চারদিন ঘুরে টিসিবির পণ্য পেলেন বৃদ্ধ
রাজধানীর নটরডেম কলেজের ঠিক বিপরীতে ওভারবিজ্র। ঘড়ির কাঁটায় তখন রোববার সকাল সাড়ে ১০ টা। একটি ট্রাক এসে থামল। ট্রাক থামার আগেই ছুটে এলো বেশ কয়েক নারী ও পুরুষ। জানা গেল, ট্রাকটি সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদশের (টিসিবি) পণ্য বহন করে এনেছে। বাজারে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস। তাই কম মূল্যে পণ্য পেতে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগে থেকেই এই ট্রাকটির অপেক্ষায় ছিলেন তাঁরা। এরমধ্যে ছিলেন বয়স্ক রফিকুল ইসলাম। চারদিন ঘুরে তিনি আজ পেয়েছেন টিসিবির পণ্য।
সাধারণত লাইনে দাঁড়িয়ে টিসিবির পণ্য নিতে হয়। কিন্তু, কে লাইনের আগে দাঁড়াবেন তা নিয়ে শুরু হলো তুমুল বাকবিতণ্ডা। বাকবিতণ্ডা শেষে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে গেলেন সবাই। অল্প সময়ের মধ্যে সেখানে আরও অনেকেই হাজির হলেন। বোঝা গেল, আশপাশেই অপেক্ষা করছিলেন তাঁরা।
লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে বাকবিতণ্ডায় জড়ানো শিউলি বেগম বলছিলেন, ‘আগে দুদিন লাইনে দাঁড়িয়েও মাল (পণ্য) নিতে পারিনি। আমি ট্রাকের কাছে যাওয়ার আগেই মাল সব শ্যাস।’ একই কথা আরও কয়েকজন বললেন। সেজন্য, লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে তৎপর উপস্থিত অনেকেই।
তখন বেলা পৌনে ১১টা। রিয়াজুল ইসলাম রাসেল ট্রাকে বসে ছিলেন। সেখানে বসে তিনি দুই কেজি করে সয়াবিন তেল, মসুরের ডাল, চিনি ও ৪ কেজি পেঁয়াজসহ মোট ১০ কেজির পণ্য দেওয়া শুরু করলেন। দাম রাখছেন ৫৮০ টাকা। রিয়াজুল একজন টিসিবির ডিলার। পণ্য দেওয়ার আগে তিনি ভোক্তাদের হাতে কলম দিয়ে সিরিয়াল লিখে দিলেন রাসেল।
যদিও আরও পরে টিসিবির পণ্য নিতে আসা অনেকের হাতে সিরিয়াল লিখে দেওয়ার সুযোগ পাননি রাসেল। কারণ, তারা (ট্রাকে থাকা চারজন) ব্যস্ত ছিলেন। এ এই সুযোগ গ্রহণ করে একেকজন একাধিক ব্যাগ পণ্য নিয়েছেন। এ অভিযোগ ওঠাদের সবাই নারী।
জানা গেল, কেউ কেউ আবার পণ্য সংগ্রহ করার পর তা বিক্রি করে দিয়েছেন। এসব নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে অনেক ভোক্তাকে।
আজ রোববার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল পৌনে তিনটা পর্যন্ত ঘটনাস্থলে অবস্থান করে এসব দৃশ্য দেখা গেছে। দেখা গেছে, একই পরিবারের একাধিক সদস্য এসেছেন পণ্য নিতে। শেষমেশ পণ্য সংগ্রহ করার পর তা একসঙ্গে বস্তায় ভরে নিতে দেখা গেছে। এসব বিষয়ে কথা বলতে গেলে রিয়াজুল ইসলাম রাসেল এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ট্রাকে বসে কতদিকে সামাল দেওয়া যায়? এরচেয়ে বেশি কঠোর হতে গেলে ডিএনএ পরীক্ষা করে করে পণ্য দিতে হবে আমাকে।’
রফিকুল ইসলাম একজন বয়স্ক মানুষ। থাকেন রাজধানীর মতিঝিলে। তিনি গত তিন দিন ধরে সকাল সাড়ে সাতটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশে অপেক্ষা করেছেন টিসিবির পণ্য নিতে। কিন্তু, গত তিনদিন ধরে সেখানে টিসিবির কোনো ট্রাক যায়নি। রফিকুল ইসলাম বলছিলেন, ‘আমি বেকার মানুষ। এক পুটলা মাল (পণ্য) পেতে আগের তিন দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশে অপেক্ষা করেছি। কিন্তু, কোনো গাড়ি যায়নি। আজ শুনলাম, এখানে (আরামবাগ) গাড়ি এসেছে। শুনেই দৌড় মারলাম। বাজারে জিনিসপত্রের যে দাম, কিনতে পারিনি। চেয়ে-চিন্তেও খেতে পারি না। কি যে জ্বালা! আমাদের দেখা কেউ নেই।’ রফিকুলের এই অকুতি দেখে রিয়াজুল ইসলাম রাসেল তাঁকে তাৎক্ষণিকভাবে এক ব্যাগ পণ্য দেন।
নজরুল ইসলাম। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। অফিস থেকে কিছু সময়ের ছুটি নিয়ে এসেছেন টিসিবির পণ্য কিনতে। নজরুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এক ঘণ্টার মতো ছুটি নিয়ে আমি এখানে এসেছি। কিন্তু, যে বড় লাইন। মনে হয় না নিতে পারব। তাঁকে (রাসেল) বললাম। কিন্তু, লাইনে দাঁড়াতে বললেন। গতদিন একবার এসেছিলাম, পণ্য নিতে পারিনি। কিন্তু, অনেককে দেখেছি একাধিক ব্যাগ নিতে। এরা ছেলে-মেয়ে-বৌ, সবাইকে লাইনে দাঁড়িয়ে দেয়। সেই খাবার আবার বিক্রিও করে দেয়।’
ট্রাক থেকে যখন পণ্য দেওয়া শুরু করে, তখনই রাহিমা বেগম এক ব্যাগ পণ্য নেন। তাঁর দাবি, মতিঝিলেই তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি বলছিলেন, তার ছেলে নেই। পণ্যের জন্য ঘুরছেন কিন্তু নিতে পারছেন না! ফলে, প্রতিবেদক যেন তাঁকে এক ব্যাগ পণ্য সংগ্রহ করে দেন। তিনি জানেনই না, প্রতিবেদক তাঁর গতিবিধির ওপর নজর রাখছেন। তিনি হয়তো ভাবছিলেন, তাঁর পণ্য নেওয়ার কথা কেউ জানেন না। এক সময় তাঁর কাছে প্রথমবার পণ্য নেওয়ার প্রমাণ দেখালে তিনি দ্রুতই কেটে পড়েন ঘটনাস্থল থেকে।
সুমি আক্তার নামের এক নারী এক ব্যাগ পণ্য নেওয়ার পর চলে যান সেখান থেকে। কিন্তু, লাইনে ছেলেকে দাঁড় করিয়ে রেখে যান। পরে তার ছোট ছেলে আরেক ব্যাগ পণ্য সংগ্রহ করেন। ছেলের নাম আরিফ হোসেন। মতিঝিলের একটি স্কুলে লেখাপড়া করে আরিফ। জানতে চাইলে সে বলে, ‘মা চলে গেছে তেল-ডাল নিয়ে। আমাকে টাকা দিয়ে গেছে। এখন আমি বাসায় যাচ্ছি।’
নাজনিন আক্তার ছেলেকে স্কুলে দিতে এসেছিলেন। দেখেন, টিসিবির পণ্য দিচ্ছে। দাঁড়িয়ে গেলেন লাইনে। নাজনিন বলছিলেন, ‘বাজারে সবকিছু যে দাম। মনে হল, দাঁড়িয়ে থেকে কিনি। কটা টাকা হলেও তো কমবে। আজই প্রথম দাঁড়িয়েছি। প্রথমে লজ্জা করছিল। কিন্তু, আয়-রোজগারের কথা ভেবে দাঁড়িয়ে গেলাম।’
সিহাব উদ্দিন লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘এখান থেকে মহিলারা একেকজন একেবার নিচ্ছে চোখের সামনে। মহিলারা হাও-কাউ করতে পারেন। একেবার নিয়ে আবার লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। একজন পুরুষকেও দেখেছি দুবার পণ্য নিতে। কার ভাগের জিনিস কে নেন। দুজন ছেলে এসেছিল পণ্য কিনতে। কেনার পর তারা দুজনই যখন-তখন সব আবার বিক্রি করে দিলেন। একজন নারী সব পণ্যই কিনে নিলেন।’
এসব নিয়ে কথা হয় টিসিবির ডিলার রিয়াজুল ইসলাম রাসেলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি প্রথমে হাতে সিরিয়াল লিখে দিলাম। পরে লোকজন বেশি আসায় সেই সুযোগ আর হয়নি। এরমধ্যে কে কোনভাবে যেন লাইনে দাঁড়িয়ে গেল। দাঁড়ানো নিয়ে ঝগড়াঝাটিও করল। লোকজন বলাবলি শুরু করল, একেকজন একাধিকবার পণ্য নিচ্ছেন। আমি তো আর সবাইকে চিনি না। একবার করে দেখলে চিনব কীভাবে? এ হক তো মানুষের। তাঁরা লাইনে যদি কাউকে দেখেন, একজন দু্বার বা তার বেশি নিচ্ছেন, তাহলে কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারেন। পণ্য শেষ হয়ে গেলে প্রতিবাদ করলে তো আর হবে না।’
রাসেল বলেন, ‘যেভাবে মানুষ আসে, সবাইকে পণ্য দেওয়াও সম্ভব না। আমি ২৫০ জনকে পণ্য দিয়েছি। লোক তো এসেছেন আরও অনেক। শেষে কাউকে কাউকে তেল আর পেঁয়াজ ছাড়া ডাল আর চিনি দিয়েছি।’