প্রায় ৩০০ আগ্রহী সাপ্লাইয়ার আলমগীরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এক সিএফটি বালিতে ১০ টাকা লাভ হবে বলে সাপ্লাইয়ারদের প্রলুব্ধ করেন তিনি। এভাবে সাপ্লাইয়ারদের সঙ্গে ভুয়া চুক্তি করে কমিশন হিসেবে সাপ্লাইয়ারদের কাছ থেকে ৩৫-৪০ কোটি টাকা হাতিয়ে প্রতারক আলমগীরের চক্র।
ইমাম হোসেন বলেন, প্রজেক্ট এলাকায় সাপ্লাইয়ারদের নিয়ে প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে ব্রিজের বালি সরবরাহের নিজস্ব ডাম্পিং পয়েন্টের শুভ উদ্বোধন লেখা ব্যানারে যমুনা সেতুর পাশে লালগালিচা বিছিয়ে ধুমধাম করে কাজ উদ্বোধন করা হয়। যার অনেক ছবি ও ভিডিওচিত্র বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে রয়েছে। এ প্রোগ্রামে নামিদামি অনেক ব্যক্তিদের হাস্যোজ্জ্বল উপস্থিতি দেখা যায়।
ইমাম হোসেন বলেন, এ ধরনের কার্যকলাপ দেখে বিশেষ করে টাঙ্গাইল এলাকাসহ দেশের অন্যান্য এলাকার অনেক সাপ্লাইয়ার কাজ পাওয়ার আশায় প্রতারক আলমগীরের অফিসে এসে চুক্তি করে প্রতারিত হয়েছেন। পরে সবার টাকা আত্মসাৎ করে অফিস ও মোবাইল ফোন বন্ধ করে উধাও হয়ে যান আলমগীর। অভিযোগের ভিত্তিতে গতকাল রাতে আলমগীরসহ এই চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আলমগীরকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে ইমাম হোসেন বলেন, এই প্রতারণা কাজ চলা সময়ের মধ্যেই লেনদেনের সূত্র ধরে ইস্টার্ন ব্যাংকের এক নারী কর্মকর্তার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এক পর্যায়ে ওই নারীর সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। ওই নারী ব্যাংক কর্মকর্তা নিজে জিম্মাদার হয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে ২ হাজার কোটি টাকার এলসি, ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ক্যাশ করে দেবে বলে আলমগীরকে আশ্বস্ত করেন। এমন আশ্বাস পেয়ে আলমগীর তার প্রথম স্ত্রীকে না জানিয়ে ব্যাংকার সালমা সুলতানা সুইটি নামে ওই নারীর দাবি মোতাবেক ১০ কোটি টাকার কাবিন দিয়ে গত বছরের জুলাই মাসে বিয়ে করেন। বিয়ের পর গুলশানের একটি বাসায় মাসিক ২ লাখ টাকায় ভাড়া করে দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে থাকা শুরু করেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এদিকে মানুষজনকে প্রতারিত করে আত্মসাৎ করা টাকা দিয়ে দ্বিতীয় স্ত্রীর চাহিদা মতো কোটি টাকার গহনা ও নগদ টাকাসহ প্রায় ৪ কোটি টাকা তাকে দেন। পরে এলসি না হওয়ায় আলমগীর ও তার দ্বিতীয় স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য হয়। এক পর্যায়ে গত বছরের নভেম্বর মাসে আলমগীরকে ডিভোর্স দিয়ে ১০ কোটি টাকার দেনমোহর আদায়ের জন্য তার দ্বিতীয় স্ত্রী আদালতে মামলা দায়ের করেন।
আলমগীর এর আগেও নানা কৌশলে বিভিন্নভাবে মানুষজনকে প্রতারণা করেছেন। তিনি বিনিময় ইন্টারন্যাশনাল নামে ট্রাভেল এজেন্সি খুলে সৌদি আরবের জাল ১৫০টি ভিসা নিয়ে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। তার বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনার ও প্রতারণার অভিযোগে ডজন খানেক মামলা রয়েছে বলেও জানান সিআইডি কর্মকর্তা ইমাম হোসেন।