অবৈধ সম্পদ অর্জন : স্বাস্থ্যের সেই গাড়িচালক ও তাঁর স্ত্রীর বিচার শুরু
দুদকের দায়ের করা অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক আবদুল মালেক ওরফে ড্রাইভার মালেক ও তাঁর স্ত্রী নার্গিস বেগমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন আদালত।
আজ বুধবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৬-এর বিচারক আল আসাদ মো. আসিফুজ্জামান এ আদেশ দেন। এদিন আসামিদের আদালতে হাজির করা হলে, শুনানি শেষে আসামিরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায় বিচার প্রার্থনা করেন। বিচারক সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী ৭ জুন পরবর্তী দিন ধার্য করেছেন।
নথি থেকে জানা গেছে, ২০২১ সালের ২৭ অক্টোবর মামলা দুটি তদন্ত করে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন দুদকের সহকারী পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম। এর আগে একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আলোচিত গাড়িচালক আবদুল মালেক ও তার স্ত্রী নার্গিস বেগমের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র অনুমোদন দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এজাহার থেকে জানা গেছে, মালেক দম্পতির বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পৃথক দুটি মামলা করে দুদক।
অভিযোগপত্রে মালেকের বিরুদ্ধে ৯৩ লাখ ৫৩ হাজার ৬৪৮ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন এবং এক কোটি ৫০ লাখ ৩১ হাজার ৮১০ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনসহ মোট দুই কোটি ৪৩ লাখ ৮৫ হাজার ৫৫৮ টাকার সম্পদ পাওয়ার তথ্য উল্লেখ করা হয়। এছাড়া অন্য মামলায় আব্দুল মালেক ও তার স্ত্রী নার্গিস বেগমকে আসামি করা হয়। এ মামলায় নার্গিস বেগমের দুই কোটি ১২ লাখ ৩৫ হাজার ৪৩১ টাকার সম্পদের তথ্য উল্লেখ করা হয়, যার বিপরীতে বৈধ উৎস পাওয়া যায় এক কোটি এক লাখ ৪৩ হাজার ৩৮২ টাকা। অবশিষ্ট এক কোটি ১০ লাখ ৯২ হাজার ৫০০ টাকার সম্পদ অবৈধ উপায়ে অর্জিত। তার বিরুদ্ধে দুদক আইন ২০০৪ এর ২৭ (১) ও ২৬ (২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত ৩টায় রাজধানীর তুরাগ থানাধীন কামারপাড়া এলাকা থেকে আবদুল মালেককে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরদিন র্যাবের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, র্যাবের প্রাথমিক গোয়েন্দা অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর তুরাগ এলাকায় আবদুল মালেক অবৈধ অস্ত্র ব্যবসা, জাল টাকার ব্যবসা, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করেন। তিনি এলাকার সাধারণ মানুষকে অস্ত্র দেখিয়ে জিম্মি করে শক্তির মহড়া ও দাপট প্রদর্শনের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করেছেন। জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে তার কর্মকাণ্ড। তার ভয়ে এলাকায় সাধারণ মানুষের মনে সর্বদা আতঙ্ক বিরাজ করে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এরই পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব তুরাগ থানাধীন কামারপাড়াস্থ বামনের টেকের বাসা নম্বর ৪২-এ অভিযান চালিয়ে আবদুল মালেককে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের সময় তার কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, পাঁচ রাউন্ড গুলি, দেড় লাখ টাকার জালনোট, একটি ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করে।
আবদুল মালেককে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, তিনি পেশায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিবহণ পুলের একজন গাড়িচালক। তিনি একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি পাস। ১৯৮২ সালে সর্বপ্রথম সাভার স্বাস্থ্য প্রকল্পে গাড়িচালক হিসেবে যোগ দেন। পরে ১৯৮৬ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিবহণ পুলে চালক হিসেবে যোগ দেন।
বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আবদুল মালেকের স্ত্রীর নামে ঢাকার কামারপাড়ায় দুটি সাত তলা বিলাসবহুল ভবন রয়েছে। ধানমণ্ডির হাতিরপুলে সাড়ে চার কাঠা জমিতে একটি নির্মাণাধীন ১০ তলা ভবন রয়েছে। এ ছাড়া দক্ষিণ কামারপাড়ায় ১৫ কাঠা জমিতে একটি ডেইরি ফার্ম আছে। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে নামে-বেনামে তার বিপুল টাকা গচ্ছিত রয়েছে।
গ্রেপ্তারের দিন র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক আশিক বিল্লাহ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আবদুল মালেক তার অবৈধ সম্পদ রক্ষার জন্য বিদেশি পিস্তল ব্যবহার করেন। তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমান সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের আস্থাভাজন ছিলেন। অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যবহার করে এত সম্পদের মালিক হয়েছেন। আবদুল মালেকের ১০০ কোটি টাকারও বেশি সম্পদ আছে। মালেক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বদলি-বাণিজ্য এবং বিভিন্ন দপ্তরে তদবির করার নাম টাকা নিতেন।’
জানা গেছে, মালেক তার মেয়ে নৌরিন সুলতানা বেলিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অফিস সহকারী পদে, ভাই আবদুল খালেককে অফিস সহায়ক পদে, ভাতিজা আবদুল হাকিমকে অফিস সহায়ক পদে, বড় মেয়ে বেবির স্বামী রতনকে ক্যান্টিন ম্যানেজার হিসেবে, ভাগ্নে সোহেল শিকারীকে ড্রাইভার পদে, ভায়রা মাহবুবকে ড্রাইভার পদে, নিকট আত্মীয় কামাল পাশাকে অফিস সহায়ক পদে চাকরি দিয়েছেন।
মালেক নিজে গাড়িচালক হলেও স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেনের জন্য বরাদ্দ একটা সাদা পাজেরো জিপ (গাড়ি নম্বর ঢাকা মেট্রো গ- ১৩-২৯৭৯) নিয়মিত ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন। ওই গাড়িটি ছাড়াও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আরও দুটি গাড়ি তিনি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন। একটি পিকআপ গাড়ি (ঢাকা মেট্রো ঠ-১৩-৭০০১) তিনি নিজের গরুর খামারের দুধ বিক্রি এবং মেয়ের জামাইয়ের পরিচালিত ক্যান্টিনের মালামাল পরিবহণের কাজে ব্যবহার করতেন। অপর একটি মাইক্রোবাস (গাড়ি নম্বর ঢাকা মেট্রো চ- ৫৩-৬৭৪১) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কর্মরত তার পরিবারের অন্য সদস্যেরা ব্যবহার করতেন।
এদিকে, ২০২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক আব্দুল মালেককে অস্ত্র আইনের মামলায় এক ধারায় ১৫ বছর ও আরেক ধারায় তাকে ১৫ বছরের কারাদণ্ডের রায় দেন ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ রবিউল।